ভ্রমি বিস্ময়ে, সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে কহলীল জিবরানের ‘ দ্য ওয়ান্ডারার ‘
ভূমিকা ও তর্জমা : সুস্মিতা কৌশিকী
ভাববাদের সঙ্গে উপযোগিতার, ভাষার সঙ্গে সঙ্গীতের, ধর্মের সঙ্গে মর্মের, নীতির সঙ্গে কৌতুকের একাত্মতায় আত্মউন্মেষের সফল ফসল যাঁর লেখায় ফলন্ত, যাঁর লেখায় অবলীলায় রচিত হয় পৃথিবী ও স্বর্গের মাঝে হাতির দাঁত ও সুবর্ণ সিঁড়ি, যাঁর ভাব ও ভাষার সম্মিলিত মুর্ছনা অর্ফিয়ূসের বীণার মতো কঠিন পাথরকেও উজ্জ্বল প্রদীপে পরিণত করে, বৃক্ষশাখাকে করে তোলে সর্বজ্ঞাত বুদ্ধ, তিনি কহলীল জিবরান, আরব সাহিত্য জগতের অন্যতম আলোচিত নাম। পৃথিবীর এমন কোনো কোণ নেই যেখানে বইপড়া আছে অথচ জিবরানের বই পৌঁছে যায়নি। আরবি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সচল ও সমান দক্ষ তাঁর মরমী কলম। জিবরান একাধারে দার্শনিক, কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সঙ্গীতবোদ্ধা, চিত্রশিল্পী। এবং কিছু দিন ভাস্কর হবার শিক্ষাও গ্রহণ করেন। অর্থাৎ শিল্পের কোনো শাখাই তাঁর কাছে অস্পৃশ্য বা অস্পর্শ ছিলনা। জীবদ্দশায় রেখে গেছেন পঁচিশটি প্রকাশিত বই, যেগুলি তাঁর বহুগুণের সাক্ষ্য বহনকারী। ‘দ্য প্রফেট’ গ্রন্থের জন্যই তিনি সারা বিশ্বে খ্যাতিমান। বইটি প্রায় সমস্ত মানবিক ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে।
লেবাননের মায়াময় বিশারি গ্রামে ১৮৮৩ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে জিবরান জন্মগ্রহণ করেন। পরে মা ও ভাই -বোনেদের সঙ্গে চলে যান মার্কিন মুলুকে। সেখানেই তাঁর লেখা পড়া ও যাবতীয় শিল্পবোধের পরিস্ফুটন ও প্রকাশ। যদিও বিশারির মায়াময় পরিবেশ তাঁর হৃদয়ে সব সময় সমুজ্জ্বল হয়ে ছিল।
জিবরানের পুরো নাম জিবরান খলিল জিবরান। আরবিয় রীতি অনুসারে তিনি পিতা খলিল বে-র নামটি মধ্যনাম হিসেবে ব্যবহার করতেন। সাহিত্য রচনার প্রথম পর্বে আরবি রচনাগুলোতে পুরো নাম ‘খলিল ‘ বানানেই লিখতেন তিনি। পরে ইংরেজি রচনার প্রকাশকালে খলিলের পরিবর্তে কহলীল লিখতে শুরু করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৮৯৭ সালে বোস্টনের স্কুলে পড়াকালীন ইংরেজির শিক্ষক তাঁর নামের শুদ্ধ বানান কহলীল হিসেবেই লিখে দেন এবং সেটাই অনুসৃত হয়।
লেখক হিসেবে জিবরানের দর্শনের মূলকথা হলো আত্মজ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা। তার মতে জীবনবোধের বৃত্তান্ত লুক্কায়িত থাকে আত্মোপলব্ধির মধ্যেই, জীবনকে জানতে হলে প্রথমে নিজের হৃদয়কে প্রসারিত করতে হবে। কারণ মনুষ্য হৃদয়ই ঈশ্বরের প্রকৃত আবাসস্থল। হৃদি উন্মোচিত হলেই এই বোধির জন্ম হয় যে জীবনের প্রতিটি জলসিঁড়িতে রয়েছে ঈশ্বরের স্মারকচিহ্ন।
মারোনাইট খ্রীষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং ধর্মীয় পরিবেশে মানুষ হয়েও তাঁর রচনায় ধর্মতত্ত্বের কচকচানি অনুপস্থিত। বরং কাঠ পাদ্রীদের তিনি বহু নিন্দামন্দ করে তাঁদের রোষের শিকার হন। তিনি তাঁর রচনায় অতীন্দ্রিয় বিশ্বমানবতার কথা বলেন। যা পরবর্তীতে জীবরানবাদ নামেও খ্যাতি লাভ করেছে।
যাই হোক, আলোচকরা তাঁর লেখায় জার্মান দার্শনিক নিটশে, ফরাসি প্রতীকধর্মী কবি ও চিত্রশিল্পীদের প্রভাবের কথা বলেন , তাঁর কাব্যপ্রকাশে রয়েছে ইংরেজ কবি – চিত্রকর উইলিয়াম ব্লেকের আঙ্গিকের প্রভাব। এসব সত্ত্বেও জিবরানের লেখা যে স্বতন্ত্র ও অতুল্য তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘দ্য ওয়ান্ডারার ‘ বইটি জিবরানের সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের এবং সর্বশেষ ফসল বলা যেতে পারে। ইংরেজিতে লেখা এই বইটির প্রকাশকাল ১৯৩২ সাল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি এর প্রকাশ দেখে যেতে পেরেছিলেন। গদ্য রচনায় এই বইটিকে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি বলে ভাবা হয়। যদিও জিবরানের কোন রচনা থেকেই পদ্য ও গদ্যকে আলাদা করা সম্ভব নয়। কারন তাঁর গদ্যও মিস্টিকধর্মী কবিতার সারাংশ।
দ্য ওয়ান্ডারার মূলত নীতিকথামূলক গল্পের সমাহার, যাকে প্রাত্যহিক যাপন ও আদর্শ জীবনচর্চার অন্যতম আয়ূধ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বইটির বৈশ্বিক প্রজ্ঞা ও নিত্যকার উপযোগী জ্ঞানের যৌথ মহড়া বিবলিকাল প্যারাবল ও বৌদ্ধ জাতকের গল্পগুলোকে ছাড়িয়ে আধুনিক অনুগল্পের অনেক নিকটবর্তী। ইংরেজিতে লেখা হলেও এই গল্প গুলিতে পাশ্চাত্যের ঝা চকচকে চটকদার রঙিন দুনিয়াদারি বা বস্তুবাদী ভাবনার চেয়ে প্রাচ্যের ভাবগম্ভীর প্রজ্ঞার সরল প্রকাশ বেশি করে উপলব্ধ হয়। ভাষায় সরল কিন্তু ভাব ব্যঞ্জনায় গভীর এই ছোট ছোট গল্পগুলো দার্শনিক প্রজ্ঞার সঙ্গে ব্যবহারিক কৌতুক, ব্যঙ্গ ও মৃদু ভর্ৎসনার আশ্চর্য মিশেল।
এই লেখা পড়তে পড়তে একজন পাঠকের মনে হতেই পারে কী প্রয়োজন জিবরান পাঠের, জিবরান অনুবাদের এই নবতি সাল পরেও। দুটো প্রশ্নের একটাই উত্তর আমার কাছে এবং অপরিবর্তনীয় — জিবরান পাঠ মনের অন্যতম প্রশান্তির অমৃতধারা। শুদ্ধ চিত্তই জ্ঞানের ধারক ও প্রজ্ঞার আজ্ঞাবহ। তাই জিবরান অতীতের, আজকের, আবহমানকালের।
জিবরানের প্রতিটি রচনাই যেন তাঁর দ্য প্রফেট – এর ‘Forget not that I shall come back to you’ এই বহু পল্লবিত পংক্তির অনুরণন।
১
পরিচ্ছদেরা
একদিন সমুদ্রতীরে সৌন্দর্য্য ও কদর্যতার সাক্ষাৎ হল। তারা একে অপরকে বলল, ‘এসো সমুদ্রে স্নান করা যাক।’
নিজেদের পোশাক সমুদ্রতটে খুলে রেখে তারা জলের মধ্যে সাঁতার কাটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর কদর্যতা উঠে এসে সৌন্দর্য্যের পোশাক পরে সেখান থেকে চলে গেল।
তার কিছু পরে সৌন্দর্য্যও জল থেকে উঠে এল এবং সে তার পোশাক খুঁজে না পেয়ে নগ্ন অবস্থায় খুবই লজ্জিত হল। লজ্জা নিবারণের জন্য সে নিজেকে কদর্যতার পোশাকেই ঢেকে নিল অগত্যা। এবং সেখান থেকে চলে গেল।
সেই দিন থেকে পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে সবাই সৌন্দর্য্য ও কদর্যতাকে নিয়ে ভুল করে।
তবু কেউ কেউ আছেন যাঁরা সৌন্দর্য্যের প্রকৃত বিভা জানেন এবং তাঁরা তাকে পোশাকের মাধ্যমে চিহ্নিত করেন না। এবং কেউ কেউ এমনও আছেন যাঁরা কদর্যতার স্বরূপ দেখেছেন, পোশাক দিয়ে তাঁদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।
২
বিদ্যুতের ঝলকানি
এক ঝড়ঝঞ্ঝার দিনে অ-খ্রীষ্টান এক মহিলা গির্জায় খ্রীষ্টান যাজকের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘আমি খ্রীষ্টান নই, নরকের আগুন থেকে নিস্তার পাবার আমার কি কোন উপায় আছে?’
তখন বিশপ মহিলাকে দেখলেন এবং বললেন, ‘না এক্ষেত্রে শুধু তারাই উদ্ধার পেতে পারে যারা খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত।’
তিনি (বিশপ) নিজের কথা শেষ করেছেন কি না এমন সময় আকাশ থেকে বজ্রপাত হলো গির্জার উপর এবং পুরো গির্জা আগুনের লেলিহান শিখায় ঢেকে গেল।
শহরের মানুষ দৌঁড়ে এলো এবং তারা মহিলাকে উদ্ধার করল কিন্তু আগুনের করাল গ্রাসে হারিয়ে গেলেন বিশপ।
৩
ভালোবাসা ও ঘৃণা
এক যুবতী এক যুবককে বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” শুনে যুবকটি বলল, তোমার ভালোবাসা আমার হৃদয়ে অত্যন্ত মূল্যবান।
এবং যুবতী জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমাকে ভালোবাসো না?” যুবকটি তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
তখন সেই যুবতী অত্যন্ত ক্রুদ্ধস্বরে চিৎকার করে বলল, “আমি তোমাকে ঘৃণা করি।” এবং যুবকটি শান্তভাবে বলল, “তাহলে এই ঘৃণাও আমার হৃদয়ের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।”
৪
পাগলটি
পাগলাগারদের বাইরের বাগানে এক যুবকের সঙ্গে আমার দেখা। যুবকটির মুখটি ম্লান কিন্তু অনিন্দ্য সুন্দর ও বিস্ময়ে পরিপূর্ণ। আমি বেঞ্চে তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এখানে কেন?’
সে আমার দিকে অবাক চোখে তাকাল এবং বলল, ‘এই প্রশ্নটি যথাযথ নয়, তবু আমি উত্তর দিচ্ছি —– বাবা আমাকে তাঁর মতো বানাতে চান এবং আমার কাকা চান তাঁর নিজের মতো। আমার মা মনে করেন তাঁর সমুদ্রচারী স্বামীই আমার ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য মানুষের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমার দাদা মনে করে আমার তার মতো দক্ষ খেলোয়াড় হওয়া উচিত।’
‘এবং আমার শিক্ষকরাও চান আমি তাঁদের মতো গবেষক, সঙ্গীতজ্ঞ বা যুক্তিবাদী দার্শনিক হই। তাঁরা প্রত্যেকেই এব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প এবং তাঁরা নিজেদের আয়নায় নিজস্ব প্রতিবিম্বে (হিসেবে) আমাকে গড়ে তুলতে চান।’
‘তাই আমি এখানে চলে এসেছি। এখানে আমি অনেক বেশি সুস্থ মানুষদের খুঁজে পাই। অন্তত আমি নিজের মতো (হয়ে) থাকতে পারি।’
তারপর হঠাৎ সে আমার দিকে ঘুরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু বলুন আমায় আপনিও কি সুশিক্ষা আর সুউপদেশের দ্বারা তাড়িত হয়ে এখানে এসেছেন?’
আমি উত্তরে বললাম , ‘ না, আমি একজন পরিদর্শক মাত্র। ‘
এবং সে প্রতিউত্তরের মতো বলল , ‘ওহ্ আপনি তাহলে তাঁদের মধ্যেই একজন যারা এই মস্ত পাগলাগারদের ঠিক একটি দেওয়াল ওপারেই থাকেন।’