তুমি পরজনমে হইও…

পার্থ প্রতিম চট্টোপাধ্যায়

কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডব ও কৌরবরা সম্মুখীন হয়েছে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের। কৌরবদের বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং অসংখ্য বীরের সংখ্যা যুধিষ্ঠিরদের বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষমেশ পান্ডবরা কৃষ্ণের শরণাপন্ন হলেন। কৃষ্ণ যুদ্ধে জেতার জন্য এক বিশেষ পূজার আয়োজন করতে বললেন পাণ্ডবদের। এই পূজার শর্ত অনুযায়ী পান্ডব পক্ষের কোন এক বীরের আত্মাহুতির প্রয়োজন। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু যোদ্ধাদের কাছে গর্বের। কিন্তু আত্মাহুতি! … কোনো যোদ্ধাই তো এই কাজের জন্য রাজি হবেন না। চিন্তায় পড়ে গেলেন পাণ্ডবরা। 

অবশেষে মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন ও নাগকন্যা উলূপীর পুত্র ইরাবান রাজি হলেন যুদ্ধ জেতার জন্য এই পূজায় আত্মাহুতি দিতে। কিন্তু এই আত্মবলির আগে অবিবাহিত ইরাবান কৃষ্ণের সামনে দুটি কঠিন শর্ত রাখলেন। প্রথমটি হল, যুদ্ধ জয়ের আনন্দ উপভোগ করার জন্য তাঁর মাথাটি দেহ থেকে আলাদা হয়েও জীবিত থাকবে যুদ্ধ জেতা অবধি। দ্বিতীয়টি, আরও কঠিন, আত্মবলির আগে বিবাহ করতে চান তিনি। অবিবাহিত অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন না তিনি। কৃষ্ণ প্রথম শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করলেও দ্বিতীয় শর্তটি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। বিবাহের পরদিন বৈধব্য অনিবার্য্য জেনে কোনো মহিলাই এগিয়ে এলেন না ইরাবানকে বিবাহ করতে। এমতাবস্থায় কৃষ্ণ ঠিক করলেন তিনি সেই মোহিনী রূপ ধারণ করবেন যা তাঁকে সমুদ্রমন্থনের সময় ধারণ করতে হয়েছিলো। যুদ্ধ জয়ের উদ্দেশ্যে, আত্মাহুতির একদিন আগে ইরাবানের সঙ্গে বিবাহ হলো লিঙ্গ পরিবর্তিত মোহিনীর। আর এর একদিন পর ইরাবানের আত্মবলির সঙ্গে সঙ্গে বিধবা হলেন মোহিনী। 

মহাভারতের এই কাহিনী শুনে অবাক হচ্ছেন তো? আমিও হয়েছিলাম এই কাহিনীর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়ে। আমাদের জানা মহাভারতে, কখনও পড়িনি এই ঘটনা। কিন্তু মহাভারতের এই কাহিনী দক্ষিণ ভারতে বিশেষ ভাবে প্রচলিত। দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন স্থানে পূজিত হন ইরাবান, “আরভান” বা “কুথানডাভার” নামে। আরাভানের যে মূর্তি এই মন্দিরগুলিতে পূজিত হয় তা কেবলমাত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথাটি। 

এই মন্দিরগুলির মধ্যে চেন্নাই থেকে প্রায় ২০০ কিমি দূরের, তামিলনাড়ুর এক প্রত্যন্ত গ্রাম, কুভাগামের আরাভানের মন্দিরটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কুভাগামের এই মন্দিরটিতে, প্রতি বছর এপ্রিল – মে মাসে (তামিল পঞ্জিকা অনুযায়ী চিত্রা পূর্ণিমার আগে) ১৮ দিন ধরে এক উৎসব হয়। প্রতিদিনই বিশেষ পূজা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর মাঝে-মধ্যে সন্ধ্যাবেলায়, আরাভানের মাথাটি মন্দির থেকে বের করে, রথে করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হয় কুভাগামের বিভিন্ন স্থানে। এ যেন জয়ের আনন্দ উপভোগ করার জন্য, ইরাবানের কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধভূমি পরিদর্শন। 

এই উৎসবের সমাপ্তির এক দিন আগে কুভাগামে সমাগম হয় দক্ষিন ভারতের অসংখ্য মোহিনীদের, যারা “আরাভানী” বা “থিরুনাঙ্গাই” নামেও পরিচিত। কুভাগামের মন্দিরে পূজিত আরাভানের “একদিনের বিবাহ” ও পরদিন আরাভানের মৃত্যুর পর আরাভানীদের বৈধব্যের মাধ্যমে সমাপ্তি হয় এই উৎসবের।

বেশ কয়েক বছর আগে বন্ধু নীলাদ্রি বলেছিলো কুভাগামের এই উৎসবের কথা। Covid – এর  জন্য ২ বছর বন্ধ থাকার পর, ২০২২ তে আবার শুরু হয় এই অনুষ্ঠান। নীলাদ্রির সঙ্গে আমরা আরও কয়েকজন গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম কুভাগামে সেই বছর। কিন্তু সঠিক খবর না থাকার জন্য মূল অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেবার দেখতে পেলাম না মূল অনুষ্ঠানটি। কিন্তু মূল অনুষ্ঠানের আগের দিনগুলির কিছু অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেবার। এর পরের বছর আবার এসে উপস্থিত হলাম কুভাগামে অসম্পূর্ন কাজটি শেষ করার জন্য।

এবারে কুভাগামে পৌঁছে এক অন্য দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হোলো। মন্দির থেকে প্রায় ২ কিমি দূরে নেমে পড়তে হলো গাড়ি থেকে। লোকে লোকারণ্য, আর এদের মধ্যে আরাভানীদের (Transgender women) সংখ্যাই বেশী। এরা সবাই এসেছেন কুথানডাভারের মন্দিরে বিবাহের উদ্দেশ্যে। ভিড়ের সঙ্গে মিশে আমরাও মন্দিরে এসে পৌঁছলাম এই বিয়ের উৎসব স্বচক্ষে দেখতে। মন্দিরের পূজারিরা আরাভানের সঙ্গে আরাভানীদের বিবাহ সম্পন্ন করাচ্ছেন তাঁদের  হলুদ রঙের “থালি” বা “মঙ্গল্যম” (তামিল বিবাহ প্রথা অনুসারে মহিলাদের বিবাহের চিহ্ন) পরিয়ে। এই বিশেষ বিবাহের বেশ কিছু ছবি তোলার পর মন্দির থেকে বেরিয়ে দেখি, মন্দির চত্বরে সদ্য বিবাহিত আরাভানীরা একজোট হয়ে নাচ গানের মধ্য দিয়ে উদযাপন করছেন তাঁদের এই বিবাহ। প্রায় সারা রাত ধরে চলবে তাঁদের এই একদিনের বিয়ের আনন্দ উৎসব। 

বেশ কিছু সময় ধরে এই অনুষ্ঠানের আনন্দ উপভোগ করে রাতে ফিরে এলাম প্রায় ৩৫ কিমি দূরের হোটেলে। পরদিন আবার খুব সকালে আসতে হবে কুভাগামে, এই উৎসবের শেষ পর্ব দর্শন করতে। সারা রাত এই একদিনের বিয়ের উদযাপনের পর সকালে আরাভানের মৃত মস্তকটি নিয়ে মন্দির থেকে শোভাযাত্রা বের হলে সদ্য বিবাহিত আরাভানীরা তাঁদের বিবাহের চিহ্ন মুছে ফেলে বিধবা হবেন।  

পরদিন খুব সকাল সকাল কুভাগামে এসে পৌঁছলাম আমরা। মন্দিরের সামনে আরাভানের মূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রথ, আর হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে আছেন, রথারোহী আরাভানের দর্শনের জন্য। রথের চলা শুরু হতে, একত্রিত আরাভানীরা ধীরে ধীরে মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল থেকে চলে যেতে লাগলেন। তাঁদের পিছু নিয়ে আমরাও এসে পৌঁছলাম সেই স্থানে যেখানে আরাভানের সঙ্গে “One-Night-Stand” শেষ হওয়ার পর আরাভানীরা বিধবা হওয়ার জন্য জড়ো হয়েছেন। 

এই জায়গায় এসে যে দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম তার জন্য মানসিক ভাবে একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। গত কয়েক ঘণ্টার আনন্দ-উৎসব হঠাৎ করে যেন এক শোক-উৎসবে পরিণত হয়েছে। সদ্য স্বামীহারা আরাভানীরা একত্রিত হয়ে তাঁদের বিবাহের চিহ্ন হিসেবে পরা “থালি” কেটে আর হাতের চুড়ি ভেঙ্গে বিধবা হচ্ছেন। এ এক অসহনীয় দৃশ্য, দেখে মনে হছে, সত্যি সত্যিই যেন এঁরা পরম প্রিয়জন হারা হয়েছেন। চারিদিকে পরে আছে ভাঙ্গা কাঁচের চুড়ির টুকরো আর বিভিন্ন কোণ থেকে ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ। বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে পারলাম না এই নিদারুন দৃশ্য, বেরিয়ে এলাম এখান থেকে বেদানাতুর মন নিয়ে। 

এই স্থানটি থেকে বেরিয়ে কিছুটা হাঁটার পর হঠাৎ আর এক দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হোল। মাঠের মধ্যে গাছে ঘেরা একটি জায়গা থেকে কয়েকজন আরাভানী পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে আসছেন। সদ্য স্বামীহারা আরাভানীদের জীবনের সব রঙ যেন এক লহমায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তাঁদের পোশাকের রঙ এখন সাদা, আর চোখে মুখে চরম বেদনার চিহ্ন।  

খুব খারাপ হয়ে গেল মনটা। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধরলাম ফেরার পথ। মনে ভেসে আসছে অনেক প্রশ্ন …

সত্যি সত্যি কি কখনো এঁরা আসল আরাভানের খোঁজ পাবেন না? 

এদের এই বিবাহ কেবলমাত্র একটি দিনের জন্যই কি হতে হবে? 

কখনো কি পারবেন তাঁদের বৈবাহিক জীবনের রঙের স্থায়িত্ব পরিবর্তন করতে? 

জীবনের চলার পথে চিরকালই কি এদের একাই হেঁটে যেতে হবে?  

মোহিনী রূপী কৃষ্ণ তো ইরাবানের সঙ্গে একদিনের বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জেতার জন্য। কিন্তু আজকের আরাভানীদের কোন যুদ্ধ জেতার জন্য মন্দিরের এই প্রাণহীন আরাভানের সঙ্গে একদিনের জন্য বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে?

লেখাটি শেষ করতে চাই দক্ষিণ ভারতের এক প্রখ্যাত Transgender Activist, Kalki Subramaniam এর বই “WE ARE NOT THE OTHERS” –এ প্রকাশিত, একটি তামিল কবিতার ইংরাজি অনুবাদের কিছু অংশ দিয়ে। এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন N. Elango.

Fate, I Wrote

“Wedded to God,

widowed in a day,

I am an experimental poem,

my nuptial knot

stayed firm and fast

just from dawn to dusk.

After that, around a tree,

was wound

my wedding thread

and I learned 

the threadbare string

will dry

and dissolve into dust.

It will not, ever,

Never ever

decide even my life’s crust……….”

ফটোগ্রাফ: লেখক পার্থ প্রতিম চট্টোপাধ্যায়।

14 Comments

  • দেবলীনা

    Reply June 29, 2023 |

    ভীষণ ভালো একটি প্রতিবেদন পড়লাম এই প্রথার কথা বিষদে জেনে অদ্ভুত কষ্ট হলো কিন্তু একটা গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম !! আজকের এই সমাজ তার উত্তর দিচ্ছে খুবই সন্তর্পণে!

    • Sujata De

      Reply July 8, 2023 |

      পার্থবাবুকে স্যালুট। এই অজানা বিষয়ের উপর অসাধারণ লেখা ও ছবি। ঋদ্ধ হলাম।

  • অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়

    Reply June 29, 2023 |

    খুবই সংবেদনশীল বিবরণী। ভাল‌ লাগল পড়ে। নিশ্চয়ই আরো অনেক ছবিই আছে লেখকের ভাণ্ডারে।সেসব কোনোদিন দুই মলাটের মাঝখানে একত্র দেখলেও ভাল লাগবে।

  • Asim

    Reply June 30, 2023 |

    খুব সুন্দর লেখা।

  • Madhumita Mukhopadhyay

    Reply July 1, 2023 |

    খুব ভাল লাগল লেখাটা পড়ে ৷ মহাভারতের এই কাহিনীটা অজানা ছিল ৷ আর আপনার উৎসাহের ফসল হিসেবে আমরা পাঠক-পাঠিকারা জানতে পারলাম এখনকার দিনের এই অদ্ভুত প্রথার কথা ৷ আবার বলি , তথ্যসমৃদ্ধ একটা সুন্দর প্রতিবেদন উপহার দিয়েছেন আপনি ৷

  • Urmimala Roy Chowdhury

    Reply July 1, 2023 |

    পার্থ , তোমার এই লেখাটা পড়ার অপেক্ষায় ছিলাম ।
    অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম এই transgender সম্প্রদায়ের , যা তুমি অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছো।
    ছবিগুলো খুব ভাল লাগলে।

  • Joy Bhattacharjee

    Reply July 3, 2023 |

    Lekhonir noipunno, biboron er jatno, aabeg a mesha lekhok er pothchola, mahakabyer awjana kotha tule dhore amader shomridhho korar jonno amar obhibadon roilo Lekhok ke, aagami te titikhhay thaklam……

  • পরীক্ষিৎ মালী,

    Reply July 3, 2023 |

    তোমার লেখা পড়ে অনেক অজানা তথ্য জানা হয়ে গেল, অসাধারণ কাহিনী পরের পর্বের আশায় থাকব 🙏

    • Banibrata Podder

      Reply July 7, 2023 |

      Dear Partha,
      Photos and write up are exceptionally good. Wish you explore more and more such stories. Congratulations 💐.

  • Malay Chakraborty

    Reply July 3, 2023 |

    পার্থ,
    সত্যিই অনেক অজানা তথ্য আজ তোমার এই লিখাতে জানতে পেলাম, কিছুক্ষনের জন মনটা একটু ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। কিন্তু অনেক অজানা তথ্য জানা গেলো, যেটা নাকি এর আগে জানা ছিল না। যাক তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই।

    • Sima Mukhopadhyay

      Reply July 4, 2023 |

      খুব ভালো লাগলো প্রতিবেদনটি পড়ে। এমন একটি প্রথা এখনো চলছে জেনে অবাক লাগছে। কত বিচিত্র আমাদের এই দেশ।

  • লোপামুদ্রা রায়চৌধুরী

    Reply July 7, 2023 |

    কতো কিছুই জানি না আমরা! মনকেমন করা লেখা।

  • Sharmistha Nathmandal

    Reply July 7, 2023 |

    খুব ইন্টারেস্টিং গল্প। অনেক কাহিনী জানতে পারলাম। না বেড়ালে এসব জানাই যায় না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই

  • গোরা চক্রবর্তী

    Reply July 7, 2023 |

    পড়লাম পার্থ তোমার এই অসাধারণ প্রবন্ধ এবং দেখলাম তোমার তোলা অসাধারণ সব ছবি। পঠনে ঋদ্ধ হলাম। জানতে পারলাম Transgender-দের সম্বন্ধে অনেক কিছু। নাগকন্যা উলূপীর পুত্র ইরাবান-কে নিয়ে এই গল্পটিও ইতিপূর্বে পড়ি নি। দক্ষিণ ভারতের এই মন্দিরের কথাও আগে শুনিনি। তোমায় অনেক ধন্যবাদ এই লেখার জন্য।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...