যোজন ভাইরাস’- শব্দ, ধ্বনি ও যৌনতা তালাশের এক অপরূপ শিল্পভাষ্য–
তনুময় গোস্বামী

ইতিহাসের কানাগলি আর ধুলো পড়ে যাওয়া অন্ধকার মনের বারান্দাগুলি হঠাৎ-ই সজোরে দুলে উঠলো এক প্রবল কম্পনে। এই তো সেদিনের কথা। রংচটা দেওয়ালের খসে পড়া বালির দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই কেটে গেলো সারাটা সকাল। তারপর, রামধনু তার পাখায় পাওয়া ক্ষণকালের ছন্দটুকু নিয়ে যেভাবে বাতাসে ভেসে বেড়াতে চায়- আমারও তখন সেই নির্ভার ফুরফুরে দশা। বিষণ্ন দুপুরের ধূসর ছায়া মিলিয়ে যাবার আগে আগেই স্পর্শ করলো কয়েকটি পংক্তি,-

‘পেল্লাই দালান। ঢাউস-ঢাউস থাম। বড়-বড় কাটরা। বালাখানা। আওয়াজি। সবই সেই পুরাতনী টাইপ। দেয়ালের ছই ঘেঁষে বেশুমার আগাছা। আর কাদার পলি, থকথকে। বহু বছর মানুষ ঢোকেনি এ-তল্লাটে, কেন-জানি, কমল বুঝে ফেললো। কুকুর? সম্ভবত তারাও পরিত্যাগ করেছে এ মৃতনগরী। কমলকে দেখে ডানা ঝাপটে পালিয়ে গেল একপাল দেহাতি বাদুড়। দেখল, সাপখোপের নিরুদ্বিগ্ন চলাফেরা। চিলছাদে পাখিদের স্মার্ট উড়ে এসে বসা, উড়ে যাওয়া। টিকটিকির অজস্র কাটা ল্যাজ। কিছু পরিত্যক্ত খোলস ও দাঁড়। অষ্টাপদ মর্কটের নিপুণ আল্পনা। ক্ষয়ানো দেয়ালে বারোক ফ্যান্টাসি।’

শব্দ-বর্ণ-চিত্র-ধ্বনির পারস্পরিক সংঘর্ষ অকস্মাৎ  ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্ককে জড়িয়ে নিলো সর্বনাশের নাগপাশে। তারপর কানের ডাইনে-বাঁয়ে মন্দিরার মতো গদ্যের ধ্বনি বাজতেই থাকলো সপ্তম সুরে- শুরু হল বিধ্বস্ত হওয়া। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো ফেলে আসা ভাবনা, সুখদ স্মৃতি, স্থিতাবস্থা। এক ধাক্কায় পাল্টে গেলো পুরোনো ভাবনা আর ফিলোজফি। অস্তিবাদ মানুষকে শ্রেণীগত হিসেবে না দেখে ব্যক্তি একক (Individual) হিসেবেই দেখতে চায়, যেহেতু ব্যক্তির অস্তিত্বের সাথে অনুভূত সত্যও তাঁর নিজস্ব (Subjectivity is truth, subjectivity is reality)। অস্তিত্বের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত স্বাধীনতার প্রশ্নটি। এই স্বাধীনতা- চয়নের স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা, আর এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ব্যক্তিকে নিরন্তর সংঘর্ষ করতে হয় তথাকথিত সামাজিক শেকলের বিরুদ্ধে, ক্ষমতার ডিসকোর্সের বিরুদ্ধে, অন্তর্নিহিত উদ্বেগ-আশঙ্কার বিরুদ্ধে । দেকার্তের ‘আমি চিন্তা করি, অতএব আমি আছি’ (‘I think, therefore I am’)- কে কিয়ের্কেগার্দ প্রমুখ অস্তিবাদী বদলে দিয়ে বললেন- ‘আমি আছি বলেই আমি চিন্তা করি’ (‘I think because I exist’)।

অজিতের উপন্যাসে শুধু আখ্যান (plot) এবং অভিনেতারা (actors) থাকে তা নয়, সাজসজ্জা, দৃশ্য, রঙ অপরাপর উপাদানগুলিও বিদ্যমান। মঞ্চের ওপর নাটক যেভাবে সজীব ও প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে, সেই দৃশ্যমানতার সুযোগ না থাকলেও চরিত্রের অন্তর-বাহির, চেতন-অবচেতন কিংবা ঘটনাসমূহের পটভূমি বর্ণনায় অজিতের লেখার ফ্লেক্সিবিলিটি, সরসতার জন্য তাঁর কাহিনীগুলি আমাদের কাছে থিয়েটার বা সিনেমার মতোই জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই কারণেই হয়তো Marion Crawford উপন্যাসকে ‘pocket theatre’ বলে অভিহিত করেছেন। ইংরেজ ঔপন্যাসিক থ্যাকারে যেমন বলেন, ‘আমার চরিত্রগুলিকে আমি নিয়ন্ত্রিত করি না, আমি যেন তাদেরই হাতের পুতুল, তারা আমাকে যেখানে নিয়ে যায়, সেইখানেই আমি যাই।’

‘দোগলা চরিত্ (৮৮)’, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না (৯২)’, ‘এক জার্নালিস্ট কি মৌত (৯৫)’, ‘পাপারাৎজি (৯৭)’। এরপরেই অর্থাৎ ১৯৯৮-এ ‘যোজন ভাইরাস’-এর আত্মপ্রকাশ। যাকে বলে একদম ধুঁয়াধার এন্ট্রি। যার চেকনাই এখনো, দু-দশক পরও অমলীন। আসলে কিছু লেখক থাকেন যাঁদের এক্সপ্লোসিভ্ এন্ট্রি সমগ্র লেখার পরিবেশ’টা কে জোর ধাক্কা দেয়। তছনছ করে ফেলে। ‘যোজন ভাইরাস’ সেরকমই। একজন লেখক বা শিল্পীর সবথেকে বড় কাজ মানুষের যে static psychological framework-সেটাকে ক্রমাগত disturb করা। যা অজিত রায় সচেতন ভাবেই করেছেন। He reacted like a people’s writer। ওঁর লেখা এবং গদ্য শৈলীর যে অভিঘাত সেটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরদিন লেখা থাকবে। সন্দিপন-এর মধ্যে যে মজা বা স্পার্ক ছিলো সেটাকে পুরোপুরি না নিয়ে, নিজের মাল মশলা মিশিয়ে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন যা একান্ত ভাবেই ‘অজিতীয়’। যেন বাংলা গদ্যকে re-discover করলেন এবং এটাই ওঁর অন্যতম ক্রেডিট। নিছক পপুলারিটি বা গদ্যে ফেস-পাউডার লাগানো নয়, অজিত রায় হচ্ছেন সেই লেখক যাঁর লেখায় সমাজের প্রতিটা স্তরের মানুষ, তাঁদের যাপন- এ সব কিছুরই উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়  এবং অজিত রায় যে focus টা নিয়ে এসেছিলেন সেটাকে maintain করে গেছেন , যা সচরাচর দেখা যায়না। লেখক হিসাবে অজিত রায়ের মনে ‘Aesthetics’ ছিল তাঁর সমগ্র সত্তারই এক বিকশিত রূপ। যার মুলে ছিল তাঁর নিজের দেশ, সমাজ এবং তাঁর বৈচিত্রময় জীবনরেখা। আসলে প্রতিটি লেখকের জীবনেই এমন একটা সময় আসে যখন হাওয়ার মধ্যে ভাবের বাস্প প্রচুর পরিমাণে বিচরণ করতে থাকে। খুব কম লেখকই, মননের চারপাশে জমাট বাঁধা সেই অস্বচ্ছ পর্দাকে সরিয়ে, ভাবের জগতে ঢুঁ মারতে সমর্থ হয়। অজিত রায় সেই বিরল প্রজাতির গদ্যকারদের অন্যতম। পলিটিক্যাল সাইন্স-এ ফার্স্ট ক্লাস এম-এ, এল এল বি  হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র সাহিত্য করবেন বলেই, হেলায় লুফে নেন দারিদ্র্যকে। তিনি মৃত না জীবিত ? ঈশ্বর না ভগবান ? স্বপ্নের সওদাগর না প্রবঞ্চক ?
এই উপন্যাস কে ‘Epiphany’ ? না ‘Orgasmic’ ? কোন স্তরে রাখবো, সেই নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হতে হয়। যেমন ‘দিগ্বলয়’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে অজিত রায় বলেন-
“এ গল্প আমি অন্য জগতে বসে লিখেছি। পাক্কা দেড় বছর আমার ধারেকাছে কেউ ছিল না-শুধু অথৈ নির্জনতা আর নৈঃশব্দ। বই নয়, বউ নয়, লিঙ্গ বা কসমেটিক যৌনতা একরকম বিলুপ্ত ছিল। যে-কারণে ভাষায় সেক্স এসেছে ভাববাহী হয়ে- স্তনের নরম পাহাড় বেয়ে নেমে আসা অম্রফলার মতো। এ-ভাবে সেক্স-অনুষঙ্গেও রচনার বহুমাত্রিকতা আনার চেষ্টা। কোথাও কোনো সরাসরি বর্ণনা এসে থাকলে, দেখবে, সেক্ষেত্রে যৌনতাকে খাঁড়া হিসেবে ঠাউরে মধ্যবিত্ততা বা দোগলাপনাকে ঘায়েল, কোথাও-বা ভাষারই যৌন গড়ন-এভাবে প্রচলধারার গদ্য বানাবার হায়ারার্কিকে চরম খেলো বা অপমান করার চেষ্টা।”
আসলে ‘যোজন ভাইরাস’ ছিল অজিত রায়ের শৈল্পিক সত্তার চূড়ান্ত নিদর্শন । যা পাঠক হিসাবে আমাদের মগ্ন অবগাহনে বাধ্য করে। শিল্পে সৌন্দর্য অনুভূতির বিষয়ে অ্যাকুইনাস (Aquinus) তিনটি নীতির কথা বলেন,- Integritus, Consonantia and Claritas । অর্থাৎ সহজভাবে বলতে গেলে, কোনও বস্তুকে আমরা প্রথমে দেখি এক সম্পূর্ণতার দৃষ্টিতে। তারপর আসে তার সৌন্দর্য, বৈশিষ্ট্য, তাকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বোঝার চেষ্টা করা। সবশেষে আসে তার অন্তর্নিহিত স্বরূপ উদ্ঘাটন। অ্যাকুইনাসের এই নীতিকে অজিত আরোও সূক্ষ্ম ও নিপূণভাবে ব্যবহার করেছেন তাঁর রচনায়। চরিত্র চিত্রণে চিত্রকরের রঙ্ তুলির ন্যায় নিজের কলমকে ছড়িয়েছেন। চিত্রকরের ক্ষেত্রে যেমন মনে আসা ছবিকে সার্থক রূপদানের জন্য একটি দীক্ষিত হাতের প্রয়োজন হয়, ‘যোজন ভাইরাস’-এর ক্ষেত্রেও তেমনি নরনারীর যৌন জীবনকে অবিকল ফুটিয়ে তোলার জন্য একটি দীক্ষিত ও সচল হাতের প্রয়োজন ছিল। যা অজিত রায়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান। অনেকেরই উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকে নরনারীর যৌনতা। প্রত্যেকেই বাস্তবের রূপ নিজের মতো করে উন্মোচন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু একের মানদণ্ড আরেকজনের ওপর খাটেনা। অজিত রায়ের সাথে সাধারণ লেখকের ফারাক এই জায়গায়, যে, প্রথমত, অজিতরা যা দেখেন, তা তাঁরা সাধারণ দশজনকে দেখাতে পারেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক গভীরভাবে দেখতে পারেন। প্রথমটি অবশ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা ও অনুশীলনের ব্যাপার। কিন্তু সার্থক সৃষ্টির কাজে শুধু এগুলিই যথেষ্ট নয়। তারজন্যে দরকার হয় এমন এক গভীর অন্তর্দৃষ্টির, যার মাধ্যমে লেখকের কাজে দেখা দেয় নতুন রূপ, ফর্ম ও শৃঙ্খলা। বৈজ্ঞানিকের মতো একজন লেখকেরও কাজ হচ্ছে নতুন করে দেখা, আবিষ্কার করা। বৈজ্ঞানিক অঙ্ক ও সাঙ্কেতিক চিহ্নের মাধ্যমে আবিষ্কার, গণনা করেন। আর লেখক শিল্পীরা তাঁদের শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ঘটনাবলীকে এমনভাবে তুলে ধরেন, যার ফলে মানুষের চোখে তার মুল্য বেড়ে যায়। এইসব গুণের প্রকাশ নির্ভর করে ব্যক্তিস্বরূপের ওপর, তাঁর উপায়-উপকরণের ওপর। যেমন, গোইয়া বা দ্যমিয়ে তাঁদের ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন শ্লেষ, ক্লোদ ল লোরেনের ছবিতে মহৎভাব, রেমব্রান্টে তীব্র মানবিক অনুভূতি। যোজন ভাইরাসে অজিত রায় নিপূণ হাতে যেন দ্যমিয়ে-লোরেন-রেমব্রান্টকে এক ক্যানভাসে তুলে ধরেন। এবং চরিত্রগুলিকে প্রাণদানের জন্য এখানে তিনি চিত্রকলার মতো মডলিং, ফোরশর্টেনিং, পারস্পেক্টিভ্ কিংবা চলচিত্রের মতো ক্লোজ আপ্, ফেড্ ইনস্, ফেড্ আউট-এর সব কৌশল অথবা ফ্ল্যাশব্যাকের দ্বারা স্মৃতির রোমন্থন করেছেন। অজিত যেন ইচ্ছাকৃতভাবে সচেতন হয়ে এইসব কলাকৌশল গুলির প্রয়োগ ঘটান রানী এবং অন্যান্য চরিত্রগুলির বর্তমান সত্তাকে আবিষ্কারের জন্য।
*
যোজন ভাইরাস উত্তর উপন্যাস গুলির অধিকাংশই পাঠ করে ফেলেছি। যদিও প্রত্যেকের গড়ন-গাঠন একরকম নয়। আলাদা আলাদা। তবে কী, যে, ঐ সমস্ত উপন্যাসগুলি দিয়ে যদি একটি পূর্ণ বৃত্ত আঁকা যায়, আর কেন্দ্রে থাকে লেখকের মস্তিষ্ক, তাহলে প্রত্যেকটি উপন্যাসই সেই কেন্দ্রস্থিত মস্তিষ্কের সাথে সেন্ট্রিপেটাল এবং সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্সের দ্বারা একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কৌশিক চক্রবর্তী যথার্থই বলেছেন, কিছু লেখক থাকেন যাঁরা প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন লেখা লেখেন। নতুন কিছু তৈরী করেন। একটা আলাদা আলাদা segment । আবার কিছু লেখক থাকেন, যাঁদের প্রতিটি কাজই একটি দীর্ঘ continuation-এরই ছোট ছোট অংশ। তাঁদের লেখা আদৌ monocentric নয়। অজিত রায় হচ্ছেন এই দ্বিতীয় ধারার লেখক, যাঁর সমস্ত লেখায়, একটি দীর্ঘ continuation-এর ছোট ছোট অংশ। পাঠক হিসেবে আমরাও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে angle of incidence কে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই continuation-এর পরিবর্তনকে খেয়াল করার চেষ্টা করি।
এখানে আমি একটি দৃশ্যকল্প রচনা করার চেষ্টা করি। ধরা যাক, মঞ্চের সামনে অর্থাৎ দর্শকাশনে আমি বসে আছি বিচারক হিসেবে। যোজন ভাইরাস এবং অপরাপর উপন্যাসগুলি একটি একটি করে মঞ্চস্থ হচ্ছে।  প্রত্যেকটি উপন্যাসের চরিত্র, প্লট, অভিনেতা, আলো, পোষাক, রঙ আলাদা। একে একে, আমি দেখলাম যোজন ভাইরাসের রানীকে, দেখলাম কারগিল হাসিলের দিনগুলির জনিতা’কে, ম্যাওড়াজোনে জীবিকার দায়ে ধানবাদে আসা বিশু ও নিত্যরাম রায়কে, আর্থ-সামাজিক-দৈহিক প্রেক্ষাপটে অনুভব করার চেষ্টা করলাম  জোখিম কোরকাপের মেঘনা’র চরিত্রের সূক্ষ্ম দিকগুলিকে। সবশেষে কাঁটাছেড়া করতে বসলাম যোজন ভাইরাসের চরিত্রগুলিকে।
রানী নামক বৃত্তটি কন্সট্যান্ট, আর কমল এবং বাবর নামক বৃত্ত দুটি পরিবর্তনশীল। লেখকই এখানে বাবর, আবার লেখকই কমল। প্রথম ব্যক্তি হচ্ছে বাবর, যে গল্পটা বলছে। সে আবার এক দ্বিতীয় সত্ত্বাকে নিয়ে আসছে, কমল, এবং তাকে দেখছে। কমল কিন্তু সরাসরি বাবরকে দেখছে না। কথা বলছে বাবরের সাথে, কিন্তু তাকে দেখছে না। অন্যভাবে যদি দেখি, বাবর হচ্ছে মঞ্চের একপাশে চুপ করে বসে থাকা দর্শক। অবজারভার। কমল রানীকে দেখছে। রানীর সাথে কমলের সম্পর্কের সুতোর গাঢ়ত্ব, রানীর সাথে সাথে বাবরের সম্পর্কের তুলনায় বেশী। বিশিষ্ট কবি, সমালোচক বারীন ঘোষাল বলছেন, “রানী আর কমলের মধ্যে যা হল, তার দর্শক না থাকলে পাপটা টের পাওয়া যায়না। পাপ মুখে লেখা থাকে না। কিন্তু উপন্যাসটার যে অংশে বাবর দর্শক হিসেবে উপস্থিত নেই, সেখানে দর্শক কমল। কমলের পৃথিবী রানী নয়। কমলের পৃথিবী হল প্রেম এবং তা থেকে কামাসক্তি। তাই সে যখন দেখার চেষ্টা করে রানীর মধ্য দিয়ে, সে একটা শুন্যে পৌঁছে যায় সত্য ও মিথ্যার মিলনে। নিষ্ঠ এবং অনিষ্ঠ এমন একটা ফাঁপায়- এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় দুজনেই, কমল এবং রানী। সম্পর্ক ভেঙে যায়। রানী, তাকে ঠিক ভাবে দেখা হয়নি বলে আক্ষেপ করে, মাত্র ‘দেখা হয়নি’ বলে নয়। এবং এই দেখার মধ্য দিয়ে কমলের শূন্যতাবোধ।” মূল ঘটনাক্রম আমরা দেখছি কমলের মধ্য দিয়ে। কমল রানীর স্বামী। কমল চরিত্রটি গোঁড়ামি মুক্ত। সে তার বউকে বাবরের সাথে শুতে দেখছে। বলে, ‘বউ ব্যাপারটা হলো অনেকটা লেকস্যান্স সেলের মত। ঘনঘন চার্জ না করলে বউয়ের কাছ থেকে একটা জিনিশ চিরকাল পাওয়া যায়না। ইউ নো, ভালোবাসা, আর’। তার নিজের বউকে অন্যপুরুষের শয্যাসঙ্গী করে জেনে নিতে চায় জীবনের সত্য-অসত্য, ভালো-মন্দ গুলিকে। এক কঠোর নিদারুণ ঘূর্ণিঝড় কে প্রত্যক্ষ করার জন্য সে দেখেতে চায় এক গুমোট নিম্নচাপ কে। সকালের আলোয় স্নাত হওয়ার জন্য সারারাত ঘনকালো অন্ধকারে ঠাই বসে থাকে।  অদ্ভুত এক multidimensional reflections of crisis, shifting of crisis from one point to another । আর এভাবেই শেষ পর্যন্ত কমলের বিয়োগ অর্থাৎ আত্মসমর্পণ। হেরে যাওয়ার বিষাদের মাধ্যমে লেখক উপন্যাসের ইতি টানেন।  
*

রোঁলা বার্থ আধুনিকোত্তর সাহিত্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, “The literature of exhusted possibility”। অজিতের লেখার মধ্যেও আছে সেই “exhusted possibility”। অজিত রায় মানেই বাংলা গদ্যের এক জাম্প। যে জাম্প কোনও বাধা মানে না। অজিত রায় মানেই বাংলা গদ্যের এক ভিন্নতর সুর, এক অন্যতম প্রত্যয়। তিনি লেখেন, “মানুষের সেক্স একটা অর্গানিক ট্রুথ।  আহার, নিদ্রা আর মলসাধনের মতই নিখাদ শরীরচর্চা।  কিন্তু কপুলেশন বা মৈথুন বা তসলিমার দি গ্রেট সরাফমামু যারে কয়েছেন ‘ড্যাস-ড্যাস’, সেটি ভদ্দরপুঞ্জে সহজ উচ্চারণ নয়। কেননা এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অ্যাসটোনিশমেন্ট আর ভ্যাজাইনাল সেন্সিবিলিটি। যে কারণে এত জরুরি একটা কাজ আমাদের অন্যান্য জৈবিক কারবার থেকে বেপোট হয়ে গ্যাছে। এটা ওই ভদ্দরপুঞ্জের টুলোদের কারসাজি। ওরাই সামাজিক ট্যাবু ম্যানুফ্যাকচার করেছে। শ্লীল-অশ্লীলের মধ্যে ভিড়িয়ে দিয়েছে কোঁদল। ওই কোঁদল আর তার অ্যাডহিরিং লুকোচাপার দরুন এদেশের ফিল্ম এবং সাহিত্যেও যৌনতা দেখানো হয় পারভার্টেডলি। বলতে পারো, যৌন বর্ণনা বা ছায়াকরণের ক্ষেত্রে মোটামুটি পর্নোগ্রাফিকেই উল্টো ছাঁদে সার্ভ করে আসছেন এ দেশের সমস্ত গঙ্গাজলী রাইটার-ডিরেক্টররা।”
এ থেকে আমরা সহজেই বুঝে যাই, আজিত রায় আর যাই হোক গদ্যের প্রচল পথে হাঁটবেন না। হাঁটেনও নি। আশির দশকের গদ্যকার অজিত তাঁর সময়ের সবচেয়ে স্বতন্ত্র ও মৌলিক গদ্যকার। স্বকীয় এবং মৌলিক বলেই তিনি দীপ্ত কন্ঠে আঙুল উঁচিয়ে বলতে পেরেছেন,  “আমার সমস্ত উপন্যাসেই ‘নারী’ পুরুষের ইন্টেলেক্ট থেকে আঁকা। কিন্তু একজন বখাটে খানাখারাব হলে কি নারীদেহের মহার্ঘ পার্টসগুলোকে আমি অন্য চোখে দেখতাম ? হয়ত, একদমই না। এ ব্যাপারে ভদ্দরলোক বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা। মাথার শিরোজ থেকে গোড়ের পদরজ, একটা হোলদামড়ি নারীর কী-ই না ভাল্লাগতো কালিদাসের ! তবে আমার-মতো উনি কতখানি সাধুলোক ছিলেন, খটকা আছে। সাধুমণ্ডলে নারীর অষ্টোত্তর শতনাম। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী —– এসব তো মানুষের নিজস্ব এলেমে হয়নি, খোদ বিশ্বকর্তা নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন। ফের এদের মধ্যে শঙ্খিনী আর পদ্মিনী হলো ‘আইটেম’ বিশেষ। তেনার ‘অন্তিমের মার’ও বলতে পারো। একা তুমি কেন, বাইবেলেও বলেছে, নারীই বিধাতার শেষ সৃষ্টি। ‘হে শুভদর্শনা’, অশোক ফরেস্টে সীতাকে দেখে রাবণ কেলিয়ে গিয়ে বলছেন, ‘আমার মনে হয় রূপকর্তা বিশ্বনির্মাতা তোমায় রচনা করেই নিবৃত্ত হয়েছেন, তাই তোমার রূপের আর উপমা নেই।’ অথবা, ঈভার প্রতি মিল্টন : ‘ও ফেয়ারেস্ট অফ ক্রিয়েশন, লাস্ট অ্যান্ড বেস্ট / অফ অল গড’স ওয়র্কস’।”
‘যোজন ভাইরাস’-এ যৌনতা কখনো বিষয় আবার কখনো সর্বাত্মক ক্রাইসিস হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। আঙ্গিকের রকমফের লক্ষ্য করা যায়। কোনো একটি পার্টিকুলার ডাইমেনশান্ দিয়ে বিচার করতে গেলে পাঠককে বে-বকুব বনে যেতে হয়। আসলে তা মাল্টিডাইমেনশনাল্। তিনি যৌনতাকে এক দার্শনিক বিস্তারের দিকে নিয়ে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে এক অসম্ভব আধ্যাত্মিকতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছেন আমাদের । এভাবেই আত্মকে আবিষ্কার করে জীবনের গোপন বেদনা স্রোতের বিরূপ হওয়ার দর্শন অজিতের গদ্যে জ্বলজ্বল করে ওঠে। ক্রাইসিস চিনিয়ে দেওয়ার জন্যে তথাকথিত হিপোক্র্যাট, যারা ছেঁদো ব্যাকরণ-গন্ডীর চালুনি নিয়ে বসে আছেন, তাঁদের কাছে এই সমস্ত উপাদান তো অশ্লীল ঠেকবেই। তাঁদের তথাকথিত সাংস্কৃ্তিক অভিযোজন থেকে অজিত শত-যোজন দূরে সম্পূর্ণ অন্য ধারায় চলে গেছেন। ‘কাফকা, আমাদের’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেছেন, “অশ্লীলতা অপবিত্রতাই হচ্ছে সেই গভীর তল যা তুমি লক্ষ করবে তোমার খুব নিকটেই উপস্থিত আর সে গভীরতায় না আছে লাভা, না আছে আগুন, আছে কেবল নোংরা অপবিত্র বস্তুরাজি, আছে কেবল অস্লীলতা। এই-ই হচ্ছে নিম্নতল এবং অথবা উপরিতল।” এই সত্যেরই এক সূক্ষ্ম নিদর্শন মেলে যোজন ভাইরাসে,-
“রানী যখন তার চামড়ার ঘ্রাণ আর জেল্লা সমেত কমলের সামনে এসে দাঁড়ায়, যখনই, পেঁয়াজের ছিলকার চেয়েও মসৃণ অংশকুট এবং বেশ-কিছু নিচে চর্বি ঝরে যাওয়ার পরেও অবাক-হারে ওলন ও চোস্ত তার বক্ষগোলক-দুটি, স্রেফ ও-দুটি, কমল তো ভেবেই অস্থির হয়ে ওঠে, এ মেয়ে স্রেফ বদিসের হুক খুলে দিলেই তার, কমলের, সারাজীবনের লেখা স্থগিত থেকে যাবার পক্ষে এন্তার। এমনই উত্তুঙ্গ, এমনই উচ্ছ্রায়ী, এমনই সুডোল, এমনই দ্রড়িষ্ঠ সে-দুটি। এবং পুরো চিৎবুক হলেও একেবারে প্লেট হয়ে মিলিয়ে যায়না সে-দুটো।”
কিংবা-
“…তার শান্ত শীতল শরীর বহুদিন পর হঠাৎ কেমন উষ্ণ-চাঞ্চল্যে নাড়ান দিয়ে উঠছে যেন। ঠাহর করে, কমল তাঁর শায়ার ফাঁসও ঈষৎ আলগা করে দিল। এখন রানীর হাঁটু থেকে জঘন, জঘন থেকে নাভি, নাভি ও নিতম্বের উতলা ঢেউয়ের চারপাশে, দেহের থরে-বিথরে থাবা হয়ে ঘুরে বেড়াবার অবাধ অভয়ারন্য।”
যৌনতা এমনই স্বাভাবিক। স্বাধীন। এ কোন অশ্লীলতা নয়, স্বাভাবিক জীবনছন্দ। এ কোনও আরোপিত বিষয় নয়। নির্বাধ রতিবাসনা। যে নারী একদা ছিল যৌনসামগ্রী, এখানে সে যৌনতার নিয়ন্ত্রক। অজিত রায় যৌনতার নব ভাষ্যকার –
“তো, সেই রানীই কালক্রমে সিরোজে সিঁদুর পরে, নিজে ও নিজের অন্যান্য মাল সহ উঠে আসে কমলের ছোট্ট একফালি কুলায়। সে সেই সাত বছর আগেকার কথা। তারপর দৃশ্যত মামুলি সব আলনা কাসকেট পোর্টম্যান্টো সুটকেস কোলাঙ্গ আর চেস্ট অব ড্রয়ার্স থৈ-থৈ করতে থাকে তার গুলতান কাতান বালুচর পেটিকোট শেমিজ জিনস চুড়িদার সালোয়ার স্লিপ করসেট আর ব্যবহৃত-অব্যবহৃত অনন্ত-অফুরন্ত-সব ব্রেসিয়ারে ।”
যৌনতার গতি এক অমোঘ ক্রিয়াগতি। বৌদ্ধরা স্বভাবতই স্ত্রী-উন্নাসিক । কিন্তু বৃদ্ধ ভিক্ষুকও সদ্যভিক্ষুণী কিশোরীর সংস্পর্শে এসে এক কিশোর হয়ে যান। এ হল মানব মনের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা আদিম পাশবিক প্রবৃত্তি। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড তাঁর ‘Psychopathology of Everyday Life’ শীর্ষক গ্রন্থে একথা বলেন। বিনয় মজুমদারের কাছে যৌনক্রিয়া তো মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘কীর্তি’ বলে বিবেচিত। ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যের ‘আরো বেশি ঘন ঘন’ শীর্ষক কবিতায় বিনয় লিখেছেন,-
          “আরো বেশি ঘন ঘন বসবার ইচ্ছা হয় ; বসেই দেখেছি
          এত বেশি সুখ আর কোন কিছুতেই নেই ; কবিতায় গানে
          এত বেশি সুখ নেই ; অনেক দৃশ্যই আমি জীবনে দেখেছি
          তবুও দেবীর দেহ, দেবির বাতাবী গ্রাস সকলের সেরা।
          এদের মতন এত সৌন্দর্য রোমাঞ্চ আর কোনো কিছুতেই
          পাইনি, পাব না, তাই বুঝি সে বসাই হল আসল ব্যাপার।
          গ্রাসের ভিতরে স্তম্ভ পুরে দিয়ে ঢেউ দেওয়া- এই ব্যাপারের
          তুল্য অন্য কোনো কীর্তি মানুষের নেই বলে টের পাই।
          ফলে বুঝি বসা হল মানুষের জীবনের কর্তব্য, হয়তো
          একমাত্র কর্তব্য…. ”

কবি আস্বাদিত এই নির্মল অনুভূতি কোনও ব্যক্তিক সত্য নয়, তা সর্বজনীন সত্য। যৌনতা জারিত এই বোধ শরীর ও সত্তাকে এক সুত্রে গেঁথে দেয়।  “গ্রাসের ভিতরে স্তম্ভ পুরে দিয়ে ঢেউ দেওয়া”-র অর্থ যৌনক্রিয়া। আর ‘বসা’ হচ্ছে অনিবার্য প্রবৃত্তি- ‘মানুষের জীবনের কর্তব্য- হয়তো একমাত্র কর্তব্য’। ‘দুজনের অতি ব্যক্তিগত’ কবিতায় বনয় যৌনতার পক্ষে আরও জোরালো সওয়াল করেন- ‘রতি রক্তিমতা দিয়ে প্রীতি সদৃশ্যতা আনা যায়,/ কেবল সঙ্গমক্রিয়া সব কার্য সম্পাদন করে।’ অস্তিত্ত্বের মূলে রয়েছে যৌনতা ।
অজিতের গদ্যে যৌনতা খোলামেলা। তাতে দোষের কী আছে ? আমাদের সংস্কৃত সাহিত্য গুলিতে তো কাম অকপটে উপস্থিত আছে। নয় কী ? মানব আদিম অস্তিত্ত্বের সঙ্গে যৌনতা জড়িয়ে রয়েছে। তা চিরকালীন সত্য। আর সত্যের অবদমন চলে না । মানব জীবনের সমস্ত আচরণ ও ক্রিয়াকলাপকে তো ফ্রয়েড যৌনতার নিরিখেই বিশ্লেষণ করেছেন । মিশেল ফুকো তাঁর “The History of Sexuality” গ্রন্থে যৌনতাকে মানুষের সার্বিক সত্তার সঙ্গে সংশ্লেষিত স্বরূপ বলে বিশ্লেষণ করেছেন। অজিত লিখছেন, “বাংলা সাহিত্যেও নারীর উপমা যে একেবারেই নেই, সেটা বললে বাওয়াল হবে। তবে আমি আমার কথাই বলব। আমি রানীর বুকে কান পেতে শুনেছি সমুদ্রের কলকল। নারী সমুদ্র ছাড়া আর কী, বলো ! হোক নোনা। কিন্তু নোনা থেকেই লোনা। লোনা থেকে লবণ। লবণ থেকে লাবণ্য ।  কত নুন খেয়েছো  ! সব নুন কি তোমার দেহে ? আর খেয়ো না । এতে সৌন্দর্য হারায়। অবিকগুলি খসে-খসে সহসা খোয়ায় ।” ‘নগ্নতার সৌন্দর্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর লখেছেন – “নগ্নতার সৌন্দর্যে প্রাণ সম্যক প্রস্ফুটিত।….নগ্নতায় সৌন্দর্যের কনক-মিলন । নগ্নতা পরমাসুন্দরী।” অজিতের কাছেও নগ্নতা যেন পরমাসুন্দরী, –
“চেয়েছি টরসো মূর্ধা সৃক্ক নোলা কল্লা সিনা রাং নিতম্ব পয়োধর নাভি যোনি নবদ্বার সম্বলিত একটি পূর্ণাবয়ব নারী, যাকে স্পর্শ মাত্রের লহমা থেকে শব্দের স্রোত ধেয়ে আসবে বেবাক এবং প্রতিরোধহীন। স্ব-পরিচয়হীনা, জন্মহীনা, ইতিহাসহীনা, নিয়তিহীনা সেরকম কোনও নারী আজও আমার উপজ্ঞার বাইরে রয়ে গেছে। দ্য বেস্ট রিলেশান বিটুইন আ ম্যান অ্যান্ড আ উওম্যান ইজ দ্যাট অফ দ্য মার্ডারার অ্যান্ড দ্য মার্ডারড। দস্তয়ভস্কির কথাটাই কি তবে মোক্ষম ? নারী পুরুষকে হালাল করবে, তার আগেই নারী বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত-সব বাহারি শব্দঘোঁটের বিছেহার জোর করে লাথিয়ে ভেঙে ফেলা দরকার যদ্বারা উদ্ঘাটিত হবে নারীর মৌল স্বরূপ।”
যোজন ভাইরাসের অজস্র বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হল অবচেতনজাত ভাববোধ। ডঃ শিবাজী প্রধানের মতে, “যোজন ভাইরাসের অর্ধেকটাই বুঝি অবচেতন থেকে লেখা। তার সঙ্গে রয়েছে সুররিয়ালিজম ও শব্দজাদুর খেলা।” কমল যখন রানীর সঙ্গে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হচ্ছে তখন কমলের সচেতন মন রানীর সঙ্গে মিশছে আর অবচেতন মন কমলকে লক্ষ্য করছে। এই ধরণের  বর্ণনা আমরা পাই কাফকার ‘দ্য কাসল্’-এর চতুর্থ অধ্যায়ের শুরুতে কে আর ফ্রিডার রতিক্রিয়ায়। একটি মাত্র বাক্যে তা বিবৃত,- “তার সঙ্গিনীও কিছু একটা খুঁজে চলেছে, সেও কিছু একটা খুঁজে চলেছে, পাগলের মতো, বিকৃতমুখে, খুঁজতে খুঁজতে মাথা ঠেসে ধরছে একে অন্যের বুকে……।” সুইডিশ ভাষাবিজ্ঞানী ‘স্পারবার’-এর মতে মানুষের ভাষার উৎস ও বিবর্তনের প্রধান কারণ যৌনতা। এটা হয় দু’ভাবে । এক, যখন ক্ষুধার্ত শিশু তার মায়ের জন্য কাঁদে । এবং দুই, যখন কামজর্জর পুরুষ তার সঙ্গিনীকে ডাকে এবং প্রত্ত্যুত্তর পায়। কমল রানীর রতিক্রিয়া , মানে, spirit of sexuality মাঝে মধ্যে এমন স্তরে পৌঁছাচ্ছে, যে, তা প্রায় হিংস্রতায় পরিণত হচ্ছে। সমরেশ বসুর ‘বিবর’-এ আমরা হিংসার বিবরণ পেয়েছি। কিন্তু যোজন ভাইরাসের শ্রেষ্ঠত্ব এই জায়গায়, যে, তা যৌন বিবরণে সকলের থেকে অনন্য। আবার কমল-রানীর মধ্যে যৌন বিবরণ এক্সট্রিম লেভেলে যাচ্ছে যখন বাবর সেন তাদের মাঝে চলে আসছে। কমল বলে ওঠে, “আমি মোদো মাতাল হতে পারি, যৌনলোলুপ, পারভার্টেট, সাইক হতে পারি। কিন্তু হিপোক্র্যাট না।” আবার জীবন তাকে শিক্ষা দেয়, “শুধু সেক্স দিয়ে তো পুরো ভাতটা মাখা যায়না, তার সঙ্গে মুলো বেগুন পালঙের একটা ঘ্যাঁট অন্তত লাগে । মানে, ঐ যাকে প্রেম বলে আর-কি।” শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘শব্দ আর সত্য’ নামক গ্রন্থে বলেছেন- “যৌনতা অমোঘ”। একে কোনভাবেই বাঁধা যায় না। প্রবল তার শক্তি। ‘গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ – যুদ্ধ ও যৌনতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে অরুনেশ ঘোষ বলেছেন, “খোলামেলা যৌনতা মার্কেজের লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে, ওইসব দেশের নারী ও পুরুষের জীবনকে একটা উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছে।” অজিতও খোলামেলা যৌনতার পক্ষেই সওয়াল করেছেন। কমলের ভাবনা দিয়ে বলছেন ঃ
“আমি যে লিখতে পারছি না, আমি জানি, এ আমার যৌন অতৃপ্তির প্রতিদান। এক নিরন্তর পাপ ও তার জিন আমাকে অতৃপ্ত রেখেছে। ঐ জিনই আমাকে লিখতে দিচ্ছে না। আমি লিখতে তখুনি পারবো যখন এই শায়িত ধূসরিত বহুধর্ষিত নারীটিকে আমি সমগ্রভাবে পাবো। শুধুমাত্র অভিজ্ঞান দিয়ে নারীকে গর্ভবতী করা সহজ কিংবা সমাজ-অনুমোদিত উপন্যাস । অথচ যে-সৃষ্টি আমি দিতে চাইছি, যে নির্মাণ, তাতে স্রষ্টাকে সর্বাগ্রে হতে হয় হারমাফ্রডাইট, পক্ষান্তরে উভলিঙ্গ। আমি নিজেকে নিজের প্রেক্ষিতে এবং তোমাকে তোমার অধিধ্যানে সুসম্পূর্ণ জেনে নিতে চাই মিলি। তুমিই কি সেই, যা আমার অন্তরাত্মার বহির্বাস ?”
একজন স্রষ্টাকে তার মানে সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত হতে গেলে, তিনি উভলিঙ্গের কথা বলেছেন । ভাবায় আমাদের ! তিনি নারীর যোনিতে বিশ্বদর্শন করেন । বোদলেয়ার প্রথম ফরাসি কবি, যিনি পাপ থেকে সৌন্দর্য খুঁজে আনেন । বুদ্ধদেব বসুর আনুবাদে পাই, “আলোর স্তম্ভ নারকী স্থাপনায় ধন্য/…পাপকর্মের অবিকল চৈতন্য !” বোদলেয়ার যেভাবে ‘ফ্ল্যর দ্যু মাল’ কাব্যের মধ্যে আধুনিক কবিতার বীজ পুঁতে রেখেছিলেন। অজিত তেমনি যোজন ভাইরাসে ‘উত্তর আধুনিকতার’ চারা রোপণ করেছেন। হাংরী আন্দোলনের অন্যতম লেখক সমীর রায়চৌধুরী অজিতের গদ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তা স্বীকারও করেছেন। শয়তান কেন্দ্রিক ভাবনায় আধুনিকতার প্রথম লক্ষণচিহ্ন দেখা যায় বোদলেয়ারে, পরে তা পূর্ণতা পায় র্যাঁবোতে, তেমনি যৌনতা কেন্দ্রিক আধুনিকতার যে পুর্বাভাষ সন্দিপনে পাওয়া গেছিল, সেই বৃত্তটি সম্পূর্ণ হয় অজিতে।  সৃষ্টির শুরুতেই কে যেন বলে দিয়েছিল, ‘দেখো’। এই দেখার মধ্যেই গতি, দেখার মধ্যেই প্রগতি। আর এই দেখার বিবর্তন ঘটে চলেছে সময়ভেদে, স্থানভেদে। আমরা সাধারণরা যা দেখি, শিল্পীরা তার থেকে বেশিই দেখে, তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে। অজিতের অন্তর্দৃষ্টি দেখুন ঃ
“সত্যি, এক বিশাল মহাযোনি পয়োধি এই নারী। আর পুরুষ কেসটা হলো, অই উষ্ণু মাংসল অলীক পাথার-কিনারে বাল্বের ছেঁড়া ফিলামেন্টের মতো অধীর কাঁপুনি সহ দাঁড়িয়ে থাকা পৌনে ছ’ফুট লম্বা একটা হাইটেন্ডেড ও ব্যবায়ী পুরুষাঙ্গ মাত্র। মাইরি একটা কথা কী জানো, খুব কৈশোর থেকে একজন পুরুষ তার যৌন-অহংকার নিয়ে তিল-তিল করে গড়ে ওঠে, স্রেফ, একজন নারীকে জয় করবে বলে।”

মার্কেজে যেমন যৌনতার অভিমুখ পুরুষ থেকে নারীর দিকে। বিনয় মজুমদারেও তাই । কিন্তু অজিত রায়ের ক্ষেত্রে দুই’ই বিদ্যমান। ‘যোজন ভাইরাস’-এ অভিমুখ পুরুষ থেকে নারীর দিকে আবার ‘জোখিম কোরকাপ’-এ নারী থেকে পুরুষের দিকে। বিনয়, অরুনেশ, মার্কেজ, অজিত-এঁরা ‘পূর্ণ সংগম’-এর চিত্র তুলে ধরেছেন ফ্রয়েডীয় যৌনবিজ্ঞানের সূত্র মেনে। মার্কেজের মতো এঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাব্যে, গদ্যে পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তবে বিনয় যেমন যৌন প্রতীকের ব্যবহার করেছেন, সেখানে অজিত সরাসরি যৌনাঙ্গের নাম তুলে ধরেছেন। বিনয়ের কাব্যে,-
লিঙ্গ = ভুট্টা/ স্তম্ভ/ থাম/ চন্দনকাঠ
যোনি = গুহা/ হ্রদ  
স্তন = কমলালেবু/ বেল/ বাতাবী ইত্যাদি।
সেখানে অজিত সরাসরি জঘন, শ্রোনী, স্তন, কোথাও পাছা কোথাও নিতম্ব, ভাপানো বুক, নুনু, নঙ্কু, বীর্য, নাভি ইত্যাদির কথা বলেছেন।
‘যোজন ভাইরাস’ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৯৮-এ, সেখানে মার্কেজের ‘মেমোরিজ অব্ মাই মেলানকলি হোরস’ ২০০৫ এ । জানিনা, মার্কেজ এ উপন্যাস পড়েছিলেন কী না ! পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে দু’জন লিখছেন। অদ্ভুত মিল। দুই ক্ষেত্রেই লেখক অবতীর্ণ হচ্ছেন পুরুষের ভূমিকায়। এবং যৌনতার অভিমুখ পুরুষ থেকে নারীর দিকে  প্রবাহিত হচ্ছে। তবে অজিত যেমন যোজন ভাইরাসে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় যৌনজীবনের ভৌতধর্ম মেনে চলেছেন, তেমনি জোখিম কোরকাপে আবার নারীর চোখ দিয়ে যৌনতাকে দেখিয়েছেন ।  যৌনতার নারীবাদী বিশ্লেষণ।
একজন শিল্পীর প্রধান কাজ হচ্ছে, মন ও আত্মাকে তার নিজের সৃষ্ট জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে অবলোকন করা। অষ্টাদশ শতকের অনেক সমালোচকের মতে, কাব্য-গদ্য বাস্তব থেকে দূরে গভীরে নিয়ে যায় চেতনাকে। অজিতের উপন্যাস মাঝে মধ্যে বড়ো বেশী করে বাস্তবের গহ্বরে নিয়ে চলে যায় পাঠককে ! কখনো কখনো নিজেকেও অদৃশ্য সাক্ষী করে এনে টেনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন লেখার মধ্যে। ‘যো-ভা’ তে যা আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি। যেমন ঐ পংক্তিটি, “সংবিত্তি ফিরলে কমল প্রথম যে প্রাণীটির অস্তিত্বের কথা জানতে পারে, তার নাম কমল।” সন্দিপন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, এ লেখা নিশ্চয় ভুতের ! এ মানুষের সাধ্যাতীত। আবার অন্য এক জায়গায় ‘যো-ভা’ তে বলছেন, “এমনিতে জিন্স্। তবে শাড়ী পরলে শ্রোণী যেন থাকে ফেঁপে। ভাপানো বুক। বার্ন্টসিনা বোঁটা। বোম্বাই নলকীনি। মুঠো খানেক মুজঘাস। কিংবা মধুকুপি। পাকাপোনার পেটির সদৃশ সিংহদ্বার । পাল্লা সরালে সদ্য পেড়ে-আনা ভূতকেশী ফুলের পারফিউম ।” এখানে এই বর্ণনা আমাদের গায়ে শুধু চিমটি কাটা নয়, শরীরের ভেতরে স্পাইনাল কর্ডে এসে চাবুক মেরে দিয়ে যায় । যেখানে একটি বিরাট আকারের টারবাইন্ অনবরত মুভ্ করছে আর প্রশ্ন করে চলেছে, আমি কে ? আমি কে ? আমি কে ? হয়ত বা এই কারণেই কেউ একজন উত্তর দিয়ে চলেছেন, অজিত রায় আসলে একজন ঔপন্যাসিক, একজন দার্শনিক, একজন সন্ত, একজন মানব জীবনের দরদী ভাষ্যকার। আসলে মাঝে মাঝে আমরা অস্পৃশ্যদের দলে চলে যায়। নিজস্ব সত্ত্বাকে চিন্তে ভুল করি। কেঁজ়ো হয়ে পড়ি ক্রমশ । প্রতিস্ঠান তাদেরই চুম্বন করে যারা পরাধীন-নির্বীজ। স্বাধীনতাকে নিজের মধ্যে প্রত্যক্ষ করতে গেলে তার অবস্থা চন্ডিদাস, দান্তে, মধুসুদনের মতই হয়, তবে অভিযাত্রাটা থামেনি। স্বপ্ন সফল হোক কিংবা বিফল ! স্বপ্ন দেখে যেতে হবে আজীবন। যুগযুগান্তরের কাব্যে-রচনায়-গদ্যে-আলাপে যৌনতা যেভাবে এক মোড়কের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিল, অজিতের গদ্য তাকে ভেঙে-চুরে একশা করে দিয়েছে।
‘ইগনোরেন্স’ (২০০০) উপন্যাসে মিলন কুন্দেরা যৌনতার মধ্য দিয়ে নর-নারীর ভালোবাসা ও মনুষ্যত্বকে খুঁজতে চেয়েছেন। যৌনতা সেখানে চৈতন্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। অজিতের ক্ষেত্রে যৌনতা কোন কোন সময় পারস্পরিকতার ফলে নৈতিক হয়ে উঠছে। ‘একদিন’ পত্রিকা (১১.১০.২০১১) লিখছে- সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ৬৫ শতাংশ বিবাহিত মহিলা এবং ৮০ শতাংশ বিবাহিত পুরুষেরই গোপন সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন গবেষক ইরিন ক্র্যাশনো ‘দ্য সিক্রেট লাইভস অব্ ওয়াইভস’ গ্রন্থে লিখেছেন, গোপন ও নিষিদ্ধ সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া মহিলারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবনে সুখী। স্বামীকে ‘কো-স্টার’ করে তারা জীবনের সৌন্দর্য খুঁজেছেন। শরীর ও মনের সুষম সায়ে যৌনতার নিপূণ বুনন ঘটিয়েছেন অজিত তাঁর যোজন ভাইরাসে। যৌনতার সেখানে মানব জীবনের প্রতীক হয়ে উঠছে। মার্কেজের ‘মেমোরিজ অব্ মাই মেলানকলি হোরস’ (২০০৫)- এর আগে অজিতের যোজন ভাইরাস। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তিনি মার্কেজের অগ্রবর্তী। মার্কেজের মতো অজিতের উপন্যাসের ম্যাজিক রিয়ালিজমের মধ্যে রয়েছে আত্মপরিচয় সন্ধানের উদগ্র তাগিদ। খুঁজে বেড়িয়েছেন সত্ত্বার অর্থ। জীবনানন্দের ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে নরনারীর মধ্যে কোনরকম যৌন-তৎপরতা নেই। হয়তো অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা না থাকায়, নরনারীর যৌন জীবনে শীথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জীবনানন্দের অধিকাংশ পুরুষ চরিত্রই অবসন্ন, যৌনজড়, অজিতে সেখানে যৌনচঞ্চল।  
অজিত দা’র সাথে ব্যক্তিগত কথালাপে জানতে পারি, জঁ পল সার্ত্র-এর জীবন ও সৃষ্টি তাঁকে গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে । বিশেষ করে সার্ত্র-এর ‘ইরোস্ট্রেটাস’। যেখানে পল হিল ভিয়ার-এর জীবন-দর্শনের সঙ্গে ‘যোজন ভাইরাস’-এর কমল কে ছাঁচে ঢেলে পরখ্ করে নিতে চেয়েছেন। সুন্দরী তরুণীকে হোটেলে ডেকে নিয়ে ভিয়ার তাঁকে নগ্ন হতে বলছেন। শুষে নিতে চাইছেন তার শরীরি ঘ্রাণ। আবার পরক্ষণেই জেগে উঠছে মানুষের প্রতি ভিয়ারের ঘৃণা-বিদ্বেষ-খোঁটামি। ঠিক যেভাবে আমরা কমল কে মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণা-দ্বেষ’এ ভরে যেতে দেখছি,-
“….. ওফ, টস করেও বোঝা দায় এই মেয়ে জাতটাকে। একেক সময় খটকা জাগে,নারী এক হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক শিল্প। নারী মৃত্যুর বিজ্ঞান। ডেথোলজি। আচ্ছা, এ নারী কে ? এ দিনে এক, রাতে আরেক ! এ নারীকে সত্যিই আমি চিনি না। পরিচিত দায়রার যথেচ্ছ-নারীর কাছে কোনোকালেই কোনো যাচনা ছিল না আমার। আমি এমন নারী খুঁজিনি যে শুধু ঘুমোতে আগ্রহী বা গামলা-ভরা খাদ্যে। নারীকে নারীর মুখ বা নারীর চোখ মাত্র আলাদা করে চাইনি, কেবলি। নাঃ । নারীকে সঠিক ডিফাইন করতে পারছি না বলে নিজেকে ভীষণ ইরিট্যান্ট লাগছে।”
কিংবা, অদ্ভুত এক শ্রদ্ধা-ঘৃণা মিশ্রিত আবেগ ঃ
“নারী কী, আমি জানি না। এই যে আমি নারীকে লিখতে পারছি না, আমি বুঝি, শুধু একটি অপঠিত নারীর ঈপ্সিত অলঙ্কার ও তার নিরবচ্ছিন্ন অন্বেষা কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে, নিস্ফল শূন্য বিহার-সম, আমাকে ক্রমশ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শায়িত, দীর্ঘ বৈচিত্র্যহীন, একঘেয়ে এক নারীর দিকে। কমল যে লিখতে পারছে না, কমল বুঝলো, এ তার অভিজ্ঞতার হাহাকার। নারী বিষয়ে কোনো প্রিফিগারই তৈরি হয়নি তার মনের স্লেটে। স্রষ্টা তার চূড়ান্ত মুহূর্তে একটি কেন্দ্রভূম খোঁজে,যাকে ঘিরে সৃষ্টির সুসমৃদ্ধ বেকনোফায়ার । এই মুহূর্তে আমার ধারেকাছে কেউ নেই, যে আমার সহায়। কে এই শায়িত রমণী ? কী তার পরিচয় ? যে নারী আমার অন্বিষ্ঠ, যে আমার সোনার পাথরবাটি, সেই কি এ ?”
আবার ধরা পড়ছে পুরুষের তীব্র আকুতি
“একটা উদ্ভট চেতনা তার অসংযত মানসিক স্টেটকে পরাভূত করে ক্ষণিকের জন্যে হলেও স্বপ্নে দেখা মিথুনলগ্ন নরনারীর বিমূঢ় শরীর বিভঙ্গের দিকে ছুঁড়ে দিল তাকে। সে দেখতে পেল রানী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। —- রানী ! সে ছুটে গেল। ছুটছে। কমল ছুটে যাচ্ছে, অই। …. তারপর অন্ধকারে, তীব্র অন্ধকারে, নিজের মুখ আড়াল করে, স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে, সে, আরও ক্ষণিকতর স্বপ্নের মধ্যে। ….রানী,  তুমি আমাকে মাদারলি আদর করো। এই আমি চোখ বুজলুম।”
আসলে অজিত যৌনতার বর্ণনার মাধ্যমে কখনো প্রকাশ করেন ঘৃণা, আবার কখনো তার মধ্য দিয়েই মুক্তির পথ খুঁজে নিতে চান। মার্কেজের মতো অজিতের নায়কও মহিলার নগ্নতায় খুঁজে নিতে চেয়েছেন তৃপ্তি, স্বস্তি আর রোমান্টিকতাকে। যৌনতা ভারতীয় সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অঙ্গ। কোনারকের সূর্যমন্দির গাত্রে খোদিত হস্তমৈথুন, স্তনমর্দন, যোনিলেহন, ‘গীতগোবিন্দ’-এর রতিরস, ‘কুটিনীতম্’-এর যৌনতত্ত্ব- এ-সব কিছুই আমরা মেনে নিই। তা সত্ত্বেও সমাজ জীবনে যৌনতা নিয়ে এত আড়ষ্টতা কেন জানি না! শিল্পীরা এইসব সত্য খোদাই করেছেন মন্দির গাত্রে, আর অজিত ছবি এঁকেছেন নিজের উপন্যাসে। যৌনতায় শরীর নয়, মনই আসল । পবিত্র, নিষ্কলুস মন । কিন্তু সমাজ জীবনে বাধ্য-বাধকতা থাকলে, পরাধীনতা থাকলে সেই পবিত্র মনের উদ্গীরণ সম্ভব নয় । যৌনতা স্বাধীন। বিদেশীদের সাথে আমাদের এই জায়গায় ফারাক, যে, তারা যৌনতাকে সামাজিক সম্পর্ক রূপে দেখতে চান। জীবনের সহজ-সরল-স্বাভাবিক অঙ্গ। তা কখনোই পাপ নয়। যে কারণেই হয়তো বাংলা সাহিত্যে গুটিকয়েক উপন্যাস ছাড়া সেই অর্থে যৌনতার চরিত্র-চিত্রন সম্ভব হয়নি। ঠিক এই জায়গাতেই অজিত রায়ের স্ট্রোক, ঝাঁকুনি। যৌনতাকে তিনি মনে করেন  স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচার নয়। যোজন ভাইরাসে কমলের ভাষ্যে,-
“নারী-পুরুষের সম্পর্ক তো একটাই। যৌন সম্পর্ক। এটাই প্রাকৃতিক সম্পর্ক। যা প্রাকৃতিক, তাই ধর্ম। তাই সত্য। এর ভালো-খারাপ হয়না। মানুষ ছাড়া আর-সব প্রাণী এই নিয়ম মেনে চলে। একমাত্র মানুষই নারী-পুরুষের ধর্মীয় আর সামাজিক সম্পর্ক মেনে নিয়েছে। নারী-পুরুষ, দাম্পত্য এসব বানানো সম্পর্ক। মিথ্যে সম্পর্ক। যেহেতু ধর্ম ও সামাজিক সম্পর্ক মানুষের বানান তাতে ভুল্ভ্রান্তি সম্ভব। তুমি এই ভুল ভেঙে দাও।”
অজিত নির্মাণ করেন না, সৃষ্টি করেন। নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্বার্থ। আর সৃষ্টিতে থাকে উন্মাদনা-মগ্নতা-প্রত্যয়। যা ক্ষণকালের নয়, চিরকালের। অজিতের গদ্যের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য হয়ে ওঠে ‘ক্ষুরধার শিখা’। কিছুটা দ্বন্দ্ব, কিছুটা পিছুটান, কিছুটা বিপন্নতার গহীনে দাঁড়িয়ে অজিত কখনো আক্রমণ করেছেন সামাজিক টাবু কে, সংস্কারকে, শ্লীলতার ভন্ডামিকে। আবার অন্যদিকে প্রেম-ঘৃণা-নগ্নতাকে আলিঙ্গন করে নিয়ে, তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা গদ্যের এক অবিসংবাদিত নায়ক। 

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...