ভুল
অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়


ভুল, সবই ভুল! অতল জলের আহ্বান-এর সেই অবিস্মরণীয় গানটা মনে পড়ে? কতজন যে এককালে এর সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে চোখের জল ফেলেছিলেন! কিন্তু জীবনখাতার সেই ভুল নয়, রোজকার জীবনে আমাদের যে নিত্য ভুলে যাওয়া, নিত্য নাজেহাল হওয়া, তাই নিয়ে এই নিবন্ধটি।

আমি একজন পাক্কা ভুলেশ্বরী, সেই কম বয়েস থেকেই। কারো নাম মনে থাকত না অথচ মজার ব্যাপার, ভুলের মধ্যেও বেশ একটা সাজুয্য রেখে ভুলতাম। মানে সুমিত্রাকে সুচিত্রা, শর্মিলাকে উর্মিলা, সন্তোষকে সন্দীপ, অনিমেষকে অনিকেত – কোন দিক দিয়ে কোন মিল মিলিয়ে কোন মনস্তাত্ত্বিক বিক্রিয়ায় যে সেইসব আশ্চর্য ভুলগুলো করতাম তার হদিশ জানা নেই, হয়তো মনস্তত্ত্ববিদ বা শব্দ ও মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণাকারীদের কাছে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থেকে থাকবে। অভ্যাসটা আজও বিদ্যমান তবে এখন লোকে সেটা বয়সের দোষ বলে ক্ষমা করে দেয়। ভুল ভাঙানোর চেষ্টাও করি না। কষ্ট করে এত বছর বেঁচে বয়স বাড়ালাম, আর বয়স বাড়ার সুবিধাটা নেব না? কমবয়েসে ভুলের ব্যামো সামলানোর জন্য কাগজে লিস্টি করে রাখতাম, পাছে কিছু মিস হয়ে যায়। সে অভ্যেস এখনও আছে। তবে মোবাইল আসায় আমার টেনশান অনেকখানি কমে গেছে, অ্যালার্ম আর টু-ডু-লিস্টের দুটি ক্রাচে ভর করে আমি পদে পদে ভুলে যাওয়ার বিভ্রাট থেকে নিজেকে কোনও রকমে বাঁচিয়ে রেখেছি। হুঁ হুঁ, ভাবো বুঝি অ্যালার্মের কাজ শুধু ভোরবেলায় ঘুম ভাঙানো? মোটেই না। আমার জীবনে অ্যালার্ম এক বিরাট উপকারী বন্ধু। শুধু বিল জমা দেওয়ার দিন মনে করিয়েই ছেড়ে দেয় না সে, সময়মত বেজে আমাকে দিয়ে বিলগুলো জমা করিয়ে তবে সে ক্ষান্ত হয়! এভাবে কত যে লেট ফি বাঁচিয়ে দিয়েছে! আগের সেই ঘড়ি পরার রেওয়ামও এখন উঠিয়ে দিয়েছি, মোবাইল আমার কম্পিউটার মোবাইল আমার ঘড়ি, মোবাইল আমার মধুসূদনদাদা দয়াল শ্রীহরি। অবশ্য মোবাইল যে উল্টে কী সর্বনাশ করতে পারে, সেটা সম্প্রতি মোবাইল হারিয়ে মোক্ষম বুঝে গেছি! হারিয়ে যাওয়া নম্বরের হদিশ পাওয়ার কোনো উপায় নেই! কোনো নম্বর মনে নেই। বহুবার করা ফোন নম্বরও মাথা থেকে বেমালুম সাফ। আলু ফাঁক! উচ্ছে ফাঁক! করতে করতে সে কী নাস্তানাবুদ!

আজকাল কোভিডের তাড়ণে মনে রাখার বাড়তি কিছু আপদ এসে জুটেছে যথা মাস্ক, হ্যান্ড স্যানেটাইজার, স্প্রে। বেরোবার আগে মনে করে লিপস্টিক লাগিয়েছি, টিপ পরেছি, দুল পরেছি, মাস্ক পরতে হবে কোনোদিনও ভেবেছিলাম? অথচ এখন মাস্ক পরা মাস্ট। সেদিন তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে গেছি, বেশ কিছুটা গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হল, ওই যাঃ! মাস্ক পরিনি তো! বাড়ি ফিরে মাস্ক পরে ফের রওনা দিই! হয়রানি আর কাকে বলে! আজকাল তাই খুব সতর্ক থাকি। বেরোনোর সময় বারবার দেখে নিই সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছি কিনা। পার্স, কার্ড, মোবাইল, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানেটাইজার, স্প্রে, জলের বোতল। 

বুড়ো বয়সে শতেক ভুল! দেখে-বেছে জিনিস কিনলাম, টাকা দিলাম, তারপর জিনিসটা কাউন্টারের ওপর ফেলে রেখে বাড়ি চলে এলাম! একদিন লেক মার্কেটে সবজি দেখে ধাঁ করে নেমে পড়লাম, সব কটা জিনিস থলিতে ভরলাম কিন্তু কড়াইশুঁটির কচুরি বানানোর জন্য সাধ করে কেনা এক কিলো টাটকা কড়াইশুঁটি ভুলে ফেলে রেখে এলাম। ইদানিং আরেকটা ইন্টারেস্টিং ভুল হচ্ছে, আমার চেনাশোনা সমবয়েসীদেরও নাকি অনেকের এটা হয়। কাজ করতে করতে হঠাৎ কি করতে যাচ্ছিলাম খেই হারিয়ে যায়। তখন তারা যা করে আমিও তাই করি, যেখানে ছিলাম সটান সেইখানটাতে চলে যাই। তারপর ব্যাক ক্যালকুলেশন করতে গেলে টপ করে সব মনে পড়ে যায়! ট্র্যাক মাই ফোন, ট্র্যাক মাই অর্ডারের মত এখন আমাদের চাই ট্র্যাক মাই মেমরি, ট্র্যাক মাই ওমুক, ট্র্যাক মাই তমুকের জন্য একটা আলাদা ট্র্যাকিং অ্যাপ।

আরেকটা ভুলের কথা বলি। রান্না সেরে ভাত বসিয়ে সেইসময়টা একটু ল্যাপটপে কাটাই… কখন যে মন বুঁদ হয়ে যায় টের পাই না…হঠাৎ নাকে পোড়া পোড়া গন্ধ আসে….আহা রে, না জানি কাদের বাড়ি ভাত পুড়ছে…ভাবতে ভাবতে উঠি…আরে যত রান্নাঘরের দিকে এগোই তত পোড়া গন্ধ বাড়ে… ও হরি!! এ তো আমারই রান্নাঘরের গ্যাসে চড়ানো ভাত, পুড়ে পুড়ে ডেকচির ভাতে বড় বড় বোতামের মত চন্দনের ফোঁটা! সবশুদ্ধু ধরে ফেলে দিতে হলো। অন্ন মানে লক্ষ্মী শিখে এসেছি ছোটবেলা থেকে। মন খারাপ হয়ে যায় কিন্তু তার চেয়েও বেশি জাগে ভয়, শ্যামলীর কথা ভেবে। কাল এসেই হুঙ্কার ছাড়বে, ইস্, কীভাবে পুড়িয়েছ! এখন এই বাসন মাজব কি করে? এই পোড়া তুলব কি করে? ভাত খাওয়া মাথায় থাক, শ্যামলীকে তুষ্ট করতে আলুর খোসা কেটে ওই বাসনে ফোটাই, লোকে বলে পোড়া ছাড়ে, দেখা যাক শ্যামলীর কষ্ট লাঘব করা যায় কিনা! কত দিন চায়ের জল বসিয়ে ভুলে গেছি, এক ঘন্টা পরে গিয়ে দেখি জল ফুটে ফুটে শুকনো, বাসন পুড়ে গনগনে লাল। একদিন মাংস সীমে রেখে ভুলে গেছি, পুরো মাটন চারকোল রান্না হয়ে গেল! এখন এইরকম স্টপগ্যাপে আমি অ্যালার্ম দিয়ে ল্যাপটপে বসি, দশ মিনিট… বিশ মিনিট… আধ ঘন্টা… অ্যালার্ম বাজলেই সোজা রান্নাঘর। ভাত আর পুড়ছে না, চায়ের জল আর ফুটে ফুটে শুকিয়ে যাচ্ছে না আর ব্ল্যাক চারকোল মাটনও বহুদিন রাঁধিনি! 

সেদিন সকালে দরকারী একটা কাজে বেরোতে হবে, নানা কাগজপত্র নেওয়ার ঝামেলা মাথায়, আগের দিন রাত্রেই তাই ভেবেচিন্তে সবকিছু গুছিয়ে রেখেছি, পাছে ভুলে যাই মাস্কটা ব্যাগের পকেটে গুঁজে রেখেছি, আজ আর কোনও রকম ভুল হবার যো নেই! দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরেকবার চেক করে নিই – পার্স, কার্ড, মোবাইল, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানেটাইজার, স্প্রে, জলের বোতল –নাঃ, সব মনে করে নিয়েছি। কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে নিয়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিই।  পরমুহূর্তেই স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে যাই!  

চাবিটা ব্যাগে ভরতে ভুলে গেছি!

6 Comments

  • Sujata Tarafdar

    Reply March 13, 2021 |

    ঐ যা: ! কি যেন লিখব ভাবলাম …… মনে পড়ছে না

    • Anjanaa Chattopadhyay

      Reply March 13, 2021 |

      হাঃ হাঃ…মোবাইলে লিখে রাখবেন! 😀

  • Dipankar Das Gupta

    Reply March 13, 2021 |

    খুব ভাল লাগলো

    • Anjanaa Chattopadhyay

      Reply March 15, 2021 |

      শুনে আনন্দ পেলাম। ধন্যবাদ।

  • Sudip Dasgupta

    Reply March 13, 2021 |

    কী সাবলীল রচনা! সাধারণ বিষয়কে আসাধারণ সুন্দর করেছে।
    সুদীপ দাশগুপ্ত।

    • Anjanaa Chattopadhyay

      Reply March 15, 2021 |

      পাঠককে স্পর্শ করতে পেরেছি জেনে খুব আনন্দ পেলাম। ধন্যবাদ।

Leave a Reply to Sujata Tarafdar Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...