প্রথম মহিলা নাট্যকার সুকুমারী দত্ত
তনিমা হাজরা


খুব নীরবে পেরিয়ে যাচ্ছে একটি অত্যন্ত মূল্যবান ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক মুহূর্ত। যে দৃশ্যে পর্দা উঠলে দেখা যাচ্ছে এক আবছা হয়ে যাওয়া প্রতিভাময়ী রমণীর মুখ।

আলোআঁধারির সেই দৃশ্যপটে, আজ থেকে দেড়শো বছর আগে কলকাতায় বসে একজন ‘সিঙ্গেল মাদার’ নিজের সন্তানের গ্রাসাচ্ছদনের জন্য অনন্যোপায় হয়ে প্রতিষ্ঠা করছেন মেয়েদের অভিনয় ও নৃত্যগীত শেখাবার স্কুল এবং  আয়ের পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন কেবলমাত্র মহিলাদের নিয়ে থিয়েটারের দল। এমনকি সেই দলের অভিনয়ের জন্য জেদের বশেই কেবলমাত্র মহিলা চরিত্র নিয়েই লিখে ফেলছেন  পূর্ণাঙ্গ একটি নাটক। এটিই ভারতের ইতিহাসে প্রথম মহিলা বিরচিত ও নির্দেশিত নাটক। সেই  নাটকের নাম “অপূর্ব সতী”।

এই সেই সমাজ যা তদ্দিনে বেশ এগিয়ে গেছে নবজাগরণের পালে হাওয়া লাগিয়ে। রামমোহন সতীদাহ-রদ আইন পাশ করিয়ে ফেলেছেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবাদের দ্বিতীয় বিবাহের সমর্থনে আইন পাশ করিয়েছেন, মাইকেল মধুসূদন থিয়েটারে নারীচরিত্রের অভিনয়ের জন্য দাড়িগোঁফকামানো পুরুষকে হটিয়ে জলজ্যান্ত নারীকেই এনে ফেলেছেন।

“অপূর্ব সতী”!  আহা! নামের ভিতরেই কী অদ্ভুত একটা দোলা, অর্থাৎ এই যে আমাদের সমাজের মাথারা যাঁরা  পুরুষের বহুবিবাহকে সহজভাবে নিচ্ছেন, কিন্তু নারীর একগামিতা ও সতীত্ব নামক বিষয়টি নিয়ে আবহমানকাল ধরে যাঁদের বড্ড চিন্তা, তাদের কাছে আমাদের এই নাট্যকার মঞ্চে নিয়ে আসছেন এক বিয়োগান্ত নাটক। ইনি সেকালের সমাজে অবশ্য “নাটুকে মেয়েছেলে ” উপাধিতে ব্যঙ্গায়িত। এই নাটক কি তাঁর সমাজের মূলস্রোতের কাছে তথাকথিত পতিতা বলে আখ্যায়িত নারীদের তরফ থেকে কৈফিয়ত, নাকি সঠিক অধিকার পাওয়ার দিকনির্দেশ করে সপাটে জবাব?

তা সে কৈফিয়ত বা সপাট জবাব যাইহোক না কেন তিনি কিন্তু পুরুষদের উদ্দেশ্য করে সে নাটকের মুখবন্ধ লিখছেন না। 

সমাজের ঘরোয়া মেয়েছেলেরা, যাঁরা রঙ মেখে ষ্টেজে বারোভূতের মনোরঞ্জন করেন না, যাঁরা  সিঁথেয় সিন্দুর দিয়ে স্বামী সন্তানের মঙ্গল কামনায় হাজারো বারব্রত করে, স্বামীর পাদোদক খেয়ে আর উদয়াস্ত ঘরের ঘাটুনি খেটে, সংসারের সক্কলকে তোয়াজ করে নিজের ভালোলাগা, মন্দলাগা এমনকি  নিজের অস্তিত্বটুকুনও হেঁসেলের আগুনে নুড়োর মতো  গুঁজে দিয়েছেন, সে কেবলমাত্র  নিজেকে যথেষ্টরূপে সতী বলে প্রমাণ করে তুলবার জন্যই তো। এমন জীবনের আকাঙখাই কি নাট্যকারের, নাকি অবজ্ঞা সেই জীবনের প্রতি?
তাই বুঝি সেইসব মহিলাদের  উদ্দেশেই নাটকের মুখবন্ধটি  লিখছেন তিনি।
” হে আমার পাঠিকাগণ! তোমরা এখনো কি জ্যোতি প্রার্থী? তোমরা শিক্ষিতা, উন্নতমনা… আমরা তোমাদের বিরাগ বা প্রীতির আকাঙ্ক্ষী নই, যদি আমাদের ভাগ্যবলে তোমাদের উৎসাহ প্রাপ্ত হই… তাহাই আশাতিরিক্ত”।

আশা করছেন, তাঁরা যদি তাঁদের আন্তরিক সহমর্মিতা ও সমবেদনার আলোতে এইসব রঙ্গালয়বর্তিনী মেয়েদের শিল্পচর্চা ও জীবনের  দিকে তাকাবার ও তাঁদের নিয়ে ভাববার খানিক অবসর পান।  নাকি আলোর দুনিয়ায় বাস করা মেয়েরা আঁধারের দুনিয়ার মেয়েদের ভিতরের আগুন দেখে যদি নিজেদের প্রায় নিভন্ত আগুনে ইন্ধনটুকু উস্কে দিয়ে মিথ্যে সতীত্বকে কয়লা ঘুঁটের সাথে সাথে উনুনে জ্বালিয়ে ছাইকে আলিঙ্গন করে উঠে দাঁড়াতে শেখেন, কোনটা?

এই সেই যুগ যেখানে ঘরের মহিলা আর নাটুকে মেয়েছেলেদের নামের মধ্যেও একটা ফারাক রেখে তাঁদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হতো যে, কী তাঁদের সামাজিক অবস্থান। তাঁদের পদে পদে অপদস্থ করে বুঝিয়ে দেওয়া হতো তাঁরা পতিত, তাঁরা সমাজের পবিত্র মূলস্রোতের বাইরে নর্দমার জল।  তাই তো বাপের হদিশ না জানা খারাপ পাড়ার মেয়ে পদবিহীনা গোলাপবালা যখন বিবাহিত হয়ে সামাজিক অবস্থান পাবেন আশা করছেন তখন তিনি বড় আশায় নিজেকে নামকরণ করছেন “সুকুমারী দত্ত”। কিন্তু এই অবস্থানে ফিরেও তাঁর কি মুক্তি আছে?  বরং পরিস্থিতি হচ্ছে একেবারে বিপরীত। বেঁকে দাঁড়াচ্ছে সমাজের বুদ্ধিমান মাথারা৷ মাথা খাটিয়ে তাঁকে স্বামী বিচ্ছিন্না করে হীনবল করতে চাইছে।   ঘুচিয়ে দিতে চাইছে  তার মূলস্রোতে প্রবহমানতার সাহসী পদক্ষেপ। এটাই কি এই নাটক লেখার পিছনের ইন্ধন?

মাইকেল মধুসূদন দত্ত চেয়েছিলেন যুগান্ত আনতে। মঞ্চে শুধু পুরুষেরই একচেটিয়া অধিকার কেড়ে নিয়ে নারীরও প্রবেশপথ করে দিতে  মৃত্যুশয্যায় বসে তিনি  লিখেছিলেন “মায়াকানন” নামে একটি নাটক। তাঁর বৈপ্লবিক সাধ ছিল, সেই নাটকে বাংলার  রঙ্গমঞ্চে নারী চরিত্রে অভিনয় করুন মহিলারাই। বিদ্যাসাগর তার বিরোধিতা করলেন। তবুও সব বাদানুবাদ, দ্বন্দ্ব দ্বিধা কাটিয়ে জিতলেন মাইকেল মধুসূদনই।
বেঙ্গল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা তথা ছাতুবাবুর নাতি শরৎচন্দ্র ঘোষ ১৮৭৩ সালে বিভিন্ন নিষিদ্ধ পল্লি থেকে নিয়ে এলেন ৪ জন অভিনেত্রীকে।  আমরা মঞ্চে দেখলাম  গোলাপসুন্দরী, জগত্তারিণী, এলোকেশী ও শ্যামাকে। গোলাপসুন্দরী এসেছিলেন শ্রীরামপুর নিকটবর্তী মাহেশের একটি নিষিদ্ধ পল্লি থেকে। কিন্তু মাইকেলের দুর্ভাগ্য তিনি সেই অভিনয় দেখে যেতে পারলেন না। আর “মায়াকানন”ও মঞ্চে নামাতে ভরসা পেলেন না শরৎচন্দ্র ঘোষ। একে মহিলাদের নিয়ে প্রথম নাটকের শো, তায় অনামা নাটক, তাই  বেছে নিলেন মধুসূদনেরই বিখ্যাত  ও জনপ্রিয় নাটক “শর্মিষ্ঠা”।

‘শর্মিষ্ঠা’র  নামভূমিকায় অভিনয় করলেন গোলাপসুন্দরী। তারপর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’য় তিনি করেছিলেন মতিবিবি।

বারাঙ্গনাকন্যা গোলাপসুন্দরীর অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার এই সংগ্রাম কিন্তু  বিস্ময়কর। সাহায্য পেয়েছিলেন এক মহতী হৃদয় মানুষের, তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস। উপেন্দ্রনাথ গোলাপের বিবাহ দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তর সঙ্গে। এই ঘটনা নিয়ে তখনকার সমাজে প্রবল নিন্দাবাদ হয়েছিল। উপেন্দ্রনাথকে নিজের পিতৃসম্পর্কও ত্যাগ করতে হয়েছিল এর খেসারত হিসেবে। গোষ্ঠবিহারী–সুকুমারীর মর্যাদাপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের ব্যবস্থা করে দিলেন উপেন্দ্রনাথ । তারা ভদ্রপল্লীতে এসে বাসা বাঁধলেন।

কিন্তু সমাজের তা সহ্য হলো না  উপেন্দ্রনাথের  পিতা এগিয়ে এসে  সম্পর্ক পুন:স্থাপিত করে  উপেন্দ্রনাথকে বিলাতে পাঠিয়ে দিলেন।  গোষ্ঠবিহারী দেখলেন, তিনিই বা কেন শুদুমুদু বলির পাঁঠা হয়ে সমাজের গালিগালাজ সইবেন?  তাই তিনিও ভুল শুধরে উপেন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে  জাহাজের খালাশি হয়ে বিলাত চলে গেলেন  সুকুমারীকে ছেড়ে।  সুকুমারী যখন স্বামী পরিত্যক্তা হন, তখন তিনি এক কন্যাসন্তানের জননী।

স্বামী পরিত্যক্তা সুকুমারী কিন্তু থেমে থাকেননি। সেখান থেকেই দৃঢ়হৃদয় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন। মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুললেন। কিন্তু সেটা বেশি দিন চালাতে পারলেন না, কারণ বারাঙ্গনার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে ভদ্রলোকেরা কেউ মেয়ে পাঠাতে চাইলো না। তাই খুলে ফেললেন “ন্যাশনাল ফিমেল থিয়েটার “। বাজারের মেয়েদের কাছে এই থিয়েটার হয়ে উঠলো বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে বাঁচতে চাওয়ার এক মুক্তিমন্দির।
ন্যাশানাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য সুকুমারী লিখলেন “অপূর্ব সতী”নাটক।

গল্পটির সারমর্ম অনেকটা এই রকম:—এক যৌনকর্মীর মেয়ে নলিনী স্কুলে পড়ে, শিক্ষিতা হতে চায় এবং কোনও ভদ্রপল্লির বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এক সময়ে চন্দ্রকেতু নামক ধনী, নিষ্ঠাবান পুরুষের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হলে, এক সুস্থ জীবনের আকাঙ্খায় তারা পালিয়ে যায় কাশী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভদ্রসমাজ তাদের বিচ্ছেদ ঘটায়, নলিনীর আত্মহত্যা দ্বারা নাটকটি শেষ হচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে কাশীর ঘাটে তার শবদেহ এবং সবাই তাকে অশ্রুসিক্ত চোখে আখ্যায়িত করছে “অপূর্ব সতী “।

নাট্যকার হয়ত তখন এই নাটকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এমন উপাধি পেয়ে যৌনপল্লীতে বেড়ে ওঠা এক কন্যা শেষমেশ তার যোগ্য সম্মান পেতে সক্ষম হবে।

ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
একমাত্র কন্যার শিক্ষার বিষয়ে কোন অবহেলা করেননি সুকুমারী। কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু একটা দুঃখ বয়ে বেড়াতে হয়েছিল তাকে আমৃত্যুই। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখার অধিকার ছিল না সুকুমারীর। অথচ দায়িত্বহীন গোষ্ঠবিহারীর মতো পালিয়ে নিজেকে না বাঁচিয়ে দায়িত্বশীলভাবে গোলাপ তার কন্যাকে পিতৃ ও মাতৃ উভয় পরিচয়ই দিতে পেরেছিলেন যোগ্যতার সাথে।

১৮৯০-৯১ পর্যন্ত গোলাপবালা  নানান থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। তারপর কবে যে কোথায় চলে গেলেন তা আর জানা যায় না। অন্ধকার জগত থেকে আলোয় ফেরা গোলাপদের জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ তখনকার সমাজ মনে রাখেনি। সম্মান তো দেয়ইনি বরং পদে পদে অপমান করেছে এতবড় একজন প্রতিভাধরকে শুধুমাত্র সে ভিন্নস্রোত থেকে উঠে আসা একজন নারী বলেই।

গোলাপ নিজেই কি জানতেন তাঁর অভ্যন্তরীণ স্বর্গীয় সুগন্ধের এতবড় কথাটা?  জানতেন না বলেই সমাজের কাছে  সতীত্বের এই বৃথা  ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিলেন। আর তাঁর  নিজের অজান্তেই তিনি কী অনন্য এক কীর্তি রেখে গেলেন সাহিত্যের ইতিহাসে।
ভন্ড সমাজের তুচ্ছ আর হাস্যকর  সতীত্বের ষ্ট্যাম্পের চেয়েও সে সম্মান অনেক অনেক বড়, সেই সম্মান হলো তাঁর মাথার উপরে চিরউজ্জ্বল রত্নখচিত সেই ইতিবৃত্ত, যাতে লেখা আছে স্বর্ণাক্ষরে, “ভারতের প্রথম মহিলা নাট্যদল স্থাপয়িতা, প্রথম মহিলা  নাট্যনির্মাতা ও নাট্যকার ” হবার শিরোপা।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...