অ সহ বাস
সুজন ভট্টাচার্য
অ সহ বাস
সুজন ভট্টাচার্য
‘যদি কিছু লিখে দিতে বল –
গোত্রহীন নামময় বাক্যমালা কিছু,
স্মৃতির পিছনে থাকা আবাসীর নাম –
আমার কিছুই নেই জমানো অতীত
যার কথা বলে সহবাসী সময়কে দিতে পারি
বন্দনার গান।
স্তিমিত সূর্যের কোলে
আমি শুধু লিখে দেব কাহিনী
অসহবাসের’।
কিছুদিন আগের কাহিনী। মৃত্যু হল এক বৃদ্ধার। শবদেহ ফিরে এল ঘরে। তখন মাঝরাত। আসন্ন শীতের উঁকিঝুঁকি এসে গেছে গাছের ফাঁকফোকরে। যদিও এতখানি অবসন্ন নয়, টিভির সুচারু প্রদর্শনমালা ছেড়ে নেমে আসা যায় না রাস্তার ধারে। বৃদ্ধা চলে গেলেন শেষ আশ্রয়ের অভিমুখে। যে মহল্লায় জীবনের শেষ তিরিশটা বছর কাটিয়ে গেলেন তিনি, সেখান থেকেই বিদায় হয়ে গেল নিতান্ত অপরিচিতের বেশে। যদি সংজ্ঞা থাকত বৃদ্ধার, হয়তো সিদ্ধান্ত নিতেন, নিতান্তই অসহবাসী ছিলেন তিনি নিজস্ব ঠিকানায়। সহবাসী কেউ ছিল না তাঁর নিত্যদিনের পরিচিত দলে।
সহবাস কী তাহলে? কতটুকু গাঢ় হলে সম্পর্কের দায়, সহবাসী হওয়া যায় সংশয়হীন ভাবে? আভিধানিক সংজ্ঞা বলে সাংসারিক বা বিছানার অধিকারের কথা। নিতান্ত যৌনতার কাহিনী। কিছুটা ঘাম আর স্বেচ্ছাকৃত মজা। তারপর? উপার্জিত ক্লান্তির শেষে মানুষ কোথায় যায়? পার্শ্ববর্তী নিথর দেহের আর কোন দাম থাকে চাহিদার খাতায়? জীবদ্দশায় কতটুকু সময়ই বা মেলে তার? কিংবা শয্যায় তুফান আনার কাল অস্তগামী হলে? তখনও কি সহবাস চলে? চলা সম্ভব? নাকি বিগত যৌবনের স্পন্দনের মুহূর্তগুলো যাকে ঘিরে ফোটে, সেও হয়ে যায় অপাংক্তেয়? জটিল নয় এমন প্রসঙ্গ কি আছে জীবনের স্খলিত গমনে?
তাহলে বিস্তৃত করি সংজ্ঞার নিভৃত ঠিকানা। সহবাস নয়; সহ বাস, সহিতে বাস, সহনের দায়ে। জীবনের কোঠাঘরে কেবলই স্ফূর্তি নেই, নেই শুধু মজার উচ্ছ্বাস। সেখানেও আচমকাই হানা দেয় বিষাক্ত কীট, শস্যের পুঞ্জীভূত ঘরে অবাধে ক্রীড়া করে নদীর উচ্ছ্বল জল। প্রতিটি আনন্দের আগেপরে চলে আসে বিপর্যয় অথবা রিক্ততার ডাক। তখনই মানুষ খোঁজে আশ্রয়ের দ্বার। একটি সমমনা হৃদয়ের ভরন্ত আশ্বাস – যতকিছু হোক, আছি আমি দেখো। আর তখনই মানুষ পায় অতিরিক্ত নির্ভরতা, যার কাছে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা যায় যাবতীয় অসহায় দশা। কিংবা ভিক্ষার সামগ্রী রূপে নয়, নিতান্ত সরল আয়াসে পেয়ে যায় প্রাণের স্পন্দন।
যে মানুষ পায়, তারই শুধু সহবাসী মেলে। জীবনের আঘাটায় নোঙর নামাতে ভায় পায় না সে। তার পাশে আছে মিলেমিশে একত্রিত হয়ে আরও এক সজীব সম্পদ। যৌনতার অধিকার তখন আর শর্ত নয় তার, নিছকই সরল প্রণিপাত। কতটুকু দীর্ঘ হল রতিমন্ত্রমালা, জীবনের সোহাগের কাছে সবকিছু গৌণ হয়ে যায়। মৌন হয় অপ্রাপ্তির বঞ্চনারাশি। কারণ ততদিনে কারও আর নিজস্বতা নেই, স্বকীয় অর্জন বলে সংসারে আর কিছু অবশিষ্ট নেই যৌথতার সাধনার বলে। তখন সেই সহবাস বিস্তৃত জীবনের প্রতিটি পরতে। আর সেটাই প্রকৃত সহবাস, দুইজনে পারস্পরিক সহবাসী।
সংসার বা পরিবার নিছকই এক সংক্ষিপ্ত রূপ। একক মাত্রার। যে বিপুল বারিধি বিস্তৃত চারিদিকে, সেটাই সমাজ। সেই সমুদ্রেই ভাসমান প্রতিটি মানুষ, আর পরিবার তার। সেই মহাসমুদ্রে পরিবার নিছকই এক বিন্দুমাত্র জল। এমন অজস্র জলকণার পারস্পরিক সংসক্তি আর আসঞ্জনের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে তটে, আবার ফিরে আসে নিজস্ব কোটরে। সমাজেও তাই। একটি পরিবারে নিতান্তই সংসর্গহীনভাবে থেকে যেতে পারে না সমাজের বুকে। আর সেখানেই চলে আসে বৃহত্তর সহবাসের উপাখ্যান, সামাজিক যৌথতার কাহিনী। আর নিতান্ত দুর্ভাগ্য আমাদের, বড়ই প্রকট আজ সেখানেও যূথচারী অসহবাসের উন্মাদ সাধনা।
সমাজ গড়ে উঠেছিল দায়ে, নিতান্তই জৈবিক দায়ে। অস্তিত্বরক্ষার আশঙ্কা ছিল, সম্ভাবনা ছিল আগামীর সম্প্রসারের। সেই হিসাবে নেহাতই বুনো কুকুরের ঝাঁক। সেখানেই শুরু নতুন দিগন্তের সন্ধানে। তার জন্য প্রয়োজন ছিল মস্তিষ্কবৃত্তির। অভিব্যক্তির আপাতত শেষ ধাপের ফসল যে বড়ই অসহায়, শারীরিক ক্ষমতার বিচারে। সেই অভাব মিটিয়ে নিল সে মস্তিষ্কের ক্রমশ বিকাশে। আর অবশ্যই দুই মুক্ত হাত খুলে দিল সম্ভাবনার অনন্ত দ্বার। পাশব প্রজাতি মস্তিষ্কের ব্যবহারে রচনা করল সাংস্কৃতিক চন্দ্রাতপ, অজস্র বানিয়ে তোলা বিধি। চরম সক্ষম কোন সিংহ আদ্যাবধি লেখেনি আত্মজীবনী তার। অথবা কোন হস্তিশাবক মায়ের কাছে জোড়েনি আবদার, শোনাও রূপকথা কোন। এখানে স্বতন্ত্র মানুষ, এখানেই সে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আপন ভাগ্যের।
আর এখানেই লুকিয়ে ছিল পতনের অসীম গহ্বর। ব্যভিচারী লোভ শয়তানি টোপরূপে ঝুলিয়ে রাখা সমাজের প্রতিটি চত্ত্বরে। একা বাঁচো সমূহ উপাদান নিয়ে, আর সব নস্যাৎ হয়ে যাক। তুমি যদি থাকো, তাহলেই পৃথিবীও আছে। বিপরীতে আর যাই হোক, তোমার সাশ্রয় নেই। পবিত্র বচন অহরহ ঝরে পড়ছে মানুষের কানে। সাহিত্য শোনাচ্ছে গীতি, সেটাই পবিত্রতম, একান্তই ব্যক্তিগত যা। মানুষের যা কিছু অর্জন, সবটাই সামাজিক গাথা। তাকেই ছেঁকে নিয়ে ঢালা হচ্ছে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির কোলে। ভুলে যাওয়া হচ্ছে, সমাজ উচ্ছন্নে গেলে ব্যক্তিরও পরিত্রাণ নেই। কেউই হারকিউলিস নয়, একাই সাফাই করে দেবে গোয়ালের জঞ্জাল।
সমস্যা এখানেই। কিন্তু সেকি চিরকালই ছিল? কমবেশি তারতম্য অবশ্যই ছিল। কিন্তু এমন অসহবাসের নজির ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরকালীন নয়। একক মানুষের লোভ চিরদিনই সক্রিয় ছিল। অন্যকে ঠকালে যে আত্মপুষ্টি হয়, ধারণাটি নিতান্ত নবীন নয়। কিন্তু তাতেও মাত্রা বাঁধা ছিল মানুষের সামূহিক দায়ে। কিন্তু কালের করাল গ্রাসে সেই বোধ আজ নিতান্ত ফসিল। শুধু তুমি যা চাও, সত্য সেটুকুই; অর্থহীন অন্যান্য যাবতীয় সম্পর্কের দায়। এই বোধ আজ দানবের মত গ্রাস করেছে মানুষের মন আর বিবেক। সেখানে কেবল আত্মতাই আছে, আত্মজন বলে ঠাঁই নেই কারো। আর তার বিষময় ফল ভোগ করছে সবাই।
মানুষ যে বাসায় থাকে সাধ্যমত তাকে পরিচ্ছন্ন রাখে, রাখে সুন্দর করে। সেই সাধারণ বোধও আজ অবলুপ্তপ্রায়। তাই যে বৃহত্তর বাসা আমাদের সকলের, তাকেও উচ্ছন্নে দিতে কারও কারও অদম্য প্রয়াস। লুঠ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল, পাহাড়ে থাবা বসাচ্ছে আগ্রাসী লোভ। ওদিকে ধ্বসে যাচ্ছে মেরুদেশের হিমবাহ, টর্নেডো আর ঘূর্ণিঝড় হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের সহচর। কেন হতে পারল এমন? নিছক মানুষের মননচর্যায় তার হদিশ মিলবে না। উত্তর লুকিয়ে আছে তার বাইরের জীবনে। আর সেই কালান্তক যম হল বর্তমানের কাঙাল পুঁজিবাদ। মুনাফার পাহাড় বানাতে বসে সে নস্যাৎ করে দিচ্ছে পৃথিবী নামক গ্রহটির বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। আর তারই প্রকোপ পড়ছে মানুষের মনে।
যে মানুষ নিজের ভবিতব্য নিয়েই ছিনিমিনি খেলে তার আর যাই থাকুক উত্তর প্রজন্মের প্রতি কোন দায় নেই। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’ কামনা করেছিল ঈশ্বরী পাটনি। আর বর্তমানের দানব ঝেড়ে ফেলছে সেই দায়। হ্যাঁ, পুঁজিবাদ একদা অবশ্যই অগ্রগতির সূচক ছিল। মানুষের সৃজনক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়েছিল অকল্পনীয় গতিতে। মানুষের যাবতীয় চর্চায় এনেছিল মুক্তির ডাক। কিন্তু প্রগাঢ় জরায় আক্রান্ত সে আজ; অথচ মৃত্যুর নামগন্ধ নেই। অভিযোজনের প্রকোপে অগত্যা সে আজ কাঙাল, চারিদিকে যতটুকু আছে, সবকিছু লুটেপুটে নিতে ব্যগ্র। তাই তার আগ্রাসী থাবার নিচে পৃথিবী নামক গ্রহটির অস্তিস্ত্ব।
আর তাই আজ প্রতিমুহূর্তে বর্ষিত হচ্ছে বাস্তববাদ নামক মার্কিন দর্শনের বাণী – বর্তমানই একমাত্র সত্য; অতীত বা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। ভাবো, যেন স্বয়ম্ভু তুমি, আবার আত্মজেরও সম্ভাবনারহিত। কাজেই শিকড় বলে কিছু নেই, নেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বর্তমানের মানচিত্রে টিকে থাকাটাই একমাত্র কাজ। পিছনে তো নয়ই, সামনেও তাকিও না। আজকের বাস্তবতাই যখন একমাত্র ধ্রুবসত্য, তখন তাকেই দোহন করো যতভাবে পারো। থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু, স্থবিরতা মানেই বিনাশ। অতএব, স্বপ্ন দেখো দোহনের, গান গাও দোহনের। জীবনের একমাত্র চরিতার্থতা তাই দোহনক্ষমতায়। আর সেই দোহনের বীজমন্ত্র হল ভুবনায়ন-স্তোত্র। কিভাবে? প্রশ্ন আসে বুঝি? দেখাই যাক।
ভুবনায়িত বিশ্ব দেউলিয়া পুঁজিবাদের কাঙাল স্বপ্নকে অবাধে ফেরি করে যাচ্ছে মানুষের মনে। দোলাচলের ঠোক্করে মানুষের মন বিপর্যস্ত এমনিতেই। আর সেই সময়ে এমন রঙিন ফানুষ চোখ তো টানবেই। আর তারই প্রকোপ পড়ে গেছে মানুষের মনে। তুমি আসলে একক সত্ত্বা এক; নিজস্ব উত্থান ছাড়া অন্য কিছু ধর্তব্য নয় তোমার জীবনে। জীবন, সেও তো নশ্বর অতি। কাজেই উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত। তোতাপাখির কানে দিবারাত্র সংকীর্তন গেয়ে মন্ত্রটির পাঠ বড় ভালই দেওয়া গেছে। সামাজিক জীবনে বিষ ফলেছে তারই। প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানোর সময় নেই কারো। সময়? নাকি তাগিদ?
জল যদি ঢাল বেয়ে নামে, রেহাই দেয় না কাউকেই। আগে ডোবে নিচু ভিটে। কিন্তু প্রাসাদেও হানা দিতে বাধা নেই তার। আমাদের চিন্তনেরও সেই একই ক্রম। পাড়ার দিকে আর তাকাই না আমরা। দূরের দৃষ্টি সংকুচিত হতে হতে ঘরের দেয়ালটাও একসময় হয়ে ওঠে বার্লিনের প্রাচীর। সেই অন্ধকক্ষ কেড়ে নেয় আলোকের শেষতম দ্যূতি। আর তাই ঘরও হয়ে ওঠে অসংখ্য উপ-কক্ষের সমাহার। তাই পিতা সন্ধান রাখে না সন্তানের মনোকষ্টের, কৃতি সন্তানও বৃদ্ধাবাসের ঠিকানা খুঁজেই দায় সেরে ফেলে। দম্পতির নিত্যদিনের যন্ত্রণার মাঝে ডানা মেলে পরকীয়ার শকুন। আর সবটাই গ্রাহ্য হয়ে যায় চলতি হাওয়ার নামে।
সহিতে বাস অতীতের উপকথা তাই। সহ বাসী আর তাই কেউ নই আমরা। বিছানার সহবাসে সময় অবশ্যই মেলে। কিন্তু মানসিক সহবাসে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। মানবিক সহবাস আপাতত পরিত্যাজ্য এখন। তাই সহবাসী কেউ নই আর; দিন কাটে অসহবাসে। সুখে না অসুখে, সে বিচার করে কে!
Soumi Acharya
January 2, 2022 |জানিনা কেন চোখ ভিজে উঠছে।ভীষণ ভালো লাগল।যৌনতাকে গৌন করে দিতে পারে যে আদর যে মায়া তার স্পর্শটুকু উপলব্ধি করাই জীবন এবং সহবাস।শ্রদ্ধা জানাই কলমে।
দেবলীনা
January 2, 2022 |ভীষণ ভালো লাগলো লেখাটা … শ্রদ্ধা জানাই
Tanima Hazra
January 3, 2022 |অনবদ্য ব্যাখ্যা