নয়না
অনিরুদ্ধ সেন

(১)

বন্দিনী

নাম মৃগনয়না। শরীরে কেমন একটা মায়া জড়ানো। এখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, চাউনি ত্রস্ত হরিণীর।

মেয়েটি একটা খুনের মামলার আসামি, তার ডিফেন্স লইয়ার কিংশুক। কেসটা সম্ভবত সাজানো। কিন্তু মেয়েটির অর্থবল, লোকবল কিছুই নেই। অন্যদিকে তার প্রতিপক্ষ এক নামজাদা ব্যবসায়ী পরিবার। মেয়েটি নাকি তাদের ছেলেকে খুন করেছে।

বাপের বখাটে ছেলে ললিত গরিব ঘরের মেয়ে মৃগনয়নাকে ভুলিয়েভালিয়ে ইলোপ করেছিল। খাওয়া না জুটলেও মৃগনয়নার পরিবারের ‘বংশমর্যাদা’ টনটনে। ব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে পোদ্দার পরিবারের এক লোচ্চা ছেলের সঙ্গে পালানোর জন্য মেয়েকে তারা বরাবরের মতো ত্যাগ করেছিল। ললিতের পরিবারের দিক থেকে আপত্তিটা প্রথমে তেমন জোরালো ছিল না। তারা জানত ছেলে এভাবে সুন্দরী মেয়েদের তুলে ভোগ করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু এবার একটু বাড়াবাড়ি হল। ললিত মৃগনয়নাকে বিয়ে করে আলাদা সংসার পাতল। অসন্তুষ্ট হলেও বাপ আটকাতে পারেননি, কারণ ললিতের প্রয়াত ঠাকুর্দা পেয়ারের নাতির জন্য মোটা টাকা সহ সম্পত্তির একাংশ বরাদ্দ করে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর ললিতের সঙ্গে তার পরিবারের সম্পর্ক সাধারণভাবে শীতল হলেও তার প্রিয় বোন মৃদুলা দাদার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত।

ললিতের মা অবশ্য আশা করেছিলেন ছেলে যখন বিয়েটা করেই ফেলেছে, এবার শুধরে যাবে। তারপর কর্তার রাগ পড়লে একদিন তিনি নিজে গিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেবেন। প্রথম কিছুদিন ললিত বেশ সংযতও ছিল। কিন্তু তারপর সে আবার স্বমূর্তি ধরল। প্রায়ই মাতাল হয়ে বৌকে ঠ্যাঙাত। কলকাতার কিছু দূরে ললিতদের পরিবারের একটা বাগানবাড়ি ছিল, মাঝে মাঝে ইয়ারবন্ধু আর মেয়েদের নিয়ে সে সেখানে মধুচক্র বসাত। মৃগনয়নাকেও যেতে হত আর তার ওপর চলত সম্মিলিত যৌন নির্যাতন। প্রতিবাদ করলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়ত।

অসহায়ভাবে সহ্য করা ছাড়া মৃগনয়নার উপায় ছিল না। একজন বন্ধু মারফত বাড়িতে খবর পাঠালে তারা উত্তর দিয়েছিল, “নিজের কাজের ফল, নিজেই ভোগো।” ললিতের কড়া নজর এড়িয়ে পালানো ছিল প্রায় অসম্ভব। তার ওপর সে ভয় দেখাত পালালে মৃগনয়নার পরপুরুষের সঙ্গে সহবাসের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবে।

এভাবে কদ্দিন চলত কে জানে। কিন্তু একদিন ঐ বাগানবাড়ি যাওয়ার পথে ললিতের গাড়ির সঙ্গে একটা ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ললিত ঘটনাস্থলেই মারা গেল। তার ইয়ারবন্ধু ও বান্ধবীরা বাগানবাড়িতে অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিল।

উল্লেখযোগ্য, মৃগনয়না সেদিন ললিতের সঙ্গে যায়নি। তাদের দু-একজন পড়শির মুখে শোনা গিয়েছিল, বেরোবার আগে ললিতের সঙ্গে বৌয়ের তুমুল হয়েছিল। মারধোর, কান্নাকাটির আওয়াজও পাওয়া গিয়েছিল। শেষ অবধি ললিত বাইরে থেকে ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল, “গেলি না তো? ফিরে আসি, তোর হবে।”

ললিত আর ফেরেনি। কিন্তু তার মৃত্যু যে স্রেফ দুর্ঘটনা নয় সেটা মনে করার অন্যতম কারণ, দুর্ঘটনার সামান্য আগে ললিত বোনকে ফোন করে উত্তেজিতভাবে বলেছিল, “মৃদুল, দ্যাট বিচ –”, তারপরই ফোন এক ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে নীরব হয়েছিল। একটু পরেই ললিতের বাবা ছেলের দুর্ঘটনার খবর পেয়েছিলেন।

ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে মৃদুলা আথালপাথাল কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, “এটা দুর্ঘটনা নয়। ঐ রেণ্ডিই কিছু করেছে। হয় দাদাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল। নয় তার গাড়ির কলকব্জা বিগড়ে রেখেছিল, যাতে পথে দুর্ঘটনা হয়। দাদা সেটাই বলতে যাচ্ছিল। সে আমাকে বারবার বলেছে, বৌয়ের সঙ্গে পরপুরুষের সম্পর্ক আছে। তাতে বাধা দেওয়ায় দাদাকে সরিয়ে দিল।”

মৃদুলার কথায় পোদ্দার পরিবার পুলিশে অভিযোগ করল। তার ভিত্তিতে মৃগনয়নাকে গ্রেফতার করা হল। ললিতের বাবার চাপে সরকার পক্ষ দুঁদে উকিল মিত্রকে নিয়োগ করলেন। তিনি মৃগনয়নার বিরুদ্ধে চটপট কেস সাজিয়ে ফেললেন। তাকে সন্দেহ করার কারণগুলি, প্রথমত, ললিতের অন্তিম ফোন কল। দ্বিতীয়ত, মৃগনয়না প্রত্যেকবার ললিতের সঙ্গে বাগানবাড়ি যায় কিন্তু সেদিন প্রচণ্ড অত্যাচারের পরও মাটি কামড়ে পড়েছিল। তারপর চতুর মিত্র সম্ভবত ধনী ‘ক্লায়েন্ট’এর টাকার সহায়তায় প্রমাণ করে ছাড়লেন যে দুর্ঘটনার আগের দিন বেশি রাতে একজন পড়শি মৃগনয়নাকে ললিতের পার্ক করা গাড়ির কাছে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে।

ললিত যে বৌয়ের ওপর অত্যাচার করত বা তাকে জোর করে বাগানবাড়ি নিয়ে যেত, এটা মিত্র একেবারে অস্বীকার করলেন না। কারণ, এই অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়াকেই তাঁরা খুনের ‘মোটিভ’ বলে দাঁড় করাচ্ছিলেন। পরে অবশ্য তাঁদের লাইন কিছুটা বদলে গেল।

ওদিকে, নিঃসম্বল মৃগনয়নার কোনও উকিল দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু দয়ালু সরকার বাহাদুরের বিধান, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো যাবে না। আসামি নিজে না পারলে সরকারই তাকে উকিল দেবে।

সরকারি উকিলদের এসব কেস নেওয়ার গরজ থাকে না। সরকারের কাছ থেকে ন্যূনতম পারিশ্রমিক জোটে। দু পক্ষের উকিলই সরকারি, তাই আসামিকে বাঁচাতে তার উকিল তেমন গা ঘামায় না। কিংশুক বারে সবে জয়েন করেছে, হাতে কেসফেস কম। তাই ভেবেছিল বসে না থেকে হাতেখড়ির জন্য টাইমপাস এই কেসটাই নেওয়া যাক। কিন্তু মৃগনয়নাকে দেখে তার মনোভাব বদলে গেল।

সে বুঝতে পারল, এক ধনী পরিবার স্রেফ গায়ের জ্বালা মেটাতে একটা অসহায় মেয়েকে ফাঁসাতে চাইছে। নির্যাতিতা বলে মৃগনয়নার শাস্তি লঘু হবে না। কারণ, অভিযোগ অনুযায়ী খুন রাগের মাথায় নয়, পূর্বপরিকল্পিত। তবু যদি বা জজসাহেব দয়া করে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন দিতেন, সরকার পক্ষের উকিলের সওয়াল শুনে কিংশুক বুঝল তারা সেই ফাঁকটুকুও বোজাতে চাইছে। তারা শেষমেশ দেখাতে চাইল আসামির সঙ্গে ললিতের এক বন্ধুর ‘অ্যাফেয়ার’ ছিল আর ললিত যদি কখনও সখনও দুচার ঘা দিত, তা এই অবৈধ প্রণয়ে উত্যক্ত হয়ে। সেইজন্যেই অবশেষে প্রণয়ের পথের কাঁটা ললিতকে তার বৌ সরিয়ে দিয়েছে। কিংশুক বুঝল, ডিফেন্স ঠিকমতো না হলে মৃগনয়নার ফাঁসিও হতে পারে।

এটা বোঝার পর আর অসহায় মেয়েটার চোখের করুণ চাউনি দেখে কিংশুক ঠিক করল, সে কেসটায় পুরোদমে ঝাঁপাবে। মেয়েটাকে বাঁচানো তো আছেই। তাছাড়া, এখন অবধি তার শুধু দু-একটা পেটি কেসই জুটেছে। ললিতের ‘মার্ডার’ কেসটা ইতিমধ্যেই কাগজে কিছু পাবলিসিটি পেয়েছে। জিততে পারলে তার পসারও বাড়বে।

প্রথম থেকেই অবশ্য কিংশুক আত্মবিশ্বাসী ছিল, এই সাজানো কেসটা সে সহজেই ফাঁসিয়ে দিতে পারবে। প্রতিপক্ষের তথ্যপ্রমাণ খুব মজবুত নয়। বোধহয় তারা ধরেই নিয়েছে আসামিপক্ষের হয়ে কেউ জোর সওয়াল করবে না।

তার এই ধারণা দৃঢ় হল পোদ্দার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। ললিতের বোন ও মা তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। তবে কিংশুক যোগাযোগের চেষ্টা করছে শুনে ললিতের বাবা রমেশ পোদ্দার তাকে অফিসে ডেকে পাঠালেন।

“ওদের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। বোঝেনই তো, সেন্টিমেন্ট।” চওড়া হেসে বলেছিলেন রমেশ, “তবে আমি জানি আপনি কেন যোগাযোগ করতে চাইছেন। ঐ হাঘরে বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো মেয়েটার থেকে তো আপনি একটা পয়সাও খিঁচতে পারবেন না, ফালতু ওর জন্য প্রাণপাত কেন করবেন? বরং আমি আপনাকে খুশি করে দেব। আমার বিরাট ব্যবসা, সিভিল ছাড়া ক্রিমিনাল কেসও লেগেই থাকে। আপনার পসার এখনও তেমন জমেনি, আমি আপনাকে পরপর কেস দেব। তার ওপরও যদি –”

রমেশকে থামিয়ে কিংশুক বলেছিল, “মাফ করবেন, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার এক সচ্ছল পরিবারে জন্ম। প্রয়োজনে নয়, শুধু নিজের পায়ে দাঁড়াবার জেদে আমি এই পেশায় এসেছি। আমার প্রথম বড় কেস তাই আমি সততার সঙ্গেই লড়তে চাই।

বরং আপনিও আরেকবার ভাবুন। আপনি জানেন উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য আপনার ছেলের অপঘাত মৃত্যু হয়েছে। এক নির্দোষের জীবন নিলে কি তার অতৃপ্ত আত্মার শান্তি হবে? নাকি আপনার অফিসের দেওয়ালে যেসব দেবতার ফটো টাঙানো তাঁরা এতে খুশি হয়ে আপনার পরিবারের আর ব্যবসার প্রতি আশীর্বাদ বর্ষণ করবেন?”

রমেশকে একটু বিচলিত দেখাল। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে কিংশুককে বিদায় দিলেন।

কিংশুকের আরেক বাধা ছিল আসামি নিজে। উকিল হিসেবে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সে বুঝল, মেয়েটি লড়াইয়ের ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে। তাকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করায় সে বলল, “কী হবে এত করে? আমার জীবন তো এমনিতেই শেষ হয়ে গিয়েছে।”

কিছুতেই বোঝাতে না পেরে শেষে কিংশুক মরীয়া হয়ে বলেছিল, “আপনি কি জানেন, আপনার কী পরিণতি হতে চলেছে? যাবজ্জীবন বা ফাঁসি। অনেকে বলে জেলের ভেতর তিলে তিলে বাকি জীবনটা শেষ হয়ে যাওয়ার চেয়ে ফাঁসি ভালো। হয়তো তাই ছিল, যখন ফাঁসির দড়ি আঠেরো ফুট লম্বা হত। তাতে আসামির ঘাড়ের হাড় ভেঙে তক্ষুণি মৃত্যু হত। কিন্তু অধিকাংশ জেলেই এখন আর তেমন ব্যবস্থা নেই। ছোট দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে আসামি তাই অনেকক্ষণ অবর্ণনীয় শ্বাসকষ্ট পেতে পেতে অবশেষে  মারা যায়।”

শুনতে শুনতে মৃগনয়নার চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল সীমাহীন আতঙ্ক। সেদিকে তাকিয়ে কিংশুক বলেছিল, “আর কে বলল আপনার জীবন শেষ হয়ে গেছে? বাইরের পৃথিবী সম্ভাবনায় ভরা, সেখানে লড়াই করে বেঁচে থাকার অজস্র সুযোগ। আর সব পথ বন্ধ হয়ে গেলেও অন্তত যন্ত্রণাহীন মৃত্যু বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাটা তো থাকে।”

মৃগনয়না আকুলস্বরে বলেছিল, “আপনি – আমাকে বাঁঁচাবেন?”

“আপ্রাণ চেষ্টা করব। শুধু আমাকে সব খুলে বলবেন।”

“স-ব?”

একটু ভেবে কিংশুক বলেছিল, “না। দেওয়ালেরও কান আছে। আপনি শুধু যা যা জানতে চাইব তার সঠিক উত্তর দেবেন।”

এইভাবেই কিংশুক মৃগনয়নার কাছ থেকে তার প্রণয়, পরিণয়, সংক্ষিপ্ত মধুচন্দ্রিমা ও পরবর্তী নরকযন্ত্রণার কথা জানতে পেরেছিল। শেষে কিংশুক বলেছিল, “আর কয়েকটি প্রশ্ন। আপনার সঙ্গে ললিতের দেখা কীভাবে হয়েছিল?”

“অর্থাভাবে আমি বারো ক্লাসের বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি। তাই কিছু কোর্স করার চেষ্টা করছিলাম, যাতে অন্তত ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের চাকরি পাই। সেখানেই ললিতের সঙ্গে আলাপ। ও – আমাকে দরকারে টাকা দিয়েও সাহায্য করত।”

“বুঝলাম! আচ্ছা, আপনি নির্যাতিত হবেন জেনেও তো বরাবর বাগানবাড়ি যেতেন। সেদিন অমন মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন কেন?”

“তখন – আমার পিরিয়ড চলছিল। তবুও গেলে সব ক’জন মিলে – আমি আর নিতে পারছিলাম না!”

“বাস্টার্ড!” কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে থেকে কিংশুক জিগ্যেস করল, “আচ্ছা, ওরা বলছে আপনার সঙ্গে ললিতের এক বন্ধুর অ্যাফেয়ার ছিল। কেসটা কী?”

“ওর বন্ধু সাগর যখন আমার সঙ্গে নোংরা কাজ করছিল, ও তার ভিডিও তুলে নিয়েছিল। সেটা দিয়ে আমাকে ভয় দেখাত। হয়তো সেই ভিডিও কোনওমতে ওদের হাতে পড়েছে।”

“সাগরের ঠিকানা জানেন?”

“না। শুনেছিলাম বালিগঞ্জে থাকে।”

“এবার শেষ প্রশ্ন – আপনার বাড়ির কারও সঙ্গে কথা বলা যাবে? নাকি –”

মৃগনয়না একটু ভেবে বলল, “দুপুরে মা একা থাকে, তখন যাবেন।”

“এসো, বাবা। ঠিক সময়েই এসেছ। উনি বাড়ি নেই, নইলে তোমায় পত্রপাঠ বিদায় করে দিতেন। তা সবাই বলছিল, আমাদের টুকির ফাঁসি হয়ে যাবে। সত্যি? বিশ্বাস করো, মেয়েটা নির্দোষ। যে একটা কুকুরকেও কোনওদিন লাথি মারেনি –”

“আমি তো সেটাই প্রমাণ করতে চাইছি। আচ্ছা মাসিমা, টুকি পড়াশোনা কদ্দুর করেছিল?”

“ও বারো ক্লাসে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। এখন তো কত প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। জয়েন্ট-ফয়েন্ট দিলে ঠিক তার একটায় চান্স পেয়ে যেত। কিন্তু আমাদের সাধ্যি কি প্রাইভেটে পড়াই? অগত্যা মেয়েটা এ কোর্স, সে কোর্স করে বেড়াত, যাতে কোনও অফিসে একটা চাকরি পায়। আর বোধহয় তার টাকা জোটাতে টিউশন করত। সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরত। কিছু জিগ্যেস করলে সদুত্তর দিত না। ঐ সময়েই ঐ বাজে ছেলেটার খপ্পরে পড়েছিল।”

“আপনি বারণ করেননি?”

“প্রথমে তো জানতেই পারিনি। যখন পারলাম, বারবার বলেছি – ওসব বড়লোকের বয়ে যাওয়া ছেলে তোর মতো মেয়েদের নিয়ে স্রেফ খেলা করে। বলত, আমি ওকে ভালোবাসা দিয়ে শোধরাব। তা, পেরেওছিল। কিছুদিন ছেলেটা ভালোমনেই ঘর-সংসার করেছিল। কিন্তু রক্তের নেশা কদ্দিন চাপা থাকবে?”

“বিপদে পড়ে মেয়ে তো আপনাদের খবর পাঠিয়েছিল।”

“হ্যাঁ। ওর বাবাকে কত বলেছি, তুমি পুলিশে খবর দাও। কিন্তু ওঁর পাষাণ প্রাণ। বলেন, একবার যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, ও মেয়ে আমাদের কেউ নয়। আর সত্যি বলতে, আমরা কি থানাপুলিশ করে ওসব বড়লোকদের সঙ্গে পারতাম?”

“চলি মাসিমা, আবার আসব। কিন্তু শেষ অবধি যদি ভালো খবর নিয়ে আসি তবে কি আবার মেয়েকে –”

“আমার তো ইচ্ছে করে তাকে বুকে জড়িয়ে রাখতে। কিন্তু বাবা, এ বাড়িতে আমার জোর কোথায়?”

ললিতের ইয়ারবন্ধু সাগরকে ধরতে অবশ্য একটু বেগ পেতে হল। তার নাম সরকারি সাক্ষির তালিকায় ছিল। কোর্টের এক কেরানির হাত মসৃণ করে তার নম্বরটা বের করে কিংশুক একদিন ফোন করল।

“আপনি কীভাবে আমার নম্বর পেলেন? আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমি বাধ্য নই।” কিংশুকের পরিচয় পেয়েই তেড়িয়া হয়ে বলেছিল সাগর।

“তা নন। কিন্তু আমি জানাতে চাই, ললিতদের পরিবারের প্ররোচনায় এই মামলায় মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আপনি নিজের কবর নিজে খুঁড়ছেন। যদি কেসটা খুন প্রমাণিত হয়, আমি কিন্তু আপনাকে কো-কনস্পিরেটর বলে জড়াব। আর আপনার নামে রিপিটেড রেপের কেস আনব। দুটোরই শাস্তি মৃত্যু।”

“তাহলে আমাকে কী করতে বলেন?” ত্রস্ত সাগর বলেছিল।

“আমার সঙ্গে দেখা করুন।”

সাগর পরদিনই দৌড়ে এসেছিল। তার সঙ্গে মৃগনয়নার কম্প্রোমাইজিং ভিডিওর একটা কপি তার মোবাইলে ছিল, যেটা ললিত পাঠিয়েছিল। কিংশুক সেই মেসেজের স্ক্রিনশট নিল আর সাগরকে বুঝিয়ে বলে গেল কোর্টে তাকে কী বলতে হবে।

সবশেষে, কিংশুক মৃগনয়নাকেও ডেকে কী বলতে হবে শিখিয়ে দিয়ে গেল।

“এটা এক ঘৃণ্য, পরিকল্পিত খুন। আসামি মৃগনয়না পোদ্দার নী ভট্টাচার্য ধনীর সন্তান ললিত পোদ্দারের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নানা অজুহাতে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করত। শেষ অবধি ললিত তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরেও তুলেছিল। কিন্তু আসামি এমন মেয়ে যার এক পুরুষে হয় না। সে শিগগিরই ললিতের এক বন্ধুকে সিডিউস করে তার সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হল। তার প্রমাণও আমাদের কাছে আছে। এটা জানতে পেরে ললিত আসামিকে কিছু বলে থাকবে, হয়তো রাগের মাথায় দুচার ঘা দিয়েও থাকবে। তাতে আসামি ক্ষিপ্ত হয়ে ঠিক করল, প্রণয়ের পথের কাঁটা স্বামীকে চিরকালের মতো সরিয়ে দিতে হবে। তার জন্য সে এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করল।

ঘটনার আগের দিন সে স্বামীকে মদ খাইয়ে বেহুঁশ করে গাড়ির চাবি নিয়ে গাড়ি খুলে কিছু কলকব্জা বিগড়ে রাখল। তখন অনেক রাত। কিন্তু আসামির দুর্ভাগ্য, তাদের প্রতিবেশী মিঃ কানুনগো তাকে দেখে ফেললেন।

পরদিন যখন ললিত পরিকল্পনামতো আসামিকে আউটহাউসে নিয়ে যেতে চাইল, আসামি স্বভাবতই কিছুতেই রাজি হল না। যে বরাবর স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় আউটহাউসে গিয়েছে সে সেদিন এমনকি মারধোর সত্ত্বেও গেল না, এটাই কি যথেষ্ট সন্দেহজনক নয়?

আসামি সম্ভবত স্বামীর খাবারে বা মদে সিডেটিভ মিশিয়ে দিয়েছিল, যাতে গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট আরও সুনিশ্চিত হয়। ললিত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল, তারপর হাইওয়েতে উঠে কিছুক্ষণ বাদেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বুঝতে পেরে সে শেষ মুহূর্তে বোনকে ফোন করে জানাতে শুরু করেছিল যে স্ত্রীই তার সর্বনাশ করেছে। সেই কলের রেকর্ড আছে। মহামান্য আদালতকে অনুরোধ জানাচ্ছি সেই রেকর্ডকে নিহতের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করতে।”

সরকারি উকিল থামলে বিচারক বললেন, “আসামির উকিল মিঃ চক্রবর্তী কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ। তবে আগে বাদিপক্ষের সাক্ষিরা আসুক, তারপর।”

প্রথম সাক্ষি ললিতের বোন মৃদুলা। সে তার বক্তব্য পেশ করার পর মিঃ মিত্র বললেন, “জেরা করবেন, মিঃ চক্রবর্তী?”

“না। তবে আমার অনুরোধ, মহামান্য আদালত কল রেকর্ডটা আবার শুনুন।”

কলটা শুনে জজের মুখ লাল হয়ে উঠল। কিংশুক বলল, “বুঝতে পারছি, শব্দটা খুব শালীন নয় দেখে আপনি লজ্জা পেয়েছেন। এখন, কেউ ‘দ্যাট বিচ’ বললেই কি বোঝায় তিনি তাঁর প্রিয় স্ত্রীর কথাই বলছেন? মৃদুলা দেবীর কথা ছাড়ুন, আইন কি তাই বলে?

আর যদি ধরেও নিই ললিত আসামিকেই রেফার করছিলেন, তাতে কি প্রমাণ হয় তিনি গাড়ির কলকব্জা বিগড়ানোর কথা বলছিলেন? সম্ভবত স্ত্রী যে তাঁর ফুর্তির বাগানবাড়িতে যায়নি, সেই দুঃখের কথাই তিনি প্রিয় বোনকে জানাতে যাচ্ছিলেন। পেটে অ্যালকোহল ছিল, মোবাইলে বলতে বলতে ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন, তাই গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।”

“মোটেই নয়। ওই রেণ্ডি জানত অ্যাকসিডেন্ট হবে। তাই ঠিক ঐদিনই যায়নি।”

জজ মৃদুলাকে থামিয়ে দিলেন। মৃদু হেসে কিংশুক বলল, “মাননীয়া বৌদিকে কী শালীন সম্ভাষণ! যাক, আসামি কেন যায়নি তার কারণ হচ্ছে ঐ সময়ে তার পিরিয়ড চলছিল। গেলে সেই অবস্থাতেই চলত দলবদ্ধ অত্যাচার। তাই প্রাণের দায়েই সে যায়নি।”

“কানাঘুষায় শুনেছিলাম, এরকম একটা ডিফেন্স হবে।” মিঃ মিত্র হেসে বললেন, “তাই আমি কিছু তথ্য জোগাড় করে রেখেছি। আচ্ছা মিঃ চক্রবর্তী, মহিলাদের পিরিয়ড কদ্দিন পর পর হয়?”

“কমবেশি আটাশ দিন।”

“দুর্ঘটনার পরদিনই আসামি গ্রেফতার হয়েছিল। পুলিশ আর জেল হাজতের রেকর্ড বলছে, তার কুড়িদিন পর তার আবার স্যানিটারি প্যাডের দরকার পড়েছিল।”

কিংশুক দৃঢ়কণ্ঠে বলল, “পিরিয়ড নিয়মিত হলে আটাশ দিনে। কিন্তু নানা কারণেই মহিলাদের পিরিয়ড অনিয়মিতও হয়। আর বারবার স্বামীর ইয়ারবন্ধুদের দ্বারা ধর্ষিতা আসামির পিরিয়ড তো অনিয়মিত হতেই পারে। মিঃ মিত্রকে অনুরোধ করব এ ব্যাপারে সন্দেহ না করে বরং আসামিকে কোনও গায়নাকোলজিস্টকে দিয়ে পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করুন।”

“আমি এ ব্যাপারে উপযুক্ত নির্দেশ জারি করছি।” বললেন জজ।

এরপর সাগর। সে হাতজোড় করে বলল, “হুজুর মাফ করবেন। আমাদের কাপ্তেন ছিল ললিত। তার প্ররোচনায় মদ খেয়ে আমি ভাবিজীর সঙ্গে যা করেছি তা হুঁশে করিনি। কিন্তু ব্যাপারটা ললিতের সামনেই হয়েছিল আর ললিত সেটা রেকর্ড করে আমাকে ফরোয়ার্ড করে দিয়েছিল।”

“হ্যাঁ, ললিতই যে সাক্ষিকে ভিডিওটা ফরোয়ার্ড করেছিল, এই দেখুন তার প্রমাণ। তার সঙ্গের মেসেজটা পড়লেই বুঝতে পারবেন ললিতের ব্যাপারটায় সোৎসাহ সমর্থন ছিল।”

স্ক্রিনশটে ভিডিওর সঙ্গের মেসেজ, “See how elegant the bitch looks when pinned”, দ্যাখ, ফুঁড়লে কুত্তিটাকে কী দারুণ লাগে! দেখে ক্ষুব্ধ জজ বললেন, “মিসেস পোদ্দার, আপনি কি সাক্ষির বিরুদ্ধে রেপ চার্জ আনতে চান?”

কিংশুক যেমন শিখিয়ে দিয়েছিল, মৃগনয়না বলল, “না। আমি তো প্রমাণ করতে পারব না কাজটায় আমার সম্মতি ছিল না। তাছাড়া, পুরো ব্যাপারটার হোতা আমার স্বামী। সে-ই যখন নেই, এসব চুনোপুঁটিদের শাস্তি দিয়ে কী হবে?”

শেষ সাক্ষি প্রতিবেশী মিঃ কানুনগো। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি মিত্র যা বলেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি করলেন।

“মিঃ কানুনগো, আপনি মিসেস পোদ্দারকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন?”

“তা কেন?” কানুনগো রাগতভাবে বললেন, “প্রতিবেশী হিসেবে যা হয়, ঐ দু-একবার মুখ দেখা।”

“আর তাতেই আপনি অন্ধকারে মুখ ঢেকে যাওয়া মহিলাকে দেখে মিসেস পোদ্দার বলে চিনে নিলেন?”

“গাড়িটা যখন তাঁদের, মহিলা আর কে হবেন?”

“পৃথিবীর যে কেউ হতে পারেন। আর যদি ধরেও নিই ওটা মিসেস পোদ্দারই ছিলেন, আপনি কি ওঁকে গাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলেন?”

“তাহলে উনি অত রাতে আর কীসের জন্য যাবেন?”

“অনেক কারণেই যেতে পারেন। যেমন ধরুন, পরদিন যাতে বাগানবাড়ি না যেতে হয় সেইজন্য টায়ার পাংচার করে দিতে।”

“কিন্তু টায়ার তো পাংচার হয়নি।”

“কলকব্জাও সম্ভবত বিগড়োয়নি। কিন্তু মিঃ মিত্র যেই আপনাকে বললেন মিঃ পোদ্দারের দুর্ঘটনা ঘটেছে কেউ তার গাড়ির কলকব্জা বিগড়ে রেখেছিল দেখে, অমনি আপনি ধরে নিলেন আপনার দেখা মহিলা মিসেস পোদ্দার আর উনি গাড়ি খুলে কলকব্জা বিগড়োতে এসেছিলেন। আসলে আপনি যাকে দেখেছিলেন তাকে চেনেননি, তাকে গাড়িতে ঢুকতেও দেখেননি। তাই না?”

কানুনগো নিরুত্তর। কিংশুক বলল, “এবার আমি আদালতের অনুমতি নিয়ে মিঃ মিত্রকে দু-একটি প্রশ্ন করতে চাই।”

জজ অনুমতি দিলে কিংশুক বলল, “আপনার গাড়িটা কোন মডেলের?”

তির্যক হেসে মিত্র বললেন, “প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিক। তবু বলি, হন্ডা সিটি। কেন, ইনকাম ট্যাক্সে জানাবেন নাকি?”

“ছি, ছি! আপনার আয়ের তুলনায় গাড়িটা যৎসামান্য। আমার শুধু জিজ্ঞাস্য, আপনার গাড়ির কন্ট্রোল গীয়ারগুলির সঙ্গে আপনি পরিচিত?”

“অবশ্যই। ড্রাইভার থাকলেও আমি প্রায়ই গাড়ি নিজে চালাই।”

“আচ্ছা, আপনার গাড়ির ব্রেক বা অ্যাকসিলারেটর আলগা করে রাখতে আপনার কত সময় লাগবে?”

মিত্র চমকে উঠে বললেন, “ওভাবে কি বলা যায়? ওটা মেকানিকের কাজ, আমি তো এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ নই। তাছাড়া আজকালকার কারগুলিতে এত ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল যে কোনটা কী বোঝাও দুস্কর।”

“ঠিক। আর ললিতের গাড়িটা ছিল টয়োটা ইনোভা, যা আরও উন্নত মডেলের, যার ইলেকট্রনিকস আরও জটিল। অথচ সেই গাড়ির কলকব্জা কিছুক্ষণের মধ্যে বিগড়ে রেখেছে একজন বারো ক্লাস পাশ গৃহবধূ! তাও আবার যে সে বিগড়ানো নয়। নিশ্চয়ই তার কম্পিউটার কন্ট্রোলও ‘হ্যাক’ করা হয়েছিল, যাতে গাড়ি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে স্পীড নিলে তবেই দুর্ঘটনা ঘটে। সম্ভব?”

কোর্ট নিস্তব্ধ। কিংশুক বলে চলল, “মৃতের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে তার পেটে সিডেটিভ নয়, অ্যালকোহল ছিল। সুতরাং ওষুধ খাইয়ে বেহুঁশ করার তত্ত্ব টেঁকে না। প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট বলছে, দুর্ঘটনার আগে গাড়ি সম্ভবত চালকের বশে ছিল না। সেটা মত্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলতে বলতে চালাবার জন্যও হতে পারে। গাড়ির ব্ল্যাক বক্স ইলেকট্রনিক সিস্টেমে কিছু গোলযোগের ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু গাড়ির ড্যামেজ এত বেশি যে সেটা দুর্ঘটনার আগে না পরে পিনপয়েন্ট করা মুস্কিল। ব্ল্যাক বক্স থেকে আরও অনুমান, ঘণ্টায় একশো কিলোমিটারের বেশি স্পীডে ছোটার সময় চালক সিট বেল্ট বাঁধেননি। হয়তো কখনওই বাঁধতেন না। নইলে টয়োটা ইনোভার এয়ারব্যাগগুলি তাঁকে বাঁচাতে পারত।

সুতরাং আমরা যেন একটি অসহায়, অত্যাচারিতা মেয়েকে অযথা দায়ী না করে মেনে নিই এক বেপরোয়া যুবকের উচ্ছৃঙ্খলতাই তার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু ডেকে এনেছে।”

“কিন্তু যদি আসামি এই কাজ কোনও অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানের সহায়তায় করে থাকে?”

“প্রতিবেশীরা বলেছে, ললিত বাড়ির বাইরে গেলে তার স্ত্রীকে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রেখে যেত আর বেরোলে গাড়ি নিয়েই যেত। কাজেই তার গাড়ি আর চাবি তার স্ত্রীর হাতে আসতে পারত একমাত্র ললিত রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমোবার পর। সোসাইটির সিকিউরিটি খুব কড়া। অত রাতে তাদের চোখ এড়িয়ে কোনও আগন্তুকের কমপ্লেক্সে ঢোকা কার্যত অসম্ভব।”

পেছনে কে যেন ধীরে ধীরে হাততালি দিয়ে চলেছে। কিংশুক চমকে তাকিয়ে দেখল, রমেশ পোদ্দার। তিনি এবার মিত্রের কাছে এসে কী যেন বললেন।

জজ চিন্তিতমুখে বললেন, “কোর্ট ডিসমিস। পরশু সকালে আবার হিয়ারিং।”

কোর্ট থেকে বেরোবার পর মিত্র কিংশুককে ইশারায় ডেকে নিয়ে গেলেন কোর্ট চত্বরের এক নিরালা কোণে। তারপর বললেন, “মিঃ পোদ্দার আপনার ডিফেন্সে খুব ইমপ্রেসড। তিনি এখন প্রায় নিশ্চিত যে ললিতের দুর্ঘটনাটা কারও কারসাজি নয়। শুধু একটি ব্যাপারে আসামি রাজি হলে তিনি এ নিয়ে আর আমাকে চাপ দেবেন না।”

মানে, আর পেমেন্ট করবেন না। কিংশুক মনে মনে হেসে বলল, “কী ব্যাপার?”

“আইনত, ললিতের সম্পত্তির অর্ধেক তার স্ত্রীর প্রাপ্য। মৃগনয়নাকে লিখে দিতে হবে সেই দাবি সে ত্যাগ করছে। সে রাজি হলে তুমি জামিন চাইলে আমি বিরোধিতা করব না।”

“বেশ, ওর সঙ্গে কথা বলে জানাব।”

পরদিন কিংশুক জেলে মৃগনয়নার সঙ্গে দেখা করে কথাটা তুললে সে বলল, “আমি রাজি। তবে কোর্টে আমি সত্যিটাই বলব।”

পরদিন মিত্রের বিশেষ আহ্বানে মৃগনয়না কোর্টে দাঁড়িয়ে বলল, “ধর্মাবতার, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমার ও ললিতের বিয়ে সত্যিই হয়েছিল কিনা এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের বিয়ে হয়েছিল এক মন্দিরে ভগবান শিবকে সাক্ষি রেখে। মন্ত্রোচ্চারণ করেছিলেন মন্দিরের পুরোহিত। তার সামনেই ললিত আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিল। তার কোনও প্রমাণ বা ফটো আমার কাছে নেই। অনেকবার বলা সত্ত্বেও ললিত আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রিও করেনি।

ঈশ্বর জানেন আমি ললিতের স্ত্রী ছিলাম আর এখন আমি তার বিধবা। কিন্তু আদালতে তা প্রমাণ করা আমার অসাধ্য। তাই আমি আদালতে হলফনামা দিয়ে আমার মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার ছেড়ে দিতে রাজি।”

সেদিন বিকেলেই কিংশুকের আবেদনক্রমে মৃগনয়নার জামিন হয়ে গেল। কিংশুক নিজেই হল জামিনদার। টাকার ব্যবস্থাও সে করে দিল।

মৃগনয়নার যাওয়ার কোনও জায়গা নেই জেনে আদালত অন্তত মামলার নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে এক সরকারি হোমে রাখার নির্দেশ দিলেন।

(২)

রহস্যময়ী

খুনের মামলায় বাদিপক্ষ সরকার। তাই পোদ্দাররা হাত তুলে নিলেও কেস তক্ষুণি মিটল না। কিংশুক হোমে গিয়ে মৃগনয়নার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ক্রমে উকিলবাবু উপলব্ধি করল সে ক্লায়েন্টের সঙ্গে এক অনভিপ্রেত ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। দরকারে ছাড়া অদরকারেও তার কাছে চলে যাচ্ছে।

অবশেষে একদিন প্রত্যাশিতভাবেই মৃগনয়না বেকসুর খালাস পেল। তাকে স্বাগত জানাবার কেউ ছিল না। কিংশুকই এসে বলল, “চলুন, একটু সেলিব্রেট করা যাক।”

“ট্রিট তো আমারই দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি যে কপর্দকশূন্য।”

“বেশ, তাহলে সেলিব্রেশনটা ছোট্ট করে গঙ্গার ধারে বসে বাদামভাজা খেয়ে সারা যাক।”

মৃগনয়না হাসল, মেঘভাঙা রোদের হাসি। গঙ্গার পারে বসে কিংশুক বলল, “আমার পেশাদারি কর্তব্য শেষ। কিন্তু আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে না ভাবলে সব ফাঁকা লাগে।”

মৃগনয়না শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাল। কিছুক্ষণের চেষ্টায় দ্বিধা কাটিয়ে কিংশুক বলল, “তোমার ঘর নেই। আর আমার ঘর শূন্য। তুমি আমার শূন্যতা ভরাবে? তোমার অভিভাবক নেই, তাই তোমার কাছেই আমার নিবেদন।”

মৃগনয়না কেঁপে উঠল। বলল, “দয়া করছেন? অবশ্য আমাকে দয়া করার লোকই বা আর কে আছে!”

“দয়া নয়, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতে পারি না।”

“আরেকজনও একদিন এই কথা বলেছিল।” অস্ফুটস্বরে বলেই মৃগনয়না কিংশুকের হাত চেপে ধরে বলল, “ছি ছি, কীসে আর কীসে!”

“জীবনে তুমি অনেক ঘা খেয়েছ, তাই তোমার সংশয় স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ভালোবাসা দিয়ে আমি ধীরে ধীরে সব সংশয় দূর করে দেব, নয়না। হ্যাঁ, প্রথম দিনই তোমার মায়াভরা চোখ আমায় বেঁধেছিল। তাই ঐ নামেই আজ থেকে তোমায় ডাকব। আর তুমিও আমাকে আর আপনি বলবে না। এবার বলো, আমার প্রার্থনা মঞ্জুর?”

“তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। তোমার ইচ্ছে আমার কাছে আদেশ। শুধু দুটি দিন আমায় ভাবতে দেবে?”

“ওভাবে বোলো না। দু’দিন কেন, দরকারে আরও সময় নাও। আমাদের আবার দেখা হবে।”

“কী, ভাবলে?”

“কিছু কিছু। কিংশুক, তোমার সমাজে একটা স্টেটাস আছে। সেখানে আমার মতো মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে নয়, বড়জোর রক্ষিতা হিসেবে মানায়।”

“ছিঃ, নিজেকে কখনও ছোট ভাববে না। সৌভাগ্যক্রমে আমার আত্মীয়বন্ধুদের বিশেষ কেউই সঙ্কীর্ণমনা নয়। তোমাকে বিয়ে করলে বড়জোর একটা ছোট্ট আলোড়ন হয়ে আবার মিলিয়ে যাবে। আর যদি না মেলায়, আমি ঝাড়া হাতপা মানুষ। তোমাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাব।”

একটু দ্বিধার পর নয়না বলল, “আমার শরীরের ওপর দিয়ে কী গেছে তুমি জানো। সব জেনেও আমাকে ছুঁতে তোমার ঘেন্না হবে না?”

“একদম না।”

“কিন্তু আমি তো নিজেকেই বুঝি না। লাগাতার অত্যাচারে আমার শরীর-মন যদি অসাড় হয়ে গিয়ে থাকে, সেই তুষারমানবীকে নিয়ে কি তুমি সুখী হবে?”

“আমি আমার দরদ আর সোহাগ দিয়ে তোমাকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করব আর অপেক্ষা করব।”

নয়নার চোখে দুফোঁটা জল। সামলে নিয়ে সে বলল, “এবার শেষ কথা। তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। তুমি এগিয়ে না এলে আজ আমি থাকতাম না। তবু আমাদের জীবন যদি এক হয়, সেখানেও আমার কিছু নিজস্ব ব্যাপার থাকবে। আমি নিজে না বললে প্লীজ সেসব নিয়ে কিছু জানতে চেয়ো না।”

এক মুহূর্ত ভেবে কিংশুক বলল, “রাজি।”

“আমিও কথা দিচ্ছি, তোমার নিজস্ব ব্যাপারে আমি নাক গলাব না।”

সব সংশয় দূর হয়ে কিংশুক আর নয়না এখন স্বামী-স্ত্রী। তাদের বিয়েতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিশেষ হয়নি। বরং নয়নার কেসটা মিডিয়ায় প্রচার পাওয়ার ফলে উদারচেতা আইনজীবী হিসেবে কিংশুকের সুনাম হয়েছে, পসারও বেড়েছে।

কিংশুকের আত্মীয়বন্ধুরা মাঝে মাঝেই আসে। নয়না তাদের আপ্যায়নে ভরিয়ে দেয়। নয়নার কেউ নেই। শুধু তার মা একদিন গোপনে এসে ওদের আশীর্বাদ করে গেছেন।

শরীর সম্বন্ধে নয়নার আশঙ্কাগুলিও শয্যার উষ্ণতায় ভেসে গেছে। কিংশুক সেকথা মনে করিয়ে দিলে নয়না হয়তো লাজুক হেসে বলে, “মিলনে যে কী সুখ বোঝাবার জন্যই বোধহয় ভগবান আমায় এত কষ্ট দিয়েছেন।” আবার কখনও হয়তো আনন্দে কাতরাতে কাতরাতে বলে, “উঃ, আর নিতে পারছি না। এবার আমাকে মেরে ফেলো।” তারপর দুটি একত্রিত শরীর একসঙ্গে স্বপ্নলোকে পাড়ি দেয়।

গৃহস্থালীও নয়না খুব দক্ষতায় সামলাচ্ছে। কিংশুকের অগোছালো সংসারে শ্রী এসেছে। বাড়ি থাকলেই থাকে হরেক রকমের মেরামতি। কিংশুকের অনুপস্থিতিতে নয়না সেসব নিখুঁতভাবে করিয়ে রাখে। কিংশুক শুধু তাকে ফোন নম্বরের একটা লিস্ট আর টাকা ধরিয়ে দেয়। নিপুণ ‘টাস্কমাস্টার’ নয়না মনে হয় কাজগুলি দরদাম করে সস্তায়ও করায়। একদিন কিংশুকের গাড়ির কিছু গোলমাল হয়েছিল। নয়না বলল, “তুমি ক্যাব নিয়ে যাও। দেখি আমি ফোন করে সারিয়ে রাখতে পারি কিনা।” কিংশুক ফিরে এসে দেখল গাড়ি ফিট। একটু অবাক হয়ে বলল, “অটো গ্যারেজ থেকে তো বলল কালকের আগে পারবে না। তা, এসেছিল বুঝি?”

“তাই?” নয়না একটু ভেবে বলল, “তাহলে কি অ্যাপ দেখে ফোন করেছিলাম? যাক, ভালো করে দেখে নিও। টাকাও তো বিশেষ নিল না।”

শুধু সংশয়ের সূক্ষ্ণ কাঁটা হয়ে থাকে ঐ নয়নার ‘নিজস্ব ব্যাপার’। বার দুয়েক “আমাকে কিছু টাকা দেবে গো?” বলে কয়েক হাজার করে টাকা চেয়ে নিয়েছে। কী দরকার, না বললে জিগ্যেস করার উপায় নেই। এমনিতে অবশ্য নয়না মোটেই উড়নচণ্ডী নয়। এমনকি এক এক সময় কিংশুকের মনে হয়, এত কমে সংসার চালায় কীভাবে? জিগ্যেস করলে হেসে বলে, “তুমি বড্ড ভালোমানুষ, সবাই ঠকাত। এখন তোমার বৌ এসে গেছে।”

কিন্তু সবচেয়ে বড় রহস্য, নয়নার ছোট কাবার্ড। তার আব্দারে কিংশুকই কিনে দিয়েছিল তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখার জন্য। কিন্তু তারপর থেকেই নয়না তার দুটি চাবিই কব্জা করেছে। মাঝে মাঝে সম্ভবত কিংশুকের অনুপস্থিতিতে কীসব রাখে, বের করে। কিংশুক মজা করে কিছু প্রশ্ন করলে সিরিয়াস হয়ে বলে, “মনে আছে, কথা দিয়েছিলে আমি নিজে না বললে জানতে চাইবে না?”

অগত্যা!

নয়না মাঝে মাঝে বাইরেও যায়। জিগ্যেস করলে বলে “শপিংয়ে।”

“কিন্তু এতক্ষণ কী শপিং করো? টাকা তো দেখি যেমন তেমন থাকে।” বললে উত্তর দেয়, “জানো মশাই, উইন্ডো শপিং বলেও একটা ব্যাপার আছে।”

অবশ্য যেখানেই যাক, কিংশুক ফেরার আগেই নয়না ফিরে আসে। আর কিংশুকের ছুটির দিনেও একা কোথাও যায় না। সেদিক থেকে বলার কিছু নেই।

কোথায় যায় নয়না? কী আছে ঐ কাবার্ডে? কৌতুহল বড় বালাই। আর কৌতুহল থেকেই আসে সংশয়।

অথচ একজন মেয়েকে তার স্বামী যে কারণে অর্থাৎ কোনও ‘অ্যাফেয়ার’ আছে বলে সন্দেহ করে থাকে এখানে তার জায়গা নেই। নয়নার প্রতিটি রোমকূপ কিংশুকের কাছে আত্মনিবেদনের জন্য উন্মুখ। সে নিঃসন্দেহ নয়না তার, আর কারও নয়।

আর নয়না কী লুকোতে চায় ঐ কাবার্ডে? তার অতীতের কীই বা কিংশুকের অজানা? সেসব যখন তাদের মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, কী এমন থাকতে পারে যা নয়না প্রাণ দিয়ে আড়াল করছে?

তবু কিংশুক অনেক কষ্টে কৌতুহল দমনের চেষ্টা করে, সংশয়ের কাঁটা যদিও খোঁচাতে থাকে।

কিংশুক যখন বাড়ি থাকে নয়নাও থাকে। আর কাবার্ডের চাবি যথারীতি নিজস্ব গুপ্তস্থানে রেখে দেয়। তাই ইচ্ছে থাকলেও কাবার্ড খুলে কথাখেলাপি হওয়ার সুযোগ কিংশুকের নেই। কিন্তু মানুষ যতই সতর্ক হোক ভুল একদিন করবেই। একদিন কোর্ট সেরে কিংশুক একটু আগে ফিরল। নয়নার জানা ছিল না, তাই সে একটু বেরিয়েছিল। চাবি ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে হঠাৎ কিংশুকের চোখ চকচক করে উঠল, নয়নার কাবার্ডে চাবি লাগানো! বোধহয় কিংশুক আসবে ভাবেনি, তাই একটু অসতর্ক হয়েছিল।

কয়েক মুহূর্তে দ্বিধা কাটিয়ে কিংশুক কাবার্ডটা খুলে ফেলল। প্রথমেই চোখে পড়ল নানারকমের যন্ত্রপাতি, টুলসেট। উকিল কিংশুকের তার কিছু চেনা, অনেকটাই অচেনা। অবাক হয়ে ভাবছে, হঠাৎ চোখে পড়ল এক কোণে কিছু কাগজপত্র, তার মধ্যে একটা ল্যামিনেটেড সার্টিফিকেট। কাছে এনে দেখল সেটা মৃগনয়না ভট্টাচার্যের দমদমের একটি কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস উইথ ডিস্টিংশন পাশ করার শংসাপত্র! 

চোখের সামনের একটা পর্দা মুহূর্তে এক ঝোড়ো হাওয়ায় ছিড়েখুঁড়ে উধাও। কাঁপা কাঁপা হাতে সার্টিফিকেটটা যথাস্থানে রেখে সবে চাবি ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, পেছনে একটা হিসহিসানি, “তুমি ওখানে কী করছিলে?” ঘুরে দেখল, জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে নয়না। কখন নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি।

“আমি – এই একটু আগে এসেছিলাম। দেখলাম তোমার চাবি কাবার্ডে লাগানো। কোনওদিন তো থাকে না, তাই ভাবছিলাম কোনও ব্রেক-ইন নাকি, কিছু খোয়া গেছে কিনা অথবা তালাফালা ভাঙা কিনা। কিন্তু মনে হচ্ছে, সব ঠিক আছে।” হড়বড়িয়ে বলে গেল কিংশুক।

নয়নার চোখের আগুন ধীরে ধীরে নিভে এল। সে মৃদু হেসে কিংশুকের মুখোমুখি হয়ে বলল, “তোমাকে এই সময় বাড়ি দেখে কী ভালো লাগছে! কখনও তো তোমায় এভাবে পাই না।” তারপর তাকে জড়িয়ে ধরল।

কিংশুকের বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইল, “আমি সব জানি, নয়না। কিন্তু তিলে তিলে নিস্পেষিত হয়ে মরার থেকে বাঁচতে তুমি যা করেছ তাতে কোনও অন্যায় হয়নি। হলেও আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে রাখতাম।”

কিন্তু তার মুখে কথা ফুটল না। একটু আগে সে দেখেছে নয়নার জ্বলন্ত চোখ। তা ত্রস্ত হরিণীর নয়, কোনঠাসা শ্বাপদের, যে বাঁচার মরীয়া চেষ্টায় প্রতিপক্ষের গলায় মরণকামড় বসানোর সুযোগ খুঁজছে।

রাত গভীর। একটু আগের উদ্দাম সঙ্গমও আজ কিংশুকের চোখে ঘুম আনতে পারেনি। নিদ্রিত পার্শবর্তিনীর দিকে চেয়ে সে চোখ বুঁজে আকাশপাতাল ভাবছে।

ঘরে পরি এসেছিল। শুধু প্রেমময়ী পত্নী বা গৃহস্থালীর নিপুণ পরিচালিকা হয়ে নয়। তার যাদুহাতে ঘরে যাবতীয় গৃহযন্ত্রের দেখভাল করে আর বাইরে সম্ভবত মোটর গ্যারেজে খুচরো কাজ করে সে কিংশুকের সীমিত রোজগারের সংসারে একটু সচ্ছ্বলতা আনতে চেয়েছিল। সন্দেহ নেই, কিংশুকের গাড়িটাও সে-ই সারিয়েছে।

আজ মুহূর্তের অবিমৃশ্যকারিতায় কিংশুক সেই এক টুকরো স্বর্গে ঢেলে দিয়েছে সংশয়ের বিষ। নয়না কি বিশ্বাস করবে নীতিনিষ্ঠ আইনজীবি সব জেনেও চিরকাল মুখ বুজে থাকবে? আর কিংশুকই কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে যে আত্মরক্ষার জান্তব প্রবৃত্তি আবার একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের জন্ম দেবে না? ভালোবাসার বন্যা কি সব সংশয় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?

কেন জানলাম!

পাশ ফিরে নয়নার নিশ্বাস পরীক্ষা করে কিংশুক বুঝল, সেও ঘুমোয়নি। আলতো করে ডাকল, “নয়না!”

“উঁ!”

“ঘুম আসছে না?”

“এই আসবে।”

“মাথায় হাত বুলিয়ে দিই?”

“দাও না।” আদুরে বেড়াল ঘন হয়ে এল।

“নয়না, আমরা যদি ক’দিন কোথাও বেড়াতে যাই?”

“ক’দিন নয়, অ-নেক দিন।”

“আচ্ছা সে নয় কাল সকালে ঠিক করা যাবে। এখন একটু কাছে এসো।”

তারপর তারা নিবিড় হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।

কিংশুকের সকাল হল কিন্তু নিঃসীম শূন্যতায়। নয়না পাশে নেই। কোথাও নেই। শুধু মূর্তিমান বিদ্রুপ হয়ে দাঁড়িয়ে তার শূন্য কাবার্ডটা।

পরি সবার সয় না।

(৩)

মেঘের চিঠি

কেন জানলে?

পালালাম। বড্ড ভয় করছে – আইনকে, তোমাকে, এমনকি নিজেকেও।

মাফ কোরো, ভালোবাসায় ভরসা রাখতে পারলাম না। নিষ্ঠুর জীবন এই বোকা মেয়েটাকে শিখিয়েছে ভালোবাসা পদ্মপাতায় জল। আজ আছে কাল নেই।

অভাবে, অত্যাচারে আমি সত্যিকারের বাঁচার মানে জানতাম না। তুমি শিখিয়েছ। আজ যে আমার বাঁচার ভারি লোভ গো, তাই কোনও ঝুঁকি নিতে পারলাম না। তবু যদি বুদ্ধির দোষে আবার জীবনের কানাগলিতে আটকা পড়ি তবে তুমি যেমন বলেছিলে, যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর স্বাধীনতাটুকু তো রইল।

অনেক চুমু।

1 Comment

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...