স্মৃতিসরণি বেয়ে ..
মধুছন্দা মিত্র ঘোষ

     

        ‘মধুর’ – হ্যাঁ, এই নামেই আমাকে সম্বোধন করতেন, নাগপুরের খনন পত্রিকা সম্পাদক প্রয়াত কবি শ্রী সুকুমার চৌধুরী দাদা। আমি বিগত দশ বছর মুম্বইয়ে থাকতাম। কলকাতায় বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে দেখা তো আগে হতোই, পরবর্তীতে আমি যখন মুম্বই প্রবাসী, আমরা দেখা হলেই মজা করে পরস্পরকে বলতাম, “আমচি মুম্বই”, “জয় মহারাষ্ট্র”, প্রত্যুত্তরে সুকুমারদাও বলতেন, “আমচি নাগপুর … জয় মহারাষ্ট্র”। প্রায় দুই দশক ধরে পরিচয় এবং বর্হিবঙ্গের বহুল পরিচিত ‘আমারাঠাবঙ্গের কোরাস’ নামী ‘খনন’ পত্রিকায় আমার লেখালিখি। ১৯৮৬ সাল থেকে আমৃত্যু প্রকাশিত খনন পত্রিকার মধ্য বিংশ দশক থেকে প্রতিটি সংখ্যায় নিয়মিত আমার লেখা প্রকাশ করতেন সুকুমারদা। সে ছোটগল্প, মুক্তগদ্য, বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধ, কবিতা, পুস্তক পর্যালোচনা এবং হালে মরাঠা কবিতার অনুবাদ। খনন পত্রিকার প্রায় প্রতিটি সূচীপত্রে আমার নামটি থাকতই। এতোটাই প্রিয় লেখক হয়ে উঠেছিলাম ‘খনন’ পত্রিকা সম্পাদক তথা সুকুমারদার কাছে।   

        আগেই বলেছি, আমি বিগত দশ বছর কর্তার কর্মসূত্রে মুম্বইতে থাকতাম। আমি আনন্দবাজার পত্রিকা, মুম্বই ক্রোড়পত্রেও নিয়মিত লিখছি তখন। এদিকে মহারাষ্ট্রে থাকার সুবাদে মরাঠি ভাষা সামান্য হলেও রপ্ত করেছিলাম। ওই প্রবাসে দীর্ঘ সময় কাটালে যেমন হয় আর কী। সেখানকার ভাষাও কিছুটা হলেও আয়ত্বে চলে আসে। সুকুমারদা নিজেও বহু বছর মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের নাগপুর শহরে থাকতেন। তাই সম্পাদকের চাহিদা ও নির্দেশ মোতাবিক মরাঠা সাহিত্য ঘেঁটে বহুচর্চিত মরাঠা কবিদের কবিতার ভাষান্তর করে গেছি বিদর্ভের খনন পত্রিকায়, তাও আবার একটা দুটো নয়, বিভিন্ন সংখ্যায় এক একজন মরাঠা কবির গুচ্ছ কবিতা তথা ১৪/১৫ টি করে কবিতার ভাষান্তর। এই অনুবাদের কাজটা বড্ড চাপের ছিল, তবু খনন সরণি থেকে প্রকাশিত পত্রিকার কঠোর সম্পাদক ফোনে নির্দেশ দিয়ে কাজটা আমাকে দিয়ে ঠিক আদায় করিয়ে নিতেন।        

        সুকুমারদা মরাঠা ভূখণ্ড থেকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাসাহিত্যকে। কবি বা সম্পাদক হিসাবে নির্দিষ্ট কোনও ভৌগোলিক প্রান্তভাগে বিশ্বাসী ছিলেন না। পুরুলিয়ার বলরামপুরে জন্ম ও ঝালদায় প্রাথমিক সময়টা ছাড়িয়ে বাকি জীবন কেটে গেছে বহুজাতিক সংস্থার পেশায়, সুদূর মহারাষ্ট্রের নাগপুরে। সদালাপী সুকুমারদার সঙ্গে কতবার যে দেখা হয়েছে। কখনও কলকাতার কোন বড়ো মাপের কবিসম্মেলনে, কখনও হলদিয়ায় অনুষ্ঠিত সাহিত্যউৎসবে। আমিও আমন্ত্রিত থাকতাম, সুকুমারদা তো বহির্বঙ্গের সম্পাদক (প্রসঙ্গত বলি ‘বর্হিবঙ্গ’ শব্দটায় প্রবল আপত্তি ছিল দাদার, উনি ‘বাদবাংলা’ বলতেই পছন্দ করতেন) ও কবি হিসাবে মঞ্চ আলোকিত করে থাকতেনই। আর মুম্বইতে হাতে গোনা কিছু অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। এই যেমন সেবার, হলদিয়ায়, আমাকে ওঁর স্টলে বসার দায়িত্ব দিয়ে হাওয়া। আমি খননের স্টল ছেড়ে উঠে চলে যেতেও পারছিনা। ভরসা করে বসিয়ে গেছেন, সুকুমারদার স্টল ও ক্যাশবাক্স সামলাচ্ছি। ওখানে উপস্থিত অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আড্ডা মেরে অনেক পরে ফিরলেন। এখন এইসব লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে কতটা ভরসা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হলেই লেখক-সম্পাদকের সম্পর্ক পোক্ত হয়।   

        সুকুমার চৌধুরীদা বেশ কিছু বই আমাকে উপহার দিয়েছেন। ‘লাল নীল হইলদা তিন দিকে ঝাইলদা’, ‘মায়ের বাপেরবাড়ি’, ‘গদ্য প্রতিবেশী’, ‘মানুষ হে’ ইত্যাদি পড়ে, পুস্তক পর্যালোচনা করে দিতে বলতেন। দিতামও। আমারও একটি কাব্যগ্রন্থের রিভিউ খনন পত্রিকায় যত্ন সহকারে প্রকাশ করেছিলেন। বছরে দুটি করে পত্রিকা প্রকাশ করতেন, ‘রবিঠাকুর’ ও ‘দুগ্গাঠাকুর’ সংখ্যা। একটায় লেখা প্রকাশের হতে না হতেই সুকুমারদার এন্তার তাগাদা শুরু হয়ে যেত পরবর্তী সংখ্যার জন্য লেখা জমা দেওয়ার জন্য। আসলে ওদের ছাপার পুরো কাজটাই হতো কলকাতা থেকে। তাই আগাম গুছিয়ে সব কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে চাইতেন।  

        মুম্বইয়ে থাকার সুবাদে, তখন মুম্বই আনন্দবাজারের প্রতিটি ক্রোড়পত্রেই আমার লেখা কভারস্টোরি নিয়মিত থাকত। এবিপি মুম্বই সংস্করণ, মহারাষ্ট্রের প্রতিটি বড় শহর পুণে, নাগপুর, থানে, নাসিক, কোহ্‌লাপুরে পৌঁছে যেত। সুকুমারদা আমার সেই লেখায় চোখ বুলিয়েই ফোন করতেন ও লেখাটির জন্য নিজের ভালো লাগা ও অভিনন্দন জানাতেন। এক্কেবারে স্পষ্টাস্পষ্টি প্রায়শই বলতেন, “দেখলে তো মধুর, কলকাতা এবিপি প্রথমে সুযোগ দিত না। কিন্তু মুম্বই আসায় তোমার লেখা এখন আমন্ত্রণ করে ১, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট চেয়ে নেয়”।

     যখনই কোনও অনুষ্ঠানে দেখা হতো, আমাকে স্বাস্থবতী বলে ব্যাঙ্গ করতেন সবার সামনেই। আমি বেজায় খাপ্পা হয়ে যেতাম। বলতাম, “নিজে কী ? অ্যাঁ ? বেঁটেখাটো নাদুসনুদুস মহারাষ্ট্রের নাগপুরকর্‌ ‘ভাই’। মরাঠিতে ‘বস্‌’ শব্দটির তর্জমায় ‘ভাই’ বলা হয়ে থাকে। সুকুমারদা হো হো হেসে বলতেন “আহা রাগ করো কেন ?”  আমরা কর্তাগিন্নি দুজনেই একটু শাঁসে-জলে, তাই অনেকসময় বলতেন, “কী হে, ‘মোটামুটি’ ভালো আছো তো ?” আমি তখন আরও রেগে যেতাম। হ্যাঁ এইরকমই ঠাট্টা তামাশা করতেন।   

        একবার মুম্বইয়ে এক সাহিত্যসভায় আমার সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিল। সেখানে কবি হিসাবে সুকুমারদাও আমন্ত্রিত। মঞ্চে সুকুমারদাকে আসনগ্রহণ করার জন্য ডাকলাম। তারপর মাইক্রোফোনের সামনে প্রথমেই আমার সম্পর্কে এক্কেবারে যাকে বলে ভূয়সী প্রশংসা শুরু করলেন। তখনও তাঁর নিজের বক্তব্য রাখা বাকি। আমি কিছুটা বিব্রত। যদিও উপস্থিত সুধীজনের সামনে সুকুমারদার তাৎক্ষণিক প্রশংসা আমাকে লাজুক ও বিব্রত করলেও আহ্লাদিত হয়েছিলাম, ঋদ্ধ হয়েছিলাম সেদিন। যেহেতু সেদিনের অনুষ্ঠানে আমাকে সঞ্চালক হিসাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তাই সেই দায়িত্বটুকুই যথাযথ পালন করেছিলাম। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়েছি। দর্শক আসন থেকে সটান উঠে এসে, মাইক্রোফোনে বললেন, “মধুছন্দা কিন্তু কবিও। আমরা ওর কবিতা শুনবো। ওর কবিকন্ঠে কবিতাপাঠ দিয়েই অনুষ্ঠান শেষ করার আবেদন জানাচ্ছি”। আমি খুবই দ্বিধায় পড়লাম। কারণ আমার কাছে ওই মুহুর্তে কবিতা ছিল না। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি, মুম্বইয়ে যতদিন থেকেছি, আমার পরিচিতি ছিল সঞ্চালক, ভাষ্যপাঠ, অনুষ্ঠান উপস্থাপক এবং অন্যটি হলো এবিপির বেতনভোগী লেখিকা হিসাবে। আমাকে ইতস্তত দেখে, ব্যাগ থেকে একটি পুরনো খনন পত্রিকা বের করে সেখানে আমার লেখা কবিতার পৃষ্ঠাটি খুঁজে এগিয়ে দিলেন। সুকুমারদা এমনই ছিলেন। সরল, সদা হাস্যময়, অনুজকে ভালোবাসা ও সম্মান দেখানো, বড়ো একটা মনের মালিক। কোথায় যে অকালেই হারিয়ে গেলেন এমন সহৃদয় মানুষটি!   

        কিছু কিছু প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের বিবশ করে দেয়। বিচলিত করে দেয় মানসিক স্থৈর্য। স্মৃতিসরণি বেয়ে কত যে ব্যাক্তিগত মুহূর্তকথা রয়ে গেছে। সুকুদা, আপনার ‘মধুর’ কে কত বকাঝকা করে আপনার পত্রিকায় লিখিয়ে নিতেন। আজ আপনাকে নিয়ে স্মৃতিকথন লিখছি। আমার বিনম্র শ্রদ্ধা নেবেন।        

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...