সিকিমে শেখা
স্বপন রায়



অতনু বলল, তুমি ব্যায়াম করছ?
-আড়মোড়া এটা, ব্যায়াম না
-ও। আড়মোড়া?
উমাপদ হাঁক দিল, এবার ফাটাচ্ছে রে!
অতনু লাফ দিল বিছানা থেকে। ক্যামেরা নিয়ে। আমিও বেরিয়ে এলাম। সূর্য উঠছে আর কাঞ্চনজঙ্ঘা নিচ্ছে। দেয়া, নেয়া। পাখি ডাকছে। শীতের তীব্রতা কেটে, ভুবন ভরানো ডাক, আর তার গান শোনানো ‘ফাঁকি’ও হচ্ছেনা। খুব মিশে যাচ্ছে, উদয়কালীন এই ‘হোম-স্টে’ আর ঐ কাঞ্চনজঙ্ঘার অরুণায়নে। আলোর তো কোন সীমানা নেই, তার সহায়ক পরিবেশ চাই। এই ভোর তার সহায়। আমাদের অংশ এখন সূর্যের দিকে। আমরা অংশত সূর্যমুখিই এখন।তো, আলো এখন ছড়াচ্ছে। লয়টা বিলম্বিত। উত্তর-পূর্ব সিকিমের মাংখিমে বিলম্বই এক সধারণ গুণনীয়ক, সবেতেই আছে। এই দ্রুতিহীনতার সফল আবাহনে আমি আর চট্‌জলদি কোন উদ্ভাসের কথা ভাবছি না। এই ভোর উমাপদকে আরো ‘বুদ্ধ’ টাইপ করে তুলল। স্বভাবগম্ভীর উমার মুখে স্মিত হাসি, সূর্যোদয়ের বোধে বিদ্ধ বোধিসত্ব আমাদের। অতনু বলল, উমাদা চলো ওখানটায় যাই। দূরে একটা ওয়াচ-টাওয়ার। সিঁড়ি নেমে গেছে। উমার হাঁটুতে পুরনো চোট, বলল, পারবো?

আমরা নামছি। উমাও। আর কেউ নেই। নিস্তল নৈস্তব্ধ। একেকটা পাতায় পাতা পাইনের বিচ্যুতি ডোরা ডোরা ঈশারা ফেলে দিচ্ছে। এই সময়ে আমি লীন হয়ে যাই। বিলীন। থাকিনা আরকি। একটা স্রোত বিচ্ছিন্ন হতে হতে মিলিয়ে যায় আমার দেহান্তিক অভিপ্রায়ে। বলে, দোস্ত সুকুন মিলা? শান্তি পেলে? ব্রেক মারি। রাস্তার শুরু-ইতি থেকে ক্রমশ উঠে আসছে ধারাবাহিক রিয়ার উদাসীন গেহুঁয়া রঙ। গমের প্রতিভা নিয়ে আমি আর কি বলি। রিয়া বিদৃশ্য হয় ততটাই, যতটা ভেসে আসে, ‘লহেরাকে আয়া হ্যায় / ঝোঁকা বাহারকা/ মৌসম হ্যায় প্যার কা/ আ ভি যা’… রফি, লতা, রাহুল দেববর্মণ…আমার হাতের ভেতর দিয়ে ফাল্গুন হতে থাকে ঘামের কাহিনি, জাস্ট একঝলক দেখে। আজ এই সিকিমাস্বাদনের ভোর পোহানো নরম সন্নাটায়(নির্জনতায়)কেন মনে পড়ল সেই আচমকা ব্রেক মারার শব্দটা বা ওই গানের ফিনিক দেয়া সেক্টর আঠারোর একটি হিমদুয়ারি বাঁক যেখানে মাঝে মাঝে রিয়া ফুটে উঠত মুছে যাবেনা বলে। লেডিজ সাইকেলের মছলিসাঁতার দিয়ে রিয়াই কী চলে যেত উত্তরের আয়নে , দক্ষিণের আননে। আজ ‘আরিটার লেক’ বা ‘লাম পোখরি’র দিকে নামার সময় আমি আর নেই সে আমি। ওইতো অতনু হঠাৎ নেচে উঠল। আমি পিছন ফিরে দেখলাম উমা’কে, যদি উমাও নেচে ওঠে! মনে মনে বললাম, উমা, হয়ে যাক। উমা বুদ্ধ। উমা ‘ওঁ মনিপদ্মে হুম’। উমা সেই হাসিটা দিল। নিস্তরঙ্গ, বৌদ্ধিক। সামনের নিলোক আকাশে হিমালয়ান পাঞ্চ দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমরা মাংখিম থেকে দু’হাজার ফুট নিচে আরিটার লেকের দিকে নামছি, সিঁড়ি বেয়ে। একেকটা বাঁকে দৃশ্য চলানুক্রমিক থাকছে না। বদলাচ্ছে। মোচড় দিচ্ছে। আমিও রিয়াকে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ রিয়াকেই অস্বীকার করতে শুরু করলাম। নীচে নয়, নিচে নামছি। এই বানানো রিয়াকে আর সহ্য করা কেন? সময় তাকে অগ্রাহ্য করবে না কেন? রোমান্স, শরীর নিংড়ে খাদে নেমে আধিভৌতিক হয়ে চলেছে। রিয়ার যা কিছু আমার বানানো, সেখানে রিয়া তো প্রতিস্থাপিত, আমিময়। তাছাড়া আমি রিয়া নাম্নী মহিলাটির ভেতরের কথা কীভাবেই বা জানতে পারি? বাইরের উষ্ণতা, শৈত্যকেও বা কীভাবে? কাঞ্চনজঙ্ঘা হাসছে। বিদ্রুপের হাসি। ফেক, ফেকু আমায় নিয়ে, লম্বা শ্বেত পর্যায়ের হাসি চলেছেই তার!

উমাপদ বলল, পিছল আছে রে… পাইনের ভেজাপাতা জমতে জমতে পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে শ্যাওলার ঘেরাটোপে। অতনু আগে, মাঝে আমি, উমা তারপর। পাথুরে সিঁড়ি শেষ হওয়ার নয়। মাঝে মাঝে প্রায় দু’হাজার ফুট নিচে থাকা পান্না-সবুজ আরিটার লেক উঁকি মারছে। রিয়া যেমন। মিথ্যে আমার লেখাপত্র যেমন। উঁকি মারে। রেকি করে। ছোঁয়া দেয়। মুখ, বুক, কোমর, লিঙ্গ, থাই, হাঁটু, পায়ের ডিম, গোড়ালি, পায়ের পাতা বইতে বইতে মনে হয়, এখনো মনে হয় রিয়া আমার বানিয়ে তোলা আশ্রয়, যা এমনকি সঙ্গমের পরেও বইতে থাকে, মিলনসার জলের ধেয়ানে ফাটাফাটি। অতনু ছবি তুলছে। ছবি ঢুকে যাচ্ছে অতনুর ছটফটে মগজে। ভাইব্রেশন হচ্ছে। অন্তর্লীন। তৈরি হচ্ছে এক অকল্পনীয় বৈদ্যুতিক চুম্বকীয় ক্ষেত্রের। সবার অজানতেই হচ্ছে কিন্তু এসব। ‘ইৎবুমু’, যেমন লেপচারা বলে, এই ক্ষেত্রের শুরুতেই ভেবেছিল সামঞ্জস্যের কথা। ‘ইৎবুমু’, সেই প্রথম সৃজিকা, মা। একে একে সব বানালো। পাহাড়, নদী, ঝিল, ঝর্না, সমুদ্র। জঙ্গল। কি যেন নেই, তবু। নিলো একদলা তুষার কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীর থেকে, নিয়ে বানালো সেই প্রথম পুরুষকে। উৎসপিতাকে। তুষার হল অগ্নিপ্রবণ। সেই প্রথম পুরুষের নাম, ‘ফুদোনথিং’। রিয়া আমায় বলেছিল, তুমি সিওর তো ‘ফুদোনথিং’ ‘ইৎবুমু’কে রেপ করেনি?

কবিতা খোঁজার জন্য ঘুরে বেড়ানোটাই বিকল্প আমারা কাছে।। পা আছে যতক্ষণ। সিকিম টানে, আমি নিরপেক্ষ থাকতে পারিনা। প্রেফারেন্সটা জানাই। উমাপদ আর অতনু রাজী হয়। আরো কেউ কেউ শেষ অবধি নানা কারণে যুক্ত হতে পারেনা। রংপোতে এসে প্রতিবারই ‘পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকে’র ‘আই.ডি.কার্ড’ মুশকিল আসান করে দেয়। সিকিমের নিরাপত্তারক্ষীরা আর কারো পরিচয়পত্র দেখতে চায়না। পাঞ্জাব-দা-ব্যাংকের প্রতিপত্তি দেখে প্রতিবারই শ্লাঘা বোধ হয় আমার, অবসরের পরেও! একবার এখানেই বারীনদা(সদ্য প্রয়াত কবি বারীন ঘোষাল) তিস্তার দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। যা কিছু বহমান, সচল, সেই সবের দিকে মানুষটার মুগ্ধতা ছিল শিশুদের মত। রংপো সিকিমের মুখ্য প্রবেশদ্বার। খুব কড়াকড়ি এখানে। বিদেশীদের অনেক বাধা পেরিয়ে আসতে হয়। এ নিয়ে সিকিমিদের ক্ষোভও আছে। রংপোতে মাংখিম যাওয়ার জন্য গাড়ি নিতে হবে। উমা, আমি আর অতনু গাড়ি ঠিক করে চা টা খেয়ে নিই। মাংখিম ছ’হাজার ফুট ওপরে একটি গ্রাম। ‘আরিটার লেক’(চার হাজার ফুট)-এ না থেকে আমরা মাংখিমে থাকার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। হিল স্টেশনে ঘুরে বেড়াবার আগ্রহ বহু আগেই হারিয়েছি। কয়েকদিন থাকবো। সভ্যতাবিযুক্ত হয়ে। কবিতায়, গানে, হাঁটায়।অতনুর মুখে ‘লিকারিক্যাল’ হাসি। উমার ঠোঁটে তার প্রচ্ছায়া, আলতো। ‘পিতে হ্যায় আপনে মজে কে লিয়ে/ খামোখা বদনাম গম হ্যায়/ পুরি বোতল পী কে দেখো/ ফির দুনিয়া ক্যা জন্নত সে কম হ্যায়’, কি বনেদিয়ানা লিকারে, ‘মীর তকি মীর’ থেকে অতনু , উমা পর্যন্ত লাট্টু! ‘দারু পে জাগে শায়রোঁ/ বব্বাল মচায়ে কায়রোঁ! সেই দারুচিহ্ণিত হয়ে এক না যাওয়া পথে শুরু হল আমাদের মাংখিমের দিকে চারচাকার রাস্তা-বিজয় অভিযান। আমাদের অবাক করেই রাস্তার হালত পুরো খাস্তা। রোরাথাং নদীর ধারে ‘সিপলা’, ‘জুভেন্টাস’। বড়সড় ওষুধের কারখানা। সিকিমের ভেষজ সম্পদের আকর্ষণে গড়ে ওঠা এই কারখানারগুলোর পাশ দিয়ে গিয়েছে শতছিন্ন রাস্তা।বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে রাস্তা আচমকাই দুরুস্ত হয়ে ওঠে। পাশে কাঁপতে থাকা দৃশ্যাবলী ঠিকঠাক ফিরে আসে চোখের দেখায়!

সেই ভোরের কথা বলি। মাংখিমের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা মিরর হোম স্টে’ থেকে আমরা নামছিলাম। সিঁড়িবাহিত হয়ে। আমরা তিনজনই শুধু, আর কেউ নেই। এখন তো সকাল। ডিসেম্বরের দু’হাজার সতেরোর ছ’ তারিখের সকালে আমরা নেমে যাচ্ছি আরিটার লেকের দিকে। বিচ্ছিন্ন আনন্দে। ‘ফুদোনথিং’ আর ‘ইৎবুমু’ প্রণীত এই দুনিয়ায় আমাদের আর তো কিছুই নেই, অহঙ্কার আর স্পর্ধা ছাড়া, যদি কিছুটা নামিয়ে রাখতে পারি, যদি ঘরের কোণে জমানো অন্ধকারের পাণ্ডিত্যকে কিছুটা ঔজ্জ্বল্য দিতে পারি। এখন সকাল। তবে শীতের রাতগুলোয় লেপচাদুনিয়ায় ঢুকে পড়ে তিমিরাচ্ছন্ন শীতাগ্নির কথকতাগুলি। কাঞ্চনজঙ্ঘায় আছড়ে পড়ে ইলোপাতুর জ্যোৎস্না। রিয়া সুতো তৈরি করে চাঁছা জ্যোৎস্না দিয়ে। সেই সুতোর বল লাফায়, ফিনিক দেয় পিচ্ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে। অথচ এসবের ভেতরেই রিয়া অদৃশ্যে থাকে। যেন সব তার হাতেই রয়েছে, আড়ালে।পাণ্ডিম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় সুতোজ্যোৎস্নার বল সম্বাদী হয়, বিবাদী হয়। নাচে। ছায়াশরীরের পুতুল তাদের আধিভৌতিক গল্পগাছার ঝুরি নামিয়ে দেয় লেপচাসভ্যতার আনাচে কানাচে। কিন্তু কিছু একটা আড়ালেই থেকে যায়। কিছু একটা নয়, রিয়া। নাকি উমাপদ’র পুতুল সিরিজের কবিতায় থাকা ‘দম শেষ হয়ে যাওয়া ছড়টি?

‘গ্রাফ পেপারের মুখোমুখি বসিয়ে দেওয়া হলো
এক স্প্রিং-দম-এ চলা পুতুলকে
কার্যত সে ড্রাম বাজায়
প্রতিটি শব্দ কণায় ভরে যাচ্ছিল গ্রাফের একেকটি বর্গ
বাজনা শেষ হয়ে গেলে
দেখা গেল একটা বেহালা
কিন্তু দম শেষ হয়ে যাওয়ায় ছড়টি
আঁকা হয়নি…’

অতনু আর আমি, উমাপদ’র এই পুতুল সিরিজের বেশকিছু কবিতায় অবাক হচ্ছিলাম কবিতাগুলোর ‘হটকে’ ভাষ্যের জন্য। বাইরে জমাট শীত। পাহাড়ের গায়েই গা লাগিয়ে আমাদের ‘হোম-স্টে’। আরেকটা পাহাড়ের মাথায়। বাইরে প্রতিটি পাহাড়ের গায়ে ফুটে আছে মুন্নামুন্নী আলোর দেওয়ালি। বৈদ্যুতিক এই সাজানো আলোর উপাচার দেখছে তারাসমগ্র। আমরা ভেতরে কবিতা শুনছি। বেঁচে থাকার আর কি ভাল উপায় হতে পারে জানিনা। কবিতা লিখুক বা না লিখুক যে দূরের কাছে যেতে পারেনা, তার কবিতা কেন, লেখালিখিই হয়ে ওঠে শুষ্কং কাষ্ঠং! তার কল্পনার কোন রিনিউয়াল হয়না। সে অন্যের লেখা নকল অথবা চুরি করতে শুরু করে। আর এই চুরি ঢাকার জন্য সেকেণ্ড হ্যাণ্ড নলেজের ছররা ছুটিয়ে দেয় সোশাল মিডিয়ায় বা অন্য কোনখানে। যে ভারতীয় বাঙালি উত্তরবঙ্গ দেখেনি, হিমালয়ে যায়নি সে কবিতা লিখতে পারে অবশ্যই, তবে ওই রুখাসুখা। নীরস। কাঠামোময়। সমুদ্র’র কথা বললাম না, আছে সমুদ্রও আছে, কবিতাকে ট্রিগার করার জন্য। ‘পুরী সিরিজ’ মনে নেই? এই প্রকৃতিকে যে পায়ের তলায় পেলো না তার কাছে কবিতার উৎসমুখ খুলবে কি করে? তবে, ‘গুগল’ করে আজকাল ‘নলেজেবেল’ হওয়া যায়। যে কোন জায়গার খোঁজ রাখা যায়, বিস্ময় কারো তাতে বাড়ে, কারো মিটে যায় বিস্মিত হওয়ার, অবাক হওয়ার খিদে। সিকিমে আসা যাওয়া লেগেই থাকে। আমরাও তো এসেছি। না এলে, কিভাবে জানতে পারতাম, এই পৃথিবীর ভেতরে কত অজানা কুঠুরি আছে। কতরকমের নিষ্কলুষ গন্তব্য, কিছুটা তো জানলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপারে থাকা লেপচাদের আদি বা অনাদিকালের জনপদটি স্ফূট অস্ফূট রহস্যের আধারে এখনো নাকি জীয়ন্ত। রিয়া গিয়েছিল। ও সব জায়গায় যেতে পারে। শি ইজ ওমনিপ্রেজেন্ট! আরিটার লেকেও রিয়া, দূরে অবশ্য। ভাসমান রেস্তোরাঁয়। অতনু ছবি নিল। আমিও নিলাম। রিয়া জানলো না। লেন্স তুলল ওকে, নাকি জেনেশুনেই এই দূরত্বটা রিয়া আরিটার লেকের ওপরে ভাসিয়ে দিয়েছে?‘বাতাস ভেঙে ভেঙে আমরা ফিরে এলাম আয়নার কাছে..’ কাল পড়ছিল অতনু। এই আয়নাটা আমাদের। আমরা আরিটারে ফিরে পেলাম। মালকিন রিয়া। রিয়া লেপচা। ‘ফুদোনথিং’ আর ‘ইৎবুমু’র মেয়ে।

‘পর্বত কে পিছে, চম্বে দা গাঁও/ গাঁও মে দো প্রেমী রহতে হ্যায়….’ এই গানটার রচয়িতা আনন্দ বক্সী নিশ্চয়ই জানতো না যে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপারে ‘চম্বে’ নামের না হোক ‘মায়েল’ নামের একটা গ্রাম আছে লেপচাদের, যেখানে তাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষরা এখনো থাকে। গান গায়। ধান বোনে। জল আনতে যায় নদীতে। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে রোদের মুখোমুখি। রিয়া আর রিয়ার বন্ধু ইয়াংচেন সেই গ্রামের খোঁজে, স্যাংগ্রিলার খোঁজে একদিন, এই যেমন আমি আর অতনু এখন হাঁটছি মাংখিম ছাড়িয়ে অনেকক্ষণ, সেরকমই হাঁটতে হাঁটতে এক অজানা আকর্ষণে ‘মায়েল’-এর দিকে চলতে শুরু করেছিল। পাহাড়, নদী, জঙ্গল, গিরিখাত পেরিয়ে সে এক রোমাঞ্চকর অভিযান। অনেকদিন আগেকার কথা। রবীন্দ্রনাথ তখনো বেঁচে। ধরা যাক মংপং-এ রিয়া আর ইয়াংচেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। খুব ঘুরিয়ে মানুষের যা হয়, রবিঠাকুরেরও তাই হল। ভাবলেন, এদের সঙ্গে হাঁটা দেবেন কিনা। শরীর বেশ খারাপ তখন। মৈত্রেয়ী আগলে রাখছে সবসময় যাতে খেয়ালি মানুষটা কোন বিপদ না বাধিয়ে বসে। রবিঠাকুরকে রিয়া বা ইয়াংচেন চেনেনা। তবে বয়স্ক লোক। শাদা দাড়ি ইকড়িমিকড়ি খেলছে গালে। আর হাসিটায় সুদূরের ডাক বসানো। রিয়া বলল, লেকিন দাদু, আপ যাওগে ক্যাসে? বহত দূর তক যানা হ্যায়। উও ভি কাহাঁ ইয়ে গাঁও হমে পতা নহি। হম তো ইহুঁহি নিকল গয়ে। রবিঠাকুর হাসছেন। ‘ আমি চঞ্চল হে/ আমি সুদূরের পিয়াসি/দিন চলে যায়, আমি আনমনে/তারই আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে..’ অপেক্ষা যাদের ছিল, আজ তারা এসেছে। মৈত্রেয়ীর কালেকশন। অদ্ভুত মেয়ে। কত যে বিচিত্র ওর যোগাযোগ। ওর অভিজ্ঞতা। মৈত্রেয়ী কিন্তু বুদ্ধিমতী, রিয়াদের বলল না রবিঠাকুর কে, কি তাঁর পরিচয়।। তো, একটা মনচলা গল্পগাছা হতে লাগল সেই অদেখা গ্রাম নিয়ে। রহস্য যার পরতে পরতে।

কয়েকশো বছর আগের কথা। লেপচাদুনিয়ার প্রবীণরা খুব চিন্তিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপারের এক বসতি, মায়েল। সেখানে বসবাস করে প্রাচীণতম লেপচারা। তারা তাদের উত্তরসূরীদের কাছে নেমে আসতো। খোঁজ খবর নিত। রিয়া রবিঠাকুরকে বলল, দাদু আপ জ্যায়সা দিখনেওয়ালা ভি উনমে হ্যায়। রবিঠাকুর হাসেন। মৈত্রেয়ীকে বলেন, এই দেখো, আমি তো কবে থেকেই বলছি যে আমার নাম রবি ঠাকুর নয়, রবি লেপচা, তা’ তোমরা মানছ কই? মৈত্রেয়ী রিয়া আর ইয়াংচেনের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বলে, বেশ তো এবার নাহয় মানলাম, উপাধিতে কি যায় আসে, রবি নামটা তো আর পাল্টাবে না! বলছ? বলেই একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন, আমার ড্রিংকটা দাও, সূর্য ডোবার পরে জানোই তো চা চলেনা আমার। মৈত্রেয়ী চাপা হাসি হেসে উঠে গেল ফিল্টার্ড নিমপাতার ্রস দিয়ে বানানো ড্রিংক তৈরি করতে। ডিক্যান্টারে ঢালা সেই সবুজ পানীয় দেখে ইয়াংচেন বলে উঠল, ইয়ে হরা রঙ’কা দারু পিকে মজা আতা হ্যায় দাদু? আপ ছাং পিনা শুরু কর দো, পুরা তন্দরুস্ত হো যাওগে! রবি আড়চোখে মৈত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখলে তো, এখনো একটা পাণিপীড়নের চান্স আছে, কিন্তু ওয়ে আউটটা পাচ্ছিলাম না! এবার পেলাম। ছাং। আহা, ঝংকারিছে! রিয়া কি বুঝল কে জানে, বলল, দাদু বহত মজাকিয়া হ্যায়। রবি বললেন, উও তো হ্যায়, লেকিন কাহানি রুকি কিউঁ?

সেই ‘মায়েল’ গ্রামের আদি মানুষরা আর নেমে আসছে না। তাদের মতে লেপচারা আর আগের মত নেই। তাদের মতিভ্রম হয়েছে। পাপ টানছে তাদের, পুণ্য নয়। তারা না আসায় লেপচারা আর দিকনির্দেশ পাচ্ছেনা। জানতে পারছে না কিভাবে খরা, ধ্বস, প্রবল বৃষ্টি, তুষারপাত, হড়কা বানের ভেতরেও বেঁচে থাকা যায়। আনন্দে থাকা যায়। একটি দামাল ছেলে, যার কাজই ছিল, নদিতে সাঁতার। জঙ্গলে ঘোরা। পাহাড়ে চড়া। শিকার করা আর ঝর্নায় স্নান। একদিন শিকার করতে করতে এক ঝর্নার নিচে মাথা পেতে দিল। খুব ক্লান্ত। ঠাণ্ডা জলের স্পর্শে তার চোখে নেমে এল ঘুম। আর আচমকাই পা পিছলে ঝর্নার স্রোতে ভেসে গেল সে। ঘুমের ঘোর কাটতেই ভাসে যাওয়া ছেলেটির হাতে জড়িয়ে গেল এক নাম-না-জানা ফুল। পাতার বদলে সূঁচের আকারের কাঁটা তাতে। ফুলের শরীর একটি ছোট স্বর্ণগোলকের মত। উজ্বল। ঝলমলে। ছেলেটি সেই ফুলের ডাল ধরে উঠে এল নদীর ভেতরে থাকা একটি পাথরের টিলায়। হাতের ফুলে তখন স্নাত স্বর্ণাভা। ছেলেটি বুঝতে পারল, এই ফুল এই অঞ্চলের নয়। তাহলে কি ‘মায়ালে’র?

আমি আর অতনু হাঁটছি। উমাপদ’র হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে। পুরনো ভাঙা জায়গায় কাল চাপও গেছে যথেষ্ট। আজ নিজেই বলল তোরা ঘুরে আয়। ভোর ছ’টা নাগাত বেরিয়ে আজ আমরা ‘মূলখাকড়া লেক’ –এ গিয়েছিলাম। প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচুতে এই লেকের জলে ছায়া পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার। যাওয়া, আসা হোম-স্টে’র গাড়িতে।গাইড হোমস্টে’র তরুন মালিক ললিত রাই। সারাক্ষণ কাঞ্চনজঙ্ঘা, সারাক্ষণ নীলকাচা আকাশ। পারফেক্ট সবকিছু। রাস্তাটা বোল্ডারের। যাদের কোমরে সমস্যা, তাদের না যাওয়াই ভাল। ‘মূলখাকড়া’ দার্জিলিং জেলায়। পঃবঙ্গে। খুব ভাল পর্যটনের ঠিকানা হতে পারে। হয়নি। হয়ত হবেও না। যাইহোক লেক থেকে কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পরেই একটা উপত্যকা। আহা! সব্জে। গাছালিময় পাহাড় ঘেরা। বেশ স্বর্গ, স্বর্গ। তো, স্বর্গ থেকে ফিরেই উমদা জলখাবার (রুটি, আলুর দম ইত্যাদি। বলে রাখি এই হোম-স্টে’র খাদ্য বেশ সুস্বাদু এবং সহজপাচ্য) সাঁটিয়ে আমি আর অতনু বেরিয়ে এসেছি, গান গলায় ঘুরছে, ‘Trekking through an open mind/ I got a window in my spine’.পাশে এলাচের খেত। বিশাল লম্বা বাঁশ ঝাড়। আর কিছু চাষাবাদ। দুদিকে গ্রামের ঘরবাড়ি। সিকিমে যেমন হয়, ফুলেল। সব বাড়িতেই ফুল ফুটে আছে স্বমহিমায়। ‘ফুদোনথিং’ আর ‘ইৎবুমু’র সন্তান সন্ততিদের হাসিমুখের সম্ভাষণ পেরিয়ে আমরা হাঁটছি। যেমন একবার হেঁটেছিল, রিয়া আর ইয়াংচেন। ‘মায়েল’ নামে সেই বসতির টানে। লেপচাদুনিয়ার অলীক বাস্তব ‘মায়েল’। আমরা এক জায়গায় এসে থামলাম। রোদ হাল্কা চাঁটি মারছে। হাওয়াটা ঠাণ্ডা। রবি ঠাকুর সেদিন মৈত্রেয়ীকে বলেছিলেন, এমন গল্প শুনেও আনন্দ। রিয়া আর ইয়াংচেন চলে গেছে। ওদের শিরদাঁড়ার জানলায় খোলা হাওয়ার ডাক। মৈত্রেয়ী বলল, ‘মায়েল’ই কি তাহলে আমাদের স্বর্গ? ইয়াংচেন বর্ণিত সেই দামাল ছেলেটি অবাক করা ফুলের ঝর্নার উৎসে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিল সেই গ্রাম। সেই ঝর্না শুরু হয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপারে, ‘মায়েল’ গ্রামে।ছেলেটিকে আদর করে ডেকে নেয় প্রবীণতম লেপচারা। আপ্যায়নের চূড়ান্ত করে। আর ছেলেটি অবাক হয়ে দেখে ঐ বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তরুন হয়ে যাচ্ছে। বয়স কমে যাচ্ছে তাদের। বিকেলে হতেই তারা বালক, বালিকা হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। একদিনেই তারা পুরো জীবনবৃত্ত পার করে দিচ্ছে। আবার নতুন হয়ে উঠছে তারা। রোজ, একইভাবে তাদের নতুন হয়ে ওঠা। ছেলেটি সেখানে আর থাকেনি। নিজেকে অযোগ্য মনে করেছে। মনে হয়েছে এই উচ্চতায় সে থাকতে পারেনা। গল্প শেষ করে রিয়া আর ইয়াংচেন চলে গেছে অনেকক্ষণ। রবি ঠাকুর রাতের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে গাইছেন, তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ/ ও মোর ভালবাসার ধন…

রিয়া, রিয়া লেপচা আমায় বলেছিল এইসব। সে তখন রিয়া ফার্ণান্ডেজ নয়। রিয়া ইয়াসমিন নয়। ইয়াংচেনের বান্ধবী রিয়া লেপচা। আরো বলেছিল, ওখানে, ঐ ‘মায়েল’ গ্রামে একটা দিঘি আছে। তার ভেতরে দুই বুড়োবুড়ি থাকে। তারা গান গায়। এলাচের ফুল ছড়িয়ে দেয়। বিলিয়ে দেয় গমের দানা। ফু দিয়ে পাঠাতে থাকে বৃষ্টি আর চোখ দিয়ে শরীর, মন তোলপাড় করা প্রেম। রিয়া, কালজয়ী। তারাই ‘ফুদোনথিং’ আর ‘ইৎবুমু’। রিয়া আরো বলে, আমি সিওর, ‘ফুদোনথিং’ ‘ইৎবুমু’কে রেপ করেনি। রিয়া এভাবেই আসে আমার কাছে। আমায় গোহারা হারিয়ে চলে যায়।

আমি আর অতনু সিকিমের এই প্রান্তে বসে আছি। অনেকটা দূরে আছে উমাপদ। আর সময় ধুয়ে দিচ্ছে আমাদের। অতনু’র একটা লেখায় আছে, নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে লোকটি, মোমবাতি জ্বালিয়ে/ উৎসব লিখতে লিখতে…আমরাও ফিরে যাবো। এই ‘সেলিব্রেশন’ নিয়ে ‘ফুদোনথিং’ আর ‘ইৎবুমু’র সিকিম থেকে। একদিন রিয়ার বানানো এই পৃথিবী থেকেও…

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...