অশেষ যন্ত্রণার অরুণ আলো : বাংলা কবিতার আফ্রেদাইত
শুভদীপ নায়ক

নতুন করে বেজে উঠেছে সুর, রোদ পড়েছে আমার পার্বত্য ঘাসের জমিতে, পাইন গাছের সারির ফাঁক দিয়ে, রোদ পড়েছে দূরের বরফাবৃত পাহাড়ে । আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন বইপত্রের ঘরেও সেই রোদ্দুর লুকিয়ে এসেছে জানলা পথে, আর বলেছে, ‘ কতকাল তুমি মরে থাকবে নেশায় ? ডুবে থাকবে নির্জনতার সমুদ্রে ! উঠে এসো, শঙ্খ তোমার অপেক্ষায় আছে ।’
বয়স যত মৃত্যুর দিকে এগচ্ছে, ততই যেন মানুষ হারাচ্ছি আমি । আমার মধ্যে নতুন করে ফিরে আসছে মানুষেরই স্মৃতি, যেন অনির্বাণ আলোয় জ্বলতে থাকা সম্পর্কগুলো আজও মরেনি, সরে গেছে জীবনের অন্যপ্রান্তে, আমিও ভুলেছি তাদের, নতুন করে আবার কবিতাকে ভালবাসব বলে । আমার বইপত্রের ঘরে বহুবছর ধরে বেড়ে উঠেছে সুধীন্দ্রনাথের কবিতার বই, বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধের বই, সার্ত্রের দর্শন, কালিদাসের বিরচিত বই, পদাবলী সাহিত্য, গ্রিক দর্শন, মার্কিন কবিদের কাব্যগ্রন্থ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সাহিত্য ও ফরাসি প্রেমের কবিতার বই । তারা পরস্পরের সঙ্গে সহবাস করছে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের বইয়ের পাশে । আরেকটি বইয়ের সারিতে এসে স্থান পেয়েছে কিছু কবিবন্ধুদের বই, আধুনিক কবিদের বই, ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলী, আছে হোমারের ‘ইলিয়ড’ ও ভার্জিলের ‘ইনিভ’ । সেইসব বইয়ের পাশে অনতিদূরে গড়ে উঠেছে পত্রিকাদের একটি কলোনি । প্রতি সপ্তাহে কিংবা প্রতিমাসে একটি করে কাগজ সেখানে নতুন সংসার পাতে । আছে চিঠির বই, পৃষ্ঠাভর্তি সেই সমস্ত আর্তনাদ, যা হয়তো লিখিত হয়েছিল কোনও এক সুদূর অতীতে, যা হয়তো ঝরে গেছে পাঠকের অভাবেই, যা হয়তো পৌঁছেছিল কোনও না কোনও এক প্রেমিকার কাছে, কিন্তু মূল্য পায়নি, অথবা অনেক বাধ্যবাধকতায় ফিরে এসেছে । বিস্তর এই বইপত্রের মাঝে আমি চিরকাল হারিয়ে যেতে চেয়েছি, তাই আমার জীবনে গড়ে ওঠেনি সম্পর্ক, ঘরবাড়ি, মানুষের প্রতি আস্থা, বন্ধন ও শিথিলতা । আমি তো বাঁচতে চেয়েছি রবীন্দ্রনাথের গানে, কিটসের চিঠিতে, শেলির কাব্যে, ফরাসি উপন্যাসের পাতায় পাতায় আমি খুঁজে বেড়িয়েছি জীবনের সেই তাড়না, যা আমাকে আলাদা করবে সমাজ থেকে, আমাকে বিশ্রাম দেবে, আমাকে বয়ে আনবে সবুজ প্রকৃতির মধ্যে, প্রেমের যন্ত্রণার একেবারে কেন্দ্রে । আমি চেয়েছি, কোনও মেয়ের বুকে যেন আমার জন্য অপেক্ষা না থাকে, আমি চলে গেলে নতুন করে আমাকে যেন আর কারোর না মনে পড়ে !
দীর্ঘকাল কবিতা লেখা বন্ধ করে গদ্যে হাত দিয়েছি, কেননা কিছু বইপত্র নিয়ে আমার কয়েকটি কথা লেখার ছিল । আমার লেখালিখির একটা বিরাট অংশ জুড়েই অবস্থান করে সমাজবিমুখ জীবনের শূন্যতা । আমি চিরকালই উৎসববিমুখ, আনন্দ আমাকে স্পর্শ করে না । কোনও সম্পর্কের মধ্যে আমি আজও হতে পারিনি আনুষ্ঠানিক, পুরোটা রাখতে পারিনি নিজেকে । তাই আমার সম্পর্ক ভেঙেছে, ঝড় উঠেছে, দুর্বিপাকে পড়েছে আমার সমস্ত জীবন, তবু সেই প্রলয়াশ্রিত জীবনে আমি বারবার শুনেছি সর্বনাশের ডাক, বাতাসের শব্দ, পেয়েছি দাবানলের উত্তাপ, কবিতার মধ্যে দিয়েই আমাকে ইশারা পাঠিয়েছে অন্য সম্পর্কের পরজায়া । আমি পেয়েছি সেই দুর্লভ নারীর দৃষ্টিপত্র, চোখের ওপর চোখ পড়তেই যে নজর ফিরিয়ে নিয়েছে অন্যত্র । বলেছে, ‘মানুষ চিরজীবন মানুষকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ।’
আমি যখন সমুদ্রতীরে একা, পৃথিবীর শেষ রোদ কুসুমরঙের আভায় ঢেউ ও বালির চর-কে একসূত্রে বেঁধেছে, সেসময় আমার পড়ন্ত গোধূলির সাক্ষী হয়েছে এমন একটি বই, যে বইয়ের কবিতাগুলো লিখছে স্বয়ং আফ্রেদাইত, সুফলা এক নারী, যিনি প্রতিভায় বিদগ্ধ, জীবনদর্শনে বিস্মিত ! বইটির নাম উল্লেখ করার আগে আমি আবারও পড়ে নিতে চাই কাব্যগ্রন্থটি থেকে আমার পছন্দের কিছু ব্যক্তিগত পংক্তি ।

‘কবিতা শুরুর কাছে
কবিতা শেষের কাছে ফিরে আসছে
মোহগ্রস্ত, অকপট, ঋণী
বুকে এসে কথা লাগছে
নতুন কাপের ছলে
পুরোনো ধোঁয়াকে ছুঁল ঠোঁটের কাহিনি’

আট, দশ, বারো ও চোদ্দ মাত্রার মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যিনি মানুষের সুর ও কথার সারাৎসারকে বেঁধে ফেলতে পারেন, তিনি কবি কস্তুরী সেন । যাঁর অনবদ্য প্রথম বই ‘ধীরে, বলো অকস্মাৎ’ নিয়ে কেটেছে আমার সমুদ্রযাপন, আমার পাহাড়ি স্তব্ধতা । এই স্তবকটি যে কবিতার, সেই কবিতাটির শিরোনামেই লুকিয়ে আছে প্রণয়, প্রীতিলিপি, রমণ, বিভা ও নতুন মায়াজাল । কেননা, ‘চলন্ত লেখার থেকে/ আরও তুঙ্গে উঠে যাচ্ছে অভিজ্ঞতা’ । কবিতাটির শিরোনাম তাই ‘সমর্পণ’ । ‘সমর্পণ’ শব্দটি জীবনের সবচেয়ে বড় আত্মজিজ্ঞাসা, অন্তত আমার কাছে । আমি এতই ঝড়-জলে বিশ্বাসী, এতই তীব্র আমার রুদ্রবীণার সুর, এতই কম্পিত আমার প্রেম, আমি কখনো নিজেকে রাখতেই পারলাম না অন্যকারোর হাতে । যে হাতে থেমে যাবে আমার সমস্ত ন্যায়-অন্যায়, যে হাত আমায় জীবনে ফেরাবে, কবিতার মতো যে হাত আমাকে জানাতে চাইবে ‘বঙ্গোপসাগর ওহে/হাওয়া ঢালো, / কাব্যের নিকুচি মানি !’ অতঃপর অন্তরালে সে লিখবে এক বিভ্রান্তির কথা, ‘কী অন্ধ যে করে গেছ/ তহপরা সঙ্গসুধা দিয়ে ।’
সার্বিকভাবে আমার জীবনের পক্ষে এই বিভ্রান্তিই বড় ভাল, বিশেষভাবে উচিত । এই বইয়ের কবিতাগুলো অাধুনিক কবিতার সময়ে দাঁড়িয়ে রচনা করছে আমার সংশয়ে ভরা অতীতকে । সমগ্র পৃথিবীতে কবিতা যেখানে পৌঁছে গিয়েছে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক পর্যায়ে, সেখানে বাংলা কবিতায় নতুন করে উঠে আসছে রোম্যান্টিসিজম, আসছে পুরনো সম্পর্কের মনেপড়া স্বাদ, আসছে অসম বয়সের সুর, পুরুষের বিস্ময় পুনরায় সম্মিলিত হচ্ছে নারীর লজ্জা নিবেদিত প্রেমের সঙ্গে । এই পূর্বরাগ আমি পেয়েছি পৃথিবীর সেরা গ্রন্থগুলোর মধ্যে, পেয়েছি গ্রিক নারীদের চরিত্রে, পেয়েছি বাইজেনটাইন নারীদের প্রণয়ে, পেয়েছি বৈষ্ণব পদাবলীতে । সাহিত্যে নারীরা চিরকালই প্রশ্নবোধক, উন্মোচিতা, তাঁদের চোখের কটুদৃষ্টি সর্বদা পৌরুষে ফাটল সৃষ্টি করেছে, পুরুষ তাই পা দিয়েছে মোহতে, মুগ্ধতায়, অকল্পনীয় লালিত্যে, আর বলা বাহুল্য জীবনস্রোতে ভেসে গেছে অনেকগুলো প্রাণ ।
মনে পড়ে যায়, কবি কস্তুরী সেনের এই বইটিকে নিয়ে আমি বসেছিলাম এক পাহাড়ি জ্যোৎস্নার নিচে । সামনের গিরিশৃঙ্গে বরফের ওপর পূর্ণিমা-চাঁদের আলো পড়েছে, আর চাঁদের বাকি কলঙ্কটুকুর ছায়া পড়েছে আমার মনের ওপরে । আমি হোটেলের বারান্দায় বসে আছি আমার প্রিয় সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কি নিয়ে । ঠাণ্ডা হাওয়ার ছুরি আমাকে ফালাফালা করে দিচ্ছে চতুর্দিক থেকে । সেইমুহূর্তে আমার চাই উষ্ণতা, চাই একজীবন উত্তাপ, চাই কাঠের আগুন, যা আমাকে বাঁচাতে পারে প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতার হাত থেকে । কিন্তু সেদিন আমি বড় নিরুপায়, কেননা তুষারপাতে ভিজে গিয়েছে ফারারপ্লেসের জন্য বরাদ্দ করা কাঠ । আমি তরল হুইস্কির সঙ্গে ভাগ করে নিলাম আমার সেই উপায়হীনতা, খুললাম এই বইটির পৃষ্ঠাগুলো । দেখলাম লেখা রয়েছে,

   'দুলিয়ো তাকে দ্রাক্ষাকুসুমলতা

দুলিয়ো তাকে মুগ্ধে মধুরাতে,
দোলাটি দিয়ো, খরচ কোরো তাকে
আয়না, আতর, সাবান, গোলাপখাতে—’

প্রবল তরঙ্গ লাগে, দুর্ঘটনা জানান দেয় সে আর বড় বেশি দূরে নেই, মেনে নাও তার অস্তিত্ব, সাড়া দাও তার ডাকে । বিমুগ্ধ উষ্ণতায় সেদিন ভরে গিয়েছিল সমগ্র পাহাড়তল, চিড় ধরেছিল বিরাট বরফের চাঁইয়ে । পরিশেষে অবশিষ্ট আর কিছুই থাকল না, কারণ সবটুকু তাঁর বলা হয়ে গিয়েছে ‘অবশিষ্ট’ কবিতাটিতে । যেহেতু কবিতায় আমি লোভের উপাসক, তাই এ কবিতাটি সর্বস্ব তুলে না দিয়ে আমি ভাল থাকতে পারছি না ।

    অবশিষ্ট

এসবই লুকিয়ে রাখা কাজ, এই তীক্ষ্মধার
স্তরে খেলাধুলো
নিষেধ প্রচ্ছন্ন থেকে তাকে আজ
বিন্দু বিন্দু ধর্মমতে ছুঁল ।

এক পা এগোলে ভুল, দ্বিতীয় তৃতীয় পায়ে
সংখ্যাতত্ত্ব বসে ছক পেতে—
এ জমি আমার আর বাকি জমিটিতে
দেখে রাখা, কে হারে কে জেতে…

এসবই সজ্ঞানে খুব, বাকিটুকু নতমুখ, বাকিটুকু
নিষেধও পারেনি—
সে থেকেছে বাকিটায়, সন্ধ্যায় জলের ধারে;
আমাকেও, একাকী ছাড়েনি ।

নিটোল নির্ভুল অক্ষরবৃত্তে রচনা এই লেখাটি এমন একটি কবিতা যা প্রমাণ করে নারী অনন্তকাল অমীমাংসিত, অন্তত প্রেমের ক্ষেত্রে, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে । ‘বিন্দু বিন্দু ধর্মমতে ছুঁল’— এ কথাটি নিছক কোনও বালিকার কথা নয়, এ কথাটি বলতে পারে সেই অঘোর যুবতী যার ভিতরে বজ্রবিদ্যুতের যাতায়াত । যে মানে বোঝে মনুসংহিতার, যে মেয়ে লজ্জায় থামতে চায় ও একইসঙ্গে লজ্জাকে ভাঙতে চায় । ‘এ জমি আমার আর বাকি জমিটিতে/ দেখে রাখা, কে হারে কে জেতে…’— এই হল প্রণয়যুদ্ধ, এই হল পুরুষের সঙ্গে শালগ্রামশিলার লড়াই,— এই হল প্রেম, কবিতার চিরন্তন জারণ, যা সব মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয় । এমন অভিসারী আত্মকাতর, রতিযন্ত্রণায় বিমুগ্ধ নারী আফ্রেদাইত ছাড়া আর কেই-ই বা হতে পারে ? মহাকবি হোমারের ‘ইলিয়ড’ কথিত জিয়ুস আর ডাইয়োনের সেই কলঙ্কিতা কন্যা যে আসলে নষ্ট শরীরের দেবী । নিজেকে ভেঙেই যে দেবী সৃষ্টি করলেন রুদ্রকাম, সৌন্দর্য, ও আকর্ষণের কৃষ্ণমেঘ । গ্রিক ধর্মমতে যাঁর পদস্পর্শে পৃথিবীর সমস্ত নারীর মধ্যে জেগে উঠল প্রণয়াকাঙ্ক্ষা, পুরুষদের মন মজে গেল মেয়েদের প্রতি । ভাঙল শৃঙ্খল, থাকল না নিয়ন্ত্রণ, উঠে গেল নিয়মনীতির বেড়া আর ঘেরাটোপ, পরিবর্তে এল মিলন, অপেক্ষা, লোভ, ক্ষিপ্রতা, অধিকারবোধ, আদরের লালসা । কবি কস্তুরী সেনের কবিতার অন্তরে বয়ে চলেছে সেই ফল্গুধারা, যা আসলে আদিরসে সমৃদ্ধ, যা আমরা পাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, যা আমরা পাই বৈষ্ণব পদাবলীতে, যা আমরা ছত্রে ছত্রে অনুভব করি গ্রিক সাহিত্যে, রোম্যানিয়ান ভাস্কর্যে, ইতালিয়ান শিল্পী মিকেলাঞ্জেলোর সৃষ্টিতে, টিৎসিয়ানের আঁকা নারীর ন্যুডিটিতে । লেখাগুলোর প্রাচুর্য এমনই, কবিতাগুলো এতটাই আমন্ত্রণী, যে আমি কিছুতেই পারলাম না একটানা এ বই শেষ করে ফেলতে । আমার মনের মধ্যে চলতে লাগল মহড়া, বাজতে লাগল সুরের ঝংকার, গেয়ে উঠল অচেনা কণ্ঠ । আমি পাগল হয়ে খুঁজে বেড়ালাম সেই নারীকে যে আমার ভেঙে যাওয়া জীবনকে হঠাৎ এসে গাঁথতে চাইছে প্রণয়সূত্রে ।
কিছুকাল পর এই বইটিকে সঙ্গে নিয়ে আমার যাত্রা হল দূরপাল্লা ট্রেনে । আমি চলেছি অনন্তে, নির্জনাবাসে । আমাকে নামতে হবে দিকশূন্যপুর স্টেশনে । সেখানে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে সেই স্বপ্নতুরা নারী, যাকে আমি চিরকাল খুঁজেছি বইয়ের পৃষ্ঠায়, সবুজ বনান্তে, আকাশের শেষ সীমায় । পাইনি ! ব্যর্থ হয়েছি আমি । এবং ক্রমাগত একা হতে হতে বুঝেছি, প্রেমে যে সর্বস্ব হারায়, জীবনের শেষে সেই-ই প্রেমের সবটুকু পুরস্কার বাড়ি নিয়ে যায় । তাই, আমার বইপত্রের মধ্যে রয়ে গিয়েছে কবি কস্তুরী সেনের এই বইটি । আমার জীবনের ভাঙচুর কোনওভাবে মেঘলা করেনি এই বইটিকে । এতবার পালিয়ে বেড়ালাম, শিকড়হীন মদ্যপ একাকী জীবন অতিবাহিত করলাম, ভেঙে পড়লাম, সমস্ত ভাঙন ঘিরে পুনরায় উঠে দাঁড়ালাম, জীবনের কাছে এই যে আমি চিরকাল অপরিচিত হতে চাইলাম, তার আসল অর্থ হল ‘মিসিং’ । অনেক মানুষ ভাবল আমি হারিয়ে যাচ্ছি হতাশার অন্ধকারে, যেমন করে হারাতে চেয়েছিলেন টি.এস.এলিয়ট, কেউ কেউ ভাবল আমি আমার গোপন প্রেমিকাটিকে ধীরে ধীরে স্পয়েল করে তুলছি, কিন্তু কেউ যে কথাটা ভাবল না, তা হল;— ভুলতে চাওয়া আর ভুলতে পারা তো এক ব্যাপার নয় । ভুলতে চাওয়া হল মনের সঙ্গে লড়াই । আর ভুলতে পারা, সেও ঐ মনেরই একটা ব্যথা ।
যে বই চিরকালীন আমার ব্যক্তিগত নিরালার পাঠ্য, আমি তাকে বয়ে বেড়ালাম আমার সর্বত্র । ক্রমশ লজ্জা ঝরছে, কুণ্ঠা সরছে, ভেসে আসছে ছুঁতে চাওয়ার ইঙ্গিত, ফুটে উঠছে দেখতে চাওয়ার আনন্দ । বুঝতে পারছি, আমার ভবিষ্যত যত এগচ্ছে, ততই বড় বেশি গভীর হয়ে উঠছে আমার অতীত । এবং আরও একটি কথা না জানিয়ে পারছি না, আমি যখন মারা যাব, স্তব্ধ হয়ে যাবে আমার নতুন লেখালিখির আশা, তখন আমি যা হারাব, তা আমার সাহিত্যজীবন নয়, তা হল আমার বর্ণময় অতীত ! অনেক অন্যায়, অনেক পাপ, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ও সংশয় মিশে রইল আমার সেই অতীতে । কারণ, আমি আজও ভালবাসি বিচ্ছেদ ও যন্ত্রণা, ভালবাসি শেলির অব্যর্থ বেদনার ‘ওড্’ অথবা ‘সনেট’ । কেননা, শেলির মনের চলার পথটি চিরকালই তো অন্যান্য কবিদের চেয়ে ভিন্ন, সেখানে ভালবাসার প্রদাহ মিশছে একা থাকার নিঃসঙ্গ তাড়নার সঙ্গে । বুদ্ধিমত্তা ও ব্যাকরণের তত্ত্বকে প্রেমের নিগূঢ় ভাবকল্পের সঙ্গে কালের বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েই শেলি হয়ে উঠেছিলেন ইংরাজি কবিতার ট্র্যাজিক নায়ক । আমি সেই প্যাথেটিক ট্র্যাজেডির একনিষ্ট পাঠক । আজও আমি ভালবাসি রাত করে বাড়ি ফিরতে, অফিস ফেরত কোনও একটি পানশালায় বসে স্কচের সঙ্গে সমান তালে একটি কবিতার বই উপভোগ করতে । আমার ফেরার কোনও তাড়া থাকে না, কোনও বন্ধনের প্রতি দায়িত্ব থাকে না,—এই আমি চেয়েছিলাম, এবং সেই অদ্ভুত বিষণ্নতা যা সাঁকো বাঁধতে পারে সৃষ্টিতে গাঁথা মহৎ সাহিত্যগুলোর সঙ্গে, আমি তা পেয়েছি । এই একাকীত্ব আমাকে আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা কিছু বানায়নি, তা আমাকে দেয়নি ধ্যানের পবিত্রতা, জ্ঞানের গাম্ভীর্য ! বরং আমাকে জুগিয়েছে সেই অপ্রতিম আলো, যা দিয়ে আমি পড়ে ফেলতে পেরেছি মানুষের লেখাকে, সর্বোপরি, তাঁর অন্তরকে । আমি দেখতে পাই সেই মেঘদূতী রমণীকে, যে আমারই মতো লেখা পড়তে পড়তে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে, কী সুন্দর হেসে উঠছে, সে তাঁর বাঁধুনিহীন চুল কখনও সামনের দিকে নিয়ে আসছে, কখনো এক ঝটকায় পিছনে ফেলে দিচ্ছে, কখনো তাঁর ঈর্ষণীয় হাসিতে সে নিজেকে আড়াল করছে, কখনো চাপা হাসিতে মেলে ধরে বলছে, ‘আমি চিরবিশুষ্ক, আমাকে ভেজাও তুমি জীবনের জলে ।’ তাঁর সেই হাসিটিকে আমি আজও ভয় পাই, নিজেকে বাঁচাই তাঁর ইন্ধনে সাড়া দেওয়ার হাত থেকে, পিছিয়ে যাই তাঁর মোহতে পা দেওয়ার ভুল থেকে, তবু এই যে প্রতিটি বই পড়ার ভিতর দিয়ে সে ফিরে ফিরে আসে, —তার মানে সে আমাকে একা হতে দেবে না । কিন্তু আমি জানি, আমি একটা মানুষ যে নিজের রক্তমাংসের মূল্য দিয়ে আজও চিনতে পারল না নিজেকে, থেকে গেল অগোছালো, এলোমেলো, পরিচয়হীন । কোনও মেয়ের পক্ষে আর যাই হোক এমন মানুষকে ক্ষমা করা সম্ভব না । আমার জীবনের সব ছিটকে গেল হাতের বাইরে, রইল শুধু বইপত্রের জীবন, আমার ব্যক্তিগত আশ্রয়, অনুষ্ঠান ও আনন্দ থেকে বজায় রাখা আমার চিরদূরত্ব । কিন্তু সেই দূরত্বের অন্ধকার ডিঙিয়ে নিঃশব্দে কেমন করে উঠে এল এই সামুদ্রিক ঝড় আমার জীবনে ? তা জানতে, কবি কস্তুরী সেনের লেখা প্রথম বইটি আপনাকে পড়তেই হবে, এবং নিরুপায় হতে হবে তাঁর অক্লান্ত কবিতার কাছে ।

ধীরে, বলো অকস্মাৎ
কস্তুরী সেন
ধানসিড়ি প্রকাশন

1 Comment

  • কস্তুরী সেন

    Reply November 4, 2020 |

    আলোচনাটি সুন্দর লাগল। আমার বই এমন পাঠক পেয়েছে জানতে পারলে আনন্দ হয়। এই পর্যবেক্ষণকে আমার ধন্যবাদ।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...