শব্দ পরাধীন
শ্যামলী আচার্য


বারান্দায় গিয়ে চমকে উঠলাম। বাবা। আধো অন্ধকারে শুধু একটা ছায়ার মতো। বাবাকে
দেখে আমার চমকে ওঠার কথা নয়। এই চেয়ারে বসে সকালে বাবা খবরের কাগজ পড়ে। এই চেয়ারটাই বাবার। প্রত্যেকের নিজস্ব চেয়ার থাকে। কিন্তু সব চেয়ার সমান উচ্চতার হয় না।
কেউ বেঁটে পায়ার। কেউ লম্বা।
বাবার চেয়ারটা পুরনো। বেশ নিচু। পিছনের দিকটা তেলচিটে। একটা পায়া নড়বড় করছে
বলে প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে এঁটে বাঁধা। সারানো হয়নি। কিন্তু তবুও বাবাকে এই সময় বারান্দায় বসে থাকতে দেখে…বাবা এখন অনেকটা ছায়ারই মতো। আছে, অথচ নেই। অস্তিত্বহীন। প্রায় অন্ধকার ব্যালকনিতে বাবা কি এই সময় কখনও বসে থাকে? আচ্ছা আমি শেষ কবে সন্ধের আবছা অন্ধকার দেখেছি? মনে নেই। ঠাণ্ডা কিউবিকলে বন্দী হয়ে দিন রাত কেটে যায়। সে ঘরের নরম আলো বাড়েও না, কমেও না। একই রকম থেকে যায়। আমার চোখ আটকে থাকে কম্পিউটারের স্ক্রিনে। আমার চোখে ভাসতে থাকে টার্গেট আর অ্যাচিভমেন্ট। শুধু ব্যালান্সশিট। ট্রাপিজের দড়ির ওপর দিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুত ভারসাম্য রেখে হেঁটে যাওয়ার খেলা।
আজকাল বাবা কখন কী করে ঠিক জানি না। ওগুলো এখন চন্দ্রার দায়িত্বে। সে বাবার
দেখাশোনা করে। সে করায়। লোক ঠিক করা আছে। তারা দেখে। চন্দ্রা সব জানে।
আমার পক্ষে বাড়ির খুঁটিনাটি কিছু জানা সম্ভব নয়। অসম্ভব চাপ অফিসে। বাড়ি ফিরতে
গভীর রাত। তার ওপর বছর শেষে টার্গেট পূরণ করার ধকল। পেরে উঠি না। নামেই আমার সেলস ম্যানেজারের চাকরি। আসলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। যা কটা পয়সা মাইনে দেয়, তার জন্য জীবনপাত করে দিই। একটা অদৃশ্য হুমকির মধ্যে ঘাড় গুঁজে কাজ করে যেতে হয়। যে কোনও মুহূর্তে ছিটকে পড়ে যেতে পারি উঁচু মই থেকে। নিজেকে একটা অমেরুদণ্ডী প্রাণী মনে হয়। কোনওরকমে আঁকড়ে ঝুলে থাকি খুঁটি। ওটাই আশ্রয়।
বাড়িতে ফিরি। টিভির পর্দায় শব্দ, ছবি। তালিবানরা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে একের পর এক
ইস্কুল। ফুটবল খেলা বন্ধ। বন্ধ ঘুড়ি ওড়ানো। দাবা খেলা। পড়ে কী হবে? শিক্ষার প্রয়োজন
নেই। দরকার নেই আনন্দের উপকরণের। শুধু ভয় পাও, অনুগত হও। তবেই বাঁচবে। খেলা দেখি।
ছুটছে শুধু ছুটছে। একটা গোল পৃথিবী যেন, আর তাকে নিয়ে দৌড় দৌড়। উত্তেজনা, গোল হল কী হল না। হলে ভালো, না হলে ছিঁড়ে ফেল প্রতিপক্ষকে। খাবার টেবিলে বসে রুটি ছিঁড়ি। চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। আজকাল হেলথ কনসালট্যান্টরা বলছেন, স্ট্রেস ফ্রি হয়ে খাবেন। ভালো করে চিবিয়ে খেলে হজম হবে। খাবার পরে একটু পায়চারি। আফটার ডিনার এক মাইল হাঁটতে বললে জাস্ট মরে যাব। সামান্য একটু ঘোরাঘুরি করি। ওই সময় একবার টিভি, মোবাইলে টুকটাক ছবিছাবা দেখি। আর ভাবি, আবার কাল শুরু হবে রগড়ানি।
আমাদের বাবারা এসব ভাবতেও পারবে না।
বাবা দুলছে। একটা বেতের চেয়ারে বসা। পিঠ লাগিয়ে এলিয়ে বসা নয়। সোজা। বাবার
মেরুদণ্ড বেঁকে যায়নি একটুও। বাবার বয়স কত হল এখন? পঁচাত্তর পেরিয়েছে? না আশি?
ঠিক মনে পড়ছে না।
বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
“বাবা, ও বাবা”, আমার ডাকে বাবা একবারও তাকায় না। হালকা একটা দুলুনি রয়েছে
শরীরে। ঠিক যেভাবে আমরা পড়া মুখস্থ করার সময় সামনে পেছনে হেলতাম। সেইরকম।
“বাবা, এখানে একা একা বসে রয়েছ যে?” বলে ফেলে গপ করে গিলে নিতে ইচ্ছে করে
শব্দগুলো। মা চলে গেছে কতকাল হয়ে গেল। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। আমার চাকরি, টুবলুর ইস্কুল আর চন্দ্রার আমাদের পিছনে সারাদিনের ছুটোছুটি। বাবা অনেকদিন একা বসে আছে।
নিরুপায়। অসহায়।
আমার প্রশ্নেও বাবা মুখ ফেরায় না আমার দিকে। কেমন আলগা হয়ে দুলতে দুলতে বলে,
“টু প্যারালাল লাইনস নেভার মীট।”
“অ্যাঁ? কী বললে?”
বাবার কি ভুরু কুঁচকোল একবার? বাবা তো বিরক্ত হয় না। আমি কি ভুল দেখছি?
“প্যারালাল লাইন, সরলরেখা, দুটো সমান্তরাল সরলরেখা, পাশাপাশি চলে, চলতেই থাকে।
কক্ষনও তারা এক বিন্দুতে মিশে যায় না। কখনও না। এমনকি কাছেও আসে না, দূরেও যায় না।
ঠিক এক দূরত্ব বজায় রাখে। একদম এক। সারাজীবন ধরে পাশাপাশি বসে থাকে… একইভাবে বসে থাকে। টু প্যারালাল লাইনস নেভার মীট।”
এসব কথার কী অর্থ কে জানে? কিন্তু বাবাকে তো ঝাঁঝিয়ে বলা যায় না, এই ভর
সন্ধেবেলা তুমি আবার প্যারালাল লাইন ধরে অঙ্কের কচকচি শুরু করলে কেন বাবা? তা’ও
আবার জিওমেট্রি! সমস্ত ছোটবেলা জুড়ে সে ছিল আমার বিভীষিকা। তিনখানা হাতের ত্রিভুজ হোক কি পাঁচমুখো পেন্টাগন, আমার কাছে সব সেই শেষ পর্যন্ত স্কোয়্যার আর সার্কল।
একটা চৌকোনো খাতায় পাকানো পাকানো গোল্লা। সব লাল কালির দাগ। কী ভাগ্যে মাধ্যমিক পেরোনোর পরে আর অঙ্ক করতে হয়নি। অথচ বাবা বরাবর চেয়েছে, আমি অঙ্কে ভালো হই।

অঙ্কে পুরো নম্বর পাই। যেন অঙ্কে ভালো হলেই সে ভালো ছাত্র। রেজাল্ট বেরোনোর পর
তাকে ডেকে জিগ্যেস করতে হয়, হ্যাঁ, তারপর তুমি অঙ্কে কত পেয়েছ যেন? উত্তরে একটা
কমসম সংখ্যা মানেই তাচ্ছিল্যের হাসি। মৃদু উপহাস। ভবিষ্যতে অবধারিত প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে ছাত্রের আত্মবিশ্বাস টাল খাইয়ে দেওয়া।

বাবার ক্ষোভ আছে জানি। অভিমানও। বাবা চাইত আমি অঙ্ক করি, বিজ্ঞান পড়ি।
ভালো ছাত্র হয়ে ইঞ্জিনিয়ার না হই কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট তো হতেই পারি। কিংবা ফার্মেসি
নিয়ে পড়তে পারতাম। বা নিউক্লিয়র ফিজিক্স। রকেট সায়েন্স। মানে, বেশ একটা গালভরা কিছু সাবজেক্ট। যা লোক ডেকে বলা যাবে।
আমি লোক ডেকে বলার মতো তেমন কিছুই করিনি কখনও। মধ্যবিত্ত এবং মধ্যচিত্ত
হয়েই থেকে গেছি বরাবর। পুরো ছাত্রজীবনে খুব সাধারণ। মিডিওকার।
বাবা সেভাবে বলেনি কিছু। কারণ বাবার কথা বলার বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না।
বাবাকে অল্প বয়সেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল পিতৃহীন জীবন। সংসার টানার দায়ভার। তার ওপর ক্রমাগত শুনে যাওয়া ওপার বাংলায় কীরকম গোলাভরা ধান, ক্ষেতভরা ফসল আর বিঘে বিঘে জমি বাড়ি সব লুটে নিয়েছে দেশ ভাগ করা দালালের দল। এপারে শুধুই বঞ্চনা। নেই-রাজ্য। খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। থাকার মধ্যে একটা স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা আর হারিয়ে যাওয়া জন্মভূমি ছেড়ে অনুপ্রবেশকারী হওয়া। সারাজীবন বাবা ওই সংখ্যালঘু হয়ে থেকে গেল। সংসারে, চাকরিতে।
তার মধ্যে বাবা কেবল ভাবত, তার ছেলে, তার মুখে আগুন দেবার একমাত্র
উত্তরাধিকারী, আমি অনেক বড় হব। অন্তত বাবার মতো হব না। সেজন্য লোকটা খুব
প্রাণপাত পরিশ্রম করত। শুধু ভাবনা প্রকাশের স্বাধীনতা পেত না। মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাবার কথা হয়নি কখনও। ঠাকুমা ছিলেন সংসারের কর্ত্রী। তাঁর মৃত্যুর পরে যখন মায়ের হাতে রান্নাঘরের অধিকার এল, তখন সেই স্বাধীনতাকে মা বড় নির্মমভাবে ব্যবহার করেছিল। যে শোষিত হয়, সে শাসকের পদ পেলে…
বাবা তখনও একা একা ভাবত। এখনও তাই।
সবার সব স্বাধীনতা থাকে না। আমার মায়ের যেমন ঠাকুমার ভয়ে গলা খুলে গান গাওয়ার
স্বাধীনতা ছিল না। রান্নাঘর ছেড়ে বাইরে বেরোনোর ফুরসত ছিল না। আমার দিদির যেমন বিয়ে না করে বহুদূর অবধি পড়াশুনো করে যাবার অধিকার ছিল না। তন্দ্রার যেমন বিয়ের পরে শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাক পরার অনুমতি ছিল না। আমার ছেলেরও কি আছে? নিজের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা? তার ওপরে তার মায়ের কড়া শাসন। সে কী পড়বে, কতক্ষণ পড়বে, কোন স্ট্রিমে পড়বে। সব তার মা ঠিক করে রেখেছে। সে কখন খেলবে, কোথায় খেলবে, কার সঙ্গে খেলবে, কতটুকু খেলবে, তা’ও।
ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যাই। বাবা কী যেন বলছিল? প্যারালাল লাইন? নিশ্চয়ই সে
এখন বসে জিওমেট্রি ভাবছে না। সরকারি আপিসের কেরানি মানুষটি সারাজীবন কলম পেষার পর কাদের ভাবছে প্যারালাল লাইন?
“বাবা, তুমি প্যারালাল লাইনের কথা কী বলছিলে?”
“ওই তো, যারা এদিকে দাগ কেটে ওদিকে যায়, আর ওদিকে দাগ টেনে এইপারে ফিরে
আসে। আসলে তারা কেউ যায় না, কেউ আসে না। সবাই যে যার জায়গায় একঠায় দাঁড়িয়ে। মনে হয় যাচ্ছে। যায় না। সবটা আপেক্ষিক। বাইরে শুধু সেনাবাহিনি। মধ্যেখানে সংখ্যালঘু।”
বাবার কথা মাথায় ঢুকল না কিছুই। ছেলের ইস্কুলের ফিজিক্স এর চেয়ে সহজ। কাল
অনেক রাতে বই খুলে বলেছিল, “বাবা, বায়োয়েন্সি বুঝিয়ে দাও।” আমার খাবি খাওয়ার অবস্থা।
এই বয়সে শুধু মনে আছে আর্কিমিডিস স্নানের গামলা থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটেছিলেন ইউরেকা বলে। কতটা জল কোথা থেকে কীভাবে সরে গিয়েছিল, আজ আর মনে পড়ে না। ভাবতে গেলেও নাকানিচোবানি খাই।
আত্মজর কাছে আমি নিজের অজ্ঞানতা স্বীকার করি না। বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না
হয়ে তখন টুবলুকে গম্ভীর গলায় বলি, “আমাকে একটু নিউজটা দেখতে দাও। দেখেছ
আফগানিস্তানে কী অবস্থা! মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত নেই। একটাও দেশ এদের কিচ্ছু বলছে না! কী হচ্ছেটা কি!”
চন্দ্রাকে ডেকে বলি, “স্কুলগুলো আজকাল কী হয়েছে দেখেছ? বেসিক জিনিসটাই ভালো
করে পড়ায়নি! এভাবে এডুকেশন সিস্টেম চলে? যা-তা অবস্থা!”
বাবা দুলছে। আবছায়া শরীর থেকে ভেসে আসছে শব্দ। “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয়
না। একবার মাটির দিকে তাকাও, সব মরে গেছে। লোক মানে পোক।”
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করি, “বাবা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
বাবা বলেই চলে, “আচ্ছা, সব রঙ মিলেমিশে সাদা হয়, না কালো? গুলে ফেললে সব
একাকার। তাই না? সব অন্ধকার। তবু দেখ, যত মত, তত পথ। যত রঙ, তত রংবাজি। বালতিতে ঢেলে একবার গুলিয়ে দে। মরলে সবাই মাটি।”
আমার মাথা ঝিমঝিম করে।

বাবা বলেই যাচ্ছে, “ভুল করে দেশ হয়ে গেল। কাটাকুটি করে ম্যাপ। আর ভাগাভাগি করে
রাজ্য। সব ভুল। সবটাই। আজকে যে বেপরোয়া বিচ্ছু, না না না না, মোটেও গোঁফ হয়নি চুরি, কক্ষনও তা হয় না। সবাই প্যারালাল। সবাই পাশাপাশি, একটা ভ্যানিশ-রাজ্য।”
আমি একবার ভাবি, চন্দ্রাকে ডাকি বরং। বাবার কথার মানে বুঝতে পারছি না যে! ভর
সন্ধেবেলা এসব কি পাগলামি!
চন্দ্রা আমার সব সমস্যা নিমেষে মিটিয়ে দিল। হুড়মুড় করে এসে দাঁড়াল বারান্দায়।
“তুমি এইখানে? কখন থেকে তোমাকে ডাকছি জানো? শুনতে পাচ্ছ না?”
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলি, “আমাকে? তুমি? কেন ডাকছিলে?”
চন্দ্রা হাঁকিয়ে ওঠে, “আরে এসো শিগগিরি। বাবাকে বেডপ্যান দিতে পারিনি ঠিকমতো।
পেচ্ছাপ করে পুরো বিছানা ভাসিয়েছেন। শিগগির চলো। তোশক চাদর সমস্ত পালটাতে হবে। আজ আবার রাতের আয়াটা আসবে না। আমি একা আর কত করব?” গজগজ করতে থাকে চন্দ্রা,
“কাল ডায়াপার এনো তো। আর কত খরচ বাঁচাব? উনি এভাবে যে আর কতকাল…” চন্দ্রা থেমে যায়। আমি জানি ও কী বলতে চেয়েছিল। রাশ টানল কথায়।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি, বারান্দার বেতের চেয়ারে আবছায়া। বাবা নয়। বাবার কথাগুলো
ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে চারপাশে। দক্ষিণের বারান্দায়। ভেজা বাদুলে হাওয়ায়। টুকরো টুকরো কথা। রাষ্ট্রের নির্দেশে সীমান্তে সেজে থাকা সৈনিক। হুকুম পাওয়ামাত্র নিরাসক্ত মুখে চেপে দেবে ট্রিগার, বোতাম। সভ্যতা উড়ে যাবে ধুলো ধোঁওয়া হয়ে। কোথাও কেউ স্বাধীনতা ফিরে পাবে। কোথাও জবরদখল।
কিন্তু বাবার শব্দগুলো তেমন অনুগত সৈন্যবাহিনীর মতো সাজানোগোছানো নয়।
পরিপূর্ণ বাক্য হয়ে ওঠে না। আক্রমণাত্মক তো নয়ই।
বাবা প্যারালাইজড। বছর তিনেক ধরে শয্যাশায়ী। অথর্ব। অর্থ বা অনর্থের কোনও
শব্দই তার কাছে আসা-যাওয়া করে না।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...