চিঠির ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
সরোজ দরবার

মাঝেমধ্যে মনে হয় দুটো গ্রহ যেন আপন কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে খুব কাছাকাছি চলে আসে। বড়ো নির্জন তাদের প্রকৃতি। আত্মমগ্ন, নিভৃতচারী, স্বল্পভাষী। অথচ ভিতরে ভিতরে কত না কথার উৎসার। ভাবনার উৎসমুখ খুলে গেলে কথারা স্রোতস্বিনী। কিছু তার উক্ত, অধিকাংশই অনুক্ত। সেইসব কথা, জলের মতো একা একা ঘুরে ঘুরে বলে যাওয়া সেইসব কথারা কিছু কিছু তবু বাঁধা পড়ে যায় একটা নির্দিষ্ট আদলে। চিঠিদের জন্মসম্ভব হয় ফলে; আর তারই ভিতর দিয়ে যেন দেখা যায় তখন এঁদের আত্মজীবনীর অস্পষ্ট রহস্যময় খসড়াখানা। জীবনানন্দ দাশ ও ভিনসেন্ট ভ্যান গখ – কুয়াশালাঞ্ছিত দুই গ্রহের আত্মপরিচয়ের আলো হয়ে ওঠে তাঁদেরই রেখে যাওয়া কিছু চিঠি। সেই আলোতে দুই গ্রহকে দূরের তবু বড় কাছাকাছি মনে হয়; এই দুরূহ যোগাযোগের সেতু হয়ে থাকে তাঁদের চিঠি।
‘ভিনসেন্ট ছিল একেবারে মুখোচোরা।’ – বলছেন জঁ কলমা, তাঁর স্মৃতিচারণে, আমরা পাচ্ছি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর অনুবাদে – ‘এখনও আমার চোখে একটা ছবি ভেসে ওঠে। আমি তখন একটা দোকানে কাজ করতাম। প্রায়ই দেখতাম একমাথা লাল চুল নিয়ে সে দোকানের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ত। ভারি বিনীত, লাজুক ভঙ্গি।’ এ যেন সেই নির্জনতার অদ্বিতীয় সাক্ষর; অথচ আমরা তো জানি এই গ্রহেরই কেন্দ্রে অবিরাম রঙের বহ্ন্যুৎসব।
আর, জীবনানন্দ কেমন? তিনি যে স্বভাবত নিরিবিলি সে-কথা আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জানি। ভূমেন্দ্র গুহ প্রথম যখন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বাড়িতে দেখছেন তাঁকে, কোনও এক রবিবারের সকালের আড্ডায়, খেয়াল করছেন বদলে গিয়েছে আড্ডার চরিত্র, — ‘অন্য অনেকের মাঝখানে জীবনানন্দ আসীন আছেন একটা চেয়ারে, চুপচাপ, নিরিবিলি; জীবনানন্দের উপস্থিতির জন্য বা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক সভায় একটা নিথর গাম্ভীর্য তৈরি হয়েছে সেদিন; আর সঞ্জয়বাবু সোৎসাহে স্পর্শগ্রাহ্য উত্তেজনার মাথায় তাঁকে তাঁর নিজের কাব্যভাবনা বিশ্লেষণ করে শোনাচ্ছেন, কী ভাবে তাঁর কাব্যসিদ্ধি আন্তর্জাতিক সার্থকতার কাছ ঘেঁষে আছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, অপরিচিত নাতিপরিচিত বয়ঃকনিষ্ঠ জনসমাবেশে এইধরনের আলোচনা তাঁকে বিড়ম্বিত করছে যেন, কেননা সম্মুখভাষণের তুলনায় এইসব কথাবার্তা চিঠিপত্রে বা লিখিত আলোচনায় থাকাটাই বোধহয় অধিক তৃপ্তিকর।’
চিঠিপত্রেই তো মূলত সঞ্জয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিবিড় হয়েছে। যখন জীবনানন্দের কবিতাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু, প্রশ্ন তুলছেন জীবনানন্দের লেখার ধরন ও বদল নিয়ে, যা মোটেই মনঃপুত হচ্ছিল না বুদ্ধদেবের, তখন সঞ্জয় ধরতে পারছিলেন তাঁর কাব্যভাবনার বিবর্তন; সঞ্জয় বলবেন, এ হল জীবনানন্দের ‘প্রৌঢ় পরিণতি’। ‘নিরুক্ত’ কবিতাপত্রে প্রকাশিত সঞ্জয়ের এই স্বতন্ত্র মূল্যায়নই তখন সমস্ত সমালোচনার বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর একরকম অবলম্বন হয়ে উঠেছে জীবনানন্দের। এদিকে সঞ্জয় যে-কবিতা চাইছেন, কবিতার ভিতর যে মহাকাশ খুঁজছেন, তা পাচ্ছেন জীবনানন্দের কাছ থেকেই। এমনকি সঞ্জয় নিজের খরচায় জীবনানন্দের বই-ও প্রকাশ করেছেন, সেই বই— ‘মহাপৃথিবী’ পড়েই আশাহত হয়েছেন বুদ্ধদেব; এই পুরো পর্বে সঞ্জয়ের সঙ্গে জীবনানন্দের চোখের দেখাটুকু হয়ে ওঠেনি। কেউ কাউকে চিনতেন না চাক্ষুষ ভাবে। আলাপ এবং পরিচয়, সবটাই চিঠিতে। পরে যখন সঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন জীবনানন্দ, তখন তাঁকে দেখে খানিক অবাকই তাই হয়েছিলেন সঞ্জয়, তাঁর ভাবনার কবির সঙ্গে মানুষটির অবয়ব মেলেনি।
যদিও এই চোখের দেখা-র থেকেও বড় যে অন্তরে দেখা, সেটি অবশ্য ততদিনে সম্পূর্ণ হয়েছে। তাই, বাহ্যিক চেনা অতিক্রম করে ভিতরকার যে-চেনা, তা বরং এতদিনে আরও গাঢ় আর দৃঢ়। জীবনানন্দের এতখানি অবলম্বন হয়ে উঠেছেন সঞ্জয় যে, আর্থিক সমস্যার কথাও তিনি বলতে পারছেন তাঁকে। যে-দিনের বর্ণনা দিয়েছেন ভূমেন্দ্র, সেদিন জীবনানন্দ মূলত গিয়েছিলেন এরকম একটি চিঠির সুরাহা প্রত্যাশায়। আমাদের মনে পড়বে সেই বিখ্যাত চিঠির কথা, যার আঁচ দেন ভূমেন্দ্র, সঞ্জয়ের উদ্দেশে লিখেছিলেন জীবনানন্দ – ‘বেশি ঠেকে পড়েছি… এখুনি চার পাঁচশো টাকার দরকার; দয়া করে ব্যবস্থা করুন।’ ঋণশোধ তিনি করবেন লিখে-লিখে। এর আগেও সেই প্রক্রিয়া চলেছে। আবার নতুন করে প্রয়োজন যখন পড়েছে, তখন সেই সঞ্জয়েরই দ্বারস্থ তিনি এবং মুখ ফুটে বলতে পারেননি, জানিয়েছেন সেই চিঠিতে। আমরা অনুমান করতে পারি, জীবনানন্দের মতো অন্তর্মুখী একজন মানুষের কাছে এরকম দরবার করা কতটা কঠিন; আর সম্পর্ক কতখানি সহজ হলে তবে তিনি এই দাবি প্রতিষ্ঠার জায়গায় পৌঁছাতে পারেন, এমনকি নির্দ্বিধায় তাঁর লেখাও দিয়ে আসতে পারেন। একজন অন্তর্মুখী মানুষের নিজেকে নানাভাবে প্রকাশের দ্বিধাদ্বন্দ্ব সমস্তটাই কাটিয়ে দিয়েছিল চিঠির উন্মুক্ত তবু একান্ত পরিসর।
সঞ্জয় যে তাঁর কতখানি আস্থার জায়গা, তা সঞ্জয়কে লেখা চিঠির এই ক-টি লাইনেই স্পষ্ট হয়— ‘…আমার মনে হয় আমাদের দেশে আপনি একমাত্র খাঁটি ভাবুক ও সমালোচক যিনি ধূ.পা. থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত আমার সমস্ত কাব্যের দোষগুণ ঠিক ভাবে বুঝতে পারেন; আপনার হাতে কবিতাগুলো ছেড়ে দিয়ে আমি খুব আশ্বস্ত বোধ করি।’ এই আশ্বস্ত হওয়ার পৃথিবী তৈরি করে দিয়েছিল চিঠির আদানপ্রদানই। নইলে জীবনানন্দের মতো মানুষ নিজেকে, নিজের সমস্যাগুলোকে এমনকি অভিমান পর্যন্ত সঞ্জয়ের সামনে প্রকাশ করতে পারতেন কি-না সন্দেহ।
আমরা যদি এবার ভিনসেন্টের কাছে ফিরি, তখনও দেখব, মুখচোরা এই মানুষটি, যিনি নাকি পরে উন্মাদ বলেও অভিহিত হবেন, কত কথাই না বলে চলেছেন চিঠিতে। ভাই থিওকে, বা পল গঁগ্যা-কে। বলছেন রঙের কথা, ভাবনার কথা, অর্থের কথা, প্রণয়ের কথা। ছবির পরিকল্পনা শুরু করে বলছেন, – My eyes are still tired, but anyway I had a new idea in mind, and here’s the croquis of it. No. 30 canvas once again.
This time it’s simply my bedroom, but the colour has to do the job here, and through its being simplified by giving a grander style to things, to be suggestive here of rest or of sleep in general. In short, looking at the painting should rest the mind, or rather, the imagination.
চিঠি আর হাতে পাওয়া অর্থের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন – ‘Thanks much for your letter of the day before yesterday, and for the 50-franc note it contained.’ এমনই আরও কত-না কথা। এমনকি কখনও-সখনও সাংসারিক প্রয়োজনের কথাবার্তাও। আবার কখনও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রত্যুত্তর দিয়েছেন; আমাদের মনে হয় যত না তা কারও উদ্দেশে লেখা, তত আসলে তা তাঁর মনের নিকটতম কথাদের মুক্তি দেওয়া। ভিনসেন্ট থিওকে লিখেছিলেন,
‘In the springtime a bird in a cage knows very well that there’s something he’d be good for; he feels very clearly that there’s something to be done but he can’t do it; what it is he can’t clearly remember, and he has vague ideas and says to himself, “the others are building their nests and making their little ones and raising the brood,” and he bangs his head against the bars of his cage. And then the cage stays there and the bird is mad with suffering. “Look, there’s an idler,” says another passing bird — that fellow’s a sort of man of leisure. And yet the prisoner lives and doesn’t die; nothing of what’s going on within shows outside, he’s in good health, he’s rather cheerful in the sunshine. But then comes the season of migration. A bout of melancholy — but, say the children who look after him, he’s got everything that he needs in his cage, after all — but he looks at the sky outside, heavy with storm clouds, and within himself feels a rebellion against fate. I’m in a cage, I’m in a cage, and so I lack for nothing, you fools! Me, I have everything I need! Ah, for pity’s sake, freedom, to be a bird like other birds!
You may not always be able to say what it is that confines, that immures, that seems to bury, and yet you feel [the] bars…’
চিঠির পরতে পরতে এই যে এত কথা এসব হয়তো ভিনসেন্ট কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারতেন না। অসংখ্য চিঠি লিখেছেন ভিনসেন্ট, যেন নিরুপায় তিনি। না লিখে উপায় নেই। তাঁর আত্মচিন্তা, ভাবনায় বন্দি পাখিদের এভাবে মুক্তি দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনও উপায় জানা ছিল না তাঁর, সম্ভবত। ঠিক যেমনটা উপলব্ধি করি জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও।
এঁদের তুলনামূলক সাদৃশ্য টেনে লেখা শুরু করার কারণ এই নয় যে, এইটেই লেখার অভিমুখ; শুধু এটুকুই এখান থেকে আমরা বুঝে নিতে চাইছি যে, ভিনসেন্ট বা জীবনানন্দের মতো অন্তর্মুখী মেধাবীদের কাছে চিঠি আর কেবল যোগাযোগের খাতিরে লেখার জন্য লেখার বিষয় হয়ে থাকছে না, হয়ে উঠছে একরকমের নিজেকে সঙ্গোপনে উন্মোচিত করার পরিসর। চিঠিবন্দি অক্ষরের ভিতর তাই আমরা লক্ষ করি তাঁদের সত্তার ভিন্নতর উদ্ভাস। এবং ক্রমশ বুঝতে পারি, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁদের অন্তঃকরণের যোগাযোগের এইটেই একমাত্র উপায়। নইলে যে রহস্যময় আত্মজীবনীর আভাসটুকু আজ দেখা যায়, তা-ও হয়তো অনেকটা আড়ালেই থেকে যেত।
আমরা এ প্রসঙ্গে মনে করতে পারি, বহুসংখ্যক চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। খুব সহজ করে আমরা তা দুভাবে ভাগ করে নিতে পারি, খানিকটা আমাদেরই বোঝার সুবিধার্থে। একটি যোগাযোগ রক্ষার প্রয়োজনে। বহু মানুষকে তাঁর মতামত জানিয়েছেন, ভাবনার আদানপ্রদান হয়েছে সেখানে। সে-ও এক সংরক্ষিত পৃথিবী। আর-একরকমের চিঠি তিনি লিখছেন, ইন্দিরাদেবীকে, যার প্রকৃতি একেবারেই আলাদা। সেই চিঠির ভিতরের মানুষটি যেন অন্তরতর কেউ। তিনি নিজেই তো বলছেন, ‘…তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি। … তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোনো কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতর সত্য কথা সেগুলোকে কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা মনে করবি। সেই জন্য আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি।’
এই ক-টি পঙ্‌ক্তিতে চোখ রাখলে এ-ও স্পষ্ট হয়, চিঠি যোগাযোগের মাধ্যম যতই হোক না কেন, এই যে না-বুঝতে পারা বা ভুল বোঝার সম্ভাবনা সেখানেও থেকে যায়, যেমন সাধারণ ভাবে মানুষ মানুষকে ভুল বোঝে; সে কারণেই পত্রলেখকের খানিকটা বোঝাবার দায় থাকে। যেটুকু না-বোঝার সম্ভাবনা সেটুকুকে সরিয়ে রাখতে হয়। অর্থাৎ, অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে একটা দূরত্বে রেখে পত্রলেখকের ভূমিকায় বসে কলম খুলতে হয় প্রয়োজনের নিরিখে, সৌজন্যের কারণে। হাতেগোনা একটি কি দুটি ব্যক্তিগত পরিসরই থাকে, যেখানে এই দূরত্বের দায় নেই। যেখানে দূরত্ব ন্যূন করে ভিতরের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় পত্রপ্রাপকের। চিঠির সূত্রে যে-দূরত্ব অতিক্রম করে আশ্বস্ত বোধ করেন জীবনানন্দ ও ভিনসেন্ট-ও।
চিঠি তাই একরকম দূরত্বের অবসান।

২)
চিঠি আবার দূরত্ব নিশ্চিতও করে।
মূলত দূরত্বই চিঠির অনুঘটক। প্রাকৃতিক দূরত্বই তার একমাত্র স্বরূপ নয়। যেরকমভাবে আমরা আগের পর্বে দেখলাম, চিঠির ভিতর দিয়ে ব্যক্তির নৈকট্য গাঢ় হচ্ছে, তেমনই ঠিক বস্তুগত দূরত্বের ভিতর মানসিক দূরত্বের পরতখানি যে কতখানি পুরু, তারও হদিশ দেয় চিঠি। আমরা একটি চিঠির কিছুটা অংশ এইখানে পড়তে পারি —
গুণালঙ্কৃত শ্রীমতী দিনময়ী দেবী
কল্যাণনিলয়েষু
শুভাশীর্ব্বাদ পূর্ব্বকমাবেদনমিদম্‌

আমার সাংসারিক বাসনা পূর্ণ হইয়াছে, আর আমার সে বিষয়ে অনুমাত্র স্পৃহা নাই। বিশেষতঃ ইদানীং আমার মনের ও শরীরের যেরূপ অবস্থা…। এক্ষণে তোমার নিকট এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি এবং বিনয় বাক্যে প্রার্থনা করিতেছি যদি কখন কোন দোষ বা অসন্তোষের কার্য্য করিয়া থাকি, দয়া করিয়া আমাকে ক্ষমা করিবে।

তোমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যয় নির্ব্বাহের যে ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছি, বিবেচনা পূর্ব্বক চলিলে, তদ্বারা স্বচ্ছন্দরূপে যাবতীয় আবশ্যক বিষয় সম্পন্ন হইতে পারিবেক। পরিশেষে আমার সবিশেষ অনুরোধ এই, সকল বিষয়ে কিঞ্চিৎ ধৈর্য্য অবলম্বন করিয়া চলিবে, নতুবা স্বয়ং যথেষ্ট ক্লেশ পাইবে এবং অন্যেরও বিলক্ষণ ক্লেশদায়িনী হইবে। ইতি ১২ই অগ্রহায়ণ ১২৭৬ সাল।

শুভাকাঙ্ক্ষিণঃ
শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্মণঃ

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একদা সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন। উপরে উদ্ধৃত চিঠির অংশটি স্ত্রী দিনময়ী দেবীকে লেখা। দূরত্ব যে ঠিক কতখানি, তা আমাদের বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না। বাবা ও মা-কে যে পত্র দিয়েছিলেন, সেখানেও ক্ষোভ স্পষ্ট। বাবাকে লেখা চিঠির এক জায়গায় লিখছেন,
‘সাংসারিক বিষয়ে আমার মত হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি। কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি, সে বিষয়ে কোন অংশে কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। যে সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পায়, সে কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারে না। এই প্রাচীন কথা কোন ক্রমেই অযথা নহে, সংসারী লোক যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে, তাঁহাদের একজনেরও অন্তকরণে যে, আমার উপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নাই, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই।’
অর্থাৎ, প্রাকৃতিক দূরত্ব এখানে মনের দূরত্বের প্রতিনিধি মাত্র। অবহেলাজাত অভিমান এ চিঠিকে ভারি করে রেখেছে। দূরত্বের সেই ভার অতিক্রম করা সহজ নয়।
একই সময় বাড়ির অন্যান্য পরিজনদেরও তিনি চিঠি লিখেছিলেন, একই মনোভাবের কথা জানিয়ে। সেখানে অভিমান যেমন খাঁটি, তেমনই নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকার বিষয়টিও স্পষ্টভাবে লক্ষ্যণীয়। প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত খরচ বা যাঁর প্রতি তাঁর যা কর্তব্য তা তিনি পালন করবেন বলে জানিয়েছেন। বাড়ির পরিচারক গদাধর পালকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন, — ‘সাধারণের হিতার্থে গ্রামে যে বিদ্যালয় ও চিকিৎসালয় স্থাপিত আছে এবং গ্রামস্থ নিরুপায় লোকদিগের মাস মাস যে কিছু কিছু আনুকূল্য করিয়া থাকি, আমার শক্তি থাকিতে ওই সকল বিষয় রহিত হইবে না।’
এইখানে এসে দূরত্বের মাত্রা বদলে যায়। ব্যক্তিপরিসরে যে-দূরত্ব ঘনিয়ে উঠেছে বলে তিনি আর বীরসিংহ ফিরবেন না ঠিক করেছেন, সামাজিক পরিসরের ছবিটা তার থেকে সম্ভবত অন্যরকম। বা, তিনি নিজে দুটোকে এক করে দেখছেন না। তাই দূরত্বের ভিতরও এমন একটা পরিসর রচনা হচ্ছে, যা সামাজিক মানুষটাকে তাঁর নির্মিত ছায়া থেকে তেমন দূরত্বে রাখছে না। পরিবারের কাছে বিদ্যাসাগর দূর হয়ে গেলেও, অন্তত তাঁর সেরকম মনে হলেও, অনেকের কাছে যেমন তিনি যেমন কাছের মানুষ ছিলেন, তেমনই থাকলেন।
চিঠির ভিতর এমন পরিসরের নির্মাণ হওয়া সম্ভব। যেখানে ব্যবধান সত্ত্বেও একরকমের ব্যবধানহীনতার জন্ম হয়। আমরা এই প্রেক্ষিতে আর-এক পত্রালাপ পর্বে এগোই। এক তরুণ কবি তাঁর কবিতার বই পাঠিয়ে পড়ে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু তাতে ব্যাপক কোনও উচ্ছ্বাসের চিহ্ন নেই। সাদামাটা সে-চিঠি এইরকম —
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আমার কবিতার বই-এর এক কপি আপনাকে পাঠিয়েছি। আপনার কেমন লেগেছে জানতে পারলে বাধিত হব। আশা করি আপনার শরীর ভালো আছে। আমার নমস্কার জানবেন।
ইতি
বিনীত
সমর সেন

পারিবারিক সূত্রেই সমরবাবুদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সঙ্গেও তাঁর আবাল্য পরিচয়। কিন্তু এই চিঠির সূত্রে এমন একটা যোগাযোগ তৈরি হল, যা ক্রমে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আমাদের সামনে ধরা দেবে। এ আমাদের জানা কথাই যে, সমর সেনের কবিতা যে-পথে এগিয়েছে, তা রবীন্দ্রনাথের পথ নয়। এইখানে একটা সূক্ষ্ম ব্যবধান রচিত হল। কাব্যভাবনার ব্যবধান। তা সত্ত্বেও যখন শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবির সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখন অভিভূত হয়েছেন সমরবাবু। ফিরে এসে কবিকে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, — ‘শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় ফিরে অশান্তিতে সময় কাটছে। ওখানকার কাঁকরের রক্তলাল সৌন্দর্য্য আপনার শান্তমূর্ত্তি এবং ললিত মধুর ব্যঙ্গ বারবার মনে থাকবে।’ চিঠির শেষে পুনর্বার সাক্ষাৎ লাভের প্রত্যাশা করেছেন তিনি। উত্তরে বরং রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন তাতে অবশ্য কিঞ্চিৎ ‘খোঁচা’-ই তোলা ছিল সমর সেনের জন্য। কবিতায় ‘হাল্‌কা’ বিশেষণের ব্যবহার এবং গদ্যকবিতার প্রসঙ্গ তুলে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কাব্যচিন্তার ব্যবধানটুকুকেই যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি তাঁরা অর্থাৎ সমর সেনের মতো তরুণ কবিরা যে তাঁকে ‘দুর্দ্ধর্ষ দুর্জ্জন’ কল্পনা করেছিলেন, এমনটাও ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ, লিখেছেন সে-কথা চিঠিতে। বলতে গেলে সমর সেনের অভিভূতির উলটোদিকেই থিতু রবীন্দ্রনাথ।
ঠিক এইখানেই আমরা মনে করে নিতে পারি একটি তথ্য। রবীন্দ্রনাথ যে ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ সম্পাদনা করছেন এই সময়টায়, সেখানে মোট তিনজন কবির কবিতা সংকলন থেকে বাদ পড়ছে। তাঁরা হলেন বিষ্ণু দে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র এবং অবশ্যই সমর সেন। সমরবাবুরা পরে মনে করেছেন, এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে সজনীকান্তের প্রভাব ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কথা তো অনস্বীকার্য যে সবার উপরে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-ই।
যাই হোক, পূর্বোক্ত চিঠির জবাবে সমর সেন যা লিখেছিলেন সেখানে অবশ্য ব্যবধানের লেশমাত্র নেই; বরং রবি ঠাকুর সম্পর্কে তাঁর কিছু ভুল ধারণা ছিল, তা যে ভেঙেছে সে-কথা জানিয়ে লেখেন – “‘যার তার’ সঙ্গে হাসিতামাশা করলেও আসলে আপনি একান্তই সুদূর। এবং সুদূর তারকার জন্য আমাদের মতো পতঙ্গের তৃষা মাঝে মাঝে হলে আশা করি নিশ্চয়ই মাপ করবেন।” তা ছাড়া তিনি যে তাঁর কবিতায় ‘হাল্‌কা’ ব্যবহার করেন না, সে-কথাটিও জানিয়েছিলেন চিঠিতে।
সমর সেনের এই চিঠিটি আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা এর ভিতর দিয়ে একরকমের প্রীতিময় আলোর খোঁজ পাই আমরা। এরপরও তিনি রবি ঠাকুরকে চিঠি লিখেছেন, নিজের দ্বিতীয় বই পাঠিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতামত জানানোর সঙ্গে স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সমরবাবুর কবিতার রসাস্বাদন করতে পারেন যাঁরা, তাঁদের দলে তিনি নেই। অর্থাৎ, কবিতার যাত্রাপথ পৃথকই থেকেছে। রবীন্দ্রনাথের আগের চিঠিতে মৃদু খোঁচা বা শ্লেষ ছিল, তা-ও সত্যি। তবু যে মানুষটি একটি জাতির কবিতার ভাষা নির্মাণ করে দিয়েছেন আপন কলমের জোরে, নিজেকে ভেঙেছেন ক্রমাগত, কবিতাভুবনে ক্লান্তিহীন যাঁর শ্রম, — সেই মানুষটির প্রতি যে সম্ভ্রম বজায় রাখার কথা তা বরাবরই ধরে রেখেছেন সমর সেন। একে আমরা ব্যবধান সত্ত্বেও এক ব্যবধানহীন পরিসর হিসেবেই দেখব। শ্রদ্ধা, সম্ভ্রমের এই যে পৃথিবীখানা, এইরকম চিঠির ভিতর দিয়েই আমরা প্রায়শই ছুঁয়ে দেখতে পারি সেই বিরল ভুবনখানি।
৩)
ভুবনখানি কত যে ছোটো হয়ে আসে চিঠির ভিতর দিয়ে, তার অন্য একটা রূপও চোখে পড়ে। সে অনেকদিন আগের কথা। আগের কলকাতা। সেখানে পার্শিবাগান লেনের চোদ্দ নম্বর বাড়িটাকে আমরা আলাদা গুরুত্ব দিয়ে কালির দাগ দেব। কেন-না সেখানে আসে এক সাহেবের চিঠি, নাম তাঁর সিগমন্ড ফ্রয়েড। আজ এই নাম উচ্চারিত হলে যে সম্ভ্রম ও বিপুলায়তন আলোচনা সেই অনুষঙ্গে জড়ো হয়, তখন সে-পরিস্থিতির ততখানি জন্ম হয়নি। ফ্রয়েড তাঁর কাজ করে চলেছেন পূর্ণ উদ্যমে। আর সেই সময়টায়, তাঁর ভাবনা ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য পেয়েছিলেন এক দূরের বন্ধুকে। তিনিই থাকেন পার্শিবাগানে, নাম গিরীন্দ্রশেখর বসু। দুই দূরের মানুষ আক্ষরিক অর্থেই হলেন মনের মানুষ, আর তাঁদের চিঠিতেও থাকল মন; তাই নিয়ে মেলা কথা, যুক্তি ও প্রতিযুক্তি। গিরীন্দ্রশেখর চিঠিতে লিখছেন ফ্রয়েডকে, ‘You will be glad to learn that we have been able to start a psychoanalytical society in Calcutta. I am sending you the herewith the proceedings of the inaugural meeting and I shall be very glad to have your suggestions regarding our society.’ আবার অন্য একটা চিঠিতে ফ্রয়েড গিরীন্দ্রশেখরকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখছেন, ‘Thank you for your explanations. I am fully impressed by the difference in castration reaction between Indian and European Patients and promise to keep my attention fixed on the problem of the opposite wish which you accentuate.’
এইরকম বেশ কিছু চিঠি পাওয়া যায় যেগুলো পড়তে পড়তে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, চিঠি যে দূরত্বকে মুছে দেয় শুধু তাই-ই নয়, দূরকে নিকট বন্ধু করে সত্যিকার নিকটের সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দেয়। যেখানে মিলন সম্ভব, সেখানেই ঘটকালী করে পত্রদূত।
চিঠির ভিতর দিয়ে এই যে ভুবনখানি দেখার চেষ্টা করছি, সে তো আসলে মনেরই দুনিয়া। দিনপঞ্জির মতোই চিঠিও মনের নিকটবর্তী লেখা। তাই তার কাছে এসে রং বদলে যায় ভুবনের। ধরা যাক, সম্ভ্রান্ত কবি, রবীন্দ্রগবেষকের সঙ্গে আর-এক বিদ্বান মানুষের কথা হচ্ছে, চিঠিতেই। স্বাভাবিক অনুমানে আমরা তার গাম্ভীর্য মেপে নিতে পারি মনে মনে। এইবার পড়ে ফেলা যাক একখানা চিঠির একটুখানি,
‘আজ সন্ধেবেলায় বাংলো রোডের কফি হাউসের ধারে গয়ার হলের ডাক্তার মুখার্জীর সঙ্গে দেখা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘শঙ্খবাবু কী চলে গেছেন’। আমি বললুম কে, আমি তো জানি না। আবার প্রশ্ন, জানেন না, আপনাদের department এসেছিলেন, কবি, চমৎকার লোক কিন্তু। আমি বললাম, কিন্তু আমি তো জানি না কিছু, কবে এসেছিলেন। ভদ্রলোক ক্ষেপে উঠলেন, যতীন যে বলল, তাহলে ব্যাপারটা কি সত্যি নয়! আমি বললাম, যতীন বোধহয় আপনাকে ক্ষ্যাপাবার জন্য বলেছে।
ভদ্রলোক আর কথা না বলে কফি হাউসে ঢুকে পড়লেন। যতীনের কপালে আজ রাত্রে দুঃখ আছে। আর সকালেই হয়ত যতীন আমাকে এসে মারধোর করবে। কেন যে আমি এরকম করলাম!’
কেন যে এমনটা করেছিলেন শিশিরকুমার দাশ, তা তিনিই জানেন। শঙ্খবাবুকে লেখা এই চিঠির আগের ঘটনাটুকু এই যে, দিল্লিতে মাস দুই থাকাকালীন শিশিরবাবুর সান্নিধ্যেই কেটেছিল তাঁর; বুদ্ধদেব বসুর মৃত্য সংবাদ পেয়ে তিনি কলকাতায় ফেরেন। তাতেই বেশ ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল শিশিরবাবুর। হয়তো সেই হেতুই এইসব কর্মকাণ্ড। তবু পুরনো চিঠির ঝাঁপি খুলে শিশিরকুমারের যে ক-টি চিঠি প্রকাশ করেছেন শঙ্খবাবু, সেখানে দেখা যায় দুই বিদ্বান ভাবুক মানুষের এ যেন এক অন্য পৃথিবী। শঙ্খবাবুকে আর ক-জনই বা এমন কথা লিখতে পারেন— ‘লোকমুখে শুনি আপনার বয়স বাড়ছে, এদিকে আমি দেখছি আপনার বয়স কমছে। কোথায় বিজ্ঞাপন দেখলাম শঙ্খ ঘোষের গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ। লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে উঠল। একজন মহিলাকে বললাম, তিনি ধমক দিয়ে বলেলেন, তবে কি তোমার মতো রাক্ষস বিবাহ কবিতাগুচ্ছ লিখবেন। যাই হোক ও দোষ তো স্বয়ং গুরুদেবেরও ছিল, আপনারটা overlook করলাম।’
রসিকতায় নির্মল এই চিঠিগুচ্ছ আমাদের সুলুক বাতলায় সেই মনের পৃথিবীটার যা একান্তই মোড়া থাকে চিঠির গোপনে।
৪)
এই যে আমরা কয়েকখানা চিঠি নেড়েচেড়ে দেখলাম, এ তো খুব অঙ্ক কষে ভীষণরকম কোনও উদ্দেশ্যপূরণের খাতিরে নয়। এমনভাবে বরং নাড়াচাড়া হল যে, বিদ্যায়তনিক পরিসরেও তার ছিঁটেফোটা গুরুত্ব নেই। তবু কয়েকটি চিঠির সূত্রে আমরা হয়তো একটুক্ষণ ছুঁয়ে থাকলাম মনের পৃথিবী। সামাজিক পরিসরে তার ছায়া পড়ে না। যোগাযোগের মাটি থেকে চার আঙুল উঁচুতেই থাকে সে-পৃথিবীর আবর্তনরেখা। মনের ভিতর দিয়ে তথাপি একটা অন্যরকম যোগাযোগের পৃথিবীকে আমরা বহন তো করে চলি। অনর্গল কথায় তা ধরা পড়ে না। শিল্পিত প্রকাশমাধ্যমের নানা শর্তে তা কখনও জটিল, বহুমাত্রিক কিংবা অনুক্ত হয়েই থেকে যায়। একমাত্র সরোবর সেখানে চিঠি। মনের অর্গল খুলে যায় যেখানে। আর জলের মত ঘুরে ঘুরে সহজ কথারা বলে যায় আমাদের অন্য পৃথিবীর আখ্যান। এটুকুই আমাদের চিঠি ঘাঁটার প্রাপ্তি। চিঠির ভিতর দিয়ে যে ভুবনখানির দেখা মেলে, সে বড়ো সত্যি এক পৃথিবী। রবি ঠাকুর যাকে বলেন ‘গভীরতর সত্য’। তাই গোপনীয়তার ডানা তাকে ঘিরে থাকে, টিঁকে থাকার ওম্‌ দেয়।
সখেদে বলা যায়, ওই কাঙ্ক্ষিত গোপনীয়তাটুকু আজ ছত্রখান হয়ে গিয়েছে। কিংবা বিকিয়ে গিয়েছে যোগাযোগের পাঁচমাথায় বা নেহাতই কোনও এক বহুমুখী সুড়ঙ্গে। আজ সংযোগ তাই সহজলভ্য প্রত্যাশিতভাবেই। শুধু প্রকাশের আলো এসে তার ভিতর থেকে কেড়ে নিয়েছে মনের নিরবিলিটুকু। কোন্‌ কথা কার কাছে কীভাবে প্রকাশ পেয়ে মুক্তি পাবে— অবিরাম সেই ভাবনার ভার ভেঙে দিয়েছে দুই মানুষের একান্ত পৃথিবীর ভরসা, নির্ভরতা আর বিশ্বাসটুকুকে। গভীরতর সত্যির সেই পৃথিবী থেকে দূরে আমাদের সিন্থেটিক মন-হালকা করার ফক্কিকারি তাই ক্রমে কৌতুকে পর্যবসিত হচ্ছে, হয়েই চলেছে।
এইসব চিঠির ঝাঁপি খুলে আজ তাই মনে হয়, হয়তো সময়ই লাগত তাদের যাতায়াতে, তবু তাদের ভিতর দিয়ে রচিত যে-পৃথিবী, তাতে মায়া খানিক বেশিই ছিল। সেই মায়া ছুঁয়ে থাকতে সাধ হয় বলেই এই পুরনো চিঠির গায়ে হাত বোলানো।
~
সরোজ দরবার

সহায়ক বই ও অন্যান্য সূত্র –

১। ছিন্নপত্রাবলী , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২। জীবনানন্দ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং, ভূমেন্দ্র গুহ
৩। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ – স্মৃতির ক্যানভাসে (সংকলন ও সম্পাদনা – অনির্বাণ রায়)
৪। বিদ্যাসাগর রচনাবলী ১ ( দে’জ )
৫। অনুষ্টুপ – সমর সেন শতবর্ষ বিশেষ সংখ্যা
৬। পুরনো চিঠির ঝাঁপি, শঙ্খ ঘোষ
৭। স্বপ্ন, গিরীন্দ্রশেখর বসু ( সম্পাদনা – পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়)
৮। সমর সেনের কবিতা, ইরাবান বসুরায়
৯। http://www.vangoghletters.org/
১০। https://www.brainpickings.org/

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...