কবিতায় চিঠি…
অর্ঘ্য দত্ত

“দুপুরবেলা। আমি বসে বসে তোমাকে চিঠি লিখছি এখন। কাল দুপুরে ভেবেছিলাম, চিঠিটা লিখে ফেলবো। কিছুই লেখা হয়নি। খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। ‘জলক্রীড়া’ শব্দটা তারপর সারাদিন ঘুরঘুর করছিলো আমার মাথায়। আর আমি ঘুমিয়ে পড়তেই স্বপ্নে দেখেছিলাম হঠাৎ–কাঁদছি খুব।” ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘প্রিয় সুব্রত’ যখন পড়ি তখন বোধহয় সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমার কাছে তখনও চিঠি মানে নববর্ষ-বিজয়ার খাম-পোস্টকার্ড এবং অবশ্যই গোপন-রোমাঞ্চকর সব প্রেমপত্র। ভাস্কর চক্রবর্তীর এই লেখাতেই বোধহয় ‘চিঠি’ শব্দটা আমার কাছে প্রথম তার আভিধানিক অর্থ অতিক্রম করে ধরা দিয়েছিল! বন্ধু, যার সঙ্গে রোজ অথবা মাঝে মাঝেই দেখা হচ্ছে, তাকে চিঠিতে লেখার মতো এত কথাও মানুষের ভেতরে জমা হয়? জমা থাকতে পারে? তাও আবার এত দীর্ঘ এবং এমন ভাষায়! মনে আছে এ লেখা পড়ার পর একদিন আমিও সারা দুপুর বসে একটা রুলটানা গোটা বঙ্গলক্ষী খাতা ভরে চিঠি লিখেছিলাম আমার প্রিয় বন্ধু ডালুকে। ও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। এই সেদিন, সেই ঘটনার প্রায় চল্লিশ বছর বাদে, জানতে চেয়েছিলাম চিঠিটা ওর কাছে এখনও আছে কিনা! হাসলো। বললো, না রে, ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। এমন ভাবে বললো যেন সেই চিঠি ছিল রেজাল্ট বেরিয়ে যাওয়া লটারির টিকিট। আমিও ঠা-ঠা করে হেসে উঠেছিলাম, স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি জোরে, যেন ভারি মজার কথা শুনলাম!

তবে বললাম বটে, ‘প্রিয় সুব্রত’ পড়ার আগে চিঠি বলতে শুধুই নববর্ষ-বিজয়ার রীতিনিষ্ঠ পোস্টকার্ড এবং প্রেমপত্র বুঝতাম, তা বোধহয় সম্পূর্ণ সত্য নয়। তারও অনেক বছর আগে কোনো এক মনকেমনকরা সকালে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষচিঠি’ কবিতায় এক-পংক্তির একটা চিঠির কথা পড়ে বুকের মধ্যে কে যেন ছড় টেনেছিল শুদ্ধ টোড়িতে।
“…থাক সে সব কথা।
অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি,
তাতে লেখা–
‘তোমাকে দেখতে বড্ডো ইচ্ছে করছে।’
আর কিছুই নেই।”
সেই কিশোর বয়সেই বুঝেছিলাম চিঠি শুধু কেজো কথার বয়ান নয়, তার চেয়ে ঢের বেশি কিছু। অন্য কিছু।
এই অন্য কিছুটা ঠিক কী? একটু বড় হয়ে যেন আভাসে তার উত্তর পেলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এই পংক্তিতে: “… ও মন, নতুন দেশে যাবি? চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো।” সেকি তবে কোনো নতুন দেশের উদ্দেশে মনের উড়াল! সে কি এক অলীক জগতের চাবিকাঠি! ‘চিঠি’ শব্দটার গায়ে যেন আঁকা আছে মানুষের অনির্বচনীয় আবেগ ও অনুভূতির এক অলৌকিক রামধনু। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে নজরে আসে যুগ-যুগ ধরে নানান কবির কবিতায় কী বিচিত্র ব্যঞ্জনায় ব্যবহৃত হয়েছে এই একটি শব্দ– ‘চিঠি’!
“সব কথা তোমাকে জানাবো ভেবেছিলাম
কিনে এনেছিলাম আকাশী রঙের বিলিতি হাওয়াই চিঠি
সে চিঠির অক্ষরে অক্ষরে লেখা যেত
কেন তোমাকে এখনো চিঠি লেখার কথা ভাবি
লেখা যেত
আমাদের উঠোনে কামিনী ফুলগাছে
এবার বর্ষায় ফুলের ছড়াছড়ি
তুমি আরেকটু কাছে থাকলেই
বৃষ্টিভেজা বাতাসে সে সৌরভ তোমার কাছে পৌঁছতো
আর তোমার উপহার দেওয়া সেই স্বচ্ছন্দ বেড়ালছানা
এখন এক মাথামোটা অতিকায় হুলো
সারা রাত তার হুঙ্কারে পাড়ার লোকেরা অস্থির।
……………………..

এদিকে এর মধ্যে আবার নির্বাচন এসে গেল,
অথচ কে যে কোন দলে, কার পক্ষে তা আজও জানা গেলনা।
কিন্তু এসব তোমাকে কেন জানাবো?
এসব খবরে তোমার এখন কোনো প্রয়োজন নেই।
অথচ এর থেকেও কি যেন তোমাকে জানানোর ছিল,
কিছু একটা আছে, কিন্তু সেটা যে ঠিক কি
পরিষ্কার করে আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা।
টেবিলের একপাশে কাঁচের কাগজচাপার নীচে
ধুলোয়, বাতাসে বিবর্ণ হয়ে আসছে হাওয়াই চিঠি।
তার গায়ে ডাকের ছাপের চেয়ে একটু বড়,
অসতর্ক চায়ের পেয়ালার গোল ছাপ,
পাখার হাওয়ায় সারাদিন, সারারাত ফড় ফড় করে ডানা ঝাপটায়
সেই ঠিকানাবিহীন রঙিন ফাঁকা চিঠি।
অথচ তোমার কাছে
তার উড়ে যাওয়ার কথা ছিল।”
তারাপদ রায়ের কবিতায় এই সহজ স্বীকারোক্তি: “অথচ এর থেকেও কি যেন তোমাকে জানানোর ছিল, / কিছু একটা আছে, কিন্তু সেটা যে ঠিক কি / পরিষ্কার করে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না”, আমাদের বুঝিয়ে দেয় চিঠি শুধুমাত্র খবরের আধার নয় বরং একটি চিঠি বিশেষ হয়ে ওঠে তার খবরহীনতাতেই। সে রবিঠাকুর যতই ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার উদ্দেশে লিখুন না কেন,
“চিঠি লিখব কথা ছিল
দেখছি সেটা ভারি শক্ত
তেমন যদি খবর থাকে
লিখতে পারি তক্ত তক্ত।”… তিনি নিজেই বোধহয় সারাজীবন ধরে তক্ত তক্ত বিনাখবরের চিঠি লিখে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে মনে এল শান্তিনিকেতন। আর শান্তিনিকেতনের কথায় নরেশ গুহের কবিতা ‘শান্তিনিকেতনের ছুটি’:
“দূরে এসে ভয়ে ভয়ে থাকি: সে হয়তো এসে বসে আছে।
হয়তো পায়নি ডেকে, একা ঘরে জানালার কাঁচে
বৃষ্টির বর্ণনা শুনে ভু্লে গেছে এটা কোন সাল
ভুলে গেছে জীবনের দরিদ্র ধীবর আর জাল
জোড়া দিতে পারবে না। …
…………………………..
যদি তার এতকাল পরে মনে হয়
–দেরি হোক, যায়নি সময়?
শান্তিনিকেতনে বৃষ্টি: ছুটি শেষ। ভিজে আলতা-লাল
শূন্য পথ। ডাকঘরে বিমুখ কাউন্টর চুপ, কাল
হয়তো রোদ্দুর হবে শুকোবে খোয়াই ভিজে ঘাস।
লোহার গরাদ ঘেরা আম্রকুঞ্জে কবিতায় ক্লাশ
কাল থেকে বের। ঘুমে ফোলা চোখ, ভাঙা ভাঙা গলা,
কবে সে মন্থর পায়ে, পাতা-ঝরা ছাতিমতলায়
একা এসে ঘুরে গেছে? ঘন্টা গুনে হঠাৎ কখন
অকারণে দিন গেলো। ছায়াচ্ছন্ন শান্তিনিকেতন,
কলকাতায় ফিরে যদি– যদি আজ বিকেলের ডাকে
তার কোনো চিঠি পাই? যদি সে নিজেই এসে থাকে?”
—- এ কবিতা উচ্চারণ করে পড়ুন, দেখবেন ‘চিঠি’ শব্দটা কেমন নিজের কানেই মালকোষের মিড়ে বেজে উঠবে। কী বিষণ্ণ উদ্বেগ, কী কোমল প্রত্যাশা একটা অনাগত চিঠির জন্য! চিঠির অপেক্ষায় থাকাটাই যেন আমাদের নিয়তি! কী আশা করি আমরা চিঠিতে?
“সুখ নেই দুঃখও করি না।
মধ্যে মধ্যে চিঠি দিও
যে কোন পরগণায় থাকো, যাকে ইচ্ছে খাজনা টাজনা দাও
শুধু মনে করে প্রীতি, কুশল জানিয়ো।
…………………………
তোমার পাখির জন্যে বাগান থেকে ফুলগাছ সরিয়ে
আজ কিছুদিন হলো কাবুলি ছোলার চাষ করি।
গতকাল থেকে শীষ দেখা যাচ্ছে,
এ ছাড়া কী নিয়ে
সময় কাটাই বলো?
বড় ঈর্ষা হয়,
তোমার সময়
কি করে যে এত ভালো কেটে যাচ্ছে! এতখানি ভালো
সময় যায় না কারো।
তুমি বেশ আছো, তবু কুশল জানিয়ো,
যখন যেমন থাকো মধ্যে মধ্যে চিঠি-পত্র দিয়ো।”
তারাপদ রায়ের ‘চিঠিপত্র’ কবিতায় আবার দেখতে পাই অন্য আর কিছু নয় শুধু একটু কুশল সংবাদের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
জয় গোস্বামীর ‘ঝাউপাতাকে রুগ্ন কবির চিঠি’-তেও দেখি,
“…ঝাউগাছের পাতা, আমি আসতে যেতে কুশল নিয়ে যাই
ঝাউগাছের পাতা, আমার কথায় কিছু মনে করলে না তো?”

এই কুশল নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা কত বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে তারই যেন নজির পাই হুমায়ূন আহমেদের কবিতা ‘বাবার চিঠি’-তে:
“আমি যাচ্ছি নখালপাড়ায়
আমার বৃদ্ধ পিতা আমাকে পাঠাচ্ছেন তাঁর
প্রথম প্রেমিকার কাছে।
আমার প্যান্টের পকেটে সাদা খামে মোড়া বাবার লেখা দীর্ঘ পত্র।
খুব যত্নে খামের উপর তিনি তাঁর প্রণয়িনীর নাম লিখেছেন।”
বৃদ্ধ প্রেমিক আত্মজকে পাঠাচ্ছেন তার প্রথম প্রেমিকার কাছে শুধু তার কুশল সংবাদের আশায়। খামের পরে তিনি প্রাক্তন প্রণয়িনীর নাম লিখছেন অতি যত্নে, কারণ ঐ খামের মধ্যে তিনি আসলে চিঠি নয়, পাঠাচ্ছেন তাঁর এক টুকরো হৃদয়। কিছু চিঠি লেখা হয় অক্ষরে নয়, হৃদয়ের স্পন্দনে। আর তাই, সে চিঠির জন্য প্রাপকেরও থাকে পুলকিত আর্তি।

“করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানের লিখ প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি “
— যদিও এখানে কবি মহাদেব সাহা অক্ষরের পাড়-বোনা যে চিঠির দাবির কথা লিখেছেন, আমরা বুঝতেই পারি, তা নিছক কুশল-সংবাদ কামনায় নয়। চিঠি চাই… কোন কারণ ছাড়া, কোন সংবাদ ছাড়াই আমাদের এই চিঠি-কাতরতা।

অগ্নি বসুর কবিতা ‘চিঠি নেই, কতো দিন’:
“কাল সারারাত কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি!
শেষ রাতে, ঝাপসা মেঘের গায়ে ভাঙা শাঁখার মতো এক টুকরো চাঁদ,
আর ঘরের কোণে ঝিঁঝিঁদের অবিরল ঝুমঝুম
তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল।
কেউ না ডাকতেই উঠে এসে দাঁড়ালে জানালায়।
গরাদের গায়ে তোমার কাঁকনের জলতরঙ্গ বাজল।
………………………..
ভারী চোখের পাতায় কাঁপন তুলে ভাবলে, চিঠি নেই,
কতোদিন চিঠি নেই…”
চিঠির তৃষ্ণা আমাদের এই নাগরিক মরু-জীবনে এক ধূসর শূন্যতার পারে এনে দাঁড় করায়। সে কি ইচ্ছাকৃত! অপর পার ক্রমে যেন সরে যেতে থাকে দূরে, এক চিঠি থেকে অন্য চিঠি হয়ে পড়ে ক্রমশঃ দূরবর্তী।

“আমরা ক্রমশই একে অপরের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি
আমরা ক্রমশই চিঠি পাবার লোভে সরে যাচ্ছি দূরে
আমরা ক্রমশই দূর থেকে চিঠি পাচ্ছি অনেক…”
তাঁর ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’-এ শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন,
“কতোকালের পুরোনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে…”, আর এই ‘পুরোনো নতুন চিঠি’ শব্দবন্ধ আমাকে স্তব্ধ করে রাখে। কী থাকে পুরোনো নতুন চিঠিতে, যার জন্য আমরা বারবার ফিরে যাই তার কাছে! খুঁটে নিই প্রতিটি প্রাচীন অক্ষরের সূক্ষ্ম আঁশ!

এই সূত্রেই মনে পড়ে যায় অংশুমান করের লেখা একটি কবিতা :
“…………………
‘ফুটেছে অশোক? এখানে তো বসন্ত এসেছে।’
বাইরে বৃষ্টি।
ফাঁকা ঘরে বসে পড়ছি
বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া
পনেরো বছর আগেকার চিঠি…”
কী থাকে এই সব পুরোনো নতুন চিঠিতে? প্রেম-অপ্রেম-ঈর্ষা-বাসনা-অভিমান-দহণ! ‘স্ত্রীর পত্র’ কবিতায় সুতপা সেনগুপ্ত লেখেন:
“পুরোনো ট্রাংকটি আমি ছুঁইতেও ভয় পাই,
তোমার প্রথম প্রেমচুম্বনের ছবি ওখানে রেখেছ,
আর রাখিয়াছ চিঠি

ট্রাংকের প্রতি তোমার আদর দেখে মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করে
পুনর্বার জন্মাইতে ইচ্ছা করে কীটনাশক রূপে”,
যখন আলাদা করে লেখা হয় ‘আর রাখিয়াছ চিঠি’, স্বামীর প্রথম প্রেমিকার প্রতি স্ত্রীর ঈর্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে তার চিঠিতে।

আজকের কবি সোনালী মিত্রের কবিতা ‘শুধুমাত্র প্রবাসী’-তে তিনটি শব্দের এক ক্ষুদ্র চিঠি, ‘বেশ ভালো আছি’, অপরূপ তীব্রতায় প্রকাশ করে স্ত্রীর অভিমান:
“চলে আসার পরে প্রথম চিঠিতে লিখেছিলে–
‘একা থাকতে বড্ড কষ্ট হয়, ফিরে এস তুমি’
দ্বিতীয় চিঠিতে বেশকিছু দীর্ঘশ্বাস পাঠিয়েছিলে যত্ন করে
পরের ষোলোটি চিঠিতে কোনো শব্দ ছিল না, না বর্ণমালা
ভাঙার ব্যর্থ প্রয়াস। শুধু কান্নার শুকনো দাগ লেগে থাকত
গোলাপী কাগজের অভ্যাসে।
…………………….
দু’বছর বাদে চিঠি লিখলাম–আমি ফিরছি তাড়াতাড়ি
তুমি জানালে একটিমাত্র বাক্য– ‘বেশ ভালো আছি’….”
শব্দহীন, বর্ণমালাহীন ষোলোটা চিঠি লেখা হয় নিরুত্তর প্রাপকের উদ্দেশে। তবু চিঠি লিখতেই হয়। চিঠি পেতেও হয়। চিঠির জন্য যেন আমাদের এক অনন্ত তৃষ্ণা, অনিঃশেষ ক্ষুধা। কিন্তু যখন আমাদের জানা থাকে না প্রাপকের নাম ও ঠিকানা? মৃতবৎসার স্তনের মতো যখন আমাদের মন নুয়ে থাকে চিঠি লেখার অভীপ্সায় অথচ যাকে লিখব সে থাকে অচিনপুরে? তখন আমাদের মন ভালো থাকে না! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় পাই:
“একলা ঘরে শুয়ে থাকলে কারুর মুখ মনে পড়ে না
মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না
চিঠি লিখব কোথায়, কোন মুণ্ডহীন নারীর কাছে!”

— সুনীলের কাছে একলা ঘরে সমস্ত নারী-মুখ হঠাৎ অপরিচয়ের কুয়াশায় মুণ্ডহীন মনে হলেও, হাংরি কবি মলয় রায়চৌধুরী যৌবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে কবিতায় নির্দিষ্ট কোনো নারীর উদ্দেশে পাঠিয়ে দেন এক পৃথুল পত্র:
“নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেন্টাইনের দিন
ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, ‘ভালোবাসি’ লেখা কার্ড সহ
সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট…
কানে কানে বোলো, ‘আজও উন্মাদের মতো ভালোবাসি’
মাথা কেটে পাঠালুম, প্রাপ্তি জানিও, ফোন নং কার্ডে লেখা আছে”
চিঠি যেন অপেক্ষারই এক অন্য নাম, অথবা অলৌকিক প্রাপ্তির। কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করের কবিতায় সেই অপেক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে মর্মভেদী সুন্দরতায়:
” …আমার মৃত্যুশিয়রে কোনদিনই এসে বসবে না
ফ্যানি ব্রাউনের প্রেম
তবু তার চিঠির অপেক্ষা করে বেঁচে থাকি একেকটি রাত।

মৃত্যুর আগেও যদি তার শেষ চিঠি আসে, তবে
অভিমানে সেই চিঠি না পড়েই বন্ধুদের বলে যাব
অপঠিত চিঠি যেন অন্ত্যেষ্টি মুহূর্তে আমার কবরে রেখে দেওয়া হয়…”


এই সব আক্ষেপ-অভিমান-অভিযোগ-আনন্দ-বিষাদের স্বরলিপি ডিঙিয়ে চিঠি কখনো কখনো হয়ে উঠতে পারে পত্র-সাহিত্য। সামান্য দু-কলম খামবন্দী লেখাই এক অনির্বচনীয় বিভায় হয়ে ওঠে অমূল্য সাহিত্য! অশোক দেবের অনবদ্য কবিতা-সিরিজ ‘ডাকবাক্স ও চিঠি’-তে পাই সেই হয়ে ওঠার অমোঘ ইঙ্গিত:
“রাতে নদীর তীরে তীরে
সহস্র ডাকবাক্স স্বপ্ন দেখি
যেনো তারা নদীকে শোনাবে পত্রসাহিত্য।
অতিদূরে যে কনিষ্ঠ ডাকবাক্স, তার
মাথার ওপরে সামান্য কোনো পাখি–
যেনো সে জানতে পেরেছে
আমরা কেন চিঠি লিখি, সে তাই
আপন শিসে ঘুরিয়ে দিচ্ছে নদীর গতিপথ”

কবিদের কবিতায় ‘চিঠি’ শব্দটি বারবার ব্যবহৃত হয় অনিবার্য রূপক ও উপমায়। বিনয় মজুমদার যখন লেখেন,
“….তুমি এসে ছিন্ন ছিন্ন চিঠির মতন তুলে নিয়ে
কৌতূহলে এক করে একবার প’ড়ে চ’লে যাও,
যেন কোনো নিরুদ্দেশে, ইটের মতন ফেলে রেখে।”

অথবা সৈকত মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় যখন পাই:
“একজন্ম লোভাতুর কেটে গেল
ধ্যানে পেলে বুকের জরুল
ঘ্রাণে পেলে চুলের সুবাস
তারপর…?
আর কিছু নয়।
তোমার প্রথম চিঠি উড়ে গেল ঝরাপাতা বনে”,
— আমরা বুঝতে পারি চিঠি শব্দের অমোঘ দ্যোতনা। জীবনের সঙ্গে চিঠি মিলে যায় অব্যর্থ এক রূপকের ব্যঞ্জনায়।

কিছুদিন আগে এক মেঘলা সকালে ফেসবুকের ওয়ালে হঠাৎ আবিষ্কার করেছিলাম বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতা ‘চিঠি’:
“আর যে গন্ধের ভেতর ঠোঁট নিয়ে এল, তাকে কিছু
বলবে না?
ও কে হয় তোমার?
আমি ভুল করে বারবার চোখ মুছছিলাম…
কারণ আমি জানতাম না পুরোনো চিঠির মধ্যে ধারালো ব্লেড থাকে…
আমি কক্ষনো শিরাকে সাবধান করিনি…
মরচে-ধরা বিকেলে আমি তো কেবল ভালবাসতে
চেয়েছিলাম…

আমি তো কেবল আমার বিষাদ রাখতে চেয়েছিলাম তোমার অহংকার গায়ে…”
— ‘পুরোনো চিঠির’ ওপর এক অকল্পনীয়পূর্ব আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ব্লেড এবং শিরার রসায়ন থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠা একাধারে অশ্রু ও মোহ, প্রেম ও ক্ষতর বাষ্প আমাদের পাঠক সত্তাকে যেন মেদুর ও সম্মোহিত করে তোলে।
‘চিঠি’ কবিদের আদরের শব্দ। পরম আশ্লেষে তারা এই শব্দ বুনে দেন তাদের কবিতার শরীরে এবং শিরোনামে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় কবিতা ‘না পাঠানো চিঠি’, থেকে সুবোধ সরকারের ‘ছাত্রকে লেখা চিঠি’, ‘এক কনস্টেবলের চিঠি’, ‘একজন টেররিস্টের চিঠি’, বাংলা কবিতার ভূবনে ‘চিঠি’ শব্দের বহুবর্ণ ব্যবহার। আমার নিজের লেখা সামান্য কবিতাতেও এসেছে চিঠির প্রসঙ্গ:

”তোমার একমাত্র চিঠিটি এসেছিল সাতান্ন বছর আগে
তারপর থেকে অপেক্ষায় থেকে থেকে
শেষ হয়ে গেল চিঠি লেখার জমানা…
এখন দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে
অদৃশ্য ফ্রেমে বাঁধানো তোমার সাতান্নটা মুখোশ
উড়ন্ত গালিচার ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে
সেই চিঠি থেকে কবেই উবে গেছে সকালের রোদ ও ঘ্রাণ
এবার বর্ষায় চিঠিটা দিয়ে একটা নৌকা বানাব
জলে ভাসিয়ে দিয়ে বলবো, দূর হ, মুখপুড়ি!

শূন্য খামে তবু লেগে থাকবে নাছোড় কিছু সোনালি অক্ষর!”

তবে ব্যক্তিগত পাঠ-পরিধিতে যে কবির লেখায় ‘চিঠি’ শব্দের ব্যবহার আমাকে আবিষ্ট করে রাখে, তিনি হলেন কবি উত্তম দত্ত। তাঁর একাধিক কবিতার শিরোনামে এবং শরীরে আবেশসঞ্চারী দীপ্তিতে ঝলমল করে ‘চিঠি’– এই দু-অক্ষরের শব্দটি।
খোলাচিঠি, আশ্বিনের চিঠি, মনোময়কে লেখা চিঠি, নীল চিঠি, বানভাসি মফসসলের চিঠি, পিতামহকে লেখা চিঠি, অন্ধকারে লেখা চিঠি, বিশ্বাসঘাতকে খোলা চিঠি, পানশালার পত্র-র মতো একাধিক কবিতার শিরোনামই শুধু নয়, তাঁর অসংখ্য অন্যান্য কবিতায়ও ‘চিঠি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে জাদুকরী ইঙ্গিতময়তায়।
এ লেখা শেষ করব উত্তম দত্তের কবিতার এমন কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে, কবির বর্ণালী ও মরমী প্রয়োগকুশলতায় যার মধ্যে ফুটে ওঠে ‘চিঠি’ শব্দের বহুধাবিস্তৃত ব্যঞ্জনা!

**”তোমার সমস্ত বিষাদ লুকিয়ে রেখেছি করতলে
লুকিয়ে রেখেছি ব্যক্তিগত ফেরিঘাটে মস্ত এক সুবর্ণগোধিকা
ঠোঁটে তাঁর সোনার মোহর, মোহনার জলে
সে ভাসিয়েছে নীল চিঠি, ‘পুরোনো নূপুর খুলে এই শীতে
একদিন চলে এসো একা একা’।” (নীলচিঠি)

**”তোমার প্রথম চিঠিতে তেত্রিশটা বানান ভুল ছিল
তবু সেই তেত্রিশটি শব্দকে আমি স্বতন্ত্রভাবে চুম্বন করেছিলাম……
তিন বছর পরে লেখা তোমার শেষ চিঠিতে একটিও বানান ভুল ছিল না
তেত্রিশ বছর পরে আজ মনে হয়:
তোমাকে অভিধান কিনে দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছিল” (চলন্তিকা একটি মৃত বাংলা অভিধান)

**”…চুলের আড়াল থেকে লোহিত সাগরের ঢেউ
ভেসে যায় সীমান্তের দিকে। কেউ নেই চরাচরে
যে তোমাকে পৌঁছে দেবে
বাংকারে ফক্সহোলে জেগে থাকা সৈনিকের চিঠি
কেউ নেই কোনোখানে, যে তোমার দুচোখের ক্লান্তি মুছে দেবে।” ( সৈনিকের বউ )

**”তোমার চিঠির জন্য একদিন সারারাত
আমাদের মৃত ডাকঘরে রাত্রিচর পতঙ্গের মতো
উড়ে বেড়িয়েছি বলে পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মগ্রন্থ
আমাকে তাচ্ছিল্য করে চলে গেছে।” (রজস্বলাকে নিবেদন)

**”আমার ঠাকুরদা বসন্ত বলতে বুঝতেন:
কচি নিমপাতা , ফলুই মাছ আর সজনের ডাঁটা।
আমার সৈনিক পিতা বসন্ত এলেই কারগিল সীমান্ত থেকে
পোস্টকার্ডে মাকে লিখতেন:
এখন পাহাড়ের চূড়া থেকে একটু একটু করে বরফ গলছে।” (বসন্তের তিন টুকরো)
— উত্তম দত্তের কবিতায় ‘চিঠি’ কখনও অপরিসীম মিলন আকুলতার রেণুতে রাঙা নীল, কখনোবা জীবন ও প্রেমের অন্তর্লীন সরলতা এবং জটিলতার মায়াবী স্ফটিক। তার লেখায় চিঠি হয়ে ওঠে মানুষের সাতরঙা আবেগের অব্যর্থ রূপক।

সবিস্ময়ে লক্ষ‌ করি, ‘চিঠি’-র মতো একটি সাধারণ শব্দ বহু কবির অতিব্যবহারেও জীর্ণ বা ক্লিশে হয়ে ওঠেনি। তার মুখ ও বুক থেকে এখনও খসে পড়েনি রহস্যময়তার মধুবনী আঁচল। একটি চিঠির মতো চিঠি বোধ হয় আজও কোনও ক্লান্ত প্রাণে বয়ে আনতে পারে দু-দণ্ড শান্তি, হয়ে উঠতে পারে বনলতা সেনের এক অতীন্দ্রিয় বিকল্প।

( প্রকাশিত বই থেকে নেওয়া উদ্ধৃতিগুলোর সমস্ত বানান অপরিবর্তিত রেখেছি। )

11 Comments

  • সুব্রত মণ্ডল

    Reply June 29, 2021 |

    খুব ভালো লাগলো। একসাথে একাধিক চিঠি পড়তে পারলাম।

    • সুবীর বিশ্বাস

      Reply June 29, 2021 |

      বাঃ, খুব সুন্দর লিখেছেন।ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চিঠির অভিঘাত রয়ে গেল মনে।

  • Manas Chakraborty

    Reply June 29, 2021 |

    দা রু ণ

  • Rajesh Ganguly

    Reply June 29, 2021 |

    সিঁড়ির পর সিঁড়ি পেতে রেখে ঘাট নামিয়ে নিয়ে চলেছে টলটলে জলের টসটসে ছোঁওয়াটুকু পাওয়ার আকাঙ্খাকে। প্রত্যয়ী অবরোহে যে উন্মুখ উৎসারণের কিনারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান প্রবাহকে কোন খাত চিনিয়ে ওঠা গেলনা আজও…ওরা নিরুদ্দেশের দিকে উজানবাহী হয়ে চলতে চেয়েছে…রয়ে গেছে পিছুটান -“লিখিও উহা ফিরত চাহ কিনা”…
    আপনার চিঠিবিলাসকে এমন এক অলৌকিক বুদবুদে স্থাপিত করেছেন, যেখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার জন্য সত্যি কোন জাদু নয়, এক অবর্ণনীয় নস্টালজিয়ায় আহত হয়ে থাকার আসক্তি রয়েছে। আমরা যারা চিঠির লাবণ্য ব্যক্তিগত জীবনে কখনো না কখনো উপলব্ধি করেছি, কাঁদিয়েছি স্বজনকে, হাসিও ফুটিয়েছি, জীবনে অঙ্গাঙ্গী হয়ে থাকা এই যোগাযোগের অচিন আলো যারা সযত্নে আগলে রেখেছি আজও বিবর্ণ সেভিংস অ্যাকাউন্টে, তাদের কাছে চিঠি যে উপসর্গের দ্যোতনা নিয়ে আসে, তা বোঝানোর নয়। আপনি সেই অব্যক্তকে বাঙ্ময় করে তুললেন। সুবিশাল পাঠ পরিধি থেকে সুচয়নিত চিঠিগুলি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় আত্মমগ্নতার আয়নার সামনে। কি দেখতে পাই প্রতিফলনের খামে? দেখি বিদ্যুৎঝলকের ক্ষণপ্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আমার ভেতরে থাকা অবোধ সে জন, আজ যে প্রাগৈতিহাস!
    অসাধারণ! ভালো থাকবেন। আপনাকে আরো পাঠের জন্য মুখিয়ে রইলাম।

  • সমরেন্দ্র বিশ্বাস

    Reply June 29, 2021 |

    খুব সুন্দর লেখা। একরাশ মুগ্ধতা!

    • সূর্য মণ্ডল

      Reply June 30, 2021 |

      খুবই সাবলীল লেখা।

  • UTTAM BISWAS

    Reply June 29, 2021 |

    একসাথে অনেকগুলো চিঠি পাওয়া গেল। ভীষণ ভালো লাগল!

  • SANJIBAN ROY

    Reply June 29, 2021 |

    এই হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজিং এবং মোবাইলে টেক্সট এর দ্রুতগামী সময়ে , ভাবতে খুব ইচ্ছে করে আপনার এই কবিতার চিঠির প্রতিটি লাইন খানিকটা বিস্ময় নিয়ে পড়ে চলছে সদ্য তারুণ্যে অভিষিক্ত কোনো অক্ষরপ্রেমি পাঠক বা পাঠিকা , এবং অনুপ্রাণিত হয়ে হাতে তুলে নিচ্ছে ধুলোমাখা কাগজ ও কলম , প্রাণের স্বজনকে কিছু অন্যরকম লেখার জন্যে ,যা সে কোনোদিন মুখে বলতে পারেনি ,খুব কাছে থেকেও l

  • Sharmistha Nathmandal

    Reply June 29, 2021 |

    খুব সুন্দর লাগল। চিঠি লেখার বা চিঠি পাওয়ার রোমান্টিক অনুভূতি আজও বড় আকাঙ্খিত। আজ দুরন্ত কমিউনিকেশনের যুগে স্টে কানেকটেড সেই রোমান্টিকতাকে হারিয়েছে। তাই এই কবিতা গুচ্ছ পড়ে মন ভরে গেল।

    • শ্যামলী সেনগুপ্ত

      Reply July 1, 2021 |

      অপূর্ব কিছু পড়লাম এই সকালে।
      ধাপে ধাপে সিঁড়ি নামছে আর প্রবেশ করছি মায়াময় এক গহীনের দিকে…অপূর্ব!

  • Anindya Sequeira

    Reply June 29, 2021 |

    Koto chithir shomaroho – nana bhaber prokash – eto shindar kore tumi shajiyechho tomar atghyo – mon bhore porlam – ei kobitai chithi bhari obhinaba proyash. Tonar moton kolomer jod to amar nei tai amar bhalo laga bhasha te prokash korte patchhi na. Etuku bolte pari je tomake niye garbo bodh kori.

Leave a Reply to সূর্য মণ্ডল Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...