বোকা মানুষের চিঠি
জয়াশিস ঘোষ

চলে যাওয়ার দিন বৃষ্টি আসবেই

একটা একগুঁয়ে কুকুর আপনার চৌকাঠে
বসে থাকবে। বিস্কুট দিলে আপনার দিকে তাকিয়ে
মুখ সরিয়ে নেবে

চলে যাওয়ার দিন খবরের কাগজওয়ালা বলবে
একটা লটারির টিকিট কাটবেন স্যার? বাড়িতে ছেলেটার
খুব অসুখ…

চলে যাওয়ার দিন আপনি অনেকক্ষণ ধরে
গাছে জল দেবেন। নতুন পাতায় হাত বুলিয়ে বলবেন
ভালো থাকিস

হারিয়ে যাওয়া কোন বন্ধু দুম করে মেসেজ পাঠাবে
পাশের বাড়ির যে মেয়েটিকে লুকিয়ে দেখেন
সে নারকেলের বড়া দিয়ে যাবে এক বাটি

পড়ে থাকা রেডিওটা সস্তায় বিক্রি করে দেওয়ার আগেই
অনেক দিনের মৌনতা ভেঙে
বলে উঠবে বিবিধ ভারতী

চলে যাওয়ার দিন খবরে বলবে
আবহাওয়া আগামী তিনদিন খারাপ থাকবে
সমুদ্রে যাওয়া মানা…

মনে করুন, আজ আপনার আত্মহত্যা করার দিন।

আজকে ঠিক করলেন, কাল পর্যন্ত যা যা করতে পারেননি
সেইসব ইচ্ছে পূরণ করবেন।
অফিসে বসের গায়ে রেজিগনেশন লেটারটা ছুঁড়ে
বলবেন, ‘তোর এই চাকরির মুখে…

কলেজের সেই মেয়েটা, যাকে বলতে পারেননি
একসাথে সিনেমা দেখার কথা
তার বাড়িতে এক গোছা মোরগফুল নিয়ে চলে যাবেন
হাতে দিয়ে বলবেন, ‘বড়ি বড়ি শহরোঁ মে…
শাহরুখ খানের স্টাইলে, দু হাত ছড়িয়ে দিয়ে

বাসস্ট্যান্ডের সামনে যে ফুচকাওয়ালাটা
যার কাছে রোজ ফাউ নিয়ে ঝোলাঝুলি করেন
আজকে বেশি ঝাল দিয়ে খাওয়ার পর
তার হাতে একশোটা টাকা গুঁজে দেবেন
আর নিজে বানিয়ে একটা ফুচকা

চায়ের দোকানে বসা লম্বা চুলের যে ছেলেটা
রোজ বিরক্ত করে, তার সামনে গিয়ে বলবেন
চলো ভাই, আজকে একসাথে বসা যাক
সে অবাক হবে। আপনি কিন্তু জল ছাড়াই…

তারপর রাস্তার মাঝখানে এসে চোখ বুজে দাঁড়াবেন
একটা মেয়ে দৌড়ে এসে আপনাকে বলবে
আজকে সারাদিনে একটা ফুলও বিক্রি হয়নি
তুমি নেবে বারোটা গোলাপ? কম করে দেব…

ঠিক তখনই আপনার মনে পড়বে
আত্মহত্যা করতে কেউ মানিব্যাগ নিয়ে যায় না
গোলাপ নিয়ে যায় কি?
মেয়েটিকে বলবেন, আমার কাছে নেই রে কিছু!
দুম করে আকাশ থেকে এক ফোঁটা জল পড়বে
আপনার কাঁধে। তার থেকে বেরিয়ে আসবে পরি
আপনাকে হেসে বলবে,
আমার সাথে ভিজতে যাবেন?

এরপর প্রতিবারের মতই
আত্মহত্যার দিনে বৃষ্টি ভিজে বাড়ি ফেরার পর
ভুল চাবি হাতে নিয়ে
দরজায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন

যতক্ষণ না আপনার মত দেখতে কেউ বেরিয়ে এসে
হেসে বলে, ‘ওয়েলকাম ব্যাক’!

মনে কর একটা মানু্ষ চলতে চলতে ফুরিয়ে যাচ্ছে
ধীরে ধীরে মাটিতে ঢুকে যাচ্ছে
তার পায়ের পাতা, গোড়ালি

হাত মাথার ওপর তুলে লোকটি এগোচ্ছে
হাঁটু ডুবছে। ডুবছে কোমর
আর কিছুক্ষণ পরে সন্ধে হবে
সারা শহর ডুবে যাবে আলোর ক্ষণিকে

যে লোকটা ডুবে যাবে শহরের নীচে
তার মাথার ওপর পাতা হবে রেললাইন
যেখানে প্রতি সন্ধেবেলা আত্মহত্যা করতে গিয়ে
কেঁদে ফেলবে একটা লোক

একদিন বেখেয়ালে তাকাবে আমার দিকে

যদিও তোমার চোখের সামনে
সাধারণ পালকের মত পড়ে আছি
যে পাখির, সে ভুলেও গেছে একদিন
ঘর না পাওয়া চিঠি , নামহীন

তুমি তুলে নেবে। গুঁজে নেবে চুলে
একদিন এই খয়েরি মফস্বলের সমস্ত ভুলে
প্রলেপ দেবে তুঁতে সালোয়ার
সেদিন যদি দুনিয়ার ভিড় থেকে আলাদা করে আমার
চোখ পড়ে নিতে পারো

দেখবে
সন্ধে, তোমার চুলের মত গাঢ়

সমুদ্রের তীরে এক নাবিক বসে আছে
যে প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময়
একটা চিঠি বোতলে ভরে ভাসিয়ে দেয়…

অলংকরণঃ কল্লোল রায়

2 Comments

  • Chandrani Sengupta

    Reply July 2, 2021 |

    দারুণ লাগলো।

  • Teesta Chakraborty

    Reply July 3, 2021 |

    খুব খুব ভালো লাগলো কবিতাগুলি। অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...