বৃত্ত
শুভাঙ্কুর মিত্র
— আরো খেলা, মদন। বড়ো কাতলা মনে হচ্ছে।
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে পরল অনির্বাণ।
— বলো কি অনির্বাণদা? কাতলা?
— তাই তো মনে হচ্ছে। খেলা আরো একটু। তাড়াহুড়ো করবি না।
বড়শিতে মাছ ধরা পরার আনন্দে কেটে যায় রাত জেগে চার আর টোপ বানানোর ক্লান্তি। হ্যাপা কম নাকি? খোল নিয়ে এসো, মিষ্টির গাদ, মশলা গুঁড়ো, নারকেল তেল মেশাও। সাত দিন আগে থেকেই শুরু করতে হয়। অনির্বাণ প্রায় 5বছর ধরে এই নেশায়। মদন তো এলো মাস তিনেক আগে। পাক্কা আ্যংগলার হিসেবে অনির্বাণ এর নাম আছে। আগে তো কম্পিটিশনেও যেত। এখন আর ভালো লাগে না। দীঘিতে-পুকুরে নিজের খেয়ালেই মাছ ধরে এখন। প্রায় প্রতি রবিবারেই বেরিয়ে পড়ে মদনকে নিয়ে। অনির্বাণের স্কুলের পাশের চায়ের দোকানে কাজ করে মদন। আশেপাশের গ্রম গুলোর মধ্যে একমাত্র স্কুল এই বুলন্দিপুর গ্রামেই। স্কুলের চাকরিটা অনির্বাণ পেয়েছিল বছর খানেক আগে। শহর থেকে বেশ ছুটা দূরেই গ্রামটা। সবচেয়ে কাছের শহর বলতে আংরাঘাটা। সেও প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। বুলন্দিপুরে আসার সহজ উপায় হলো আংরাঘাটা থেকে বাসে চেপে গুন্ডিবাড়ি। তারপর, মেঠো পথ ধরে রিক্সা বা ভ্যানে বুলন্দিপুর। ৫ কিলোমিটারের এই রাস্তাটা প্রথমদিকে খুবই পছন্দের ছিল অনির্বাণের। দুই ধারে সবুজ ধান ক্ষেত, বাঁশবন, বাচ্চাগুলোর খালি গায়ে খেলা করা সবই নতুন লাগতো অনির্বাণের। এখন অবশ্য মনে হয় কবে ঐ রাস্তাটা পাকা হবে। ঐটুকু পথ পেরোতেই শরীরি কলকব্জা গুলো ঝড়ঝড়ে হয়ে যায়। আগে আংরাঘাটা থেকেই ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করত। মাস ছয়েক আগে চলে আসে এই গ্রামেই, একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। একলা মানুষ, যেভাবে খুশি থাকা যায়। একটা হেল্পার দরকার ছিল অনির্বাণের। ছিপ, বড়শি, চার, টোপের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়া, মাছ ধরা পরলে নেটের ব্যাগে সেগুলো নিয়ে আসা, এসবের জন্য। মদনকে পেয়ে তাই সুবিধেই হয়েছিল। তাছাড়াও চার আর টোপ বানানোর যাবতীয় সরঞ্জাম যোগাড়ের দায়িত্বও নিয়েছে মদনই। রবিবারে ওকে সাথে নিয়েই আশপাশের পুকুর বা দীঘিতে মাছ ধরতে যায় অনির্বাণ। পুকুর মালিকদের সাথে কথা বলে তাদের সম্মতি নেওয়াও মদনের কাজ। মাস্টার বলে অবশ্য সেসব পেতে ঝক্কি পোয়াতে হয়নি কখনও। প্রতি রবিবারে ৫০ টাকা উপরি আয়ে মদনও খুশি যথেষ্টই। তবে কিছুদিন ধরে অনির্বাণ লক্ষ্য করছে, মদনকেও পেয়ে বসেছে এই নেশা। টাকার জন্যে নয়, মাছ ধরার নেশাতেই মেতেছে মদন। নিজেই অনির্বাণকে জিগ্গেস করে, কোন কোন মাছ, কি কি চার, খেতে পছন্দ করে। বাইন্ডার হিসেবে কি ব্যবহার করা উচিত। বড়শি কত রকমের হয়, ছিপটা কোথা থেকে কিনেছে। ভালো লাগে অনির্বাণের।
বুলন্দিপুরে সম্ভবতঃ আজই শেষ মাছ ধরা অনির্বাণের। মদনের খুব শখ নিজে হাতে মাছ ধরবে। তাই,বুলন্দিপুর ছাড়ার আগে মদনকে ছিপটা দিয়েছে আজ।
অনির্বাণ গাছতলায় বসে নজর রাখছে। একবার মদনের দিকে,একবার ফাতনার দিকে।
— ধীরে ধীরে খেলা মদন। না হলে বেড়িয়ে যাবে। এটা কিন্তু বড়ো মাছ।
বলতে বলতেই অনির্বাণ দেখল, মাছটা গোত্তা খেয়ে নিচে ডুব মারলো, আর বেরিয়ে গেল, বড়শি ছাড়িয়ে।
— যাহ্, গেল, গেল।
বলতে বলতেই বসে পড়ল মদন। জীবনে প্রথমবার মাছ বড়শিতে গাঁথার আনন্দে যে মুখটা এতক্ষন চকচক করছিল, সেটা এখন ঝুলে পড়েছে। অনির্বাণ এগিয়ে গিয়ে ওর পিঠে হাত দিয়ে বলল,
— মাছ ধরার জন্য সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার কি জানিস? ধৈর্য। ওটা না থাকলে হবে না রে। মাছকে খেলাতে হয়, যতক্ষন না মাছটা হাঁফিয়ে যায়। এই খেলাটাই সবচেয়ে কঠিন। কে আগে হাঁফাবে? তুই না মাছ? জীবনের অনেক খেলাই তাই, বুঝলি! ধৈর্য ধরে না খেললে জীবন থেকেও।কিছুই পাবি না।
মদন অবশ্য এই মুহুর্তে জীবন নিয়ে খুব বেশী আগ্রহী নয়। মাছটা ফস্কে যাওয়ার দুঃখে বড়ই মুসরে পড়েছে বেচারি।
— ধ্যাত্। ভাবলাম, দিদিকে গিয়ে দেখাবো, আমার প্রথম ধরা মাছটা। কাল তো তুমি চলে যাবে। তারপর আমার আবার সেই চায়ের দোকান।
— তাতে কি হয়েছে? শিখে নিয়েছিস তো অনেক কিছুই। চেষ্টা করবি নিজেই।
— এসব বড়লোকি শখ গো। আমাদের কি আর ঐসব…
ওর চোখটা যে চিকচিক করছে, সেটা দূর থেকেই বুঝতে পারল অনির্বাণ।
— তুমি আর আসবে না এখানে?
বলে তাকিয়ে থাকল অনির্বাণের দিকে।
— জানি না রে। নতুন পোষ্টিং।
WBCS এর রিট্ন এ চান্স পেয়ে ইন্টারভিউটা দিয়েছিল বেশ কয়েকদিন আগেই। ভেবেছিল, আগের বারের মত এবারও হবে না। গত পরশু চিঠিটা পেয়েছে। কাল রেজিগনেশনও দিয়ে দিয়েছে স্কুলে। সাত দিনের মধ্যে জয়েন করতে হবে। অনির্বাণ খুশিই। প্রথম দিকে গ্রামটাকে ভাল লাগলেও, এখন একটু একঘেয়ে মনে হয়। কিছু লোকজনকে ভালবেসে ফেলেছে অবশ্য। তবে তাদের ছেড়ে যাওয়ার সময়, হা হুতাশ করার মতো ছেলে নয়, অনির্বাণ। জানে, এসব মায়াবী বাঁধন সারাজীবন ধরেই তৈরি হবে, আবার কাটবেও।
— চল এবার। সন্ধ্যা হয়ে এল। গুছিয়ে নে, সব কিছু।
বলে উঠে পড়ল অনির্বাণ।
ফেরার পথে মদনের পিঠে হাত রেখে বলল,
— মাছটা একবার না ফস্কালে, বড়শিতে গেঁথে মাছ টেনে তোলার চ্যালেঞ্জটা তুই বুঝতে পারতিস না। জীবনের সব ব্যর্থতাই কিছু না কিছু শেখায়। দুঃখ করিস না। অল্প হলেও, আজ তুই শিখেছিস কিছু।
মদন চুপ করে শুনে যায় ওর কথা।
— একটু ভাবলে দেখবি, কখনও মাছ হিসেবে, কখনও আবার মাছ শিকারি হিসেবে, কিছু না কিছু শেখার আছে। ।
— মাছ হিসেবে?
— হ্যাঁ। যেমন ধর, যখন কিছু লোক তোকে চারের লোভ দেখিয়ে টেনে আনবে, অথচ পুরোটা খাওয়াবে না। পুরোটা খেয়ে ফেললে তো টোপটা খাওয়ানো যায় না, তাই। তখন তুই মাছ।
— ওই, প্রথমে ফ্রীতে মোবাইল ডাটা দিয়ে, পরে ডাবল চার্জ করার মতো, তাই না?
হেসে ওঠে অনির্বাণ, বলে
— কিছুটা, তবে মোবাইলের বাইরেও একটা বড় দুনিয়া আছে রে।
— আর কিছু?
— অনেক কিছু। তুই খেলোয়ার মাছ হলে, তোর জানা হয়ে যাবে যে, মারন ফাঁদটা সেখানে থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি, যেটা দেখতে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।
— আর শিকারি হিসেবে?
— ওই যে, ফাতনায় মনোসংযোগ করে যেতে হবে, যতক্ষন না কেষ্ট মিলছে। একবার চোখ সরিয়েছ তো, ফুসস্। আর ধৈর্য্য রাখার কথা তো বললামই। কেষ্টকে তাড়াহুড়ো করে ঘরে আনতে গেলেই ফস্কানোর সম্ভাবনা বেশি।
— তুমি কালই তো চলে যাবে। কার কাছে শুনব আর এসব?
— শুনবি কেন? বুঝবি। বোঝার চেষ্টা করবি। যাক গে, ছাড় এসব। বাড়ি যাওয়ার পথে বুধুদাকে মনে করিয়ে দিস কাল সকাল সাতটায় ভ্যান নিয়ে আসার কথা। তোর তো দোকান আছে, কাল। অতো সকালে আর আসতে হবে না তোকে।
মদনকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, মাছধরার কিটব্যাগটা ওর কাছ থেকে নিয়ে, এগিয়ে গেল অনির্বাণ।
বুধুদা ঠিক সময়ে এলেও, বেরোতে বেরোতে সেই আটটা বেজে গেল। এবরোখেবরো রাস্তায় ভ্যানের ঝাঁকুনি খেতে খেতে অনির্বাণের মনে হল, এতদিন গ্রামে থাকলেও সেই অর্থে গ্রামের মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। কিছু মানুষ, যারা আজ সকালে ওকে বিদায় জানানোর জন্য এসেছিল, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ বোঝার চেষ্টা করছিল, এরা ওকে ভালেবেসে এসেছে, না আসা উচিত, বলে এসেছে। এটা বুঝতে চাওয়ার কোন দরকার ছিল না তখন। বোঝেওনি। কিন্ত ঐ না বোঝা ব্যপারটা একরাশ বিরক্তি নিয়ে এল। বুধুদা বকবক করে চলেছে নিজের মনেই। অনির্বাণ হু আর হ্যাঁ করে চলেছে।
— বুধুদা, একটু আস্তে চলো।
ঝাঁকুনিতে দূরে সরে যাওয়া কার্বন ফাইবারের ছিপটাকে আর কিটব্যগটাকে নিজের কাছে টেনে নিতে নিতে বলল অনির্বাণ। সবুজ মাঠের পাশের আলপথগুলো সোজা হয়ে যেতে যেতে কোথায় মিলিয়েছে, কে জানে? ক্ষেতের ধারের পাম্পের জলে যে ছেলেটা খেলা করছে, তাকে দেখতে দেখতে একটু খারাপ লাগাও শুরু হল কি? কিসের খারাপ লাগা, সেটা বোঝার চেষ্টা করবে না, অনির্বাণ। জানে, না বুঝতে পারলে, সেই একঘেয়ে বিরক্তি জড়িয়ে নেবে আবার।
— কাল নাকি এক মজার খবর বেরিয়েছে কাগজে?
বুধুদার কথায় অনির্বাণ একটু আনমনেই বলল
— কি?
— কোন এক ফরেনের লোক নাকি নিজের কোটি কোটি টাকা দিয়ে যাচ্ছে, মরে যাওয়ার আগেই। আমরা অনেক দূরে থাকি। নাহলে আমরাও কিছু পেতাম, কি বলেন?
বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে বিধুদা।
অনির্বাণ দেখেছে কালকের খবরের কাগজটা। মার্কিন ঐ কোটিপতির নাম চার্লস চাক ফিনে। প্রথম ডিউটি ফ্রি শপ তৈরি করেছিলেন। প্রায় ৮০০ কোটি ডলার দান করে যাচ্ছেন। এই ইহজগত থেকে বিদায় নেওয়ার আগেই ওর উপার্জনের সব কিছু দান করে যাবেন, এমনই ইচ্ছে ছিল নাকি ওনার।
— খবরটা ঠিকই শুনেছ। তবে বাজারে গিয়ে টাকা বিলি করছেন না। হসপিটাল,স্কুল-কলেজে দিয়ে যাচ্ছেন।
— ওহ্, তাই!
বুধুদা একটু হতাশ হলো।
অনির্বাণ ভাবে, সারাজীবন কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেন যিনি, তারপর কি বিরক্ত হয়েই সব দান করার কথা ভাবেন? নাকি, আসল আনন্দটা একটা বৃত্ত শেষ করতে পারার। শূণ্য থেকে শুরু করে আবার শূন্যে ফিরে বৃত্তটাকে সম্পূর্ণ করার আনন্দ। এতে একটা আত্মম্ভরিতা আছে। নিজের আত্মবিশ্বাসকে সকলের সামনে প্রমান করার আনন্দ? হতে পারে। অনেক মাছ ধরে ফেলার পরে একটা মাছ ফস্কানোয় অনির্বাণের যেমন দুঃখ হয় না, তেমনই বোধহয় আরো উপার্জনের ইচ্ছেটা ঐ মার্কিন ভদ্রলোকের নেই। ‘নেই’ মানে, চাইলেই আবার করে ফেলব সেই বিশ্বাসটা আছে, হয়ত। সবার জীবনই সরলরৈখিক হতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই।
— আর আমাদের আমিনুল সাহেবকে দেখেন। সেদিন ওর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, ওর বাড়ির কাঁঠালগুলো গাছেই নষ্ট হচ্ছে। চাইলাম। দিলে না।
আবার একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরছে অনির্বাণকে। আরও 5মিনিটের মধ্যেই পৌছে যাবে, গুন্ডিবাড়ি।
— বুধুদা, একটা জিনিস ফেলে এসেছি। একবার ফেরত যেতে হবে।
বুধু খ্যাঁচ করে ব্রেক কষে ভ্যানটা থামিয়ে, মুখ ফিরিয়ে বলল,
— কি আবার ফেলে এলেন? আপনাকে গুন্ডিবারি নামিয়ে, আমিই নিয়ে আসছি।
— না না, ও তুমি পারবে না। চলো চলো, ঘুরিয়ে নাও।
ভ্যানটা নিয়ে গ্রামে ঢুকতেই, অনির্বাণ বলল,
— ওদিকে নয়, মদনের বাড়ি যাবো।
মদনের বাড়ির সামনে এসে, দুইবার ডাকতেই বেরিয়ে এল মদন। অনির্বাণকে দেখে একটু অবাক হয়ে বলল,
— আরে, তুমি?
ভ্যান থেকে নেমে, ছিপটা আর কিটব্যাগটা ওর হাতে দিয়ে অনির্বাণ বলল,
— এটা রাখ তুই। প্রথম মাছটা ধরে ফোন করিস আমায়।
একদিনের চাক ফিনে হওয়ার আত্মম্ভরিতাই হোক বা নিজের সরলরৈখিক জীবনটাকে একটু বাঁক দেওয়ার খুশিতেই হোক, অনির্বাণ একটা সিগারেট ধরিয়ে, মদনের মুখের দিকে না তাকিয়ে, ভ্যানে চেপে বসে বলল,
— চলো, বুধুদা।