যত দূরেই যাই
মনোজ পাল

সূর্য-না-ওঠা ঘ্যান-ঘ্যানে তেতো একটা দিনে জেলার ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ সুমন্ত মজুমদারের সঙ্গে অনির্বাণ মুন্সির প্রথম বার দেখা হয়।

আগের রাত্রে দিল্লির মসনদে থাকা সরকার বাহাদুর রাজ্যের বামপন্থী কোয়ালিশনে গড়ে ওঠা প্রথম বারের মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করে দিয়েছিল। নিয়ম মোতাবেক প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাকে খারিজ করতে হলে দেশে রাষ্ট্রপতি নামক একজন পল্টুবাবুকে সেই আদেশনামায় সই করতে হয়, তবে সবাই জানে যে তার চিফ হুইপ থাকাকালীনই পার্টি আপিসের সদস্যরা পিছন থেকে টেনে তার কাছা খুলে দিতেও দ্বিধা করত না। অথচ পল্টুবাবু শিক্ষিত মার্জিত ব্যক্তি, ঘুম থেকে তুলে টাইপ করা কাগজের ওপর সই করবার ফাঁকা জায়গাটা তাকে দেখিয়ে দেওয়া হলে অনাবশ্যক জেনেও প্রথমে তিনি পুরোটা পড়লেন তারপর পরিষ্কার ইংরেজিতেই করে দিলেন সইসাবুদ। শুধু ভোর হওয়ার অপেক্ষা ছিল বিরোধী দলের নেতাদের এক এক করে গ্রেফতার করার। গম ভাঙাতে ঘুণ-পোকা পিষে যাওয়ার মত মানবাধিকার-রক্ষা কর্মীদের সঙ্গে অনির্বাণকেও পুলিশ সকাল সকালই তুলে নিয়ে গিয়েছিল; বিকেল পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে পেশ করা হল তাকে। সেখানেই দেখা।

বুদ্ধিদীপ্ত মুখাবয়ব হলেও সুমন্ত উচ্চতায় অনেকটাই ছোট ছিল অনির্বাণের চেয়ে, কম বয়সেই কপালের দুপাশে টাকও পড়েছিল অল্প-স্বল্প; উচ্চ-মহল থেকে নেমে আসা আমলাতান্ত্রিক চাপেই হয়ে থাকবে সেটা। মস্তিষ্ক বিদ্ধ করা তীক্ষ্ণ চোখে অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে হাসল সে, “আপনাকে ধরে আনাটা ঠিক আমার উদ্দেশ্য ছিল না, তবে বুঝতেই তো পারছেন, আমাকেও কারও আজ্ঞা পালন করে চলতে হয়। আমি জানি যে আপনাদের বামপন্থীপনাটা অপেক্ষাকৃত বিপজ্জনক হলেও অন্য জাতের। তবে এসেই যখন পড়েছেন, থাকুন ক’দিন – আমার লোকদের বলে দেব, যতটা পারে, আপনাদের অসুবিধে যেন না হতে দেয়।” এতটা বলার পর সে আরও যোগ করল, “বাই দ্যা ওয়ে, মিঃ মুন্সি, আপনার বুক-সেলফ থেকে মার্টিন লুথার কিং-এর যে বইটা সিজ করা হয়েছে, তার একটা কপি কি কোথাও পেতে পারি? ওটা পড়তে চাইছি কিন্তু আপাতত কাস্টোডিতে জমা দিতে হবে – আমাদের সিস্টেম তো বোঝেন, একবার জমা পড়লে ফের উদ্ধার করাটা কত মুশকিল!”

অনির্বাণের মনে পড়ল বইটার কথা – Where Do We Go from Here: Chaos or Community, বাড়ি থেকে অন্যান্য অনেক বইয়ের সঙ্গে ওটাকেও পুলিশেরা নিয়ে গিয়েছিল পুঁটলি বেঁধে।

আশ্চর্য অনির্বাণ পালটা জিজ্ঞেস করে বসল, “কিং পড়েন আপনি?”

“অবশ্যই। কেন পড়তে বারণ আছে পুলিশদের?” কিছুটা অনুযোগের সুরেই উত্তর দিয়েছিল সুমন্ত, “দাস কাপিতালও পড়া আছে, মন দিয়েই পড়েছি।”

কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় সপ্তাহ দুয়েক পরে সুশীতল রায়, অমিত পোদ্দারদের সঙ্গে অনির্বাণও ছাড়া পেয়ে গেল এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই দু-সপ্তাহের জমে থাকা কাজের চাপে ভুলে গেল কিং-এর বইটার কথাটা।

বছর দুয়েক পরে একেবারে অন্য পরিস্থিতিতে আবারও দেখা হবে তাদের।

জেলারই এক দূর গ্রামাঞ্চলে নদীতে চরা জেগে উঠেছিল। এক ধরনের ব্যবসায়ী আছে যাদের লোকজন নতুন গজিয়ে ওঠা এইসব পলি-সমৃদ্ধ জমির খোঁজখবর রাখে এবং তাদের মারফত ব্যবসায়ীরা জলের ওপর ডাঙা দেখা দেওয়ার আগেই জমিটি ল্যান্ড-রেজিস্টারের আপিস থেকে ৯৯-বছরের জন্যে লিজ করিয়ে নেয়। নিয়ম মত যে জমি তখনো জলের তলায় তার ভাড়া নিতে মূল্য লাগে নাম মাত্র; প্রকৃতির খেয়ালে যা একদিন ভেসে উঠবে তার ডুবে যেতেই বা কতক্ষণ! কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না, পলি পড়ে একবার নদীর চড়া জাগতে শুরু করলে ক্রমাগত তা আয়তনে বাড়তেই থাকে এবং তখন তার দখলকারী যে ভাড়া প্রথম বারের জন্যে গুনেছিল সেই ভাড়াতেই তিন-চারগুণ এলাকার ভোগ-দখল করে। নদীর পলিমাটি খুবই উর্বর, বিশেষ ধরনের চাষবাসও হয় তাতে অতি উত্তম। এবং যেহেতু ওই জমি আনুষ্ঠানিকভাবে নদী-চর, কৃষিজমি নয়, সরকারি আইনের নজরদারি সে জমির ওপর থাকে না বললেই চলে; জমির আপাত মালিকের মনমানির ভরসাতেই জীবন নির্বাহ করতে হয় ওই জমিতে কাজ করার শ্রমিকদের।

এমনি এক নদী-চরে ফসল উৎপাদনের পর একদল ক্ষেত-মজুরকে জমি-মালিক সেটুকু পাওনা-গণ্ডাও দেয়নি। তাই নিয়ে মজুররা ঝামেলা করেছিল, জমিদারের বাড়ির সামনে বসে পড়েছিল ধরনায়, উঠবে না মজুরি না দিলে। পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল তাদের, হাজির করল সদর থানায়। অনির্বাণের জন্যে সেটা একেবারে ফিট কেস, মুক্তি দিতে হবে ক্ষেত-মজুরদের, নিঃশর্ত; এবং মজুরি তো অবশ্যই আদায় করতে হবে চর-মালিকের কাছ থেকে। দলবল নিয়ে সেও হাজির ডেপুটি সুপারের আপিসে। তার সঙ্গে জড়ো হয়েছে বন্দী মজুরদের পরিবারবর্গ, বৌ-বাচ্চা, গ্রামের বুড়ো-বুড়ি মিলে সে প্রায় দেড়শ মানুষ ঠাসাঠাসি, ডি-এস-পি’র আপিসের দরজা দিয়ে ঢোকে-বার হয় কার সাধ্যি।

সুমন্ত মজুমদার নেহাতই স্মার্ট মানুষ, দুম করে দরজা খুলে বার হয়ে পড়ল সেই ভিড়ের মধ্যে। আর যায় কোথায়, গ্রাম থেকে আসা মানুষেরা ঘিরে ফেলল তাকে; যেন তাদের জয় হয়ে গেছে, এবার তারা যা বলবে তাই যেন মানতে বাধ্যই হয়ে যাবে ডেপুটি সুপার। ডি-এস-পি’র অবশ্যই সে রকম কোনও উদ্দেশ্য ছিল না, সে এসেছিল গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মনোভাবটা আঁচ করতে; এখন অবস্থাটা গেল উলটে, ঘেরাও হয়ে গেলেন ডেপুটি মহাশয়। ব্রিটিশ আমলের বড় বড় থাম-ওয়ালা চওড়া বারান্দার ম্যাজিস্ট্রেট বিল্ডিং-এর দু-তলায় সে এক হুলুস্থুলু কাণ্ড। ধীরে ধীরে চিৎকার চ্যাঁচামেচি কমে এলেও, ঘেরাও উঠল না, পরিস্থিতি চলে গেল অনির্বাণদেরও হাতের বাইরে।

ঘণ্টা ছয়েক কেটে গেল এভাবেই। দু-পক্ষই অনড়। শেষে বুকে বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট বাঁধা, হাতে লাঠি-ঢাল, কারও কারও হাতে বন্দুকও, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে থাকল রি-ইনফোর্সমেন্ট সি-আর-পি’রা।

এতক্ষণ ডি-এস-পি শান্তভাবেই ঘাড় এলিয়ে বসেছিল ভিড়ের মাঝখানে তার জন্যে রাখা একটা চেয়ারের ওপর; মোটা একটা ইংরেজি নভেল পড়ছিল সে বসে বসে। আচমকাই সি-আর-পি’দের দেখে বই-টই ফেলে তড়াক করে লাফ দিয়ে চেয়ারটার ওপর উঠে দাঁড়াল সুমন্ত। চিৎকার করে বলে উঠল সে, “থামো! কেউ বারান্দায় উঠবে না; নামাও, লাঠি নামাও সব। আমি যখন দায়িত্বে আছি, আমার অনুমতি ছাড়া কেউ কিচ্ছু করবে না”, ভাবখানা যেন অনির্বাণ নয়, সে-ই ঘেরাওকারী গ্রামবাসীদের প্রতিনিধি। কাজ হল তাতে। থমকে গেল লাঠি-বন্দুক-ধারীরা; একটা সাঙ্ঘাতিক লাঠালাঠি হাতাহাতি রক্তপাতের হাত থেকে রক্ষা পেল সেদিনকার পরিস্থিতি। মনে মনে সুমন্তর উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না অনির্বাণ। কিছুক্ষণ পরে উঠে গেল ঘেরাও, বিনা-শর্তে গ্রামবাসীরা ফিরে গেল গ্রামে, পরিবর্তে অ্যারেস্ট করে আনা ক্ষেত-মজুরদেরও ছেড়ে দেওয়া হল চার্জশিট ছাড়াই।

* * *

পাতা-ঝরা শেষ হেমন্তের গুমোট এক সন্ধ্যায় সাজানো দোকান, পয়সাওয়ালা খদ্দের, বিদেশি গাড়ি, ভিড়, খাটো-পোশাকের নারী আর এগ-চিকেন রোলের গন্ধের মধ্যে দিয়ে পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের শাখা-উপশাখার গলি-ঘুঁজি দিয়ে মৌলালি পৌঁছানোর চেষ্টায় ছিল অনির্বাণ; একটা গোপন মিটিং পরিচালনা করতে হবে তাকে।

তখন শহরাঞ্চলের নকশাল আন্দোলন বেশ একটা বিপজ্জনক বাঁক নিয়েছে, গেরিলা লড়াই-এর নামে বেপরোয়া খতম অভিযান চলছে। রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও অনির্বাণের পক্ষেই বুঝে ওঠা মুশকিল হচ্ছিল কে কখন কাকে পেড়ে ফেলবে। তার মত মানুষের স্বাভাবিক গতিবিধির বাইরে এরকম অদ্ভুত একটা পথ বেছে নেওয়ার কারণটাও তার ছিল সেই হিসেবেই – ওই অঞ্চলে তাকে কেউ প্রত্যাশাই করবে না; অন্তত অনির্বাণ সেই রকমই ভেবেছিল। কয়েকদিন আগেই যে ডেরাটায় সে থাকত তার কাছাকাছি একটা খুন হয়ে গেছে, মাঝারি মাপের আড়তদার, তাকে খতম না করলেও সেই মুহূর্তেই বিপ্লবের বিরাট কিছু হেরফের হয়ত নাও হতে পারত; কিন্তু খুনের পর ‘শ্রেণীশত্রুদের মুণ্ডু চাই’ লেখা পোস্টারও পড়েছে এলাকায়। সেই থেকে সে আর ঘরে ফিরতে পারেনি; সাদা পোশাকের খোচররা ঘুর-ঘুর করছে সেখানে।

ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়েছিল অনির্বাণ। গলির আধো-অন্ধকারে টাক-মাথা বর্ণনার প্রায় অযোগ্য চল্লিশোর্ধের লোকটা হঠাৎই তাকে লোনা-ধরা দেওয়ালের ওপর ঠেসে ধরেছিল পাব্লিক ইউরিনালের চড়া অ্যামোনিয়া আর দেশি চোলাইয়ের দূর্গন্ধ-ভরা একটা বাঁকে। ছোট-খাটো মানুষটার শরীরে যে অত শক্তি থাকতে পারে সেটাও এক আশ্চর্য। হয়ত ওভাবেই ট্রেনিং দেওয়া হয় ওদের।

“কথা বলবেন না, জাস্ট শুনুন”, বলেছিল সে ফিসফিস করে, “আপনি কি এখনো তারকেশ্বরের ঠেকটাতেই থাকছেন?” বারণ করা সত্ত্বেও মৃদু স্বরেই প্রশ্ন না করে পারেনি অনির্বাণ, “তারকেশ্বরের সঙ্গে ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের কি সম্পর্ক?” উত্তরে লোকটার সামান্য ঠোঁট বাঁকানো হাসিটা অনির্বাণকে মনে করিয়ে দিয়েছিল দীর্ঘদিন না দেখা হওয়া সুমন্ত মজুমদারের মুখটা।

“আজকাল নিউ সেক্রেটারিয়েটে আছি। কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন… ডিপার্টমেন্টের কাছে অর্ডার আছে আপনাকে আর অ্যারেস্ট না করার… কী বলছি মানেটা বুঝে নেবেন, আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। এখন আর তারকেশ্বরে ফিরে যাবেন না, অন্য কোনও ঠিকানা খুঁজুন, আপনি কোথায় কী কী করছেন তার প্রায় সবকিছুই ডিপার্টমেন্টের নজরে আছে। ট্রাস্ট মি, এন্ড মেক নো মিসটেক… ইউ নেভার শ মি হিয়ার… অফিশিয়ালি।” প্রাক্তন ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশের যেমন উদয় হয়েছিল তেমন হঠাৎই সে মিলিয়ে গিয়েছিল ছায়ায়।

আর কখনো দেখা হয়নি তাদের।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...