স্বরান্তরের চিঠি
বল্লরী সেন
বিদ্যাপতির রাধা সখীকে বলেন, এ শূন্য ঘরদুয়ার— আর ভরা বাদলের তর্জন; কিন্তু আমার প্রিয়তম নেই । আসলে তিনি নিজেই যে পরবাসে আছেন। ‘প্রাচীন সাহিত্যে’ রবীন্দ্রনাথ এই মাথুর পর্যায়ের পদটি সম্পর্কে বলেছিলেন যে, সখীর কাছে রাধা যেরকম বলেন তাঁর দুঃখের সীমা পরিসীমা নেই — স্বাভাবিক কারণেই আমাদের সেই রাধাকে বিশ্বাস করতে বাধে। আমার মনে হয়, বিদ্যাপতি রাধার লেখ্যজীবনের শাগির্দ, এটা হচ্ছে রাধার কলমে সখীকে লেখা দু’কলম পত্র। তাই ‘ বিদ্যাপতি কহ কৈসে গোঙায়বি , হরি বিনে দিন রাতিয়া’ — এই উদ্বেগের অন্ত নেই। তাই “ কান্ত পাহুন কাম দারুণ/ সঘন খর শর হন্তিয়া” বলামাত্র আজ আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, প্রিয়বিরহিত রাধার এ বয়ান, এক বদলে যাওয়া অনুবেদনের আততিতে ক্রমযাপনের তারে বেজে চলেছে : কেবল মন ও শরীরের সকাম বিহারের এমন বিপরীতকথন মুখে নয়, একমাত্র শকুন্তলীয় আবেশে উৎকন্ঠায় পদ্মপাতায় হরফের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়।অর্থাৎ, দুর্লভ এমন এক অযাচিত কামমোহিত রাধার অবস্থান ধরা রইল এই ন্যারেটিভে, যার ব্যঙ্গ্যার্থ আভিপ্রায়িক ও দ্বিমুখী। পুরুষ নির্দিষ্ট এরস্ এর মাতামাতিকে অপসারিত করে এখানে রাধা তাঁর নিজের লিবিডোকে যে প্রক্রিয়ায় পুনরাবিষ্কার করেছেন , তা কালানুক্রমিক পাঠের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতির রুদ্রতাণ্ডবে রাধা তাঁর শরীরের মধ্যে আর এক অবয়বকে খুঁজে পেলেন, তখন দুখের নাহি ওর’ এই পরিভাষায় তিনি নিজের “সুখ” কেই স্পর্শে চয়ন করছেন, হাত রাখছেন নিজেরই পুষ্পশরবিদ্ধ দেহের অলিন্দে। যেখানে ব্রীড়া নেই, আছে উৎসারণ। প্রিয়কে খুশি করার কৌশল নেই, পরিবর্তে আছে নিজেকে নিজের শরীরে অপর হিসেবে দুধের মাঠায় মন্থনের সক্ষমতা, আছে পুরুষের মতো নয় — নারীর নিজস্ব রমণসঙ্কল্প।
রাধাবাহিত পুরাণে আরাধিকা মেয়ের শরীর আসলে কৃষ্ণের ভজনাপ্রবণ। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ জন্মখণ্ড থেকেই রাধাকে কৃষ্ণের পায়ে দ্রবীভূত করে ফেলেছে । জয়দেবের
‘গীতগোবিন্দ’ থেকে আমরা বিভিন্ন পুরাণ ও শ্রীমদ্ভাগবতের যে সব অনুবাদ পেয়েছি, সবই কৃষ্ণস্তুতির বিভিন্ন দাপটের গল্প । কিন্তু রাধার মানবীজীবনের কুলভাঙার অভিশপ্ত কথা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল চৈতন্য পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণব ষড় গোস্বামীরা। রাধা হলেন একটা সংখ্যা, একটা শক্তির নাম। অস্তিত্বহীন এক ফানুস। এর পরেও প্রাক্- চৈতন্য যুগে বিদ্যাপতির এ হেন পদটি আমাদের এমন এক আকস্মিক মুহূর্তে অনুপ্রবিষ্ট করে যেখানে, রাধার ভাষ্যে যা পেলাম তার তাৎপর্য নারীর এক ভিন্ন শৃঙ্গার স্বপ্নে পারঙ্গম। সে কেবল প্রিয় পুরুষের আহ্লাদের নর্মসঙ্গিনী নয়, দেবতার দাসীত্ব ছেড়ে সে আত্মমুখী, আত্মরবে নিমগ্ন । প্রিয়তমের স্মৃতি অবলম্বন করে রাধা নতুন প্রৈতিযুক্তা এক অন্য কেউ, যার দেখা আমরা সমগ্র মধ্যযুগের সাহিত্যে তেমন পাই না। পুরুষের শোষণের বিপ্রতীপে সে এখানে উল্টো ফেমিনিজমের ঝাণ্ডা নিয়ে অবতীর্ণ নয়, বরং মহাভারতে মাদ্রীর সকাম লিবিডোর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। নারী তার নিজের দেহজাত যৌনকামনাকে সোচ্চারে বলবে কেন? তাকে নিষেধের গণ্ডি ভেঙে এগোতে হল “পরপুরুষ” এর দিকে । রাধার স্বামীর কোনও উপস্থিতি নেই পদাবলিতে। বিরুদ্ধ জীবনের স্রোতের কথাও উল্লেখবিহীন বলা চলে। তাই একপাক্ষিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে রাধা তাঁর কুলবধূর পরিচয়কে লঙ্ঘন করে এই চিঠি লেখেন, স্বীকৃতি দেন স্বশাসিত উদ্দীপনকে, যা প্রেমিকের অনুপস্থিতির জন্যই সম্ভব হয়েছিল। কৃষ্ণের মথুরা গমনের সাহায্যে রাধার এ হেন রিভাইভাল কোনও পুরাণেই নেই । তাই ‘এ সখি , হামারি দুখের নাহি ওর’ এর প্রকরণে পত্রমাধ্যমরীতির তিরবিদ্ধ যোগাযোগ আছে, রাধা প্রথম তাঁর তথাকথিত ‘বিপ্রলব্ধ’ এর বিরহিনীমূর্তি থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণ ব্যতিরেকে নিজের দেহকে ভোগ করেছেন। তাই তাঁর দুঃখ আসলে সুখ, তাই তাঁর বাচিক উচ্ছ্বাস লাইন থেকে লাইনে সুগন্ধির মতো ছড়িয়ে পড়ে, কারও অপেক্ষা নেই, কারও হুতাশ নেই। এ যেন লীলাকমলপত্রানি গণয়ামাস পার্বতী’ র মতো নিজ দেহে নিজে জ্ঞানহারা রাধা, পরতে পরতে উন্মোচন করে নিজে তূরীয় সুখে সমস্থিতা। আত্মকলেবরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে কবির অজান্তে তাঁর নির্মিত চরিত্র স্বয়ংক্রিয় ও তৎপর হয়ে উঠেছে, যার সাহায্যে আমি- সত্তাটি স্তরে স্তরে বহুত্বের দ্বন্দ্বে কবিতার শেষ লাইনে এসে ধাক্কা খায় । “কৈছে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া”—রাধাকে এই লাইনের মধ্যে আবার দেবতার চরণে তখন লুটিয়ে পড়তে হয়। প্রেমের এমন স্বতন্ত্র সংবেদন, এমন সুখভারাতুর আলম্বন বিভাব নারীরযৌনকুয়াশাকে জ্যা মুক্ত করে দিল। এখানে মনের কূপ খননের কার্যই চিঠির আদলে বিপরীতগামী।রাধা কেমন আছেন, প্রশ্ন নেই।কেবল উত্তর আছে। পদের ১৫ শতকীয় ব্রজবুলি তো মুখের ভাষা নয় , কোনদিন তা মিথিলা নগরীর নর-নারীর ডায়ালেক্ট ছিল না। তাই লিখিত কাব্যভাষা হিসেবেই এর জন্ম ও প্রবর্তন। আর চিঠির হরফ মাত্রেই তা মানুষের অবচেতনের লুকোনো অন্ধকারের কথা বলবে, যেমন সখীর কানে কানে এই নিগূঢ় কথা লিখতে গিয়ে যা হল। যার কোনো তদ্বির রাধা করেননি, কিন্তু তার নীরব টঙ্কার আমাদের কানে পৌঁছেছে। নারীর নিজের এই স্বগতোক্তি আমরা এত শতাব্দী পরেও যদি চিনতে পারি, ক্ষতি কি!