“জিন্দেগী অউর কুছ ভি নেহি, তেরি মেরি কাহানি হ্যায়”
সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ঘুম থেকে উঠে গাছের সামনে এসে দাঁড়াই। কচি সবুজ শিশিরমাখা পাতাগুলো কাঁপছে তিরতির করে। টবে কিছু গাছ লাগিয়েছিলাম। লকডাউনে এই নেশাটা আরো চেপে ধরেছে। প্রতি পদক্ষেপে অনুভব করেছি গাছই একমাত্র সে আপনজন যে শুধু বিনিময়ে আঘাত দেয় না। মন ভালো করে। তার আনন্দ স্পর্শে কিশোরী মেঘের মতো খোলা আকাশ দেখতে শেখে মন আবার। দুবছর আগে লাগানো হলুদ চন্দ্রমল্লিকার গাছ আজও বেঁচে আছে ছায়াসঙ্গী হয়ে। সেসব টুকরো টাকরা ভালোলাগাগুলো বারবার জায়গা করে নেয় লেখার ভেতর। তাদের আলো ভোর হয়ে ধরা দেয়। আমি সমুদ্রের ভেতরেও এই আলো দেখতে পাই। নিজেকে কম মনে হয়না সমুদ্রের চেয়ে। কত কী তো পড়ে আছে অতল অন্তরালে। হয়ত সেসব মনিমুক্তো। ঝিনুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা আকর। তবুও রহস্যে মোড়া। বাইরের ঘাত প্রতিঘাত থেকে বহুদূর গোপন সিন্দুকে রাখা। 

জীবন আসলে এক জতুগৃহ। একথা বোঝার বোধগম্যতা সকলের নেই। ধরুন,  একটি মানুষ প্রতিনিয়ত তার সংসারকে আঁকড়ে ধরে বাঁচছে। স্বামী হোক বা স্ত্রী,  যদি এটাই একমাত্র লক্ষ হয়ে ওঠে? পরস্পর পরস্পরের থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাওয়ার অনুভূতিটুকুই যদি উধাও হয়ে যায়? সেসব মনের গঠন বিশিষ্ট মানুষেরা বোধহয় অসহবাসের গভীরতা বুঝতে পারবেন না। মানুষের মন বহুস্তরীয়। সে গোপনের সন্ধান পেতে গেলে সঠিক আরো একটি মনের অনুষঙ্গ প্রয়োজন। প্রয়োজন যে কোমল স্পর্শের তা কী সবার ভাগ্যে জোটে? সোনার পাথরবাটি ভেবে আমরা কেবল আঁকড়ে ধরি জাগতিক সুখটুকু। দুঃখগুলো ভাবতে বসলে বাঁচবে কি ভাবে? 

ঝড়ের সামনে দাঁড়ালে ধ্বংস হতে বাধ্য। তখন আশ্রয় নিতে হয় নিরাপদ ছাদের নিচে। সময় বুঝে সামলে নিতে হয় আগামী পথটুকু। আমাদের যাপনও খানিক এমনই। ভালো মন্দের দাঁড়িপাল্লায় ভালোটুকুকে প্রাধান্য দিয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয় বোধহয় সকলেই আমরা খুঁজে চলি। না হলে যে প্রতিনিয়ত ঝড় ওঠে। সে এক অদৃশ্য ঝড়। তোলপাড় করে মনের ভেতর গুছিয়ে রাখা প্রত্যাশাগুলো।তছনছ করে দিয়ে অট্টহাসিতে উড়িয়ে দেয় সুখের চাবি। চারদিকে তখন তপ্ত বালি। ধু ধু মরুভূমি। 

এমন দুঃস্বপ্ন মানুষ চায় না। সামাজিক জীব বলেই নিজেকে একাকীত্বের বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলতে ভয় পায়। চেনা মানুষ দাগা দিলে অচেনা মানুষের কাছে হাত বাড়ায়৷ শুধু একটু ভালো থাকার চেষ্টায়।

দাম্পত্যকে দাঁড়িপাল্লায় মাপতে গেলে সত্যিই ভুল হবে। দুজন মানুষ যখন একসাথে একই ছাদের তলায় থাকতে শুরু করেন তখন কিছু থাকুক আর না থাকুক বিশ্বাস আর নিপাট বন্ধুত্বটুকু থাকা খুব জরুরী। এমন এক বন্ধুত্ব যাকে সম্পর্কের আয়না বলা যায়। এমন এক মানুষ যার সামনে অভিনয় খাটে না। সুখে থাকার, ভালো থাকার চেষ্টা করতে হয় না। কিন্তু দুঃখের বিষয় বেশিরভাগ যাপনেই এই রসায়ন থাকে না। তখনই আশ্রয় নিতে হয় দূরত্বের। স্পেস আর দূরত্ব কিন্তু এক নয়। সম্পর্কে স্পেস থাকাটা দরকার দুজনের যাপনের ভেতর কিন্তু আমি যে দূরত্বের কথা বলছি তা হল মনের দূরত্ব। স্পেস ছাড়া একজনকে যদি অপরজন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেন নিজের ইচ্ছেমতো তাহলে এই দূরত্ব ক্রমশ বাড়তেই থাকে। বাড়তে বাড়তে কখন যে দুটো মানুষের মাঝে একটা নিঃসঙ্গতার ঘর তৈরী হয়, তা তারা নিজেরাই বুঝতেও পারেন না। 

একে অপরের খারাপগুলো বলতে বলতে যখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে যায় মন তখন বোধহয় জতুগৃহে আগুন ধরতে শুরু করে। সেই সাথে জীবনেও। 

বয়ে চলা জীবনের ধর্ম। সে ধর্মেই আমরা নিত্য বয়ে চলি। নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ, দায়িত্ব, কর্তব্য, পরস্পরের যত্ন সবই। তবুও একে অপরের কাছে পৌঁছতে পারি না। বলা ভালো চেষ্টাই করি না। কী করে আরো ভালো থাকা যায় ভেতর থেকে সেদিকে নজর না দিয়ে বাহ্যিক ভালো থাকাটাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়ে ফেলি যে একসাথে বসবাস সত্যিই অসহ হয়ে পড়ে। উভয়ের ক্ষেত্রেই একথা সত্যি। এ অনুভূতি সকলের হয়ও না। নিত্য প্রাত্যহিকতাকে বেশিরভাগ মানুষ বেঁচে থাকার আখ্যা দেন। কিন্তু আত্মসন্ধান, আত্মোপলব্ধি কোথায় থাকে? দায়িত্ব কর্তব্যের ভেতর নিজেকে খোঁজা হয়ে ওঠে না আর। যে সব মানুষ নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করেন, মনের ভেতর যে সমুদ্রটা আছে তার তলায় হাত ঢুকিয়ে মনিমানিকগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন তারা হয়ত এই অসহবাস বেশি ভালো বুঝবেন। কিভাবে নিজেকে আগলে রেখে নিজেকে গোপন রেখে একটা মুখোশ চাপিয়ে নিতে হয়, ভালো থাকার। 

তবে অন্যকে ভালো রাখার এক ভয়ানক সত্য হল নিজেকে আগে ভালো রাখা। কোনকিছু আঁকড়ে না বাঁচলে মানুষ বোধহয় ভালো থাকতে পারে না, বাঁচতে পারে না। আর তা হল ভালোবাসা। সে যে কোন রকম ভালোবাসা হতে পারে। কোন মানুষের প্রতি যেমন, তেমনই নিজের কাজের প্রতি অথবা নিজের কোন সৃষ্টিশীলতার প্রতি হতে পারে। কেউ আবার চ্যারিটি করে ভালো থাকেন, কেউ আধ্যাত্মিকতায় মুক্তি পান। যাপন চিত্রের অঙ্গে অঙ্গে মানুষের যে না পাওয়ার ছবি ফুটে ওঠে তাকে মানুষ অন্যকাজের মাধ্যমে মোটিভেট করার চেষ্টা করেন। এসবই শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা। ভালো থাকার জন্য। 

কিছুদিন আগে হঠাৎ গিয়েছিলাম লতা বাজোরিয়া বাগানবাড়িতে। অদ্ভুত শান্তি ছিল ওখানকার বাতাসে। চারদিকে সবুজ সতেজ গাছপালা। ওনার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ১০০ প্রজাতির ওপর গাছ আছে ওই বাগানে। একটা ছোট্ট চিড়িয়াখানায় পাইথন, এমু, সাদা ইঁদুর, পাখি, ময়ূর, ময়ূরী, কচ্ছপ। এরাও তাঁরই পরিবারের সদস্য। ২২ জন কেয়ারটেয়ার নিজেদের কোয়াটারে বাস করেন আনন্দে। সবই একই বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতর। লতা বাজোরিয়া মানুষটিকে সেদিনের আগে অবধিও চিনতাম না। যখন চিনলাম নতুন এক আলোর সন্ধান পেলাম। যে আলো শুধু ভালোবাসা ছড়ায়। আমাদের মতো অজানা অচেনা মানুষদেরও যিনি নিজের করে নেন তাঁর আতিথেয়তায়, উপহারে, যত্নে ও কোমল ব্যবহারে৷ এগুলো তাঁর যাপনের অঙ্গ। ভালো থাকার অঙ্গ। হোক না অজানা অচেনা অতিথি, আজও তো প্রচলিত আছে অতিথি ভগবানসম। সে কথা মনে রেখেই হয়ত এক একটা দিন তিনি কাটিয়ে চলেছেন পরম আনন্দে। 

যাপনের অসহতায়তাকে মনে করলে জীবন জতুগৃহ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতিটা মানুষের তার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে। নিজের পথ নিজে সাজিয়ে নেওয়ার অধিকার আছে। তাতে কেউ হস্তক্ষেপ করলে সত্যিই সে যাপন বড়োই অসহনীয় হয়ে পড়ে। সবকিছু একজীবনে যেমন পাওয়া সম্ভব নয়। তেমনই যা পাওয়া যায় তা হয়ত আমরা কোনদিন ভাবতেও পারি না। না পাওয়া যন্ত্রণা থাকবেই, তবে তাকে কাটিয়ে উঠতে হবে পাওয়ার আনন্দ দিয়ে। এটুকু মেরুদণ্ড শক্ত না হলে নিজেকে চেনাও বাকি রয়ে যায়। নিজের জন্য নিজেকেই দাঁড়াতে হয়। আশা, প্রত্যাশা আঘাত পাওয়ার প্রশস্ত পথ মাত্র। যদি কি পাব, এই চিন্তা বর্জন করা যায় তবে অসহবাস খানিক হলেও নিজের কাছে অন্তত সহনীয় হয়ে ওঠে। 

মাঝে মাঝে স্বপ্ন আসে, একটা সেতু দুলছে৷ দুলতে দুলতে এতটাই বেড়ে যায় অনুরণন যে দুটুকরো হয়ে যায়। নিজেকে একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আবার কখনো মনে হয়, যদি সব ছেড়ে চলে যাওয়া যেত! দায়িত্ব আর কর্তব্যের জালে এমন ভাবে জড়িয়ে যায় জীবন যে নিজেকে মুক্তি দেওয়াও আর হয়ে উঠে না। ডাক যখন আসে, তখন আসে। তার আগে শুধু লড়াই  ভালো থাকার লড়াই। 

3 Comments

  • yashodhara Ray Chaudhuri

    Reply January 2, 2022 |

    ভাল লাগল

  • Ishita Bhaduri

    Reply January 3, 2022 |

    ভালো লাগল

  • Deep sekhar Chakraborty

    Reply January 4, 2022 |

    ভালো হয়েছে

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...