পুরাণে প্রান্তিক যৌনতা
শমীক জয় সেনগুপ্ত

[পরিচিতি: জন্ম ৯ই অক্টোবর ১৯৮৬ (বাংলা ২২শে আশ্বিন ১৩৯৩)। বাবা : শ্রীযুক্ত অভিজিৎ সেনগুপ্ত। মা : স্বর্গীয়া কেতকী সেনগুপ্ত। শিক্ষা: ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। লেখালিখি শুরু ১৯৯৪ সাল থেকে কচিকাঁচা সবুজ সাথী পত্রিকার শিশু বিভাগে। ৯০এর দশকের কনিষ্ঠতম কবিদের মধ্যে একজন হলেও নিজেকে লিটিল ম্যাগাজিন কর্মী বলতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্ বোধ করেন। বারো বছরের মত সময়কাল ধরে শমীক জয় সেনগুপ্তর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে আসছে সপ্তপর্ণ পত্রিকা। লিটিল ম্যাগাজিন এর সাথে সাথেই কলকাতা ক্যুইয়ার মুভমেন্ট ও অ্যান্টি ৩৭৭ আন্দোলনে শমীক জয় সেনগুপ্ত অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ। বই: নদীর কাছে ওরা ক’জন (২০১৬)পকেট ফুল অফ জয় (২০১৭)পুরাবর্ত্ম (২০১৭)
পুরস্কার ও সম্মান: কচিকাঁচা সবুজ সাথী শিশু সাহিত্য সম্মান(১৯৯৬), সরলাবালা বিশ্বাস স্মৃতি সম্মান (১৯৯৯) ও চুণী কোটাল সম্মান (২০১৭)]
২০১৭-র পর কেটে গেছে এতগুলো বছর। আকাশের মেঘকে ডেকে বললেম, “আমাকে দেখে তোমার কি একটুও কষ্ট হয় না?
আষাঢ়ের বর্ষাবিহীন মেঘ, গুমোট বাড়িয়ে দূরে চলে গেল। তার সময় নেই আমার মেঘদূত হওয়ার। আর কার কাছেই বা সে আমার বার্তা পৌঁছে দেবে। আমি কি ছাই নিজেই জানি। ছেলেবেলা থেকে একটা প্রবচন প্রায়শই শুনতাম, “সেই কোন কালে ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছ আর এখনো হাতে তার গন্ধ শুঁকছো।” আমার অবস্থাও খানিকটা সেরকম। আমার মন হৃদয় শরীর সবটুকু আচ্ছন্ন করে রাখা পুরাণ মহাকাব্যের চরিত্ররা বহুকাল ধরে আমার সঙ্গে আর কথা বলছে না।
কিন্তু এমন কথা তো তাদের সঙ্গে আমার ছিল না। আমি জানি চোখ বুজে একবার স্মরণ করলেই সমস্ত চরিত্ররা আমার মধ্যে এসে হাজির হয়। আমি খুব করে চাইলাম একবার আগুনের মধ্যে প্রবেশ করতে, তারপর হোমানলে শুচিস্নিগ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসতে।
কিন্তু আমার কৃষ্ণবর্ণ রং আগুনের আভায় খেলা করলো না । বরং শ্রাবণের মেঘের মতো পুঞ্জীভূত হয়ে সে বেষ্টন করলো তমাল শাখা। কপালে এঁকে দিল রসকলি। বাসন্তী ধুতি আর গোলাপি উত্তরীয় পরে এ বন থেকে ও বন ছুটে বেড়াতে বেড়াতে খেয়াল হলো আমার মুকুটে লাগানো কলাপ আর কিরীটীর ভূজপাশে গচ্ছিত হয়ে আছে। বিগত জন্মান্তরের আকুতি গলায় জড়িয়ে কিরীটী (অর্জুনের আরেকটি নাম) বলেছিল, “মোহন, একবার তোমার শ্রীঅঙ্গে মোহিনীরূপ ধরো, দেখে তৃপ্ত হব”।
পূর্বের কোন জন্মে কখনো সে ছিল পিনাকপাণি চন্দ্রশেখর মহাদেব। আর আমি মধুসূদন, শ্রীবিষ্ণু। আমাদের প্রণয়, ও পরবর্তীতে রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ জন্ম নিচ্ছে এক নতুন প্রাণ, নববিধানের ঈশ্বর, আয়াপ্পা।
আবার কোন জন্মে আমি ঋষি শ্রেষ্ঠ নারায়ণ, প্রিয়বরেষু নরের কণ্ঠলগ্ন হয়ে নিভৃত বনাঞ্চলে, বদ্রীনাথের পার্বত্য উপত্যকায় যোগসাধনায় রত। তখন কে কল্পনা করেছিল আমার প্রেমিক নর জন্মান্তরে সব বিস্মৃত হবে। তখন কুরুক্ষেত্রের আগে তাকে ব্রহ্মের স্বরূপের সঙ্গে পরিচিত করাতে আমাকেও বাঁশী সুদর্শন ছেড়ে রথের লাগাম ধরতে হবে।
সেদিনও আজকের মত সমস্ত জনারণ্যের অধিপতি, সমাজপতি ইন্দ্রর রোষভাজন হতে হয় দুই পুরুষের আত্মিক মিলনকে। নর ও নারায়ণের দাম্পত্য ভালো চোখে দেখেননি তৎকালীন দেবসমাজের ইন্দ্র। তাই আমাদের মত তথাকথিত বাঁকা পুরুষদের চাবকে নয় , নারী দিয়ে সোজা করবার প্রয়াস করতেই ইন্দ্র পাঠালেন দেবভোগ্যা বারাঙ্গনাদের। মেনকা রম্ভা ঘৃতাচী ও আরো কতজন। হৃদয় মন্থন করে যারা পুরুষের শরীর মনে জন্ম দিতে পারে আকাঙ্ক্ষা সেই সব দুর্লভ স্ত্রীদের কেবলমাত্র পণ্য করে পাঠালেন রাজা দুই পুরুষের সংসারে ফাটল ধরাতে। কিন্তু ওর অভিসন্ধি যে আমাদের কাছে লুকানো ছিল না সে কথা ইন্দ্র স্বয়ং ভুলে গিয়ে ছিল। তাকে শায়েস্তা করতে আমাদের উরুর কোশ থেকে জন্ম দিলাম কৌশিকী উর্বশীর। দুজন পুরুষের কোষজাত এক সন্তান। রূপে গুণে জ্ঞানে যে দেবতাদের কাছেও আকাঙ্ক্ষার চরম নিদর্শন হয়ে উঠতে সক্ষম। যাকে পাওয়ার জন্য রাজা ছাড়তে পারে সিংহাসন, যোগী বিস্মৃত হয় যোগের কথা, সেই অনিন্দ্যকান্তি লাবণ্যময়ী কন্যাকে নিজেদের দাম্পত্য রক্ষার্থে, স্বার্থপরের মত দান করলাম রাজ-করে। শর্ত একটাই উর্বশীর বদলে ইন্দ্র আর কখনো আমাদের বিরক্ত করবে না।
তাই এ কথা মানতেই পারি যে অর্জুনকে অদেয় আমার কিছুই নেই, কারণ সেও প্রতিটি জন্মেই আমার কাছে সমর্পণ করেছে। কিন্তু মোহনবেশ ছেড়ে মোহিনী হওয়ার প্রক্রিয়া বা সময় আসেনি। অর্জুন আমাকে কৃষ্ণ রূপেই পেতে পারে, কিন্তু মোহিনী! তাকে যে কুরুক্ষেত্রের আগে কেবলমাত্র অর্জুন পুত্রের একরাত্রের স্ত্রী হতে হবে। অর্জুন মোহিনীকে কখনোই পেতে পারে না। অন্যদিকে অর্জুন বিরাট পর্বে বৃহন্নলার ভেক নেন। বৃহন্নলা এবং অর্জুন দুজনের মধ্যে যেন দ্বৈতসত্তার ছায়া দেখা যায়। কারণ দুজনেই একই মানুষ কিন্তু বৃহন্নলা নিজেকে নারী মনে করে। যে নারীত্ব সে এতদিন পুরুষদের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। তার লাস্য ও সৌন্দর্য দেবদুর্লভ। কিন্তু এক্ষেত্রে বৃহন্নলা সম্পূর্ণ নারী নয় আবার পৌরুষ বর্জন করে সে সম্পূর্ণ পুরুষও নয়।
ইরাবানের যে আখ্যান দক্ষিণ ভারতে প্রসিদ্ধ, স্বয়ং ব্যাসদেব তার কথা মূল ভারতে লেখেননি। সে যে সময় ধরে বৈপিত্রেয় ভ্রাতার মৃত্যুবাণে শান দিয়েছে সেই নিরিখে শিখণ্ডিনী রূপী অম্বাকে স্ত্রী সুদর্শনার সঙ্গে সময় অতিবাহিত করবার সুযোগ দিতেন তাহলে স্থূনকর্ণের সাহায্যে লিঙ্গান্তর ঘটবার পর শিখন্ডির আর কোন অভিযোগ থাকতো না। অম্বা যে ভীষ্মবধ হেতু আবার জন্ম নিচ্ছে পাঞ্চালরাজের ঘরে, শিখণ্ডিনী হয়ে যাকে তার বাবা পুরুষ রূপে প্রতিপালিত করে এবং একটি কন্যার (সুদর্শনা) সঙ্গে বিয়েও দেয়। কিন্তু সময় অত দয়াপরবশ হয়নি। মুখে লিঙ্গ সাম্যের কথা বলা যত সহজ বাস্তবে তাকে প্রতিষ্ঠা করা ততটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই জন্য মেয়ের শরীরে পৌরুষের আগুন নিয়ে হারিয়ে যায় শিখণ্ডিনী রূপী শিখণ্ডীরা।
এই সমস্ত চরিত্রগুলো আসলে আমারই সৃষ্টি এবং একেক সময় এরা আমার যাপন ও দৈনন্দিন জীবন থেকে উঠে আসে বইয়ের পাতার মোড়ক ছেড়ে। সে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে এবং নিজেই উত্তর দেয়। প্রশ্নকর্তা এবং তার উত্তর প্রদানকারী মানুষ দুটি একই অংশ একই অঙ্গে ভাগাভাগি করে বসত করে।
হঠাৎ চোখ লেগে গিয়েছিল আর তাতেই বিভ্রম। যে উপন্যাসটি শেষ করতে পারিনি সেই উপন্যাস থেকেই হঠাৎ সূর্যদেব সামনে এসে দাঁড়ালেন। আর একটি ছায়া দাঁড়িয়ে আছে , এক স্নিগ্ধ কোমল কিশোরের ছবি। দেহ পুরুষের। হয়তো মনও পুরুষের। কিন্তু জন্মের সময় কিছু বৈকল্য দেখা দেওয়ায় লিঙ্গের স্থানে তাকে যোনি প্রদান করে শল্যচিকিৎসকরা। সে অরুণ। সূর্যের বৈমাত্রেয় ভাই এবং সারথি। কোথাও গিয়ে যেন প্রশ্নের সামনে সামনে হই – ভাইয়ে ভাইয়ে প্রেম সম্ভব! আর যদিও বা সম্ভব হয় তাহলেও মিথ্যা মান রাখতে, সেই প্রেমাস্পদকে কি করে সহোদর দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়? ভ্রাতৃ গমনের মত অজাচারকে প্রেমের কারণে ক্ষমা করা গেলেও, যে জায়গায় লোক জানাজানি হওয়ার ভয় থেকে সূর্যের মতো একজন প্রতাপশালী মানুষও অরুণকে ইন্দ্রের সঙ্গে সহবাস করতে পাঠায় সেখানেই ভালোবাসা প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়ায়! এবং একবার সূর্য ও পরেরবার ইন্দ্র পরপর বেশ কিছু মাস যাবৎ অরুণকে ভোগ করার পর সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এই অরুণেরই সন্তান রামায়ণের বালি ও সুগ্রীব।
আবার অন্য কনটেক্সটে চোখ রাখলে দেখতে পারি যে পুরুষ দেহকে ভালোবেসে অরণ্যচারী হয়েছিল ইল এবং বুধ সেই দেহ সেই যৌন কামনা ক্রমশ দেহাতীত হয়ে মনের মণিকোঠায় প্রবেশ করে। সেখানে ইলকে যখন তার পিতা বৈবস্বৎ মনুর দণ্ড স্বরূপ নিজ শিশ্ন হারাতে হয় তখন বুধের সেবা ও চিকিৎসা তাকে সুস্থ করে তোলে। ইল সেখানে নারীবেশে ইলা হয়ে ঘরকন্না করে এবং সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু যত সে সুস্থ হয়ে ওঠে তার মন থেকে মুছে যেতে থাকে তার প্রেমাস্পদ বুধ।
আসলে ৩৭৭ ধারা যখন লাগু ছিল তখন বলা হতো ভারতবর্ষে মার্কিন মুলক থেকে সমকামিতা আমদানি করা হয়েছে। তার নিরিখেই খোঁজ শুরু হয় এবং ২০১৭ তে আমার বই পুরাবর্ত্মর প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়। এখন পরবর্তী দ্বিতীয় খন্ডর কাজ চলছে। কাজ যত এগোচ্ছে আমাকে এই পৌরাণিক চরিত্ররা তত ঘিরে রাখছে। আসলে পুরাণ মানে তো পুরাতন আর মাইথোলজি হচ্ছে রূপকের সমনাম। মিথ বা রূপকের প্রয়োজন কেন? বাস্তব ঘটনাটাকে যখনই আড়াল করবার প্রয়োজন হয় তখনই সেখানে অভিশাপ বরদান বা অলৌকিকের অবতরণ ঘটে।
এই যেমন ধরুন যুবনাশ্ব ও ইন্দ্রের কথা। সমকামী দম্পতি সন্তান চেয়েছিল এবং তাই জন্য অরণ্যে গিয়ে গর্ভ ভাড়া করে। সেখানে কার শুক্রাণুতে নিষিক্ত হয়ে সন্তান এল, সেটা আলোচ্য নয় কিন্তু সে সন্তানকে বড় করার জন্য যুবনাশ্ব নিজের মাথায় চাপিয়ে নিল অভিশাপের বোঝা। অভিশাপ কখনও কখনও আশীর্বাদ হয়ে আসে, আর এখানেই রূপক।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মহিলাদের বেশি কথা প্রভুত্ব সাজেশন কোন কিছুই খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। সেখানে দুটো মেয়ে ভালবাসবে একসঙ্গে থাকবে কোন পুরুষের অধীনতা থাকবে না এও কি মানা যায়। কিন্তু যখন “পুত্রার্থে কৃয়তে ভার্য্যা” বলে বিয়ে করা পুরুষটি হঠাৎই মারা যায় তখন তার স্ত্রী দুজনকে কাম কেলিতে বাধ্য করে সন্তানের জন্ম দেওয়ানো এও এই ভারতবর্ষের রীতি। সেখানে ভালোবাসা মিশলো কি মিশলো না বা মহিলা দুটির নাম কি তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা সমাজপিতাদের নেই। ধরে নেওয়া যাক তাদের নাম শৈব্যা ও বৈদেহী। অন্তত এই নাম তারা আমার থেকে পেয়েছে। যাদের সন্তান ভারতের সবথেকে বড় ইরিগেশন প্রজেক্টটির একচ্ছত্র কর্তা, সেই গঙ্গাকে আনানোর কাজ যে করেছিল হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর অবধি সেই ভগীরথের (দুটি ভগের সম্ভোগে যার জন্ম) মায়েদের কোন নাম কি থাকতে নেই?
আরো অনেক চরিত্রই সামনে চলে আসছে কিন্তু যে চরিত্রকে দিয়ে এই লেখাটা আজ শেষ করব সে কিন্তু ইতিহাসের পাতায় নিজের ছাপ রেখে গেছে লৌকিক দেবী হিসেবে। ১৩০০খৃস্টাব্দের সময় গুজরাটের কাথিয়াওয়াড়ের চারণ সম্প্রদায়ের মেয়ে বহুচরা। বাপাইয়া নামের এক ডাকাত তার ধর্ষণ করলে সে সেই ডাকাতের যৌনাঙ্গ কেটে নেয়। একঘরে হবার ভয় থেকে নিজের স্তন কেটে আত্মহত্যা করে বহুচরা কারণ ধর্ষিতাকে সমাজ খারাপ চোখে দেখে। এখান থেকেই মিথের শুরু। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বাপাইয়া যখন নিজের মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করে তখনই বহুচরার শব অদৃশ্য হয়ে তার তার জায়গায় এক কুক্কুটবাহনা চতুর্ভুজা দেবীর আবির্ভাব ঘটে। সে বাপাইয়া কে বলে যে নারী বেশে যদি বাপাইয়া তার সেবা করে তাহলে একদিন ঠিক মোক্ষলাভ করবে। এই দেবীই বহুচরা মাতা। যে প্রান্তিক যৌনতার জনগোষ্ঠী হিজড়াবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত তাদের আরাধ্য ও উপাস্য দেবী।
কিন্তু এত কিছুর পরও আমরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করবো, একে অপরকে ছোট হেয় করার চেষ্টা করবো। কিন্তু জীবন কি শুধু এটুকুই! নিজেরা বিচার করুন।
দেবলীনা
June 29, 2023 |ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো লেখাটি !!