যতটুকু মেনে নিতে পারি, জীবন আমার
দেবায়ন চৌধুরী
আমরা এখানে থাকি
ভাত রুটি অনাহার ঘৃণা আর ভালোবাসা নিয়ে
আমরা এখানে বুঝি
বিষাদও কদিন পরে
প্রকাণ্ড উৎসবে ঢেকে যায়
খুব বেশি গভীরে যেয়ো না
অগভীর হাওয়াটির সাথে
নিরাপদে প্রেম করো
নিরাপদে ঘরে ফিরে যাও।
( ‘সতর্কতামূলক’, রণদেব দাশগুপ্ত)
আমরা কার সঙ্গে আছি, কার সঙ্গে বাঁচি এই চিন্তাভাবনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসলে আমাদের সহবাসী বয়ান। ‘অ’ আগে এসে বসে সুখকে পাঠিয়ে দেয় দূরে তেপান্তরে। তবু নিজেকেই ফিরে ফিরে দেখি। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর জন্য পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শব’ কবিতার শেষ লাইনটি মনে পড়ে—‘আসলে কবেই মরে গেছি। শব শুদ্ধ।’ কী আশ্চর্য ‘বম্বেDuck’ পত্রিকার (কলকাতা বইমেলা ২০২০) পাতা উলটে দেখি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভূতের শহর’ কবিতায় লিখে ফেলেছেন অমোঘ পংক্তি—‘কথা ছিল দেখা হবে গুলমোহরের দিনে, এখন তাকিয়ে দেখি এ এক ভূতের শহর…’। একই পত্রিকার একই সংখ্যায় তিনজন কবি যে বৃত্তান্ত লিখছেন, তা কোথাও পরবর্তীকালে মিলে যাবে কোনো বিষয়ের সঙ্গে। হয়ত খানিক বিষয় বহির্ভূতভাবেই।
(২)
প্রতিদিন আমরা বলি এভাবে ঠিক বাঁচা যায় না। তবুও তো বাঁচি। এটাই কি ম্যাজিক নয়? বিষাদে ডুবে যেতে যেতে আবার যে পাশ ফিরে শুই সকাল দেখব বলে, তার মূলে কী থাকে? সেই হ্যাঁ আর না।মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে তিরতিরে এক নদী। শুধু পায়ের পাতাটুকু ভেজাব বলে কত পাথর ভেঙে এলাম…।
বেঁচে থাকাটাই কি এক অর্থে অসহ-বাস নয়? নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে তা কি যন্ত্রণার থেকে নিংড়ে আনা নয়? পাওয়ার পলিটিক্সে জেরবার হয়ে রেশনের লাইন থেকে সাহিত্যসভা পর্যন্ত নিজেকে বহিরাগত মনে করা অসহনীয় নয়? কোথাও ঠিক মানিয়ে নিতে না পারাটা শেষ অব্দি যে জীবনকেই প্রশ্ন করে— মশাই, এভাবে আর কদ্দিন?
(৩)
ইদানীং খবর কাগজ পড়তে ভয় লাগে। শবদাহ করতে যাচ্ছে শ্মশানযাত্রীর দল… দুর্ঘটনা… সবাই মিলে ‘শব’। হরিনাম করতে গিয়ে বলহরি। বাইকে অহরহ মারা যাচ্ছে মানুষ, কখনো এক পরিবারের তিনজন। শোক করার মতো কেউ বেঁচে থাকছে না, কিংবা যারা রইল তাঁরা কেবল পাথর। দুঃখজনক, অনিচ্ছাকৃত শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিয়তির সর্বভূক খিদের সামনে সবাই কেমন যেন পুতুল পুতুল।
করোনা-উত্তর পৃথিবী অসহবাসের অভিজ্ঞতাকে শিল্পে উত্তীর্ণ করেছে–এমন এক লাইন লেখাই যায়। মুখ ঢেকে যায় মাস্কে, হাত ধুতে ধুতে জেরবার, মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও পারিবারিক হিংসা বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে চুলোচুলি চলছেই। দেশ আর দশের কথা, দুর্নীতির প্রসঙ্গ বাদই দিলাম, মুখ খুললেই খামোশ। ভগবান অনন্ত নিদ্রায়…
রাজনীতির ক্ষেত্রে শত শহিদের রক্ত ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হয়। কী জানি! আত্মঘাতী বাঙালি। যার আর কোনো দেয়াল নেই। লিখন তো দূর অস্ত।
(৪)
কীভাবে আমরা মেনে নিতে বাধ্য হলাম দুর্নীতিকে, রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতিকে, দাদাদের চোখরাঙানিকে– তা নিয়ে গবেষণা হোক। পরিবর্তিত পরিস্থিতি আর বৃহত্তর স্বার্থ রাজনৈতিক বুলিতেই আটকে নেই; দলবদলু নেতাদের দোষ যদি নাই থাকে, সাধারণ মানুষও কেন পতাকাবদল করবে না? করছে তো, আবার করছেও না। স্থির করে কিছু বলাটাই মুশকিল। কুয়াশার ভেতর একটি লোক রোজ ময়দানে হাঁটতে যায়, তার দল-বদল কিছুই নেই। নিঃসঙ্গতা ছাড়া।
অসহ-বাস কিংবা অ-সহবাস যাই বলি না কেন, মনে হয় সহবাসের স্বাদটা মূলত কল্পনায়, স্মৃতিতে। বাস্তবের সঙ্গে যার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। বিশ্বাস ভেঙে যাবার পরেও মানুষ আবার হাত ধরতেই ভালোবাসে। এর কোনো মানে হয়?
সমস্ত অনর্থের মধ্যেই যেভাবে থেকে যায় গূঢ় অর্থ, তেমনি অসহবাসের বয়ানেও বুঝি থেকে যায় মনকেমনের কোলাজ। মনটাকে বাঁচিয়ে রাখাটাই চ্যালেঞ্জ মনে হয়। মন মরে গেলে সনাক্তকরণ করতেই পারব না যে! আর তাই হঠাৎ অসহ-বোধের মধ্যেই ভেসে আসে একরাশ লিলুয়া বাতাস। যেমন এই লেখাটি। অ দিয়ে শুরু হয়ে অসুখ ছাপিয়ে চলে যাচ্ছে অনন্তের দিকে। তাকে ধরে রাখব এমন সাধ্য কই? তাকে ছেড়ে দেব এমন সাহস নেই। বেঁচে থাকার মানেই খুঁজে যাচ্ছি কেবল, সেখানে সহবাস আর অসহবাস স্থানবদল করছে ক্রমাগত। কোনো সিদ্ধান্তে যে পৌঁছুব, সেই স্থিরতাই যে নেই! এই দেখুন লেখার পরের স্টেশন এসে গেছে…
TUHIN SARKAR
January 2, 2022 |চলতি তথ্য ভড়াট ,নতুন আঙ্গিকে লেখা। ভালো লাগে।
yashodhara Ray Chaudhuri
January 2, 2022 |অসহ-বাস কিংবা অ-সহবাস যাই বলি না কেন, মনে হয় সহবাসের স্বাদটা মূলত কল্পনায়, স্মৃতিতে। বাস্তবের সঙ্গে যার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক
চমৎকার টান টান লেখা। খুব ভাল
Anjanaa Chattopadhyay
January 4, 2022 |“অসহ-বাস কিংবা অ-সহবাস যাই বলি না কেন, মনে হয় সহবাসের স্বাদটা মূলত কল্পনায়, স্মৃতিতে। বাস্তবের সঙ্গে যার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। ”
সব কথা যে পুরোপুরি মানতে পারছি তা নয়, তবে বক্তব্য সুপরিবেশিত। আঙ্গিকটিও টানে ।
ভালো লাগলো।