চিঠি
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

প্রিয় যতীন ডাক্তার

আমার কথা তোমার মনে না থাকবারই কথা। তোমার চেয়ে সামান্য বড় তোমার বোন সেই পটলদিদি? সেবারের দুর্ভিক্ষেয় আমার বাপ-মা মরে গেলে আমাকে দয়া করে তাদের ঘরে স্থান দিয়েছিল। কাঠকুড়ুনির আবার সাহেবী বাংলোয় ঢুকে পুনর্জন্ম হল গো যতীন বাবু।  জাতপাত সবের ঊর্ধ্বে উঠে গেল মুখ্যুসুখ্যু কুড়ানির দিনযাপন। তোমাদের রবিবাবু আমাকে সামান্যা, সাধারণার মত গড়েপিঠে নিলেন। তিনি আবার একটু বেশীই রূপ দিলেন আমার। হরিণের মত আমার ডাগর চোখদুটিতে কচি ডাবের মত টলটলে জল দিলেন । ভরভরন্ত, ডাগরডোগর, ঢলঢলে রূপ লাবণ্য দিলেন। তাইতো পটলদিদির বর আমারে নারীর বদলে হরিণী ক‌ইলেন। আর তোমার পটলদিদি সেই বনহরিণীর মত ছিপছিপে ষোড়শীকে কুড়ানি নাম দিয়ে তোমার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। বিয়ে যেন ছেলের হাতের মোয়া।

আমার পিঠের ওপরে অগোছালো, এলোমেলো চুলের বিনুনি পড়ে ছিল। মুখ ফুটে তুমি কিছু না বলতে পারলেও আমি সেদিন দেখেছিলাম গো যতীন বাবু। তোমার চোখ ছিল সেইদিকে। বহুদিনের অযত্নে, খাদ্যাভাবে আমার শূলবেদনার চিকিত্‌সে করবে বলে পটল দিদি আমাকে আরো ঘনিষ্ঠ করে দিল তোমার সঙ্গে। তুমি কি সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমার শরীরে কোনো গোল পাওনি সেদিন। পটলদিদি আমারে বোকা ভাবলেও আমি সত্যি‌ই অত বোকা ছিলেম না গো ডাক্তারবাবু। পটল দিদি হৃদযন্ত্রের গোলোযোগের কথা পাড়ল।  ততক্ষণে পেত্থম দেখাতেই আমি তোমায় মন দিয়ে দিয়েছিলাম গো বাবু।  পটল দিদি তো খুশি তে ডগমগ হয়ে বিয়ের কথা পেড়েই ফেলল। মনে আছে ডাক্তার বাবু? কিন্তু তুমি যেন বুঝেও বুঝলে না যতীন বাবু।  

কি জানি পটলদিদিরা লেখাপড়া জানা পাকা লোক। বুঝতে পেরেছিল বোধহয়। আমার সাদা মনে কাদা নেই গো বাবু। সেদিন দিদি জিগেস করতেই আমি সবার সামনে কয়েই দিলুম তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি কৌতুক বুঝিনে গো বাবু। বড়লোকদের তামাশাও ধরতে পারিনে। এখনো এমনি‌ই আছি। সেসময়ের ষোলো বছরের বোকাসোকা মেয়ে, তোমাদের কুড়ানি অত পাকাপোক্ত ছিলনা গো । বিশ্বাস করো। বিয়ের কথা শুনেই মনটা কেমন খুশিতে ভরে গেছল সেদিন। বামুন, ডাক্তার এসব মাথাতেই ছিল না। শুধু তোমার মুখটা আজো ভুলতে পারিনি। আমার প্রথম পুরুষ। যে আমাকে ছুঁয়ে দেখেছে সেই ভাবনায় সারা গায়ে কিসের শিহরণ যেন অনুভব করেছিলুম। গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেছল সেদিন।

এদিকে পটলদিদি মনের আনন্দে আমাদের বিয়ের কথা ভাবছে। আর সেই ফাগুণে তুমি আকাশের দিকে চেয়ে ভাবছিলে আমার কথা।  মুখে প্রকাশ না করলে কি হবে মেয়ে হয়ে জন্মেছি যখন ষোলো বছরে এটুকু বোঝার ক্ষেমতা আমার দিব্য ছিল। আমার শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছিল বাবু। আমার পায়ের তলায় গরম তেল মালিশ করেছিলে তুমি। সেদিন টুক করে একটা পেন্নাম করব ভাবার আগেই তুমি লজ্জায় পালিয়েছিলে । আজ চিঠিতে যদি পেন্নাম করি তোমায়? খুব রাগ করবে গো যতীনবাবু? সেদিন পটলদিদির রসিকতার চোটে অস্থির তুমি আমি দুজনেই।    

সেই ফাগুণে কোকিলগুলো যেন একটু বেশীই ডাকছিল। হাওয়ায় অন্যবারের চেয়ে একটু বেশীই যেন আমের বোলের গন্ধ নাকে আসছিল। ঠিক বলছি কিনা? তোমার কাগজ পড়ার ছুতো আর আমার দেবার কথা চায়ের পেয়ালাপিরিচ। পটলদিদি উপলক্ষ্য মাত্র। বকুলফুলের টাটকা মালা গাঁথিয়েই ছাড়ল দিদি আমায়। সেই মালা হাতে নিয়ে? থাক্‌, সবটাই জানো এরপর।  

কিন্তু কেন পরদিন হঠাত করেই পালিয়েছিলে যতীনবাবু? তুমি চলে যাবার পর আমার বুকটা খাঁ খাঁ করে পুড়ে গেছল সেদিন। তোমাকে বলতে পারিনি। ডাকতেও পারিনি। উপায় ছিল না।
রবিবাবু কি নিষ্ঠুর! তাঁরও একবার মনে হল না? তোমার পালঙ্কের পায়া ধরে মাথা কপাল চাপড়াচ্ছি, পটলদিদির নজর এড়াল না। আমি মাটিতে পড়ে আছাড়ি পিছাড়ি খেলাম। ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। কি নিষ্ঠুর তুমি যতীনবাবু!  

পটলদিদি বলে উঠল, “লক্ষ্মী বোন আমার, তোর কী বলবার আছে আমাকে খুলে বল্‌”  

তখন তোমাদের মুখ্যুসুখু কুড়ানি বোঝেনি বসন্তের সেই হাওয়ার মানে। জানো বাবু? এজন্মে রবিঠাকুর গুলে খেয়েছি আর জেনেছি সে বসন্তে আমার কান্নার কারণ। আর যেন কেউ বসন্তে প্রেমে না পড়ে।

তোমার পটলদিদির খুব সাধ ছিল আমাকে নিজে হাতে বিয়ের কনে সাজায়। হায় আমার পোড়া কপাল! পটলদিদি গো, তোমার চুড়ি-বালা-রুলি, নাকের লবঙ্গফুল, তোমার আদরের সব চিহ্ন মুছে ফেলেছে তোমাদের কুড়ানি ততক্ষণে।

যতীনবাবু, সেদিন তুমি পালালে আমাদের সবার চিন্তায় জল ঢেলে। নাগাল পেলেনা একটা মুখ্যু মেয়ের? তল পেলেনা তার মনের? শরীর নিয়ে কারবার কর তুমি। মনের খবর রাখোনা তাইনা ডাক্তারবাবু?  

কথায় বলে ভাঙা পাথর তোলা থাকে। হায় ভগবান! সেই মুখ্যু অবহেলিত পাথরটা আবার তোমার সামনে পৌঁছে দিলেন ভগবান।  

পৌঁছনোর কথা ছিল বিয়ের কনে হয়ে আর হাজির হলাম এক্কেবারে শেষ সময়ে। পটলদিদির বুনো হরিণী তখন আধমরা রোগিনীর বেশে তোমার সামনে। অজ্ঞানেও তোমার স্পর্শ পেয়ে আবারো মনে হল আমি বেঁচে উঠছি। দুধ খাইয়েছিল সেদিন। মনে পড়ে? কিন্তু শরীর সায় দিলনা গো বাবু।

আমার মা বলত, “উড়বে মেয়ে পুড়বে ছাই, তবে মেয়ের গুণ গাই”। কুড়ানি পুড়ে ছাই হল আর সেই ছাই উড়িয়ে রবিবাবু জানিয়ে দিলেন সবাইকে। এমন করে জানালেন যে এজন্মেও আমার শ্বশুরবাড়ির সবাইয়ের আমায় নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই গো বাবু।  

আর সেই বকুলফুলের শুকনো মালাটা? এজন্মে সেই মালা সোনার বানিয়ে দিয়েছে আমার বর। সেইকথাটা জানাব বলেই এই চিঠিখানা লিখে ছেড়ে দিলাম তোমার উদ্দেশ্যে। কেয়ার অফ বকুলতলা এই ঠিকানায়। বকুলতলায় ঝরে পড়া সব শুকনো ফুলেরা তোমাদের কুড়ানির কথা জানে। কোনো মেয়েরা এই ফুলের মালা গেঁথে যেন তাদের যতীন ডাক্তারদের অপেক্ষায় না থাকে। তোমার পটলদিদির কুড়ানির সংসারে এখন উপচে পড়া আদিগন্ত সুখ। উথলে উঠছে বৈভব। ঘটনাচক্রে তার স্বামী এখন ডাক্তার গো দাদাবাবু। তবে তিনি কুড়ানিদের চিকিত্‌সে করেন না। তিনি কেবল বড়লোকদের ডাক্তার। শিক্ষিত লোকেদের মনের ডাক্তার গো যতীনবাবু। শরীর নয় শুধুই মন নিয়ে তার কারবার।  আমাদের একটি ফুটফুটে মেয়ে। তার নাম রেখেছি বকুল।


পেন্নাম আগেই জানিয়েছি। বাড়াবাড়ি কোনোদিন‌ই আমার পছন্দ নয়। কেউ যেন আর কন্যা সন্তানের নাম কুড়ানি কিম্বা ফেলানি না রাখে। ব্যাস এটুকুই।  

ইতি
তোমাদের অভাগিনী
কুড়ানি 

1 Comment

  • অদিতি ঘোষদস্তিদার

    Reply July 1, 2021 |

    চমৎকার! ঝরঝরে লেখা আর শেষটা চাবুক! দারুণ

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...