বারে বারে আসা
অনিরুদ্ধ সেন
আমরা পালাচ্ছি। পালাচ্ছি প্রাণের দায়ে। কখনও অন্ধকারে গা ঢাকা দিতে গিয়ে পথ
হারাচ্ছি। কখনও ছুটতে ছুটতে মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে। তবু থামার জো নেই। কারণ মৃত্যু
আমাদের পেছনে ধাওয়া করেছে।
গল্পের শুরুতে, আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি চালিয়ে পালাচ্ছি। আমরা মানে দেবজিৎ ওরফে
দেবু, দীপ্তেন্দু ওরফে দীপ্ত আর আমি শুভ্রাংশু ওরফে শুভ্র। আমাদের গন্তব্য
পশ্চিম – কোনওমতে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত পেরোতে পারলে বেঁচে গেলাম, অন্তত
এখনকার মতো। ওদের চোখে ধুলো দিতে মূল রাস্তা ছেড়ে ধরেছিলাম অলিগলি। কিন্তু বদ
নসিব, এক আঘাটায় এসে গাড়ির তেল গেল ফুরিয়ে।
ট্যাঙ্কি ফুল দেখে কেন বেরোইনি, সেসব কথা এখন অবান্তর। তবে কেসটা এবার মাখো
মাখো হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে আমরা তিনজন চটজলদি পরামর্শ করে গাড়ির মায়া ছেড়ে
মালপত্র সমেত রাস্তায় নামলাম। গ্রাম্য এলাকার ওপর দিয়ে শুনশান রাস্তা, লিফট
পাবার ভরসা কম। আমাদের হাতে সময় ছিল না।
জিপিএস বলছে, বাঁদিকটা পশ্চিম আর সেদিকে তিন কিলোমিটার মতো গেলে একটা
হাইওয়ে পড়বে। একবার পৌঁছোতে পারলে রাতের অন্ধকারে একটা ট্রাক ধরে চুপিসাড়ে
রাজ্য বর্ডার পেরোনো অসম্ভব নয়। সেই লক্ষ্যে এক মেঠোপথ ধরে রওনা দিলাম।
সূর্য ডুবে গেছে। আশেপাশে কোনও আলোর রেখা চোখে পড়ে না। তাহলে হয়তো এটা
জনহীন প্রান্তর। সেই ভরসায় জিপিএসে চোখ রেখে সামনে পা বাড়ালাম। আর এটাই হল
দ্বিতীয় ভুল। একটু ভেতরে ঢুকতেই মোবাইল সিগনাল, জিপিএস সব গায়েব। তার মানে,
এবার অজানা পথে বেদিশায় চলা।
তবে বরাত সব সময় মন্দই হয়, তা নয়। হঠাৎ সামনে পড়ে গেল এক য়াম্মি য়াম্মি চিজ।
আমরা সবাই ভুখা ছিলাম, তাই দু’বার ভাবতে হল না। সবে কাজ সারা হয়েছে, রাস্তার
দুধারে কিছু দূরে সারি সারি আলো জ্বলে উঠে আমাদের অস্তিত্বকে দিল নগ্ন করে
ধরিয়ে।
ওঃ, এতক্ষণ লোড শেডিং চলছিল। মৃদু আলোয় অনতিদূরে এবার চোখে পড়ছে সারি সারি
গ্রামের বাড়িঘরের আবছা অবয়ব। ভাবছি এখন কী করে গা ঢাকা দিই, হঠাৎ
নিস্তব্ধতা ভেদ করে জেগে উঠল এক নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, “সর্বনাশ
হয়েছে! কে কোথায় আছো এসো – খুনে, ডাকাত!”
ভাবার অবকাশ ছিল না। মুখ বা খাপ খুলবার আগেই পাব্লিক কেলিয়ে কীচক বধ করে
ফেলবে। সুতরাং বনবাদাড় ভেঙে খিঁচে দৌড়, পেছনে রক্তপিপাসু গ্রামবাসীদের উন্মত্ত
কোলাহল। ছুটতে ছুটতে এক সময় মনে হল পেছনের আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তাহলে
কি ওদের ঝেড়ে ফেললাম? ভাবতে ভাবতেই কিছু দূরে দুরুম দুরুম আওয়াজ আর আমাদের
কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল কয়েকখণ্ড উত্তপ্ত সীসে। বেজম্মাগুলো বন্দুক নামিয়েছে!
সুতরাং আবার প্রাণপণে ছোটা। বেদিশা দৌড়ে পুব-পশ্চিম সব ঘেঁটে ঘ। কাঁধের
বোঝাগুলির ভার প্রতি মুহূর্তে আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে। নিশ্বাসের জন্য বুকটা
আকুলিবিকুলি করছে। আর পারা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে যা হয় হোক যাই দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে।
এমন সময় ম্লান আকাশের আলোয় চোখে পড়ল সামনে একটু দূরে জলরেখার মতো কী
যেন চিকচিক করছে।
নদী? আশায় বুক বেঁধে লাস্ট ল্যাপটা টানলাম। হ্যাঁ, সত্যিই তাই! একটু এদিকওদিক
তাকাতে নজরে এল অতিকায় মানুষের আকৃতির ঝাঁকড়াচুলো একটা গাছের পাশে একটা
ঘাট আর তার পাশে ভেড়ানো একটা নৌকো। চটপট জামাকাপড় একটু ঠিকঠাক করে
এগিয়ে গেলাম। একবার উঠে বসতে পারলে –
কিন্তু এত রাতে মাঝি আছে তো? হ্যাঁ আছে, এক সর্বাঙ্গে ধূসর চাদর জড়ানো মূর্তি।
আমাদের দেখে সে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, “পবন মাঝি। তা, বাবুদের একটু তাড়া আছে
মনে হচ্ছে – যাবেন কোথায়?”
“যাব? মানে, ওপারে।” আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাউয়ি করলাম। আমাদের এখন
এখান থেকে পালাতে হবে, সেটাই বড় কথা। দিক গুলিয়ে গেছে, নদীর নামও জানি না। তবে
মাঝিকে সেসব জিগ্যেস করতে গিয়ে আমরা যে এ তল্লাটের লোক নই সেটা বুঝিয়ে
দেওয়ার দরকার কী? যে নদীই হোক, সেটা নিশ্চয়ই দক্ষিণে বইছে। তাহলে ওপারটা
পশ্চিম। আমরা ঠিক দিকেই এগোচ্ছি।
“বাবুরা মাথাপিছু পঞ্চাশ করে দেবেন। ভাববেন না তাড়া আছে বলে বেশি হাঁকছি। এত
রাতে যাব আসব, অন্য সওয়ারি তো জুটবে না। তাই –”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সে হবে, তুমি চলো তো।” দীপ্ত তাড়া দিল। পবন দাঁড়ের ধাক্কায় নৌকো তীর
থেকে গাঙে নিয়ে ফেলল। তারপর বলল, “ভাড়াটা কিন্তু সবাই আগাম দেয়।”
“আরে দেব, দেব – আমরা কি মাঝনদীতে নেমে পালাব?” দেবু বলল।
“ঠিক, এই নাওয়ে একবার উঠলে কেউ পারানি না দিয়ে পার পায় না।” পবন আনমনে
বলল, তারপর তরতরিয়ে নৌকো বাইতে লাগল। দেখতে দেখতে আমরা গভীর জলে।
আঃ, শান্তি! এতক্ষণে ঐ হিংস্র জনতার হাত থেকে রেহাই পেলাম। গাঙের মুক্ত
হাওয়ায় দেবুর ভাব এসে গেছে। দরাজ গলায় সে গান ধরল,
“বারে বারে আর আসা হবে না।
এমন মানবজনম আর পাবে না।”
আক্ষরিক অর্থে ধরলে, এ যেন আমাদেরই কথা। আমাদের পেছনে মৃত্যু, তাই প্রাণে
বাঁচতে হলে ফিরে আসার উপায় নেই। আমরা শুধু পায়ের চিহ্ন মুছে দিতে দিতে সামনে
চলতে পারি। এই যে শান্ত নদী, চাইলেও কি আবার একদিন তার বুকে নৌকাবিহার করতে
পারব?
পবন অবশ্য গভীর মনোযোগ দিয়ে গান শুনছে। দেবু থামলে সে জিগ্যেস করল, “বাবু,
আপনি এই গান কোথায় শুনলেন?”
“কেন, এ তো ভূমি ব্যান্ডের গান। তুমি জানো?”
“মুখখু গাঁয়ের মানুষ, ব্যান্ড-ফ্যান্ড তো শুনিনি। আমরা এটা জানি ভবা পাগলার গান
বলে।” একটু থেমে সে বলল, “বড় ভাবের গান। কিন্তু তাই কি আর সর্বদা হয়!”
ল্যাম্পের মৃদু আলোয় পবনের মুখটা রহস্যময় হয়ে উঠেছে। বললাম, “কী বলতে চাইছ
তুমি?”
পবন আত্মগতভাবে বলল, “বাবুরা আমাকে একটা গান শোনাবার অনুমতি দেবেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, হয়ে যাক।” সমস্বরে বললাম। পার আসতে এখনও দেরি আছে।
পবন দরাজ গলায় ধরল,
“চাইলেই কি মুক্তি পাবি?
বোঝা নিয়ে কোথায় যাবি!
পাপের দেনা মেটাতে তুই আসবি বারে বারে।
(ও তুই) বোঝার ভারে আসবি ফিরে ভবনদীর পারে।
তা, মুক্তপুরুষ আর ক’জন? পাপীতাপী আমরা তাই ঐ বোঝার ভারে বারবার ফিরে আসি।”
লোকটা আমাদের কাঁধের ভারী ব্যাগগুলোর দিকে ইঙ্গিত করছে না তো? অস্বস্তি চেপে
বললাম, “এটাও কি তোমার ঐ ভবা পাগলার গান?”
“না, বাবু। আমাদের পাড়ায় নিধু ফকির আসে, সে এই গান গায়।”
“রাত তো অনেক হয়ে গেল, পবন। ওপারে থাকার জায়গা কিছু পাওয়া যাবে?” দীপ্ত
জিগ্যেস করল।
“কাছেপিঠেই পাবেন।” সামনের দিকে তাকিয়ে বলল পবন, “পার এসে গেল। এবার বাবুরা
আমার পারানিটা মিটিয়ে দেবেন। গরিব মানুষ, মালিককে দিয়েথুয়ে আমার আর কতই বা
থাকবে?”
“ও, তুমি নাওয়ের মালিক নও?”
“না, বাবু।” পবন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“তা এত রাতে, মালিককে বলার দরকার কী?”
“সে হবার জো নেই। তিনি সব খবর রাখেন। ওপারে গিয়েই হয়তো দেখব বসে আছেন।”
দেবুর ভুরুতে দেখতে পাচ্ছি চিন্তার ভাঁজ। “হ্যাঁ, পারানি তো মেটাতেই হবে। এই শুভ্র –”
বলে সে আমার দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করল।
“হ্যাঁ, দিচ্ছি।”
সব চুকে গেলে আমরা তিনজন লাফিয়ে নামলাম নৌকো থেকে, তারপর সামনে পা
বাড়ালাম।
কিন্তু একটা খটকা লাগছে। বললাম, “পবন লোকটাকে যেন আগে কোথায় দেখেছি?”
“কস্মিনকালেও নয়।” দীপ্ত বলল, “আমরা যে পথে যাই, আর ফিরে আসি না। এই
লোকটার চেহারাটা বাংলা মুভি-সিরিয়ালের টিপিকাল গ্রামবাসীর মতো, তাই অমন মনে
হচ্ছে।”
পবন বলেছিল, থাকার জায়গা কাছেপিঠেই পাওয়া যাবে। কিন্তু চিনে সেখানে যাব
কীভাবে? ঘাটে জনমনিষ্যি নেই। একটাও রিকশা বা টোটোর দেখা নেই। দূরে একটা ভ্যান
রিকশা, কিন্তু চালক নেই। বোধহয় কাছাকাছি বাড়ি, রিকশা ঘাটে রেখে ঘরে গিয়ে
খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছে। শীতকালে এত রাতে এই গণ্ডগ্রামে সওয়ারির আশায় কে বসে
থাকে?
“কী রে শুভ্র, ভ্যান রিকশা চালাবি নাকি?” বলল দীপু।
বললাম, “ইয়ার্কি রেখে আপাতত পা-গাড়িই চালা। আর রাস্তা তো একটাই দেখা যাচ্ছে,
সুতরাং –”
কাজেই এখন সেই একমাত্র গ্রাম্য রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি তিন মূর্তি। শীতটা
জাঁকিয়ে পড়েছে। গ্রামের মাঠের ঠাণ্ডা হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। রাস্তায় মাঝেমধ্যে
টিমটিমে আলো, কিন্তু দুপাশে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দু-চারটে বাড়িঘর থাকলেও
সেখানকার মানুষজন আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এভাবে মিনিট পনেরো হাঁটার পর দূরে
চোখে পড়ল একটা ক্ষীণ আলোর রেখা। আশায় ভর করে এগিয়ে চললাম।
আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর সেখানে হাজির হলাম। রাস্তার পাশে একটা সাদামাটা
দোতলা বাড়ি, সামনে একটা কম পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। এগিয়ে গিয়ে কড়া নাড়লাম।
একটু পরে দরজাটা খুলে গেল আর উঁকি মারল একটা মাঙ্কি ক্যাপ পরা মাথা। “ও,
আপনারা।” সে নির্লিপ্ত স্বরে বলল।
“আমাদের চেনো? জানতে যে আমরা আসব?” অবাক হয়ে বললাম।
“না। তবে রাতবিরেতে ঘাটের সওয়ার ঠাঁই খুঁজতে মাঝেমধ্যেই এখানে এসে জোটে। তাই
ভাবলাম –”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরাও তাই। তা ভেতরে চলো তো বাপু, বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে। কী রুমটুম আছে,
দেখাও।” দেবু সামনে পা বাড়াল।
শক্ত হাতে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে লোকটা বলল, “এটা হোটেল নয়, প্রাইভেট বাড়ি। বাবু
বিদেশে থাকেন, আমি কেয়ারটেকার ভজন। বিপদে আপদে ভদ্দরজনদের আমি মাঝে
মাঝে থাকতে দিই বটে, কিন্তু সবাইকে নয়।”
“না না, আমরাও নিতান্তই ভদ্রজন। আসলে দেবুর বড্ড শীত করছে কিনা, তাই –” দীপ্ত
বিগলিত ভঙ্গীতে বলল, “প্লী-জ ভজনবাবু, ভাড়াটাড়া যা লাগে –”
“আসুন।” ভজন পথ ছেড়ে বলল, “তবে আগে বলাকওয়া তো নেই, ঘরে একটু ধুলোটুলো
হবে।”
“সে আমরা ঝেড়েটেড়ে নেব।”
“এদিকে আসুন।” দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে বলল ভজন, “ওখানকার দুটো ঘর এরকম
হঠাৎ-অতিথিদের জন্য রাখা থাকে। তা, আপনারা ক’দিন থাকবেন?”
“জাস্ট আজকের রাতটা –“
দেবুকে হাতের ইশারায় থামিয়ে বললাম, “না না ভজনবাবু, কালকের দিনটাও ধরুন। এত
রাতে জার্নি করে এসে কাল কখন উঠব তার তো ঠিক নেই।” আসলে আমি বুঝতে
পারছিলাম না এই অচেনা অজানা জায়গায় দিনের বেলা অজস্র সন্ধানী চোখের সামনে
বেরোনো আদৌ ঠিক হবে কিনা।
“তাহলে দুদিনের ভাড়া লেগে গেল, মানে পাঁচশো।” বলল ভজন।
এই গণ্ডগ্রামে – একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? কিন্তু দেবু উল্টোপাল্টা কিছু একটা
বলে বসার আগেই আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “হ্যাঁ, ঠিক আছে, সে দিয়ে দেব’খন।”
“সবাই এখানে ভাড়া আগাম দেয়।”
“এই এলাম, রাত হয়ে গেছে, একটু গুছিয়ে নিয়ে নয় কাল সকালে দিতাম? এই অচেনা
অজানা জায়গায় আমরা তো আর ভাড়া না দিয়ে পালিয়ে যাব না।” দীপ্ত বলল।
“না, সবাই শেষ অবধি ভাড়া মিটিয়েই যায়।” বলল ভজন।
আমি দেবুর কানে কানে বলতে যাচ্ছিলাম, “বাবু তো কোন দূর দেশে থাকে –” কিন্তু যেন
আমার মনের কথা বুঝতে পেরে ভজন বলল, “ভাবছেন, বাবুকে ভোগা দিয়ে ভাড়াটা ভজনই
গাপ করছে? সে হবার জো নেই। আমাকে খুঁটিনাটি সব হিসেব রাখতে হয় আর সেসব
খবরই বাবুর কাছে নিয়মিত পৌঁছে যায়। মাইনে, তার ওপর যা ভাড়া হয় তার থেকে আমি
শুধু সামান্য কমিশন পাই।”
“কিন্তু বাবুর কাছে খবরটা যায় কীভাবে? এই তল্লাটে তো কোথাও মোবাইলে সিগনাল
পাচ্ছি না।”
“নিচের ঘরে একটা তারের ফোন আছে।”
“মানে ল্যান্ডফোন? তা, বাবু তো বললেন বিদেশে থাকেন। এখান থেকে আই-এস-ডি করা
যায়?”
“না, উনিই নিয়মিত ফোন করেন। কালই হয়তো করবেন।”
“কাল কি ওঁর ফোন করার তারিখ?”
“না। কিন্তু এই যে আপনারা এলেন – কোনও অতিথি এলে উনি ফোন করেন।”
অতিথি এলে ফোন করেন? খবর পান কীভাবে? আমরা নিঃশব্দে মুখ চাওয়াচাউয়ি
করলাম। ব্যাপারটা যেন কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠছে।
তবে মনের অস্বস্তি মনেই রেখে বললাম, “এত রাতে – খাওয়া দাওয়ার কোনও
ব্যবস্থা বোধহয় সম্ভব হবে না?”
“ডিম ভাত হতে পারে, একটু সময় লাগবে। অন্য কিছু কাল সকালে দেখা যেতে পারে। তবে
প্রত্যেকটার আলাদা রেট আছে।”
“তা তো থাকবেই।” দীপ্ত তাড়াতাড়ি বলল, “ঐ ডিম ভাতই নিয়ে আসুন। আমরা ততক্ষণ
একটু রেস্ট নিয়ে নিই। আর, মানে – ঐটা পাওয়া যাবে?”
দীপ্তর হাতের মুদ্রা পড়তে পেরে মৃদু হেসে বলল ভজন, “যাবে, তবে দেশি। চলবে?”
“হৈ হৈ করে চলবে।”
“না, আপনারা শহুরে বাবু তো, তাই বলে রাখলাম। তবে –”
“এরও আলাদা রেট আছে তো? কুছ পরোয়া নেহি, সব মিটিয়ে দিয়ে যাব।”
ভজন নিচে যেতে বললাম, “কী বুঝলি?”
“কেস সুবিধের নয়। মানে, এই ভজনের ‘বাবু’টা –” বলল দেবু।
“ওদের লোক বলছিস? দূর, তাহলে কি আর ভজন তার বৃত্তান্ত ঢাক পিটিয়ে বলতে
যেত?”
“তাও বটে। কিন্তু এখানে কিছু একটা গড়বড় আছে।”
“তেমনই গন্ধ পাচ্ছি।”
“আর ভজন লোকটাকেও কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।”
“আমাদের ‘চেনা চেনা’ রোগে ধরেছে। সেকেন্ড কেস অফ ইনফেকশন।” চোখ মটকে বলল
দীপ্ত।
দেবু একগাল হেসে দরাজ গলায় গান ধরল,
“চাইলেই কি মুক্তি পাবি?
বোঝা নিয়ে কোথায় যাবি!
পাপের দেনা মেটাতে তুই আসবি বারে বারে…”
ঠিক তখনই খাবার নিয়ে ঢুকল ভজন। সে অবাক হয়ে বলল, “নিধু ফকিরের গান আপনি
জানলেন কীভাবে, বাবু?”
“হুঁ হুঁ, জানতে হয়! তা, আপনাদের এখানেও কি ঐ ফকির আসে?”
“সে না এলেও তার গান আসে। আচ্ছা আপনারা খান, আমি তবে আসি।”
“আসুন। আর কাল খুব সকাল সকাল ডেকে দেবার দরকার নেই।”
“সে ঠিক আছে। কিন্তু আপনারা কাল এখান থেকে যাবেন কোথায়?”
“আমরা যাব প–”
দেবু ‘পশ্চিমে’ বলার আগেই দীপ্ত বলে উঠল, “মানে, আমরা পথটা যেদিকে গেছে, সেই
দিকেই যাব।”
“ভালো।” ভজন একটু সন্দেহের সুরে বলল, “তবে এই রাস্তায় বাস, টোটো সকালে চালু
হয় আবার সন্ধের আগেই বন্ধ হয়ে যায়। শীতের কালে একবার অন্ধকার হলে মানুষজন
আর রাস্তায় বেরোয় না কিনা।”
“তার আগেই আমরা ঘর ছেড়ে দেব। কতক্ষণ আর ঘুমোব, কী বলিস শুভ্র?” বলল
দীপ্ত।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ।” ঘাড় নাড়লাম।
“কী বুঝছিস?”
খেয়েদেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়েছি। কিন্তু শরীর ক্লান্ত থাকলেও কারও চোখে ঘুম আসছে
না।
“কেস সুবিধের নয়। চোখকান খোলা রাখতে হবে।” বলল দীপ্ত।
“শুনলি তো, অন্ধকার হলে গাড়িফাড়ি চলে না। আর দিনের বেলা বেরোলে ঘ্যামা রিস্ক।”
“দিন ছাড়। সন্ধে হোক, তখন দেখা যাবে।” বলল দেবু।
“কিন্তু দিক বুঝবি কী করে? কাল সন্ধে থেকে এই বিশাল এলাকায় কোথাও ফোনে
সিগনাল পাচ্ছি না। সাধে কি আর অবাঙালিরা West Bengal কে Waste Bengal বলে!”
দীপ্ত বলল।
বললাম, “ওয়েস্ট বেঙ্গলে তো কম ঘুরিনি। কিন্তু এমন সৃষ্টিছাড়া এলাকায় আসার
দুর্ভাগ্য কখনও হয়নি। তবে একটা সিগনাল বোধহয় কেউ বন্ধ করতে পারবে না,
ভোরবেলায় সূর্য এখানেও পুবদিকেই উঠবে।”
“বলছিস?” দেবু হা হা করে হেসে উঠল।
এমন সময় সবার কান খাড়া হয়ে উঠল – নিচের তলায় ক্রিং করে একটা আওয়াজ হয়েই
থেমে গেল। তারপর শোনা গেল ফিসফিস কথার শব্দ।
“ভজনের ‘বাবু’ ফোন করেছে।” বলল দীপ্ত।
দেবু উদ্বেগের স্বরে বলল, “সবাই ঘুমোলে চলবে না, পালা করে জাগতে হবে। তোরা আগে
ঘুমো। আমি ইতিমধ্যে দেখছি জানালার গরাদগুলো আলগা করে রাখা যায় কিনা। জাস্ট
ইন কেস –”
রাতটা অবশ্য নিরুপদ্রবেই কাটল। আমরা পালা করে কিছুটা ঘুমিয়েও নিলাম। সকালে
দেখি জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যদেব উঁকি মারছেন।
“দেবু দ্যাখ, আমরা ঠিক দিকেই যাচ্ছি।” খুশি হয়ে বললাম, “রাস্তাটা পাক্কা পুব থেকে
পশ্চিমে গেছে।”
“আমরা কদ্দুর এসেছি? বর্ডার আর কদ্দুর?” ঘুমজড়ানো চোখে বলল দীপ্ত।
“বলা শক্ত। ঠিক কোথায় আছি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আন্দাজ, বর্ডার
আরও তিরিশ-চল্লিশ কিলোমিটার হবে। কোনও ব্যাপার ছিল না, কিন্তু যেতে হবে
লোকের নজর এড়িয়ে। কে জানে কোথায় ওদের খোঁচড় ঘাপটি মেরে বসে আছে।”
“কুছ পরোয়া নেহি।” দেবু বলল, “সন্ধে হলে যখন সব শুনশান তখনই বেরোব। কিছু না
পাই পা-গাড়ি তো আছে। এক রাতে দশ-পনেরো কিলোমিটার হাঁটা কোনও ব্যাপার নয়,
বড়জোর তিন দিনে বর্ডারে পৌঁছে যাব। পথে এরকম কোনও ঠেক জোটে তো ভালো।
নয়তো দিনের বেলা মাঠেঘাটে, ঝোপেজঙ্গলে থাকব। সঙ্গে যা শুকনো খাবার আছে
তাতেই কোনওমতে চালিয়ে নেব।”
বললাম, “ঠিক আছে। তারপর দেখা যাক, যদি বরাতজোরে কোনও গাড়ি জুটে যায়।”
ব্রেকফাস্টটা বিচিত্র, তবে পেট ভরাবার পক্ষে যথেষ্ট। অমলেট, চা, সঙ্গে পর্যাপ্ত
মুড়ি-মুড়কি। সে পাট চুকে গেলে ভজন বলল, “বাবুরা এবার একটু নিচে আসবেন?”
গেলাম। সেখানে একটা ঘরে টেবিলের ওপর রাখা কিছু খাতাপত্র। তার সামনে বসে ভজন
বলল, “আমার পাওনাটা এবার মিটিয়ে দেবেন?”
“হ্যাঁ, অসুবিধা কী? এই দেবু –”
“হ্যাঁ, দিচ্ছি।”
কাজটা মিটলে তিনজন ওপরে চলে এলাম। এখন বোধহয় বিকেল পাঁচটায় সন্ধে নামে।
অর্থাৎ আরও আট-ন’ঘণ্টা টাইম পাস করতে হবে। ঘুমও দেওয়া যায়। শুধু আশা করি
এর মধ্যে কোনও উটকো বাইরের লোক এসে পড়বে না।
সন্ধের অন্ধকারে বেমালুম হয়ে আমরা পথে বেরিয়েছি। সোজা ঐ পথটা ধরেই চলেছি।
বোধহয় কিলোমিটার দুই হেঁটেছি, পেছনে প্যাঁকপ্যাঁক গাড়ির হর্ন। ঘুরে দেখি, সিঙ্গল
হেডলাইট। একটু কাছে এলে, একটা টোটো।
রাস্তার ওপর ঝাঁপিয়ে দাঁড় করালাম। ভেতর থেকে উঁকি মারছে একটি জিজ্ঞাসু মুখ।
টোটোয় আর কোনও যাত্রী নেই। বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে বসলাম।
“আরে, কথা নেই বার্তা নেই উঠে পড়লেন যে?”
“হবে হবে, সব হবে, আগে চলো তো। তা ভাই, তোমার নামটা কী?”
“সুবল। তা, কোথায় যাবেন না বললে চলবটা কীভাবে?”
“যাব, মানে যাব, সামনে যাব।” দেবু তোতলাতে লাগল।
সুবলের চোখে সন্দেহের ছায়া দেখে বললাম, “আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেন? দে না বলে।”
“দেব? মানে ভাই আমরা বর্ডার অবধি যাব।”
“বর্ডার?”
“মানে, এই রাজ্যের বর্ডার। তা, তোমার টোটো কি তদ্দুর যাবে? নইলে ধারেকাছে –”
“বুঝলাম। না, রাস্তাটাই তো তার আগে শেষ হয়ে যাবে। তদ্দুর নিয়ে যাচ্ছি, দুশো দেবেন।”
“ওখান থেকে বর্ডার কি অনেক দূর?”
“না, মাইল কয়েক দূর। তবে মধ্যের রাস্তায় ঝোপজঙ্গল। পথ না চিনলে ভুলে
উল্টোমুখেও চলে যেতে পারেন। আপনাদের মুঠোযন্ত্রও তো ওখানে চলবে না। “
“সে দেখা যাবে।” চিন্তিতভাবে বললাম।
“আর গেলেন নয় বর্ডারে, পার হতে পারবেন?”
দেবু একগাল হেসে বলল, “সে সব মন্ত্র আমাদের জানা আছে।”
“দেখুন।” উদাস ভঙ্গীতে বলে সুবল গান ধরল,
“চাইলেই কি মুক্তি পাবি?
বোঝা নিয়ে কোথায় যাবি!
পাপের দেনা মেটাতে তুই আসবি বারে বারে…”
“উঃ, আবার সেই নিধু ফকির!” দাঁতে দাঁত চেপে বলল দীপ্ত।
“ও, বাবুরা নিধু ফকিরের গান জানেন!” বলল সুবল, “তা, আমার –”
“ভাড়াটা? ওটা নিশ্চয়ই সবাই আগেই দেয়?”
একগাল হেসে বলল সুবল, “বাবুরা দেখি দেশের হালচাল বুঝে ফেলেছেন।”
“কিন্তু অত তাড়া কীসের? শেষ অবধি যাচ্ছি, আমরা তো আর ভাড়া না মিটিয়ে মাঝপথে
পালাব না।”
“না, তা কেউ পালাতে পারে না।” সুবল হঠাৎ যেন কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।
হু হু করে চলছে টোটো, রাস্তাঘাট জনমানবহীন। বললাম, “কিন্তু এই অবেলায় তুমি যে
বড় টোটো বের করলে? এখন তো রাস্তাঘাটে কেউ বেরোয় না।”
“শেঠ বললেন যাও, এখন সওয়ারি মিলবে, তাই বেরোলাম।”
“ও, টোটো তোমার না?”
“না, বাবুরা। আপনাদের ভাড়ার বেশিটাই শেঠ পাবে, আমার সামান্য কিছু থাকবে।”
মালিক – বাবু – শেঠ – যাঁরা সব জানেন! ব্যাপারটা রহস্যজনক আর বিপজ্জনকও বটে।
আশ্চর্য যে তবু সত্যিকারের কোনও বিপদের লেশমাত্রও এখনও দেখা দেয়নি। আমরা
অবশ্য সব সময় প্রতিরোধের জন্য টানটান তৈরি, তবু একটা শিরশিরে অস্বস্তি।
“এসে গেছি।” হ্যাঁচকা ব্রেক কষল সুবল। দেখলাম, ঘুটঘুটে অন্ধকার এক আঘাটা।
সামনে আর আশেপাশে হালকা-ভারি ঝোপজঙ্গল।
“এখানে, এই অন্ধকারে –”
“আপনারা তো সেটাই পছন্দ করেন, তাই না?” বোঝা গেল না সুবল ঠাট্টা করছে কিনা।
তবে এবার ও হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার ভাড়াটা –”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এই দীপ্ত –”
টোটোর থেকে নেমে দীপ্ত বলল, “এই সুবল লোকটাকে তোদের চেনা চেনা লাগল
না?”
আমি আর দেবু হা-হা করে হেসে উঠলাম, “এবার আমাদের থার্ড মেম্বারও ‘কোথায় যেন
দেখেছি’ রোগে আক্রান্ত।”
সুবলের কথা সত্যি হলে বর্ডার এখান থেকে ঘণ্টা দুয়ের হাঁটাপথ। কিন্তু এই অন্ধকারে
বেদিশায় পথ হাতড়ে হাতড়ে এগোলে সেটা ক’ঘণ্টায় দাঁড়াবে কে জানে!
তবু চেষ্টা তো করতেই হবে। এতদূর এগিয়ে আর পেছোনোর প্রশ্ন নেই। তাই যা থাকে
কপালে ভেবে ঢুকলাম জঙ্গলে। তারপর যে রাস্তায় এসেছি সেটা পুব-পশ্চিমে ধরে নিয়ে
সেই আন্দাজে এগোতে লাগলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হল দিক ঘুলিয়ে গেছে।
অন্ধকারে পথ হাতড়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছি। হঠাৎ অনতিদূরে মৃদু আলোর রেখা। কে যেন
একটা লণ্ঠন হাতে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে সে আলোটা আমাদের মুখে তুলে ধরল।
একটি আঠেরো-কুড়ির গ্রাম্য মেয়ে।
“আপনারা?”
“আমরা – মানে, তিন ভদ্দরলোকের ছেলে। বর্ডারে যাব। এখান থেকে কদ্দুর?”
“দূর বেশি নয়। তবে আপনারা অমাবস্যের অন্ধকারে এই জঙ্গলে পথ চিনতে পারবেন না।
বরং রাতটা কোনওভাবে কাটিয়ে ভোরে আলো ফুটলে সুয্যি দেখে সোজা পশ্চিমে চলে
যাবেন। রাতে যদি চান তো আমাদের কুঁড়েতে থাকতে পারেন। আসবেন?”
প্রস্তাবটা লোভনীয়। কিন্তু মেয়েটির শরীরের আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে একটা নিশ্বাস
ফেলে বললাম, “আমাদের দেরি করার উপায় নেই, বোন। তার চেয়ে যদি তুমি আমাদের
একটু পথ দেখিয়ে দাও?”
একটু ভেবে মেয়েটি বলল, “বেশ। তবে দুশো লাগবে।”
মওকা পেয়ে যে যা খুশি হাঁকছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল দীপ্ত, “বেশ, দেব। তোমার নাম
কী, বোন?”
“সুশীলা। হয়তো ভাবছেন আপনাদের বিপদ বুঝে যা খুশি দর হাঁকছি। কিন্তু এই করে আর
কাঠকুটো কুড়িয়েই তো আমাদের পেট চলে। তাছাড়া, এর বেশিটাই তো বাবাকে দিতে হবে।
আমার আর কতটা থাকবে?”
“বাবা মানে, তোমার বাবা?”
“আমাদের সবার বাবা। তার কথাতেই তো মাঝে মাঝে সাঁঝবেলায় জঙ্গলে এসে বেদিশা
পথিকের খোঁজ পাই।”
“হুম।” দেবু গম্ভীরভাবে বলল, “টাকাটা নিশ্চয়ই আগাম চাই? আর তুমি নিশ্চয়ই নিধু
ফকিরের গান শোনো?”
“কী করে জানলেন?” মেয়েটি অবাক খুশিতে বলে উঠল।
“অভিজ্ঞতার থেকে। তবে তুমি এটাও জেনো, তোমার পাওনাটা আমরা মিটিয়ে দেব,
কিন্তু এখন নয়।”
“বেশ। তবে সবাই শেষ অব্দি আমাদের পাওনা মেটায়, নইলে বেরোতে পারে না।”
“তা তো বটেই। এবার চলো।”
অন্ধকারে লণ্ঠনের আলোয় পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে সুশীলা। গাঁয়ের লোকের ‘মাইল
কয়েক’ মানে অন্তত দশ কিলোমিটার, দু’ঘণ্টার রাস্তা। সুশীলা সামনে অবলীলায় প্রায়
ছোটার বেগে এগিয়ে চলেছে। তাল রাখতে আমাদের হাঁফ ধরে যাচ্ছে।
কতক্ষণ কেটেছে হিসেব নেই। এক সময়ে সুশীলা বলল, “প্রায় এসে গেছি, আর একটু।”
“তাই?” খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠলাম।
“এবার আমার পাওনাটা মিটিয়ে দিন।”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই।”
তবে এবার কেউ একা নই, আমরা তিনজন মিলে।
পথ অবশ্য কিছুটা বাকি। কিন্তু জঙ্গল হালকা হয়ে এসেছে, বাকি পথটুকু নিজেরাই চিনে
নিতে পারব। এতক্ষণে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে – নানা বিপদ এড়িয়ে, বিচিত্র
অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেষ অবধি প্রাণ হাতে করে পালাতে পারলাম। আসার পথে
কোনও চিহ্ন রাখিনি, তাই ওরা আমাদের খোঁজ পাবে না। স্রেফ আর দু-এক ঘণ্টার
মামলা। একবার বর্ডার পেরোতে পারলেই মুক্তি! এরপর শুধু স্মৃতিতেই থেকে যাবে গত
চব্বিশ ঘণ্টায় দেখা এক বিচিত্র জগৎ, যেখানে সবাই ভাড়া আগাম চায় আর নিধু
ফকিরের গান জানে। যাদের মালিক, বাবু, শেঠ বা বাবা আড়ালে থেকেও সব হিসেব রাখে।
আর যেখানকার মানুষগুলোকে কেমন চেনা চেনা লাগে।
সুশীলার ক্ষেত্রে অবশ্য চেনা চেনা লাগার প্রশ্ন ওঠেনি, কারণ অন্ধকারে তার চেহারা
ভালোভাবে বোঝাই যায়নি। তবে আমার মনে একটা জিজ্ঞাসা থেকে গেছে – গ্রামবাংলার
সব ডাঁসা মেয়েদেরই কি বাঁ স্তনে আঁচিল থাকে?
জঙ্গল শেষ হয়ে এল। আঃ, কী স্বস্তি! এবার কি সামনে একটা চেকপোস্ট পড়বে? নাকি
হাইওয়ে, যা ধরে কিছুদূর গেলেই বর্ডার? একরাশ উত্তেজনা বুকে নিয়ে বেরোলাম।
কোথায়, পথ তো নয়, এ যে একটা নদী। এইজন্যেই কি সুবল বলছিল পেরোব কীভাবে?
ঠিক আছে, নদী যখন আছে তখন ফেরিঘাট বা খেয়াঘাটও থাকবে আর সেখানে লঞ্চ বা
নৌকোও মিলবে। এক নদী পেরিয়ে এসে পড়েছিলাম এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার জগতে।
আবার আর এক নদী পেরিয়ে পৌঁছে যাব এক রেহাইয়ের রাজ্যে। খুশিমনে এগিয়ে চললাম।
এই অদ্ভুতুড়ে রাজ্যে আর যাই গোলমাল থাক, সূর্যটা ঠিক দিকে উঠেছে আর আমার
ঘড়িটা ঠিকঠাক চলছে। আড়চোখে দেখে নিলাম, তারিখ পনেরোই ডিসেম্বর। ঘণ্টাখানেক
পর বারোটা বাজলে সেটা ষোলই হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, গতকাল অর্থাৎ চোদ্দই ডিসেম্বরটা আমাদের জীবনে ছিল এক স্মরণীয় দিন বা
ডি-ডে। আমরা তিন শিক্ষিত বেকার যুবক চাকরি না পেয়ে বেশ ক’বছর সাইডে এটাসেটার
চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। সাইবার হেরাফেরিতে টুকটাক মন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু একবার
নাম ফাটতে ফাটতে একচুলের জন্য বেঁচে যাওয়ার পর লাইনটা বদলাতে হল। ঘুরেফিরে
শেষে ধরলাম সুপারির ব্যবসা, মানে কিঞ্চিৎ অর্থের বিনিময়ে কোনও অভাগাকে
পটলডাঙার টিকিট ধরিয়ে দেওয়ার ধান্দা। কারবার বেশ জমে গেছিল। আমরা প্রত্যেকে
এক এক ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। দেবু ওস্তাদ অস্ত্রোপচারে, দীপ্ত লক্ষ্যভেদে আর
আমি হস্তশিল্পে অর্থাৎ স্রেফ ঘাড় বা গলার দুর্বল অংশে কৌশলী টোকায় টার্গেটকে
ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার আর্টে। তিনে মিলে এক নিটোল টিম।
তবে প্রথম থেকেই আমরা নিজেদের পেছন পরিস্কার রাখার ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। কিছু
নিয়ম বেদবাক্যের মতো মেনে চলতাম। এক, হাই প্রোফাইল কেস নিতাম না – এ অভাগা
দেশে তো রোজ কত লাশ পড়ছে, চুলকানোর কেউ না থাকলে কে তার খোঁজ রাখে? দুই,
রেকি করার সময় শিওর হয়ে নিতাম যে কাজ সেরে নিরাপদে বেরিয়ে আসার রাস্তা পাকা।
তিন, বেরিয়ে আসার সময় পায়ের সব চিহ্ন মুছে দিয়ে আসতাম। আর চার, একবার
মাড়ানো পথে দ্বিতীয়বার পা ফেলতাম না। এতসব স্ব-আরোপিত বিধিনিষেধের জেরে
আমাদের রোজগার কিছু কম হত, কিন্তু লাইফে নিশ্চিন্তি ছিল।
সেই নিশ্চিন্তি শেষ অব্দি আমরা নিজেদের হাতে চুরমার করলাম লোভের ফাঁদে পা দিয়ে।
দেবীপ্রসাদ সিং ওরফে ডিপি, ডাকসাইটে নেতা আর বালি মাফিয়া ডন। প্রতিদ্বন্দ্বীরা
তাকে ফেলে দেওয়ার জন্য মরীয়া হয়ে লোক খুঁজছিল আর আমাদের নাম কীভাবে যেন
তাদের কলবুকে ঢুকে গিয়েছিল।
তারপর আর কী – অবিরাম পীড়াপীড়ি, প্রলোভন। শেষ অব্দি অফারটা এত অবিশ্বাস্য
অঙ্কের হয়ে দাঁড়াল যে গিলেই ফেললাম টোপটা। কাজটা অবশ্য খুব রিস্কি। রেকি করে
দেখা গিয়েছিল অ্যাকশন করতে হবে দুপুর বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে, যখন লোকটা তার
এক উপপত্নীর বাড়িতে খেতে আর বিশ্রম্ভালাপ করতে যায়। একমাত্র তখনই তার
সিকিউরিটি একটু ঢিলা। রেকিতে আরও বোঝা গেছিল কাজটা সহজে সারা যাবে, কিন্তু
প্রকাশ্য দিবালোকে কলকাতার জমজমাট এলাকা থেকে পালাতে দম লাগবে। খবরটা
চাউর হওয়া মাত্র রাজ্যে তোলপাড় শুরু হবে। পুলিশ ধরলে বড়জোর যন্ত্রণাহীন
এনকাউন্টার। কিন্তু ডিপির দলের হাতে পড়লে প্রথমে আমাদের কারা লাগিয়েছিল
জানার জন্য জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নেবে, তারপর কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে। পার্টিও বলে
দিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের মধ্যে তারা কোনও প্রোটেকশন দিতে পারবে না।
কিন্তু কোনওমতে যদি বর্ডার পেরোতে পারি? তাহলে আমরা রাজা!
তবে পার্টি পালাবার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেটা ডিপির রক্ষিতার
কমপ্লেক্সের বাইরে পার্ক করে রাখা ছিল। নম্বর পাল্টানো চোরাই গাড়ি, পরে ফুটেজ
থেকে ধরা পড়লে সমস্যা নেই। ঐ গাড়িতেই তিনটে ব্যাগে রাখা ছিল আমাদের পাওনা
টাকা আর অত্যাবশ্যক কতগুলো জিনিসপত্র। গাড়ির চাবি আর কিছু অ্যাডভান্স
আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তখনকার মতো হাত ধুয়ে ফেলেছিল পার্টি।
কাজটা ঠিকমতোই সারা হয়েছিল। তবে এসব কেসের এক স্থায়ী ঝামেলা আনুষঙ্গিক
ক্ষয়ক্ষতি বা ‘কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ’। চলার পথে কোনও চিহ্ন তো ফেলে যাওয়া যায়
না। ডিপি সিকিউরিটি ছাড়াই রক্ষিতার বাড়ি আসত, কিন্তু এক বিশ্বস্ত ড্রাইভার কাম
অনুচর তার সঙ্গে থাকত। সেই রামভক্ত হনুমানটি দেবুকে নিরস্ত্র ভেবে জাপটে ধরতে
গিয়ে তার শল্যচিকিৎসার স্বাদ পেয়েছিল। পালাবার সময় এক অটো ড্রাইভার গাড়ি
দিয়ে রাস্তা আটকানোর চেষ্টা করে দীপ্তকে টার্গেট প্র্যাকটিসের সুযোগ করে
দিয়েছিল। আর এই তালেগোলে আমাদের গাড়িটা বিলা হয়ে গেছে সন্দেহ করে যখন
পালাবার জন্য নিরালা এক রাস্তায় অন্য একটা গাড়ি ধার নিচ্ছিলাম, তার ড্রাইভারটা
চাবি আঁকড়ে থাকার চেষ্টায় গলায় আমার হাতের একটা টোকা খেয়েছিল। তখন কি
জানতাম, গাড়িটার ট্যাঙ্কি ঢনঢন!
গাঁয়ের মেয়েটার অবশ্য কোনও দোষ ছিল না। কিন্তু কপাল, নিরালা অন্ধকার রাস্তায়
তিন তিনটে তরতাজা জোয়ান ছেলের সামনে পড়ে গেল। বেচারি, লোড শেডিংটা যদি আর
একটু আগেও শেষ হত!
ঐ অদ্ভুত রাজ্যে গিয়ে পড়ার পর অবশ্য আমাদের পথের বোঝা বাড়ল। পবন, ভজন,
সুবল, সুশীলা – কর্তাদের কাছে খবর আর পাওনা পৌঁছোবার আগেই তাদেরও পথ থেকে
সরে যেতে হল। চলার পথে পেছনে তো কোনও চিহ্ন ফেলে রাখা যায় না।
শুধু একটাই খটকা – মানুষ বিনা প্রতিবাদে যায় না। অন্তত হাত-পা ছোঁড়ে, খামচায়,
কামড়ায়। কিন্তু এই অচিনপুরের মানুষগুলি ব্যতিক্রম। তারা যেন কেমন দাওয়াই পড়তে
না পড়তেই নেতিয়ে গেল।
যাক, সব দুঃস্বপ্নেরই শেষ হয়। অসম্ভব রিস্ক নিয়েও আমরা শেষ অব্দি বেরিয়ে তো
এলাম! ঐ তো কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে একটা ঘাট। সেখানে একটা নৌকোও দেখতে পাচ্ছি।
ওটায় চড়ে বসতে পারলেই বর্ডার পেরিয়ে মুক্তির রাজ্যে। তর আর সইছে না, তিনজন
ছুটতে শুরু করলাম।
কিন্তু এত রাতে নৌকোয় মাঝি আছে তো? আছে, সর্বাঙ্গে ধূসর চাদর জড়ানো এক
মূর্তি। আমাদের দেখে সে নিরুত্তাপ ভঙ্গীতে বলল, “পবন মাঝি। তা, বাবুদের একটু তাড়া
আছে মনে হচ্ছে – যাবেন কোথায়?”
ধাক্কাটা সামলে এবার পেছনে তাকাতেই চোখে পড়ল ঘাটের পাশের সেই ঝাঁকড়াচুলো
গাছটা। কাল ঠিক এই সময় এখান থেকেই রওনা দিয়েছিলাম। এত পথ নাক বরাবর সামনে
ছুটে চলার পর আজ আবার ঠিক সেখানেই ফিরে এসেছি!
কিন্তু কী বললাম, গতকাল এখানে এসেছিলাম? আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম,
জ্বলজ্বল করছে চোদ্দই ডিসেম্বর। সময় কখন নিঃশব্দে একদিন পেছিয়ে গেছে!
নৌকো এখন মাঝনদীতে। আমরা চুপচাপ পাটাতনে বসে। ফুরফুর হাওয়া দিয়েছে। পবন
গান ধরেছে,
“চাইলেই কি মুক্তি পাবি?
বোঝা নিয়ে কোথায় যাবি!
পাপের দেনা মেটাতে তুই আসবি বারে বারে,
(ও তুই) বোঝার ভারে আসবি ফিরে ভবনদীর পারে।”
আর আমরা বসে বসে ভাবছি। একটু ভাবতেই ‘চেনা চেনা লাগা’র রহস্যটাও গলে গেছে –
পালাবার পথের ‘কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ’রাই এই অচিনপুরীতে আমাদের কাছে ফিরে এসে
দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন রূপে। ছিনতাই করা গাড়িটির অনুগত ড্রাইভার হচ্ছে পবন, ডিপির
বিশ্বস্ত অনুচরটি ভজন, অবরোধকারী অটো ড্রাইভার সুবল আর অন্ধকার গ্রামের
পথে আমাদের সামনে পড়া মেয়েটিই সুশীলা। মুর্খ আমরা বুঝিনি যে মানুষ মরে একবারই!
সুতরাং আমরা এক আবর্তে পড়ে গেছি। এই অচিনপুরীতে আমাদের যারা সঙ্গী ও তাদের
যে ওপরওয়ালা, সবার পাওনা না মিটিয়ে এই আবর্ত থেকে আমাদের বেরোনোর উপায়
নেই। কিন্তু আমাদের ঐ ভারী ব্যাগগুলি উজাড় করে দিয়েও কি আমরা কখনও তাদের
সমস্ত পাওনা মেটাতে পারব?
ভেবে কূল পাচ্ছি না। অথচ হাতে সময়ও বেশি নেই। একটু পরেই নাও তীরে ভিড়বে আর
পবন এসে বলবে, “বাবুরা, আমার পারানিটা?”