সুকুমার চৌধুরীর নিরন্তর খনন ও আমরা
কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
সুকুমার চৌধুরীর সম্পাদিত খনন পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার বন্ধু কিংশুক রায়। আমরা তখন সুরাতে। সেখানকার মেডিকেল কলেজে পড়াই। তখনই তাঁর কবিতা ও অন্যান্য ‘লেখাজোকা’ গদ্য আমাকে তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। তখন ভাবিনি যে আমার পরের কর্মক্ষেত্র হবে বিদর্ভ, নাগপুর, সুকুমারের শহরেই।
স্বাভাবিক ভাবেই খননের সদস্যদের সঙ্গে আলাপে আগ্রহী ছিলাম। সেটা হয়ে গেলো ২০০১ এর পশ্চিম নাগপুর পুজোর মন্ডপে। সেখানে খননের স্টল। সদ্য প্রকাশিত খনন ও তার সঙ্গে সুকুমার চৌধুরী সশরীরে। প্রথম দর্শনেই আপন করে নিয়েছিলেন। খুব অল্প দিনেই এসে গেলেন সুকুমার দা ও তুমির নৈকট্যে। তারপর কফি হাউসের আড্ডায় আমন্ত্রণ। কবিতা, সাহিত্যের জমজমাট আড্ডা ও সুকুমার দার ঝুলি থেকে বেরোনো অসংখ্য বাংলা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে প্রথম থেকেই জমে গেলো। শুক্রবার এলেই স্কুটার বাগিয়ে ধরমপেঠ কফি হাউস। সকলেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আমিও বেশ একটা লম্বা ফাঁকের পর আবার লেখালেখিতে। উৎসাহ জোগানোর অভাব ছিলোনা। আগে কিছু ইতস্ততঃ গদ্য লিখলেও আমি লিখতাম কবিতাই। সুকুমারদার প্ররোচনায় লিখে ফেললাম একটা ছোটগল্প খননের পরের সংখ্যায়। তারপর একেবারে একলাফে অনুউপন্যাস। বই হয়েও বেরিয়ে গেলো খনন প্রকাশন থেকে।
আসলে যেটা বলতে চাইছি তা হল একজন কলম তুলে রাখা মানুষকে সুকুমার দা টেনে নিলেন সাহিত্যের জগতে। সম্পাদক হিসেবে সেটা তাঁর নিঃসন্দেহে অন্যতম প্রধান গুণ। তাছাড়া এই বিদর্ভের শুখা জমিতে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতম ধারাটি অব্যাহত রাখার জন্য কতটা প্যাশন ও কমিটমেন্ট লাগে তা যাঁরা বাদ-বাংলায় বসে সাহিত্য পত্রিকা করছেন তাঁরাই কেবল জানেন।
সে গেলো সম্পাদক সুকুমার। যাঁর খনন পত্রিকা ও আয়োজিত মাসিক বুলেটিনকে কেন্দ্র করে সাহিত্য আলোচনার আয়োজন, রবি ঠাকুরের জন্মদিন পালন আর দুগ্গা ঠাকুরের মন্ডপে খননের স্টলে আমাদের পাঁচদিনের ব্যাপক আড্ডা এই সুদূর প্রবাসকে করে তুলেছিল আমাদের অন্তরের বাসভূমি।
কবি ও লেখক সুকুমার বাংলার সাহিত্য জগতে অকুন্ঠ প্রশংসা ও খ্যাতি পেয়েছেন। সুদুর পুরুলিয়ার ঝালদা থেকে উত্তরকৈশোরে কাজের খোঁজে চলে আসা এই বিদর্ভ প্রান্তে। তারপর থেকে গেছেন এখানেই। কিন্তু যাঁর রক্তে সাহিত্যের তুমুল সংক্রমণ তিনি কবিতাহীন হয়ে কদিন আর থাকবেন। তাই গুটিকয় সাহিত্য মনস্ক বাঙালি যুবকের সাথে দল বেঁধে শুরু হল খনন কার্য, বিদর্ভর শুখা বুকে সাহিত্যের চাষাবাদ। সম্পাদক সুকুমার চৌধুরী। না-আপোষ কবি ও কুশলী গদ্যকার। তাঁর হাত ধরে খনন পৌঁছে গেছে বাংলা ও বাদ-বাংলার সমস্ত মননশীল মানুষের হাতে। তাঁরা অকুন্ঠ তারিফ করেছেন। লিখেছেনও খননের পাতায়। আর সুকুমার চৌধুরীর খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে দেশের সীমারেখা ভেঙে বিদেশেও। তাঁর ইচ্ছে ছিলো তাঁর বাড়ির রাস্তার নাম হবে ‘খনন সরনী’। সেই ঠিকানাই তিনি ব্যবহার করেছেন সর্বত্র আর তাঁর চিঠিপত্র, পাঠানো পত্র-পত্রিকা ঠিক পৌঁছে গেছে তাঁর কাছে।
আজ যদি কেউ বলে সুকুমার নেই তাহলে তা নিয্যস মিথ্যে। তিনি আছেন, থাকবেন তাঁর নাগপুরের খনন সরণীতেই। আর নাগপুরের সবটুকু নির্যাস থেকে যাবে তাঁর কবিতায়, গদ্যে, চিঠিতে; তাঁর প্রতিটি প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনায়; তাঁর শিরা-তন্তু-ছিলা- পাঁজরের ‘খনন’ গাণ্ডীবে।