যুদ্ধের কবিতা কবিতায় যুদ্ধ:
অয়ন ঘোষ


“ওরে হাল্লা রাজার সেনা/ ওরে হাল্লা রাজার সেনা/ তোরা যুদ্ধ ক’রে করবি/ কি তা বল?” – গুপী গাইন বাঘা বাইন সত্যজিৎ রায় পরিচালিত “গুপী গাইন বাঘা বাইন” সিনেমার এই গান আমাদের সাধারণ জীবনবোধের কথা।
পৃথিবীর কোনো যুদ্ধই মানুষকে শান্তি দেয়নি, বা দেওয়ার সামর্থ তার নেই, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তা না হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর সেনানী MacArthur, সারা জীবন যার কাটলো যুদ্ধের ময়দানে, তিনি কেন বলবেন force is not the solution for man’s problem, বলপ্রয়োগ মানুষের সমস্যার সমাধান নয়। তবুও যুদ্ধ হয় কারণ জীবন নিয়ে আমাদের সন্তুষ্টির অভাব। সেই ত্রেতাযুগ বা তারও আগে থেকে আমরা দেখছি বারেবারে সাধারণ পারিবারিক সমস্যা এমন মারণ যুদ্ধে পরিণত হয়েছে যে, সংসার মনুষ্যশূন্য হবার জোগাড় আর সেই যুদ্ধের আবহ থেকে দেবতারাও নির্মোহ থাকতে পারেননি। হয়ত নিজের সৃষ্টিকে মারণ খেলায় মেতে উঠতে দেখলে নিরপেক্ষ থাকা দেবতার পক্ষেও সম্ভব নয়। আমাদের দেশের দুটি মহাকাব্য মূলত বীররসের কাব্য, তাতে অন্যান্য রসের প্রয়োগ থাকলেও, যেহেতু এপিক ধর্মী লেখা তাই বীররসের আধিক্য থাকাটাই স্বাভাবিক।
পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে যুদ্ধের মেজাজ বা সরাসরি যুদ্ধের আখ্যান আমরা পাই নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায়। আর আমি এই লেখাটিতে মূলত কবিতার কথা বলব, ইংল্যান্ডের প্রেক্ষিতে। তবুও সুকান্তের “প্রিয়তমাষু” কবিতার একটি লাইন খুবই প্রাসঙ্গিক: “পরের জন্য যুদ্ধ করেছি অনেক, এবার যুদ্ধ নিজের জন্য”।
সত্যিই তো যুদ্ধ কার জন্য? আর এতো যুদ্ধ করে মানুষ পায় কি? যারা গিয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে তারা কি সবাই ফিরে আসে বরমাল্য পরতে! নাকি এ সেই গল্প, যেখানে কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়, আর আমাদের মুখের আয়না আদল, আমাদেরই অসহায় করে তোলে!

ইংরেজি সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীতে সম্পূর্ণ এক নতুন লিখন শৈলীর আঙ্গিক তৈরি হয়। ভিক্টোরিয়ো ভাবধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন শব্দের প্রয়োগে প্রায় অসুস্থ্ এক পৃথিবীর গল্প শোনান শুরু করলেন সেই সময়ের কবিরা যা পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করল, patient etherized upon the table হিসেবে। যদিও W.B.Yeats নিজেকে I am the last romantic, বলে দাবী করেছিলেন এবং জর্জিয়ান কবিতায় একটা পেলবতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তবুও Eliot, Pound দের কবিতায় তার প্রমান্যতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। এইরকম পরিস্থিতিতে পৃথিবী জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণভেরী, তুরী বেজে উঠলো। বাধ্যতামূকভাবে সামরিক শিক্ষার কারণে ইংল্যান্ডে সেই সময়ের অনেক তরুণ কবিরাই যুদ্ধের ময়দানে গিয়েছিলেন আর তাঁদের লেখার গল্পই আজকের এই আলোচনার মূল বিষয়। এঁদের আমরা চিনি War Poets হিসেবে। বিংশ শতকের প্রথম ভাগেই যুদ্ধ একটি সামাজিক বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিল। যদিও মানুষের দুর্ভাগ্য ও যন্ত্রণার বিষয়, তবুও এটা যেনো একটা অবশ্যম্ভাবী সত্য। আধুনিক যাপন প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ল এর কারণে এবং এর সাথে যুদ্ধকে নিয়ে মানুষের ভাবনা রূপ পেলো তৎকালীন লেখনীর মধ্যে। যুদ্ধের মধ্যে বীভৎসতা থাকলেও বীরভোগ্যা বসুন্ধরার মানুষ তাঁকে চিরকালই শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে বা ভয়ের ভক্তির দৃষ্টিতে দেখে এসেছে। আসলে আমাদের মতো ছাপোষা মানুষ, সিনেমায় নায়ক একসাথে দশ-বিশ জনকে কাত করে দিচ্ছে দেখতে খুব ভালোবাসি, যদিও জানি যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণই কাল্পনিক, এখানেই Coleridge এর Willing suspense of disbelief এর সার্থকতা। কিন্তু আসল যুদ্ধ তো আর Willing suspense of disbelief না, তবুও কেমন যেন একটা ঘোর লেগে যায়, আমরা তাঁর বীরগাথার কাছে আত্মসমর্পণ করি। ভুলে যাই পরাজিত পক্ষ বলেও কেউ আছে আর তাঁরা মানুষেরই সন্তান, এই পৃথিবীতে আমাদের সহনাগরিক। মহাভারতে খুবই সল্প পরিচিত একটি চরিত্র ‘করেনুমতি’। তিনি চতুর্থ-পাণ্ডব নকুলের স্ত্রী ছিলেন। তাঁর একটি কথা কিন্তু এই যুদ্ধবাজ পৃথিবীর শেখা দরকার – যুদ্ধে কিন্তু কোন পক্ষই জেতে না। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লিখিত কবিতার সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন মেরু বা আবেদন আছে আর এই দুই মেরুর দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন Wilfred Owen ( 1893- 1918) এবং Rupert Brooke ( 1887 – 1915)।
Brooke তাঁর কবিতায় যুদ্ধকে গৌরবান্বিত করেছেন। যদিও তাঁর নিজের জীবন ছিল বিষাদময় কারণ নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে বিতর্ক তাঁর স্বল্প জীবনকে খুবই দ্বিধান্বিত করে রেখেছিল। ১৯১৫ সালে তিনি British Mediterranean Expeditionary Force এ যোগদান করেন এবেং ওই বছরই ২৩শে এপ্রিল বিষাক্ত মশার কামড়ে একটি ফরাসী নৌ-হসপিটালে মৃত্যু হয়, তাঁর। তাঁর কাছে যুদ্ধ দেখা দিয়েছে দেশপ্রেমের অনুভব হিসেবে।
প্রায় প্রত্যেকটি কবিতায় তিনি বীর সেনানীদের নায়কের মর্যাদা দিয়েছেন বা শহীদের দেবতার আসনে বসিয়েছেন। যুদ্ধই তাঁর প্রাণ কেড়ে নিলেও সৈনিকের মৃত্যুকে তিনি শ্রেয় বলে ভেবেছেন। তাঁর বেশ কিছু ছোট কবিতা ও সনেটে তিনি যুদ্ধকে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও অঙ্গীকার হিসেবে স্বীকার করেছেন। বিখ্যাত কবিতা Soldier এর এই দুটি লাইন পড়লেই তাঁর মানসিকতাকে অনুধাবন করা সম্ভব: Here Tulips bloom are they are told unkempt about those hedges blows The English unofficial rose.
এরই অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আছেন Wilfred Owen, যার কাছে যুদ্ধ ছিল একটি সংগঠিত কসাইখানা। যুদ্ধের মিথ্যে গৌরবকে নস্যাৎ করেছেন নিজের দর্শন ও লেখার মধ্যে দিয়ে। নিজের কবিতাকে তিনি নিজে বলতেন বিষাদের ছায়া বা এলিজি। দ্যর্থহীন ভাষায় Owen যুদ্ধ নিয়ে নিজের দর্শন জানিয়েছেন – My subject is war, and the pity of war. The poetry is in the pity. যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজের ভাইকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলছেন, পৃথিবীর কোন শিল্পী সৈনিকের মুখে যে বিষাদের মায়া থাকে তা আঁকতে পারবে না। একজন সৈনিক প্রতিদিন গোধূলিবেলায় দাঁড়িয়ে ভাবেন আগামী কালের গোধূলি হয়ত সে আর দেখতে পাবে না। যুদ্ধের বীভৎসতা তাঁকে বিমূঢ় করে রেখেছিল। তাঁর Send Off কবিতায় সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাবার যে ছবি পাওয়া যায়, তা শুধু আমাদের মন খারাপ করে দেয় তাই নয় আমাদের জীবনের খুব সফল ধারণা গুলোকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। একজন ভবঘুরে মানুষ শুধু দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনের ওপরে, আর কেউ আসেনি এই সৈনিকদের অনিশ্চিত যাত্রা কালে বিদায় জানাতে। গোটা দৃশ্য যেনো বিদ্রুপ করে এই সভ্যতাকে। কবি প্রশ্ন করেন যেমন ট্রেন ভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তেমনি ট্রেন ভর্তি করে কি এঁরা ফিরে আসবে ফুলমালার সংবর্ধনা নিতে? বহু চাদঁ পরে দু’একজন বা একা একা কেউ হয়ত ফিরে আসবে কিন্তু তাঁদের জন্য কোনো মঞ্চ থাকবে না থাকবে না কোন জয়মাল্য: A few, a few too few for drums and yells,/ May creep back, silent, to still village wells/ Up half-known roads.
তাঁর খুব পরিচিত কবিতাগুলির – Strange Meeting, Anthem for Doomed Youth, Spring Offensive, Futility ইত্যাদি। কবি বুঝেছিলেন যুদ্ধবাজ এই পৃথিবী ততদিন থামবে না যতদিন না এর রথের চাকা রক্তের স্রোতে নরম হয়ে যাওয়া মাটিতে বসে না যায়, সূর্যপুত্রের রথের মতো – much blood had clogged their chariot. ১৯১৫ সালে Owen সৈনিক হিসেবে Artists Rifles Officers’ Training Camp এ যোগ দেন আর ১৯১৮ র ৪ই নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ঠিক এক সপ্তাহ আগে যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যান গুলিবিদ্ধ হয়ে। শোনা যায় যুদ্ধের ময়দানে তাঁর অন্যতম সাথী ছিল  গীতাঞ্জলির একটি ছোট সংস্করণ। তাঁর শেষদিনের সৈনিক ইউনিফর্ম এর পকেটেও নাকি ছিল ‘গীতাঞ্জলি’। মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি যার মধ্যে দিয়ে জীবনের গান শুনতেন কিন্তু তাঁর সুর গুলি চরন পেলো তিনি কি পেলেন তাঁকে, প্রশ্ন থেকেই যায়!
বাকী কবিরা, যাদের বলা হয় War Poets, তাদের মধ্যে Owen এর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন Siegfried Sassoon তাঁর মৃত্যুও হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। ওনার কবিতায়ও যুদ্ধের প্রতি তীব্র ক্ষোভ লক্ষ্য করি আমরা। তাঁর সবচয়ে ভালো লেখা Counter Attack, এখানে কবি মৃত্যুর প্রেমিক, তার ধ্বংসের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক সন্ন্যাসী। C. H. Sorley আমার খুব প্রিয় কবিদের একজন, খুব একটা প্রচার পাননি কিন্তু সত্যি কথাটা সোচ্চারে বলেছেন, বলেছেন যুদ্ধ কোনো বীরত্বের গল্প নয়, বুলেটের মধ্যে সামনে বুক পেতে দাঁড়াতে সত্যিই ভয় লাগে, বউ বাচ্চার কথা মনে পড়ে। যাকে আপনারা সাহস বলেন, সেটা আসলে বাধ্যবাধকতা: knew that death in action was not heroic or beautiful; it was terrible and piteous, perhaps too terrible for any cheap emotions to express it. উদ্ধৃতির শেষ অংশটা লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যুদ্ধ নিয়ে হুল্লোড় করা, সাতবার “মা তুঝে সালাম” বা “বর্ডার” সিনেমা দেখা একজন civilian এর সাথে একজন soldier এর ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। কাশ্মীর বা সিয়াচেন বর্ডারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর মূল্য বেতন দিয়ে হয় না, জীবন দিয়ে হয়। জঙ্গ বা যুদ্ধ বলে যেসব নেতা বা আমআদমি লাফায় তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে কার্পেট-বোম্বিং অথবা কন্টিনিউ- ফায়ারিং এর মধ্যে রাখলে, বোঝা যাবে কত ধানে কত চাল।


এই আলোচনা যাকে দিয়ে শেষ করব তিনি Edward Thomas, নিস্পৃহ ভাবে যিনি সত্যিকারের দেশপ্রেম আর চাপিয়ে দেওয়া দেশপ্রেম এর মধ্যে অন্তর করেছেন: the worst of poetry being written today is that it is too deliberately, and not inevitably English…। এর খুব পরিচিত কবিতা হলো The Owl যা আজকের এই পরিস্থিতির সঙ্গে খুবই সাযুজ্য রাখে। বিশ্বব্যাপী Covid-19 ভাইরাসের সাথে মানুষের যুদ্ধই তো চলছে। এর মধ্যে যখন লকডাউন এসেছিল যারা আমরা জিনিসপত্র কিনে ঘরে ঢুকে যেতে পেরেছিলাম, পরিবার নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম, তাঁরা কি যখন খাবারের গ্রাসটা মুখে তু্লেছি একবারও হীনমন্যটায় ভুগিনি, চৌকাঠের ওপারে আকাশের নীচে থাকা মানুষ গুলোর কথা ভেবে? খাবার কি বিস্বাদ লাগেনি বা রাতে বিছানায় এপাশওপাশ করিনি, আগামী পৃথিবীর কথা ভেবে? যেমন হয়েছিল The Owl কবিতার সেই সৈনিকটির তাঁর সহযোদ্ধাদের কথা ভেবে। যারা পায়নি খাবার বা মাথার ওপর ছাদ, পড়ে রইল অসংখ্য লাশের মাঝে খোলা আকাশের নীচে, সয়ে জীবন যন্ত্রণা: And salted was my food, and my repose/ Salted and sobered, too, by the bird’s voice.
এরপরেও কি যুদ্ধ আমাদের মানায়? তার চেয়ে বলা ভালো: “ভালোবাসার কাছে নতজানু হলে হেরে যাবার ভয় থাকে না আর।”


Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...