যোজন ভাইরাস, একটি অজিতিয় মর্মব্যবচ্ছেদ
বনানী দাস
যোজন ভাইরাস, একটি অজিতিয় মর্মব্যবচ্ছেদ বনানী দাস
কিছু বছর আগে এক চিত্রল সাপের মতো যোজন ভাইরাস উপন্যাসটি পেঁচিয়ে ধরল আমার সচেতনতার মোড়কঘেরা ব্যক্তিত্ব। দেখলাম কাঙাল দৃষ্টি নিয়ে আমার মেয়েমানুষী বিপন্নতা মাথা নীচু করে নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। অর্থাৎ খুব সততায় সে বিপদে পড়েছে। গৃহগত জীবনে ও যাপনে যেসব গোপন উঁইঢিবি আছে তাদের ঢিল মেরে একেবারে উদলা ও অশান্ত করে দিল যোজন ভাইরাস।
উপন্যাসটির প্রথম ও প্রধান বিন্দু কমল। এই কমল অন্যধারায় সৃজিত, এক অন্যফ্রেমের চরিত্র। এর পুরাণ- কোরাণ তন্নতন্ন করে একটিই বাক্যে বলে ফেলা যায়, কমলের সঙ্গে ভেতরের কমলের দেখাশোনাটা স্বচ্ছ, সহজ।
কমলের বীজ গবেষণাক্ষেত্রে,সবজি এবং চাষবাসের গ্রাম্য ঠাঁইতে যখন আমরা প্রবেশ করি, মাটিলগ্ন, ভাষাজীবী মানুষটির জন্য প্রাণের শিকড়ে আমাদেরও টান লাগে। তবে এ কথাও বোঝা যায়, বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্পের মতোই কমলবাবুদেরও পরীক্ষা এবং নিরীক্ষাপ্রবণ বাঁচাবাঁচি। সে বীজের পরীক্ষা বা জীবনের নিরীক্ষা যাই হোক।
এমত কমলের নারী অর্থাৎ রানী মেলে। আসে জীবনের সঘন উপভোগের আরক্ত সময়! সংরাগের বছরগুলির উন্মত্ততা নিভে এলে সেই পিতলঠান্ডা দাম্পত্যের যত প্রতিফলন, প্রতিসরণ দুটি হৃদয়কে বিপর্যস্ত করে তারই লুকনো উৎসগুলি, ভাইরাসগুলিকে খোঁজা হয়েছে এই উপন্যাসে। খুঁজতে গিয়ে দান দিতে হয়েছে নিজের অধিকারবোধ, চিরে দেখাতে হয়েছে নিজস্ব নানান দুর্বলতার স্বরূপ, আদিম স্বত্ব ধারণার পূনর্বিচার হয়ে পড়েছে জরুরি। অজিত রায়এর বিশিষ্টতা এখানেই যে তিনি মূলত মর্মন্তুদ পরীক্ষা করিয়েছেন পুরুষের দিক থেকে। সম্পর্কের শৈত্য বুকে নিয়ে বর্ণময় মেয়ে রানী হয়ে পড়েছে স্পৃহাহীন, অথচ তার প্রতি সম্মানবোধ কমেনা কমলের। নিজেকে, নিজের পুরুষ অস্তিত্বকে, সিস্টেমকে সে ভাঙতে থাকে, ভাঙতে ভাঙতে আদিতম বাউল সত্যে পৌঁছে দেয় নিজেকে।
—– কি সেই অমোঘ অনুজ্ঞা যা নারীকে সচল করে, এবং পুরুষকে মৃত। কমল দেখল, রানী এই মুহূর্তে আর কেউ নয়। অন্তত কমলের কেউ নয়। অন্তত তুতুলের কেউ নয়। অন্তত সমাজের কেউ নয়।……..
সে শুধু পরম অর্থিত নারী এক, পূর্ণ ও অনন্য! সে কেবল নিজের ‘স্ব’ কে চেনে,আর সেই ‘স্ব’ এর সে আজ্ঞাবহ চারিকা মাত্র। এই অমোঘ মাত্রায় প্রিয় মানুষের স্ব- রূপকে জানবার পর কমল রানীর দিকে বাড়িয়ে দেয় আত্মবিনাশী খেলা, একহাতা কাঠকয়লার মতো। রানীর এই জ্বলন্ত পরগমনের প্রচেষ্টার খেলার শেষে কমল আর ফিরতে পারেনা আগের খোলসে। দিগন্তপ্লাবী এক ‘নেই ‘ খেয়ে নেয় তাকে। সেখানে এমনকি সূর্য বা পৃথিবীও ফিরিয়ে নিয়েছে সব মোহ!
অথচ এই খেলাটি নিঃসার এক ভ্রান্তি ছিল প্রমাণিত হয়। কিন্তু বড় হয়ে যে প্রশ্নটি ঝুলতে থাকে —– তবে কি ক্রমহ্রাসমান এক আর্তিহীন সম্পর্কে ত্রিশঙ্কু হয়ে থাকাই নিয়তি ওদের! অথবা আমাদের!
যোজন ভাইরাস এ প্রশ্নেরও উত্তর রেখে গেছে অগোচরে।উপন্যাসটি বারবার পড়লে যা গোচরে ভেসে উঠতে থাকে। উত্তরটি আছে কমল ও রানীর বেদনার মধ্যে। যেখানে তারা নিজস্ব অকর্মক প্রবণতাকে আন্তরিক চিহ্নিত করে। কোন হিপোক্রেসি নয়,সরাসরি পরস্পরের অস্তিত্বের দিকে চেয়ে ব্যাখ্যা চায়।
উত্তর! হ্যাঁ তাও আছে এই ধুলোমাখা পৃথিবীতেই। এ এক অবধারিত ধ্বস, যা অনেকটা জৈবনিক, অনেকাংশে সামাজিক, পারিবারিক নিয়মশৃঙ্খলার ক্লান্তিজনিত। এইসবকে অতিক্রম করার অনেক পথ বোধহয় অন্বেষকরা খোঁজ করে গেছেন অনেক কাল! যদি গোড়ায় গলদ না থাকে, অর্থাৎ পারস্পরিক এক প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধার নৌকায় সেদিন উঠে থাকে দুজন, তবে যখন সম্পর্কের বহিরাবরণ পালটে বা পচে যায়, তা মেনে নেবার স্থৈর্যও এসে যায়, ভেতরটা নির্লজ্জ জিয়ন্ত থাকে যে! অজিত রায় বলেন,
—– শুধু সেক্স দিয়ে তো পুরো ভাতটা মাখা যায়না, প্রেমের ঘ্যাঁটও লাগে!