বাজীগর ও বনলতা
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

১ 
কাগজের অফিসে বসেই ল্যাপটপে সেলিব্রিটিদের ট্যুইটার, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ঘাঁটছি। বলা কি যায়, কখন কেঁচো খুঁড়তে ফণা তুলে গোখরো বেরিয়ে আসে। আমাদের কাজটাই এমন যে সাপ দেখলে আমরা মুখে মুখ লাগিয়ে চুমু দিই। পাকা সাপুড়েদের কায়দায় খালি হাতে বিষ ঝেড়ে, কৌটোর মধ্যে যত্ন করে জমিয়ে রাখি। সময় সুযোগ বুঝে নেশার গুলি বানিয়ে পাঠক পাঠিকাদের পরিবেশন করি। তারাও গিলবে বলে হাঁ করে বসে থাকে। আসলে গসিপ ছাড়া ফিল্ম ম্যাগাজিন চলে না। আমার বস রোজই বিষাক্ত খবর চায়। আরে বাবা, সাপেদের দাঁতেও কি রোজানা বিষ জমে? কে বোঝাবে সে কথা?

ফেসবুক প্রোফাইলে ছবিটা দেখে চেনা চেনা লাগল। মনে হল, সৌভিক। বেশ কিছুদিন পরে দেখলাম। বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মোটা চশমার ফ্রেমের মধ্যে উজ্জ্বল দুটো চোখ। রোদ্দুরের চিলিবিলিতে পরিচয় কতকটা ক্যামোফ্লেজড। প্রোফাইলে নাম দেখলাম – বাজীগর। তাতে কী? ফেসবুক প্রোফাইলে আমি ঘটা করে নিজের নাম রেখেছি – বনলতা। কাগজেও ওই নামে লিখি। কোন কবি আমার মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য খুঁজতে আসছে? তবু মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। সৌভিক তো এখন রীতিমত পাবলিক ফিগার। তার আবার পরিচয় গোপন করার কী দরকার পড়লো? ব্যাপারটা সন্দেহজনক। ইনভেস্টিগেট করে দেখতে হচ্ছে।  

শৌভিকের নম্বরটা থাকা উচিত। টেবিলে পড়ে থাকা মোবাইলটা তুলে সৌভিকের নম্বর খুঁজলাম। সার্চ করতেই নামটা ভুস করে ভেসে উঠল – সৌভিক সেন। দোনামোনা করে কল বাটন টিপলাম। অন্য দিক থেকে সৌভিকই সাড়া দিল। গলা চিনতে ভুল করার উপায় নেই। আসা যাওয়ার রাস্তায় যখনই গাড়ির এফ এম চালাই অবধারিত ভাবে সৌভিকের ভরাট গলা আছড়ে পড়ে। মুড যেমনই থাক, শুনতে ইচ্ছে করুক বা না করুক, শুনতেই হয়। আপাতত বাংলা গানের জগতে এক নম্বর। অবশ্য গানটা ভালোই গায় সৌভিক। শুনেছি ক্ল্যাসিকাল ট্রেনিং আছে। আশ্চর্য হলাম, সৌভিক আমায় চিনতে পারল। বলল, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন? ফোন নম্বর নিয়েছিলেন, ফোন করেননি তো?’

আমি কাব্যিক খোঁচাটা গায়ে মাখলুম না। কথার সোজা জবাব না দিয়ে বললাম, ‘দেখা করতে চাই।’

এক কথায় রাজি হয়ে গেল। আধ ঘণ্টা পরে পার্ক স্ত্রীটের একটা রেস্তোরাঁয় ডাকল। ব্যাগ গুছিয়ে অফিস থেকে বেরোলাম। 

খুব দূর নয় আমাদের অফিস থেকে। হেঁটেই যাওয়া যায়। বেরিয়েই দেখি ঠা-ঠা রোদ্দুর। এমনিতেই মুখে বেশি রঙ লাগানোর অভ্যাস নেই। লাগাই, যেটুকু না লাগালে নয়। এই রোদ্দুরে হেঁটে যেতে হলে সেটুকুও গলে-ঝরে যাবে। অগত্যা গাড়ি নিলাম। পার্ক স্ট্রীটে জায়গা মত পার্কিং পেতে সময় লেগে গেল। হন্তদন্ত হয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। অপেক্ষা করে চলে যায়নি তো? ভিতরে আলো কম। চোখ সইয়ে নিয়ে দেখি একটা কোণে সৌভিক বসে আছে। মুখের অর্ধেক অন্ধকার, যাতে সহজে কেউ চিনতে না পারে। আমি চিনলাম। 

চেহারাটা ইদানীং বেশ শাঁসে-জলে হয়েছে। উদীয়মান সঙ্গীত শিল্পী সৌভিককে প্রথম দেখি একটা ফ্যাশন শো কভার করতে গিয়ে। বছর খানেক আগে। সৌভিক তখন খ্যাংরা কাঠির মাথায় আলুর দম, ছম্মক-ছল্লু উঠতি মডেল শ্যামলীর সঙ্গে লিভ-ইন করছে। শ্যামলী র‍্যাম্প কাঁপাচ্ছে আর সৌভিক গ্যালারীর এককোণে বসে হাঁপাচ্ছে। চোখের নীচে কালি, বোঝা যায় বান্ধবীটিকে সামলাতে পারছে না, বেশ চাপে আছে। বাজারে জোর খবর শ্যামলীর হাতে দু’-চারটে ফিল্মের অফারও আছে। কখন কী কাজে লাগে, সৌভিকের কাছে গিয়ে মোবাইল নম্বর চাইলাম। ফ্যাসফ্যাসে গলায় মোবাইল নম্বর দিল। লোকটাকে দেখে মায়াই হল। 

শ্যামলী অবশ্য বেশি দিন রইল না। সৌভিককে ছেড়ে তার ফিল্ম প্রোডিউসারের কাউচ-সঙ্গিনী হয়ে গেল। সৌভিকের শাপে বর হল। সে পরপর ক’খানা সাংঘাতিক বুক নিংড়ানো গান গেয়ে ফেলল। দু’পার বাংলার ল্যাং খাওয়া, হেরে যাওয়া মানুষেরা সেই গানগুলো শুনে পাগল হয়ে গেল। ইউ টিউবে তার মিউজিক ভিডিও দেখে একা ঘরে সোমত্থ মেয়েরা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালো। চারিদিকে কেবল সৌভিকের দাড়ি না-কাটা মুখ। বেশ কটা এওয়ার্ডের নমিনেশনও নাকি অলরেডি সে বগলদাবা করেছে। 

হাত বাড়িয়ে বললাম, কনগ্রাচ্যুলেশন! তোমার গানে লাইকের সংখ্যা তো গিনেস বুক অভ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তুলল বলে। সৌভিক হাসল। সাফাই দিল, ‘কে না জানে পৃথিবীতে হেরো মানুষের সংখ্যাই বেশি। তারা বন্ধু খোঁজে আর তারাই রূপকথা তৈরি করে, সেলিব্রিটি বানায়,’ এমন ভাবে বলল যেন তার নিজের কোন কৃতিত্ব নেই।  

গসিপ ম্যাগাজিনে কাজ করি বলে খবরগুলো জানতাম। জানতাম, শ্যামলীর ফিল্ম তার প্রোডিউসারকে নিয়ে ডুবেছে। আর যাই থাকুক, প্রোডিউসারের উপপত্নীর অভিনয় করার দায় থাকে না। তাই ব্যাপারটা আশ্চর্যের নয়। যেটা জানতাম না সেটা সৌভিক জানালো। শ্যামলী আবার নাকি সৌভিকের কাছে ফিরে আসার জন্য বায়না করছে। বলা ভালো রীতিমত জ্বালাতন শুরু করছে। সৌভিক ফোন নেয় না। শ্যামলী ফেসবুকের চ্যাটবক্সে মেসেজ পাঠায়, উত্যক্ত করে। দেখা করতে চায়। সৌভিক একবার আঙ্গুল পুড়িয়েছে। আর আগুনের দিকে হাত বাড়াতে চায় না। তাই সে নাম বদলে নতুন প্রোফাইল খুলেছে। এমন চটপটা খবর পাবার জন্যই তো আমরা মুখিয়ে থাকি। সৌভিক আমায় ডেকে এনে এমন খবর দেবে ভাবিনি। ফিরে গিয়েই ল্যাপটপ বাগিয়ে বসতে হবে। 

সৌভিকের চোখে কিন্তু জিতে যাওয়া মানুষের উল্লাস নেই। বরং বিষণ্ণতা। বলল, ‘জানি না কেন, ক’দিন ধরে আপনার কথাই মনে পড়ছিল, বনলতা।’

অবাক হয়ে কিংবদন্তীর পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে তাকালাম। আমাকে আবার তার কী দরকার পড়ল? সৌভিক কি উত্তরের প্রত্যাশায় ছিল? কথা না বাড়িয়ে কফির কাপের তলানিটুকু ছেড়ে রেখেই উঠে পড়লাম। আমাদের প্রোফেশনে হাঁসের মতন থাকতে হয়। পদ্ম দিঘির জল থেকে ডাঙায় উঠে ডিঙি মেরে একবার ঝটপট ডানা ঝেড়ে নাও, ব্যাস গা শুকনো। অফিসে ফিরে ল্যাপটপের খাঁ-খাঁ স্ক্রীনে চোখ রেখে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। একটা শব্দও টাইপ করতে পারলাম না। সৌভিক হঠাৎ আমাকে ডেকে এত খবর দিল কেন? আমি জার্নালিস্ট। আমার না-হয় মনে রাখা সাজে, সৌভিক কেন আমাকে মনে রেখেছে? একবার মাত্র দেখা, গোনাগুন্তি ক’টা কথা… ভাবতে ভাবতে মাথাটা ভার হয়ে গেল। পাশের টেবিল থেকে আত্রেয়ী বলল, ‘কীরে ছেমড়ি, হল কী তোর? ল্যাপটপের ওপর অমন হুমড়ি খেয়ে পড়লি কেন? মাথা ঠুকে যাবে যে!’

উঠে গিয়ে ভেন্ডিং মেসিন থেকে কফি নিয়ে এলাম। আত্রেয়ীর জন্যও এক কাপ আনলাম। কফিতে চুমুক দিয়ে আত্রেয়ীকে ঘটনাটা বললাম। অফিসে ওই একমাত্র যাকে বললে পাঁচকান হবে না। আত্রেয়ী অবভিয়াস কথাটাই বলল, ‘সৌভিক তোর প্রেমে পড়েছে। সাবধানে থাকিস।’  

বললাম, ‘ভ্যাট, ফাজলামি করিস না। মরছি নিজের জ্বালায়!’ 

বলতে না বলতেই ল্যাপটপের স্ক্রীনে ফেসবুক নোটিফিকেশনের পপ আপ এল – বাজীগর হ্যাজ সেন্ট ইউ আ ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট। আত্রেয়ী আমার কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখছিল। বলল, ‘একদম নিবি না লতু। এ’সব লোক দু’-মুখো সাপের মত হয়।’  


সবে অফিসে এসে বসেছি। অফিস টাইম পার করে আসলে ট্রাফিক একটু কম পাই। ফেরার সময়ের ঠিক নেই। তাই সকালে একটু দেরিতে আসলেও বস বিশেষ আপত্তি করে না। আসা ইস্তক দুটো গোলা পায়রা খোলা জানলায় ঘুটুর-ঘুটুর করছে। মন দিয়ে তাদের গ্রীবায় রামধনুর রঙ-বাহার দেখছি, আত্রেয়ী পাশ থেকে বলল, ‘তোকে একটা খবর দেবার ছিল।’

আমি মুখ ফেরালাম। আত্রেয়ী ধীরে সুস্থে টেবিলে রাখা কাঁচের গেলাসের ঢাকা সরিয়ে জল খেতে শুরু করল। মনে হল না জানানোর কোনো তাড়াহুড়ো আছে। জল খাওয়া শেষ করে ল্যাপটপে চোখ ডোবাল। যেন ভুলেই গেছে কিছু বলছিল।  

‘কী খবর?’

আত্রেয়ী ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল, ‘তোর সেই ধোয়া তুলসী পাতা বাজীগর সৌভিক – সে নাকি আগরওয়ালের নতুন ছবির জন্যে শ্যামলীকে রেকমেন্ড করেছে।’

আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই জানলি কোত্থেকে?’

জিজ্ঞেস করেই বুঝলুম প্রশ্নটা নেহাতই বোকা-বোকা হয়ে গেল। আমাদের প্রোফেশনে খবরের সোর্স জিজ্ঞেস করতে নেই। কেউ বলে না। আসল কথা হল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি রাবণ হলে আগরওয়াল তার দশ মাথার একটা। তার ছবিতে কাজ পেলে শ্যামলীর ঝুলে যাওয়া কেরিয়ারটা আবার দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু সৌভিক রেকমেন্ড করেছে? যে মেয়ের মুখ দেখতে চায় না, তাকে এমন একটা লোভনীয় কাজের জন্য সুপারিশ করবে? ইন্ডাস্ট্রিতে মানুষ এক হাতে দেয় এক হাতে নেয়। সৌভিক কী পেল জানতে ইচ্ছে করছিল খুব। উইকেন্ডের ডিনারে যে মানুষটাকে দেখেছি তার সঙ্গে মেলাতে পারছিলাম না। গত সপ্তাহে দেখা করার পর ভেবেছিলাম সৌভিক পর্বের সেখানেই ইতি। বড় জোর একটা ছোটখাটো আর্টিকল দিয়ে উপসংহার। কিন্তু মন থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলার আগেই ফোনটা এসেছিল, ‘শনিবার সন্ধেবেলা চলে আসুন।’

না, না করেও পৌঁছে গিয়েছিলাম নামী রেস্তোরাঁটাতে। হাজার হোক এইসব পার্টিতেই ইন্ডাস্ট্রির অধিকাংশ খবরাখবর তৈরি হয়। গিয়ে দেখি, ও হরি! আমার একারই নেমন্তন্ন। সন্দেহ হচ্ছিল আত্রেয়ী ঠিকই বলছিল। মক্কেল আমার প্রেমে পড়েছে। অস্বস্তি হচ্ছিল। আগে জানলে অন্তত ঠোঁটে গালে একটু রঙ চড়িয়ে আসা যেত। জিনস টপের বদলে সালোয়ার কুর্তা। সৌভিকের অবশ্য সেদিকে খেয়াল ছিল না। দেখলাম তার গাল ভরা হাসি চোখেও ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হল আমায় দেখে যথার্থই খুশি হয়েছে। বলল, ‘জানেন তো আজকাল কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না। সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে চলে।’  

মন খুলে কথা বলার আর লোক পেল না? ফিল্ম জার্নালিস্টের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা আর পাঁচ তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়া মোটামুটি এক। কোনওমতে প্রাণে বাঁচলেও হাড়গোড় ভেঙ্গে ‘দ’ হয়ে যাবে। সৌভিককে কে বোঝায় সে কথা। সে তখন পুরনো কথার ঝাঁপি খুলে বসেছে। তার ছোটোবেলার কথা, গান শেখার কথা।

‘জানেন তো আমাদের কো-এড স্কুল ছিল। আমাদের গানের দিদিমণিকে খুব সুন্দর দেখতে ছিল। যখন গান শেখাতেন আমরা ছেলেরা সব হাঁ করে তাকিয়ে থাকতুম, লিট্যারালি… মানে মুখটা হাঁ হয়ে যেত। এমনি ভাবে…’ বলতে বলতে সৌভিক হা-হা করে হেসে উঠল। আমিও হাসলুম। কথা শেষ আর হয় না। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় একবার জিজ্ঞেস করলুম, ‘শ্যামলীর খবর কী? আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল নাকি?’

অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘সে তো করেই। আমি ফোন ধরি না। লোকের মুখে খবর পাই থার্ড গ্রেড মুভিতে কাজ নিচ্ছে।’ 

সৌভিকের চোখে যন্ত্রণা দেখে কথা ঘুরিয়েছিলাম। 

প্রাণখোলা আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম। সৌভিক নিজেই ড্রাইভ করে বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। খুব ইচ্ছে করছিল ওকে ডাকি এক কাপ কফি খেয়ে যেতে। রাত্রির শেষ কাপ কফির নেশা যে জানে সে জানে। খোলা দরজায় কাজের মেয়েটা ঘুম-ঘুম চোখে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওকে বলতেই পারতাম, যা গিয়ে শুয়ে পড়। নিজেই না-হয় দু’-কাপ কফি বানিয়ে নিতাম। হাতে কফি নিয়ে লিভিংরুমের সোফায় পা মুড়ে বসে আরও কিছুক্ষণ গল্প করা যেত। সৌভিক কি আসত? সেদিন মনে হয়নি লোকটার মধ্যে কোনও শঠতা আছে। ডাকিনি সেদিন। ভেবেছিলাম, আর ক’দিন যাক। 

আত্রেয়ীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যি বলছিস?’

আত্রেয়ী খিঁচিয়ে উঠল, ‘বিশ্বাস না হয়, বসকে জিগা। আগরওয়ালের নাতির নামকরণের পার্টিতে মাল খেতে গিয়েছিল। সেখানেই শুনে এসেছে। তুই শালা, ল্যাড়ল্যাড় করছিস কেন? এত আঠা কীসের?’  

রেগে গেলে আত্রেয়ীর মুখ দিয়ে কাঁচা খিস্তির ফোয়ারা ছোটে। ওকে বেশি না ঘাঁটানোই ভালো আপাতত। সকাল-সকাল মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। সেভাবে দেখলে সৌভিক শ্যামলীকে কাজের জন্য সুপারিশ করল কি না করল তাতে আমার কী যায় আসে? কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথাও যেন পাড় ভাঙল। অল্প-অল্প করে যে বিশ্বাসটা তৈরি হচ্ছিল সেটা টলে গেল। আর্টিকলটা নিয়ে এখনও বসতে পারিনি। এবার হয়তো লিখতে পারব। লেখার জন্য একটা বিষয় থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরে দাঁড়াতে হয়। সৌভিক আমায় সেই সুযোগটা তৈরি করে দিল। আমি ডেস্ক ছেড়ে উঠলাম। ওয়াশ রুমে গিয়ে চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে চুলটা মাথার পিছনে টান-টান করে বাঁধলাম। ফিরে এসে ল্যাপটপ টেনে লিখতে বসলাম। দু’-লাইন লিখতে না লিখতেই পিঠে হাতের স্পর্শ পেলাম। ফিরে দেখলাম আত্রেয়ী হাসি-হাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ‘বলল, এই তো লক্ষ্মী মেয়ে, এই জন্যেই তোকে এত… দাঁড়া কফি নিয়ে আসি।’ 


ঘাড়ে টোকা দিয়ে কস্তূরী বাই জানিয়ে গেল, ‘লতাদিদি তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এয়েচে গো।’

অফিসের আগাপাশতলা স্পিক এন স্প্যান রাখা থেকে খিদের মুখে গরম-গরম চায়ে নাস্তা সাপ্লাই করার ভার কস্তূরীর। নীল পাড় সাদা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রাতদিন অফিসটা চষে বেড়ায়। ড্রাইভারের কামরা থেকে বসের কেবিন পর্যন্ত তার অবাধ যাতায়াত।  

‘কে রে?’

‘জানি না, আগে দেখিনি। ভিজিটর্স রুমে বসিয়েছি।’  

ঝট করে মনে হল সৌভিক। গত দুদিনে অন্তত পনেরোবার কল করেছে। আমি ধরিনি। অফিস পর্যন্ত উজিয়ে এসেছে, এখন দেখা না করাটা নিতান্তই অভদ্রতা হবে। উঠে ভিজিটার্স রুমের দিকে এগোলাম। কাঁচের দরজার বাইরে থেকে দেখে মনে হল একটা মেয়ে বসে আছে। ভিতরে ঢুকে অবাক হলাম – শ্যামলী। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। এক বছর আগে দেখা ঝাঁ চকচকে রূপের ছায়া মাত্র। বোঝা যায় ইদানীং বিশেষ ঘষা-মাজা নেই। চোখ মুখ বসে গেছে, চুল উস্কোখুস্কো, একটা ময়লা সালোয়ার কামিজ পরে আছে। ওড়নাটা কুণ্ডলী পাকিয়ে সোফার ওপর নামিয়ে রাখা।  
কাছে যেতেই আমার হাত দুটো টেনে নিয়ে বলল, ‘দিদি আমায় সৌভিককে ফিরিয়ে দাও।’

আ গেলও যা! চেনা নেই জানা নেই। আমি তোর কোন সম্পর্কের দিদি? বাপ মা সহবৎ শেখায়নি? ন্যাকাপনা দেখে রাগে গা-পিত্তি জ্বলে গেল। বললাম, ‘এটা অফিস, নাটক কোরো না। বোসো।’

শামলী বসল। কিন্তু আমার হাত ছাড়ল না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার কাছে এসেছ কেন?’

শ্যামলী বলল, ‘ও তোমার কথাই শুনবে। তোমাকেই বন্ধু মানে। আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না।’

বললাম, ‘মানে? তোমায় তো কাজ দিয়েছে। এখন তো তোমার পোয়া বারো। আবার কী চাই?’

‘আমায় কাজ দিয়েছে? কোথায়?’

‘কেন? আগরওয়াল প্রোডাকশনের নেক্সট ফিল্মে তুমি তো হিরোইনের রোল করছ! শুনলাম এগ্রিমেন্ট সাইন হয়ে গেছে। পছন্দ হচ্ছে না?’

শ্যামলী আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল, ‘কে বলল তোমায়? সৌভিক আমায় কাজ দেবে? পাগল হলে? কে রটাচ্ছে এই সব গুজব? দিদি প্লীজ, সৌভিককে বলবে একবার আমার সঙ্গে কথা বলতে? শুধু একবার… তুমি বললেই শুনবে। আমি জানি।’ 

আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে। কোনওমতে শ্যামলীকে বললাম, ‘আচ্ছা বলে দেখব।’

ফিরে এসে দেখলাম আত্রেয়ী মাথা নিচু করে বসে আছে। আমার চেয়ার টেনে বসার আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলল, ‘খান্‌কি মাগীটা কী বলতে এসেছিল?’

আমি আত্রেয়ীর কথার জবাব দিলাম না। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম ওর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠছে। ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘আমায় মিথ্যে বলেছিলি কেন?’  

আত্রেয়ী ফেটে পড়লো, ‘লতু, তুই ওর কথা বিশ্বাস করছিস?’

আত্রেয়ীর গলা শুনে অফিসের অন্যান্যরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আত্রেয়ী উঠে চলে গেল দুম-দুম করে পা ফেলে। দু’-মিনিট পরে আমিও উঠলাম। আমরা সবাই যেখানে বসি তার ঠিক পিছনে লম্বা টানা বারান্দা। দরজা খুলে বেরিয়ে দেখলাম কস্তূরী বাই মেঝে মপ করছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আত্রেয়ীকে দেখেছ?’  

কস্তূরী বারান্দার শেষ প্রান্তে ওয়াশ রুমের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল। বলল, ‘দেখো তো গিয়ে। আত্রেয়ীদিদির বোধয় শরীর খারাপ। আমিও আসছি হাতের কাজ সেরে।’

আমি এগোলাম। ওয়াশ রুমে ঢুকে দেখলাম আত্রেয়ী বেসিনের ওপর দু’-হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঢুকতেই মুখ তুলল। দু’-চোখ ভরা জল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হল তোর?’ 

আত্রেয়ী নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। আমায় বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদে ফেলল। জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘শোন লতু, তুই আমার, তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না। একটা উটকো লোক তোর সঙ্গে শোবে আমি সহ্য করতে পারব না রে।’  

আমি চমকে উঠলাম। আত্রেয়ীর চোখের জলে আমার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। ওর শরীর থেকে ঘাম আর পারফিউম মেশানো একটা জৈব গন্ধ উঠে আসছে। আত্রেয়ীর হাত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে। আমি এখন কী করব? যে কোনও সময় কস্তূরী এসে দাঁড়াবে ওয়াশ রুমের দরজায়। কোমর পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই আত্রেয়ীর হাত ঠেলে সরিয়ে দেব? নাকি আমিও ওকে দু’-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলব, ‘কাঁদিস না আত্রেয়ী। আমি কোথাও যাব না।’  

কস্তূরী আসার আগেই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

10 Comments

  • Arup Bandyopadhyay

    Reply June 30, 2023 |

    চমতকার গল্প। খুব ভালো চমক।

    • সিদ্ধার্থ মজুমদার Siddhartha Majumdar

      Reply July 1, 2023 |

      চমৎকার গল্প। নিপুণ বুনোট।
      গল্পের শেষ মোচড়টা বেশ ভালো লাগল।

    • Supriyo Lahiry

      Reply July 2, 2023 |

      আরে দারুণ, দারুণ। ঝটকা একেই বলে।

  • Mausumi Chaudhuri

    Reply June 30, 2023 |

    খুব খুবই ভালোলাগল গল্পটি। শেষের চমকটি অনবদ্য রেশ রেখে গেল।

  • গোরা চক্রবর্তী

    Reply July 1, 2023 |

    ভালো লাগলো গল্পটি। চমকটা ভালোই জমে উঠেছিল।

  • yashodhara Ray Chaudhuri

    Reply July 1, 2023 |

    শেষ চমক সত্যিই চমক। তবে পুরোটাই লেখা র গুণে এত ভাল।লাগল। টান টান।

  • Gautam Bandyopadhyay

    Reply July 2, 2023 |

    চমৎকার… শেষে গিয়ে পুরো নদীটাই একটা ডুবসাঁতার হয়ে গেল…

  • KOUSHIKEE CHATTERJEE

    Reply July 7, 2023 |

    আজকাল বিখ্যাত পত্র-পত্রিকাগুলোতে গতানুগতিকতার বাইরের কোন গল্পই ছাপে না। তারা কি চারপাশের দুনিয়াটা চোখ খুলে দেখে না একবারও- কত নতুন শষ্যের চাষ হচ্ছে পৃথিবীতে?
    ভাল লাগল- কথাটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

  • PALLAB CHATTERJEE

    Reply July 7, 2023 |

    আজকাল বিখ্যাত পত্র-পত্রিকাগুলোতে গতানুগতিকতার বাইরের কোন গল্পই ছাপে না। তারা কি চারপাশের দুনিয়াটা চোখ খুলে দেখে না একবারও- কত নতুন শষ্যের চাষ হচ্ছে পৃথিবীতে?
    ভাল লাগল- কথাটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

  • ঝর্না বিশ্বাস

    Reply July 8, 2023 |

    দারুন গল্প সিদ্ধার্থদা…

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...