আমার দিদা হয়ে ওঠা আশাপূর্ণা দেবীর একটি চিঠি
সুমন্ত বন্দোপাধ্যায়


কুন্ঠার সঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম, আপনাকে কী বলে ডাকি? একগাল হেসে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, দিদা বলে। এ ভাবেই সম্পর্কের সূত্রপাত। আমি তাঁকে দিদা বলেই ডাকতাম। বছরে অন্তত দু’বার চিঠি আদান-প্রদান হতো  আমাদের মধ্যে: নববর্ষ ও বিজয়ার সময়। যখন সম্পর্কের শুরু, তখন নাতির, মানে আমার বয়স কুড়ি। আর দিদার? মানে, স্বনামধন্য লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীর? তিনি আজও বয়সহীন। আমি সে হিসাবের খোঁজও রাখিনি, তিনি স্নেহে ও ভালোবাসায় প্রকৃতই আমার দিদা হয়ে উঠেছিলেন। সমস্তিপুরের বাঙালি সমাজ সংবর্ধনা দেবে বলে আমি তাঁকে  সঙ্গে করে  নিয়ে গেছি ট্রেনের থ্রি-টিয়ারে। তখন তিনি সবে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও পদ্মশ্রী পেয়েছেন। কী যে নিরহংকার ও সাধারণ ছিল তাঁর  হাবভাব, কে বলবে তিনি অত নামী একজন লেখিকা! মনে আছে, ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট পাওয়া যায়নি বলেই দিদাকে নিয়ে যেতে হচ্ছে  মিথিলা এক্সপ্রেসের থ্রি-টিয়ারে। সে কারণেই আমি খুব সঙ্কুচিত, কিন্তু তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ট্রেনে ওঁর নিচের বার্থ, আর তার ওপরে একজন অল্প বয়সী বাঙালি মহিলা  এবং সঙ্গে তার ছোট্ট বাচ্চা। এই দেখে দিদা আর কিছুতেই নিচের বার্থে বসবেন না। মহিলাকে বললেন, তুমি নিচে শুয়ো, আমি ওপরে শোবো। আমি আপত্তি করে বললাম, দিদা, আপনার এই বয়সে ওপরে উঠতে অসুবিধা হবে। তিনি নাছোড়। বলেছিলেন, একরত্তি মেয়ে মা হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়বে, আর বাচ্চাটা ওপর থেকে ধপ করে পড়ে যাবে। না না, আমি ওকে ওপরে রেখে নিজে  নিচে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। সেদিনই আমি ওঁর মানবিক চরিত্রের পরিচয় পাই। ১৯৭৩ সালের এক শনিবার বিকেলবেলায় আমাদের পত্রিকার জন্য তাঁর কানুঙ্গো পার্কের বাড়িতে লেখা চাইতে গিয়ে যে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল, তা অটুট ছিল উনি প্রায় যতদিন  জীবিত ছিলেন ততদিন।  ১৯৭৯ সালে কর্মসূত্রে মুম্বাই চলে আসার পড়ে চিঠির যোগাযোগটুকুই ছিল আমার সম্বল‌। তবে কলকাতা গেলে দেখাও করেছি।   অগনিত ব্যক্তিগত কুশল বিনিময়ের চিঠি থেকে বেছে আমি একটিই চিঠির প্রতিলিপি এখানে দিচ্ছি যেখানে তিনি আনন্দ প্রকাশ  করেছেন তদানীন্তন বোম্বাই থেকে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের খবরে। উদ্বেগ ও আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন, বাংলার বাইরে থাকা বাঙালিরা ক্রমশঃ বাংলা ভাষাকে ভুলতে বসেছেন বলে‌।  আজ তিনি জানলে খুশি হতেন যে এখনও বাংলার বাইরে থেকে নানান বাংলা পত্রিকা  নিয়মিত প্রকাশিত হয়, প্রবাসী বাঙালি না ভুলেছে বাংলা ভাষা না ভুলেছে তাদের প্রিয় লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীকে।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...