ঘুড়ি
যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা

কুমারন রেড্ডির পুত্রবধূ শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে এসে বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসল সে। লক্ষ করলাম, আজও পরনে একই শাড়ি। এই বাড়িতে আমরা এসেছি আজ চারদিন হলো। এই তিনদিনের মধ্যে ওর কাপড়চোপড়েও কোনও পরিবর্তন দেখলাম না, এমনকি চুলে চিরুনি পড়েছে বলেও মনে হয়নি।
ওর স্বাস্থ্য ভালোই, আঁটোসাঁটো চেহারা, মাঝারি উচ্চতা। মুখশ্রী অবশ্য তেমন আকর্ষণীয় বলা যাবে না, আর চামড়ার রঙ ও উজ্জ্বলতা বোঝার উপায় নেই, কারণ গায়ে ঠিক ক’পোঁচ ময়লা লেগে আছে তা জোর দিয়ে বলা যাবে না।  ব্যাপারটা আমার খুব অদ্ভুত লেগেছে।

জয়া নিজের গবেষণার কাজে এতটাই মগ্ন যে, ওর এসব পোশাকআশাক বা বাহ্যিক সব তুচ্ছ বিষয়ে নজর পড়ে না। কুমারন রেড্ডি আবার আগামীকাল ভোরে বেরিয়ে যাবেন। তিনি প্রথমে যাবেন নেপাল, তারপর সেখান থেকে তাঁর সিঙ্গাপুর যাবার কর্মসূচি আছে। একটা ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে একটা সেমিনারে। তাদের ভারতীয় এজেন্টের সঙ্গে নেপাল থেকেই সিঙ্গাপুর রওনা হয়ে যাবেন তিনি।

জয়ার হাতে তাই সময় খুবই কম বলে এখনও তার নানা প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসে আছে। বীজ সংরক্ষণ ও আধুনিকতম পদ্ধতিতে পিয়োরিটি বজায় রাখার পদ্ধতিগত দিকগুলি জেনে নিচ্ছে জমিতে দাঁড়িয়ে। রেড্ডিসাহেবের জমিতে ফক্সটেল মিলেট আর ফিঙ্গার মিলেট দিয়ে হাতেকলমে কাজ শিখছে জয়া। ওর কাজটা মূলত ধানের উপর হলেও মিলেট নিয়ে আগ্রহটা এখানে এসে তৈরি হয়েছে, হয়তো বা তুলনামূলক কোনো একটা বিষয় পরীক্ষা করে দেখতে চায়।

ব্যাঙ্গালোর থেকে যে এখানে এসে পড়ব, রেড্ডিসাহেবের সঙ্গে যে দেখা হয়ে যাবে এতটা আমরা আশা করিনি। তার কারণ তিনি একটানা খুব বেশিদিন বাড়িতে থাকতেই পারেন না। অবিরত বিচরণ করে চলেন দেশে বিদেশে তাঁর গবেষণার বিষয় নিয়ে নানা সেমিনার আর সভায়। ব্যাঙ্গালোর থেকে আমাদের দুজনের মাইশোর যাবার কথা ছিল। সেখান থেকে উটি যাব বলে ঠিক করেছিলাম। সড়ক পথে নীলগিরি অঞ্চলের ওই রাস্তায় ভ্রমণ নাকি একটা দারুন আনন্দময় ব্যাপার। রাস্তার দু’পাশের প্রকৃতি অকৃপণ হাতে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে বলে শুনেছি।

সোমবার রাতে জয়া জানতে পারল রেড্ডিসাহেবের কোনো একটি প্রোগ্রাম বাতিল হওয়ায় কয়েকদিন তিনি বাড়িতেই আছেন। অতএব মাইসোর ও উটিযাত্রা বাতিল করে ব্যাঙ্গালোর থেকে প্রায় পঁচাশি কিলোমিটার দূরে এই মুক্তিপুরম গ্রামটিতে এসে পড়া গেল। আসলে জয়ার সঙ্গেই রেড্ডিসাহেবের আলাপ পরিচয় ওর কাজের সূত্রে। আমি নেহাতই ইতিহাসের দিদিমণি, ওর সঙ্গে এসেছি মাত্র।

জয়া আর আমি স্কুলজীবনের বন্ধু, সে বন্ধুত্ব আজও যে অটুট সেজন্য আমরা নিজেরা খুবই গর্বিত আর একইসঙ্গে অনেকের ঈর্ষার পাত্রীও। তাই বলে আমরা কিন্তু হোমো-টোমো নই। জয়ার স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে। আর আমার প্রেমটা আদৌ প্রেম কিনা মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারি না। মানে আমি অরণ্যকে ভালোবাসি। কিন্তু সে বড্ড আনপ্রেডিক্টেবল। কখনও মনে হয় ভীষণ ভালোবাসে। কখনও কোনো যোগাযোগই রাখে না। কিছু জানতে চাইলেও এমন ন্যাকামি করবে যেন আমায় চেনেই না। জয়া বোঝায় আমাকে – ওকে সময় দে! ও নিজেকে বুঝুক। এই সম্পর্কটা ও চায় কিনা, সেটা ওর বোঝা দরকার। তুই একদম চুপ থাক।

জয়া প্রতিদিন ক্লাস করেছে রেড্ডিস্যরের কাছে। সন্ধ্যে পর্যন্ত জমিতেই কাজ। ওদিকে কাবাবমে হাড্ডি হবার থেকে গ্রামগুলো ঘুরে দেখা ভালো ভেবে গত তিন-দিনে আমি তিন চারটে গ্রাম ঘুরে ফেললাম। এই বাড়ির সামনে দিয়ে যে লাল কাঁকড়ের রাস্তাটা গেছে সেটাই অন্য গ্রামগুলোকে সংযুক্ত করেছে। রাস্তার পাশে পাশে রুক্ষ কাঁকুড়ে জমিতে অল্প স্বল্প সবজি আর মিলেট ও আঙুরের বড়ো বড়ো ক্ষেত। এখানে মাটি একেবারে ঝামাপাথর। তাতেই চাষীরা ফসল ফলাচ্ছেন। পশ্চিমবাংলার গ্রামে দেখা আলুবাড়ির ভেলির মত এখানেও ভেলি করে উঁচু জায়গাটায় বিভিন্ন ফসল বুনেছেন চাষীরা। সেই অংশটা পলিসিট দিয়ে ঢেকে রেখেছেন যাতে ময়েশ্চারটা যতদূর সম্ভব ধরে রাখা যায়। গাছের গোড়ায় কোথাও কোথাও কলসির ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল যাচ্ছে। এভাবে জলের সাশ্রয় ও পূর্ণ ব্যবহার আমাদের ওখানে খুব একটা দেখি না। বাংলার মতো উর্বর মাটি আর জলের প্রাচুর্য আর কোথায়? তাই অপচয়ও হয়ে চলেছে দেদার। অথচ দ্রুত পানীয় জলের উৎস ফুরিয়ে আসছে।

আমায় দেখে লোকজন কৌতুহলী হয়েছেন, কিন্তু ভাষাগত সমস্যায় কৌতুহল মেটাতে পারেননি। কারণ তাঁরা না জানেন হিন্দি, না জানেন ইংরাজী। আবার আমিও কন্নড় ছাড়া বাকি দুটো জানি। তাই পরিষ্কার বাংলায় বলি, কুমারন রেড্ডিসাহেবের বাড়ি এসেছি খুড়োরা! তারপর যে যার মাতৃভাষায় বাক্যালাপ জুড়ে দিই। দেখলাম, রেড্ডিসাহেবের নামেই অনেকে হাত জোড় করছেন। লোকজন যে তাঁকে বেশ শ্রদ্ধা করেন তা বেশ বোঝা গেল। খুব উৎসাহ নিয়ে আমাকে তাঁদের জমিতে ডাকেন, ফসল দেখান। আঙুরক্ষেত দেখাতেও ডাকলেন কেউ কেউ। হয়তো রেড্ডিস্যরের পরামর্শে তাঁদের উৎপাদন কত বেড়েছে
তাই দেখাতে চান। যেহেতু আগে কাঙালের শাকের ক্ষেত অদর্শনের মতো আমিও কখনও আঙুরক্ষেত দেখিনি, তাই বেশ উৎসাহিত হয়েই ঢুকে পড়ি। ভালো লাগে বেশ। প্রতিটা গাছ বা লতা থেকে থোকা থোকা টুসটুসে আঙুর ঝুলছে। কোথাও সাদা, কোথাও বা কালো আঙুরের বাগান। আমি দুহাতের আঁজলায় আলতো করে আঙুরগুচ্ছ ধরি।

আর কী কান্ড! আমার ঝটাকসে কেন যে রবীন্দ্রনাথ আর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কথা মনে পড়ে গেল? ঠিক এভাবেই কি আলতো করে অতীব যত্নে কবি ওকাম্পোর স্তনভার ধরে রেখেছিলেন?

 চাষীরা বলছেন, খাও না, খাও?

আমি বলি, না না! খেপেছ?

হাতের নাগালে পেলেই তা ভোগ করতে হয় নাকি? দেখে আর স্পর্শ করে সৌন্দর্য উপভোগ করলাম, এতেই খুব খুশি হয়ে গেলাম। তাছাড়া শুনেছি অতিরিক্ত পেস্টিসাইড ব্যবহার করার কারণে ভারতীয় ফলের গুণগত মান কমে যাওয়ায় বিদেশে রপ্তানী কমে গেছে। বড়ো বড়ো ফলের বাগিচায় নাকি হেলিকপ্টার থেকে কীটনাশক ছড়ানো হয়। তার মানে রেড্ডিস্যর জৈব চাষের সব আদর্শটুকু এদের মধ্যে প্রবেশ করাতে পারেননি এখনও।

আজ দুপুরে খাবার পর জয়ার সাথে জমিতে অনেকক্ষণ ছিলাম। স্যর কথা বলেন খুব সুন্দর। যে কোনো বিষয়কে গল্পের মাধ্যমে, উপমা দিয়ে এত সুন্দর করে বলেন – শুনতে খুবই ভালো লাগে। পাশের একটা জমি চাষবিহীন পড়ে আছে দেখে জয়া কারণ জিগ্যেস করল। বললেন, একজন মা এক নাগাড়ে সন্তানের জন্ম দিলে মা তো দুবলা হয়ই, বাচ্চারাও কমজোরি হয়। তাই যথেষ্ট গ্যাপ দিয়ে পরবর্তী সন্তানের জন্ম দিতে হয়। সবারই বিশ্রাম দরকার, মাতৃগর্ভেরও।

অরসিক কী আর অনাগ্রহের বিষয় বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে? আমারও জমিতে থাকতে আর ভালো লাগছিল না, তাই একটু আগে ফিরে এসেছি। বারান্দায় বসে  নানা আগডোম বাগডোম ভাবছিলাম। ভেতর বাড়ি থেকে তখনই চিত্রাদিদি এলো। ওকে দেখলেই আমার কেমন একটা অস্বস্তি হতে থাকে। সারাদিন কাজ করে চলেছে, কারও সঙ্গে ওকে তেমন কথা বলতে দেখি না। একদম অসুখী অসুখী একটা চেহারা। পুরো শরীর জুড়ে একটা দুঃখীভাব, অথচ অদ্ভুত নিরাসক্তি। দূরে নারকোল গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে বসে রইল আশ্চর্য শূন্যদৃষ্টিতে। এ বাড়িতে এসে আমরা প্রথমে ওকে বাড়ির কাজের লোক মনে করেছিলাম। কারণ সে ছাড়া বাড়ির বাকি চার সদস্যেরই উপস্থিতি ছিল আমাদের সম্ভাষণ জানানোর জন্য। পরে ওর পরিচয় জানলাম, আর তখন থেকেই আমার অস্বস্তির শুরু। বারবার মনে হয়, কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। কিন্তু তাই নিয়ে কাউকে তো আর কিছু জিগ্যেস করা যায় না! প্রথমদিন দুপুরে খাওয়ার পর গেস্ট হাউসে এসেছিল। তখন ও কাজ চালানো হিন্দিতেই কথা বলেছিল। ওকে হিন্দিতে কথা বলতে শুনে জিগ্যেস করেছিলাম, হিন্দি কীকরে শিখলেন?

ও উত্তর দিয়েছিল, বাপের বাড়িতে টিভিতে প্রচুর হিন্দি সিনেমা দেখতাম, তাতেই…! এই বাড়িতে অবশ্য টিভি নেই।

“বাড়ির মহিলারা অবসরে কী করেন তাহলে?” আমি আমার বঙ্গীয় অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, বাংলা সিরিয়ালই অধিকাংশ বাড়িতে মহিলাদের একমাত্র বিনোদন।

আমার কথা শুনে চিত্রাদিদি হেসেছিল। বলেছিল, অবসর? উয়ো ক্যায়া চিজ হ্যায়? বাড়িতে মহিলারা একটা কাজ শেষ হলে আর একটা কাজ করবে। সেটা শেষ হলে অন্য কাজ। ভোর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত এতেই আমাদের অবসর।

এরপর সন্ত্রস্তভাবে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল চারদিক তাকাতে তাকাতে। কেন রে বাবা, বাইরের লোকের সাথে একান্তে কথা বলা মানা নাকি?

দুজন মহিলা, মোটামুটি কাছাকাছি বয়সের, হ্যাঁ, ওনার কত আর বয়স হবে, চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশ? –  চুপচাপ কাছাকাছি বারান্দায় বসে আছি কোনো বাক্যবিনিময় ছাড়া। অস্বস্তিকর ওই নীরবতার পাথরটা সরাতে ইতস্তত করে হিন্দিতে জিগ্যেস করেই ফেলি, “চিত্রাদিদি, লাঞ্চ কব কিয়া?” বলেই খেয়াল হলো এখন প্রায় চারটে বাজছে, মানে বিকেল। লাঞ্চের কথা জিগ্যেস করাটা এই মুহূর্তে বেমানান হয়ে গেল না? তবে চিত্রাদিদি উত্তর দিল খুবশান্তভাবে, “আভিই তো লাঞ্চ খতম হুয়া।”

বেলা চারটে মানে, শরতের এই সময়টাতে দেশের পূর্বপ্রান্তে সূর্য পাটে বসব বসব করে। এখানে আরও কিছুটা পরে গোধূলি নামবে। এত দেরিতে দুপুরের খাওয়া শেষ হলে রাতের খাবর কখন খাবে রে বাবা! অবশ্য গ্রামের দিকের মহিলারা অনেক সময়ই এরকম সকালের খাবার দুপুরে, আর দুপুরের খাবার বিকেলে খেয়ে থাকেন শানকিতে ভাত আর ঝড়তি পড়তি তরিতরকারি চেঁছে। তাতেই তাঁরা ঠাকুরের থানে থানে, আর ঠাকুর ঘরে গলবস্ত্র হয়ে সেই পরিবারেরই মঙ্গল কামনায় আত্মনিয়োগ করার শক্তি পেয়ে যান। একটু নিজের কথা বললে – ভাবলে নিজেদের কাছেই হয়তো নিজেদের স্বার্থপর মনে হয়। অথচ সব কিছু ছাড়তে ছাড়তে, স্বার্থত্যাগ করতে করতে বয়সকালে হয়তো কোন একদিন অনুভব করে যে, তারা কবেই মানুষগুলোর মনের উঠোন থেকেও ছাড় পেয়ে গেছে। ভারতবর্যের সুদূর এই পশ্চিমাঞ্চলে কতটা ব্যতিক্রম আছে জানি না। তবে কিছুটা তো দেখছি, আবার এটাও ব্যতিক্রমী ঘটনা কিনা তাও বলতে পারব না। চিত্রাদিদির বেলা চারটেতে লাঞ্চের কথা শুনে তাই খুব একটা অবাক হলাম না।  

উঠোনে ওর বছর আটের ছেলেটি, অভিজ্ঞান ওর নাম, সে বাড়ির পোষ্যগুলোর সাথে খেলছে। কখনও বাছুরের পিছনে ছুটছে, কখনও ছাগলছানাকে বুকে জড়িয়ে আদর করছে। একটা গাছের ডাল নিয়ে নিজের মনে ছুটে চলে গেল একদিকে। তার মায়ের দৃষ্টি এবার নারকেল গাছের মাথা থেকে নেমে এলো আমার মুখে। আমি একটু হাসলাম। বললাম, “আপকা বেটা বহোত জলি হ্যায়। ভেরি ইনটেলিজেন্ট, না?”

“কোই ফায়দা নেহি। সবহি পাপাজিকা তরহা হোঙ্গে।”

তার গলার স্বরে ওঠানামা নেই, কপালে একটাও বাড়তি ভাঁজ নেই। কিন্তু গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, আমার চোখ তার মুখের উপর স্থির হলো। তার কথার মাঝেই মোটা গলায় প্যাঁক প্যাঁক করে অদূরে বাড়ির পুকুর থেকে কয়েকটি রাজহাঁস উঠে এলো ডানা ঝাড়তে ঝাড়তে। সেদিকে তাকিয়ে বলা কথাগুলোর অর্থ আমি ঠিক ধরতে পারি না। বুঝতে পারি না কার পাপাজি? তার স্বামী, রাজন রেড্ডির বাবা অর্থাৎ চিত্রাদিদির শ্বশুরবাবা? নাকি তার ছেলের বাবা রাজনদাদার কথা বলছে?

কৌতুহল এক্তিয়ার বহির্ভূত হয়ে যাচ্ছে কিনা বুঝতে পারি না। তাই অভদ্রতা হবার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জানতে চাই, “পাপাজি মিনস, রাজনদাদা?”

“না। আমি আমার শ্বশুরমশাইএর কথা বলছি। আমার স্বামী তার বাবার ছায়া, হয়তো আমার ছেলেও তাই হবে। শুধু পরিবার আর পরিবার। বাড়ির ছেলেপুলেরাই শুধু পরিবারের মধ্যে পড়ে, আমরা মেয়েরা পরিবারের নই। আমার শাশুড়ি নয়, আমিও নই।” ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলা কথাগুলোর ভেতর থাকা শ্লেষটুকু ধরতে পারলাম। কথা বলতে বলতে ও উঠে পড়ে।

“বসুন না! এখন তো কোনো কাজ নেই?”   আমি একেবারে ছোটলোকোমি উৎসাহ দেখিয়ে চলেছি। এখনও পর্যন্ত রেড্ডিস্যরকে যতটা বুঝেছি, সবই প্রশংসনীয় মনে হয়েছে। তাই অন্যরকমের একটা গন্ধ পেলাম এবার।

“রাতে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত আমার আর আমার শাশুড়ির কাজ কেবল পরিবারের তিনটি পুরুষের দেখভাল। আপনাদের রেড্ডিস্যার বলেন, রান্নাঘর আর গোয়ালঘরই হল বাড়ির মেয়েদের আসল জায়গা। নাহলে পরিবারের স্বাস্থ্য ঠিকঠাক বজায় থাকে না। কারণ আমরা সম্ভবত পরিবারের অংশ নই, সবার স্বাস্থ্য দেখতে গিয়ে আমরা কতটা টিকলাম সেটুকু জানার প্রয়োজন ওনার নেই।” এই পর্যন্ত বলে চিত্রাদিদি কেমন যেন হাসল, আর তার সামান্য পুরু ঠোঁট দুটো বেঁকে গিয়ে যেন ঝিরিঝিরি নারকেল গাছের লম্বা ছায়ার সাথে মিশে গেল। যে নারকেল গাছ মাথার উপর পাতাগুলো নিয়ে একলা হয়ে দাঁড়িয়ে রোদ বৃষ্টি আর চাঁদের আলো মাখে। মাথাটা একবার চুলকে নিয়ে বলতে থাকল সে, “দেশবিদেশের নানা লোকজন আসে গবেষণার নানা কাজে। সেইসব অতিথিদের দেখভাল করাও আমার কাজ। আর বাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক রাখা। জমির কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজের জন্য লোক নেই। গোয়ালের কাজ, পশুগুলো দেখাশোনার কাজ আমার। রান্নাঘরে শাশুড়িকে সাহায়্য করাও আমার কাজ। খামারে ফসল এসে গেলে এইসব কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফসল রোদে মেলা, ঝাড়া, শুকোনো, তোলা – এর অধিকাংশ কাজও আমার। এই তো একটু পরেই রান্নাঘরে যাব। আপনাদের স্যর এসে গেলে প্রয়োজনমতো চা-জলখাবার তৈরিতে হাত লাগাব, তারপর সেগুলো হাতে হাতে দিয়ে গোয়ালে ঢুকব। গরুর খাবারও ঠিক করতে হতে পারে, মশা তাড়ানোর জন্য ধোঁয়া দেব, এরই ভেতর ছাগল, হাঁসগুলো দেখে নিয়ে খোপে বন্ধ করতে হবে – যাই দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

 আমি তার যাবার পথের দিকে আবারও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ওই দুঃখী বিমর্ষভাবের আড়ালে এতটা ক্ষোভ জমে আছে রেড্ডিসাহেবের বৌমার মনের অন্দরে?

বাড়ির বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াই। অনেক লোক বেশ সেজেগুজে একটা নির্দিষ্ট দিকে হেঁটে চলেছে। ইশারা ইঙ্গিতে আর আমার নিজস্ব কলকাত্তাইয়া পরিষ্কার বাংলায় তাঁরা কোথায় চলেছেন জিগ্যেস করি। তাঁদের কেউ কেউ পরিষ্কার কন্নড়ে উত্তর দ্যান। মনে হয়, কোনও একটা লোকাল উৎসবে যোগদান করতে চলে গেলেন তাঁরা। সে’দলে বাচ্চা থেকে বুড়ো, কিশোরী থেকে বৃদ্ধা সকলেই আছেন। আমি তাদের সঙ্গেই কিছুটা এগিয়ে যাই।

কই, এই উৎসবে রেড্ডি পরিবারের কেউ তো গেলেন না? সবাই কাজই করে চলেছেন একনাগাড়ে। জীবনে অবসর, উৎসবও যদি না থাকে, জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দ কি কিছু থাকবে? ভাবতে ভাবতে ফিরে আসি। তখন নারকেল গাছের মাথায় অস্তমিত সূর্য যুগপত নবজন্ম আর গর্ভপাতের লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তারই ভেতর নিরলস আপন কর্তব্যজ্ঞানে প্রত্যাশার অতীত হয়ে সাঁঝতারা দেখা দিয়েছে। ওই সন্ধ্যাতারার মতোই যেন চিত্রাদিদিও কর্তব্য পালন করে চলেছে বিনা প্রশ্নে ।       

ডানদিকে গোয়ালে আলো জ্বলছে দেখে আমি এগিয়ে গেলাম, রাজনদাদা আর চিত্রাদিদি চুপচাপ কাজ করে চলেছেন। গরুর খাবার আর জল দিচ্ছেন রাজনদাদা। ভিজে খড়ে আগুন দিয়ে ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করছে চিত্রাদিদি। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কে জানে ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে জল এলো, নাকি এ বেদনার কান্না! স্বামীস্ত্রী কাজ করছেন একসঙ্গে, কিন্তু আশ্চর্য এক নৈঃশব্দ সেখানে বিরাজ করছে। দুজনের কেউই কি অপরজনের অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন না?  কিছু আগে বলা চিত্রদিদির কথাগুলো যেন আমার কাছে অর্থময় হয়ে উঠল। খুব অভিমান জমে আছে তাঁর স্বামী ও শ্বশুরের প্রতি। আমি চুপচাপ গোয়ালের সামনে থেকে সরে এলাম।

বসার ঘরে তখন জয়া আর রেড্ডিসাহেব। জয়াকে দেখে বললাম, বাব্বা! তোর কাজ হলো?  আমার কথায় ও হাসল শুধু। রেড্ডিসাহেব আমাকে জিগ্যেস করলেন, বৈকালিক ভ্রমণ শেষ হলো?

“আপনাদের এখানে আজ কোনো উৎসব আছে? অনেক মানুষই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন দেখলাম।”

“একটা লোকাল ফেস্টিভ্যাল আছে, পাশের গ্রামে। পুজোর ব্যাপার। ছোট মেলাও বসে।” তারপরই জিভে চুকচুক আওয়াজ করে বললেন, “আমার একদম মনে ছিল না। তাহলে রাজনকে বলতাম, তোমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসত। তোমাদের একটা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকত উৎসবটা।”

আমি দুম করে বলে ফেলেছি, আন্টি আর চিত্রাদিদি তো কই গেলেন না ওখানে?  এখনও তো যাওয়া চলে। চিত্রাদিদি আর আন্টিকেও সঙ্গে নিয়ে আমরা সকলেই তো যেতে পারি, স্যর? বলতে বলতেই তাঁর স্ত্রী চা নিয়ে এলেন। ছোট ছোট দুটো কাচের বাটিতে চিড়েভাজা কেবল আমাকে ও জয়াকে দিলেন, রেড্ডিসাহেব কেবল চা নিলেন। আন্টি দেখি একদৃষ্টে তাঁর স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন আমার প্রশ্নের উত্তরে রেড্ডিসাহেব কী বলেন সেটা শুনতে তিনি খুব আগ্রহী।

রেড্ডিসাহেব বললেন, এখন তো শেষের দিক,  গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে দেখার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। এটুকু বলে তিনি চুপ করে যান। বাড়ির মহিলাদের যাবার প্রসঙ্গে কিছু বললেন না। আন্টি ইংরাজি বোঝেন কিনা জানি না। তবে স্ত্রীর দিকে তাঁরও নজর গেল, হয়তো হাবভাবে তিনি স্যরের মতামত টের পেলেন। আর আমি যে আন্টির দিকে তাকিয়ে আছি সেটা আন্টির চোখে পড়ে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। কয়েক সেকেন্ডে যে একটা ছোট্ট নাটকাভিনয় হয়ে গেল, জয়া তা টের পেল না। হয়তো বা তিনজন ব্যক্তির কাছেই পুরোটা অবোধ্য থাকল, তবু একটা অকথিত সত্যের ছায়া খানিকটা যেন খেলা করে গেল ওই কটি সেকেন্ডের ভেতর।

 
রাতে টোম্যাটো রাইস, ওটাই একমাত্র। একটিমাত্র পদ। পরিবেশন করতে এলো চিত্রাদিদি। চুপচাপ খাবার দিয়ে হাত ধুয়ে সেই একই কাপড়ে হাত মুছে মেঝেতে বসে পড়ল। এসব দেখে আমার দুপুরে খাবার সময় পর্যন্ত একটু গা-ঘিনঘিন করেছে। নাকে যেন গোবর আর গো-মূত্রের গন্ধও পেয়েছি। এরকমও মনে হয়েছিল যে, তার ময়লা কাপড় থেকে খাবারের থালায় বোধহয় ধুলো ঝরে পড়ল। এই মুহূর্তে আর আমার গা-ঘিনঘিন করছে না, বরং মেয়েটির প্রতি একটা সহানুভূতি টের পাচ্ছি। তবে কৌতুহলও আমার যাচ্ছে না। একবস্ত্রে থাকার রহস্যটা কী? কই এই বাড়ির বাইরে পাড়ার মহিলাদের তো এভাবে দেখিনি? মুখচেনা হয়ে যাওয়া মহিলারা পোশাকআাশাক সাজগোজে স্বাভাবিকভাবেই পরিপাটি। তাহলে রেড্ডিসাহেবের মতো একজন খ্যাতিমান গবেষক ও লেখক, কৃষিক্ষেত্রে যুগান্তসৃষ্টিকারী একজন সমাজসংস্কারকের বাড়ির মহিলাদের এই অবস্থা কেন?

খেতে খেতে রেড্ডিদের দুই পুরুষ ও কর্ত্রী খুব সম্ভব কাল ভোরে তাঁর নেপাল যাত্রা বিষয়ে কথাবার্তা বললেন অল্প।

জয়ার দিকে তাকিয়ে রেড্ডিসাহেব ইংরাজিতে বললেন, তোমাদের ট্রেন তো পরশু রাতে। তাই কালকের দিনটা তোমরা এখানে থেকে যাও, তোমার কিছু জানার থাকলে রাজন তোমায় হেল্প করবে।

তাঁর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তিনি উঠে গেলেন। যাবার জন্য কিছু প্রস্তুতিও আছে তাঁর। তাছাড়া ভোর সাড়ে চারটায় তাঁকে বেরোতে হবে, তাই সকাল সকাল উঠে পড়াও আছে। যদিও শুনেছি তিনি প্রতিদিনই খুব ভোরে ওঠেন, আর রাত নটায় বিছানায় যান। এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও উদয়াস্ত জমিতে কাজ করেন। তাঁর স্ত্রীও তাঁর সঙ্গে ঘরে গেলেন। তাঁর এখনও খাওয়া হয়নি অবশ্য। আমরা উঠলে তবে বাড়ির দুই মহিলা খেতে বসবেন। জয়া, আমি বলেছিলাম, আন্টি, চিত্রাদিদি আপনারাও বসুন না! একসাথেই সবাই খেয়ে নেব!

কিন্তু তিনি বললেন, না বেটা! সবার খাওয়া হলে আমরা খাব।

রাজনদাদাকে কাল ভোরে স্যরের যাওয়ার ব্যাপারে জিগ্যেস করল জয়া। উনি বললেন, বাবা যতদূর সম্ভব পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা পছন্দ করেন। কথায় কথায় গাড়িঘোড়া ভাড়া করে চড়ে বসেন না।

রেড্ডিস্যরকে যত দেখছি, তাঁর সম্বন্ধে যত শুনছি ততই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছি। তাঁর বৌমার কি তাঁকে চিনতে ভুল হচ্ছে তবে? কে জানে!

খাবার পর আমি আর জয়া গেস্টরুমের দিকে যাচ্ছি। সামনে বাগান পেরিয়ে একেবারে বাউন্ডারির গা ঘেঁষে এঁদের গেস্টহাউস। নীচে উপরে সারি সারি চার চার আটখানা রুম। এই সময় আমরা দুজন ছাড়া আর কোনো গেস্ট নেই। একতলার একটা রুমে আমরা দুটো ঢালা বিছানায় রাতে ঘুমাচ্ছি। প্রতি রুমে চারটে করে বিছানা পাতা । ঘরে সামান্য কিছু আসবাবও আছে। বাথরুম ঝকঝকে। সব মিলিয়ে আমাদের কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না।

 বাগানের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে জয়া একবার পিছন ফিরে দেখে নিয়ে বলল, আন্টি আর চিত্রাদিদি এখন নির্ঘাৎ লঙ্কা ভেজে বাসি ভাত খাবে।

আমি একটু নাক টেনে বললাম, “হুমম! লঙ্কাপোড়ার গন্ধ পাচ্ছি।” বাস্তবিকই বাতাসে ভেসে এলো পোড়া লঙ্কার গন্ধ।

জয়ার খুব কাছে গিয়ে বললাম, আচ্ছা, চিত্রদাদিদির একবস্ত্রা হয়ে থাকার কারণটা কী হতে পারে বলতো?

ও আমার পিঠে ছোট্ট একটা চাপড় মেরে বলল, আর ইউ ক্রেজি? এখনও ওর শাড়ি নিয়ে পড়ে আছিস? তারপর একটু থেমে বলে, আমাদের ঠাকুমা দিদিমারা পিরিয়ডের দিনগুলো নিয়ে কেমন আচারবিচার করতো মনে নেই? ঘরের বাইরে বেরিয়ো না, ঠাকুরঘরে ঢুকো না। চান কোরো না। দিন ক’টা পেরোলে একেবারে মাথা ক্ষার দিয়ে ধুয়ে স্নান করে তবে শুদ্ধ হও। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে মেনস্ট্রয়াল নিয়ে আজও সেই ধারণা রয়ে গেছে। বলতে বলতে আমরা বারান্দা পার হয়ে আমাদের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম।

একপ্রস্থ ফ্রেস হয়ে জামাকাপড় বদলে বিছানায় বসে ক্রিম মাখতে মাখতে জয়ার কথার রেশ ধরে বললাম, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুসারে ওই সময় মেয়েদের বেশি পরিশ্রম করা নিষেধ, ভারী জিনিস তোলা নিষেধ। এমনকি এ’সময় মেয়েদের শরীর পরিচ্ছন্ন রাখতে বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু স্নান নিষিদ্ধ। বলা হয়, শরীরে ঋতুকালে যে তাপ সৃষ্টি হয়, তা রক্ষা করা জরুরি। অন্যথায় শরীরে নানা জটিলতা তৈরি হয়ে ওই নির্দিষ্ট শারীরিক প্রক্রিয়াটি বাধাপ্রাপ্ত হয়। এরা হয়তো স্নানের নিষেধটাকে পোশাক না বদলানোর এক্সট্রিম পর্যায়ে নিয়ে ফেলেছে।

আমার কথা শুনে জয়া ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ফেলল। বলল, চিত্রাদিদির সাথে সাথে তাঁহার সত্তুরে শাশুড়িমায়েরও কি ঋতুকাল চলিতং?

খেয়াল হলো, তাই তো, তিনিও তো একবস্ত্রা! দুজনে তুমুল হাসছি। এমন সময় হঠাৎ কে যেন দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ করল। আমরা হাসি থামিয়ে গলা তুলে জিগ্যেস করলাম, কৌন?

বাইরে থেকে চিত্রাদিদির গলা। বলল, চিত্রাদিদি! পানিকা বটল লিজিয়ে।

দরজা খুলে দিলাম। স্যরি! বটল লানেকে বরেমে ভুল হো গ্যয়া।

জয়া বলল, আপনাকে কষ্ট দিলাম। শুয়ে পড়তে দেরি করিয়ে দিলাম, না?

 “নেহি নেহি! কোই দের নেহি হুয়া।”

 “আপ অন্দর আইয়ে না?”  

যদিও এখন বসার মতো সময়কাল নয়, তবু চিত্রাদিদি যেন এই আহ্বানটুকুর অপেক্ষায় ছিল। তবে কি কিছু বলতে চায়? একটা বিছানায় বসল পা গুটিয়ে।

আচমকা আমরা তিনজনেই চুপ মেরে গেছি। মাথা নীচু করে বসে থাকা থেকে হঠাৎই মাথা তুলে আমার দিকে তাকাল সে। বলল, “এ বাড়িতে কাজ করার জন্য আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে বিয়ের নামে। আমার স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে রাজি হয়নি। কিন্তু ওই ডরপোক লোকটির তার পিতাজীর উপর কথা বলার সাহস নেই।”

   – তুমি তাহলে রাজনদাদার দ্বিতীয় বৌ?

“যাকে আমার ছেলে বলে মনে করছ, তার দু’বছর বয়সে তার মা তাকে রেখে ফ্যানে শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়েছিল। সে গাধার খাটনি খাটতে রাজি হয়নি। নিত্য অশান্তি হতো, সহ্য করতে পারেনি। দ্বিতীয়বার আমার স্বামী বিয়ে করতে চায়নি, তবে তার বাবার ইচ্ছার উপর কথা বলার সাহস সে ডরপোক লোকের নেই। আমার মতো গরীব ঘরের, আনপড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমার শ্বশুরমশাই বিনি পয়সার ঝি, একজন কামিনকে নিয়ে এলেন।

আমরা যে কী বলব, বুঝতে পারছি না। বাইরে হিমঝরা রাত। একটা প্যাঁচা ডেকে উঠে ঘরের ভেতরের নিস্তব্ধতা যেন বাড়িয়ে তুলল। গলা ঝাড়া দিয়ে বোকার মতো বললাম, রাজনদাদা তো নিশ্চয় ভালোবাসে তোমাকে?

“তাই কি পারে বাসতে?  তার প্রথম পক্ষের বৌকে প্রেম করে বিয়ে করেছিল। সে ছিল সুন্দরী, শিক্ষিতা, বড়োঘরের মেয়ে। তাকে ভুলে কি আমার মতো মেয়েকে ভালোবাসা যায়?  মানুষ হিসাবে লোকটা খারাপ নয়। মাঝে মাঝে সে আমার শরীরের সঙ্গে মিলিত হয়, ক্ষমা চায়, তবে ভালোবাসে না।”

আমরা কসাইএর মতো জবাই করে চলেছি চিত্রাদিদিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে। আবার একটা ঘা মারলাম সম্ভবত। বললাম, তোমার শ্বশুর বা শাশুড়ি তো নিশ্চয় তোমায় ভালোবাসেন?

শ্বশুরমশাই আমার সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলেন না। প্রয়োজনে ঠারোঠোরে। শাশুড়ি মায়েরই যা কিছুটা দরদ আছে।

কিছু যদি মনে না করো, একটা কথা বলি?

ও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। আমি কুন্ঠিতভাবে বলি, তুমি শাড়ি বদলাও না কেন?

এবার ওর ঘাড় ঝুলে গেল। জয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি প্রশ্নটা করে কিছু ভুল করলাম নাকি। কিন্তু ও একদৃষ্টে নতমুখী চিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে এক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল ওর পায়ের কাছে। মুছে নিয়ে তাকাল। বলল, “পোশাকের বাহুল্য আর সাজসজ্জা তিনি একদম পছন্দ করেন না। সতীনের একটা আলমারি ছিল। তার বাপের বাড়ি থেকে নানা উপহার আসত। সে মারা যাবার পর আলমারিটাতে শ্বশুরমশাই কাগজপত্র ফাইলটাইল রাখেন। আমার আর শাশুড়ির তিন-চারখানা করে কাপড়। তা রাখার জন্য আলমারি লাগে না।”

একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, “আমি শুতে যাবার সময় এই শাড়িটা ছেড়ে রেখে এর থেকেও যেটা পুরোনো সেটা পরে নিই। ইচ্ছে করে রোজ চুল আঁচড়াই না, সপ্তাহে দুদিন স্নান করি। আমি মনে করি, বাড়ির বৌএর স্বীকৃতি যদি না থাকে, তবে তাঁর বাড়ির সম্মান রাখার দায়ও আমার নয়। তাই ঝিয়ের মতোই দিন কাটাই।”

সেকেন্ডের পর সেকেন্ড পার হয়ে যায়। আমরা চুপচাপ বসে থাকি। বাইরের রাস্তায় একটা বাইক শব্দ তুলে পার হয়ে গেল। তার আওয়াজ আমাদের কথা বলা সহজ করে দেয়। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করা, কিংবা প্রথম গলা উচ্চে তোলা সহজ নয় কোনো সময়ই। চিত্রাদিদি বলল, আমি জানি, তোমাদের আমাকে দেখে খুব খারাপ লাগে।

ও যাবার সময় দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে গেল, কাল স্নান করে তিন নম্বর শাড়িটা পরে তোমাদের জন্য একটা স্পেশাল রান্না করব।

জয়া যথেষ্ট ক্লান্ত ছিল। একটু পরই ও ঘুমিয়ে পড়ল। আমি আস্তে দরজা খুলে বাইরে এলাম। একটা শিরশিরে ঠান্ডা ভাব বাতাসে। যদিও ব্যাঙ্গালোর ও তার আশেপাশে বারোমাসই ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকে, তবে ঋতু অনুযায়ী এবার ঠান্ডা পড়ার সময়। আকাশে তাকিয়ে গ্রহ নক্ষত্র চিনতে চেষ্টা করি আমি। শুক্র গ্রহকে খুঁজে পেলাম। আমার মনে হলো, গ্রহই বলি বা শুকতারা, তার সঙ্গে বোধহয় চিত্রাদিদির তুলনা চলে না। কারণ ওই গ্রহ মহাজাগতিক নিয়মের নিগড়ে বাঁধা, তার বাইরে যাবার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু চিত্রা রেড্ডি যত দুর্বলই হোক, তার মতো করে সে প্রতিবাদ রাখতে পেরেছে। কে জানে, সাংসারিক নিয়মের নিগড়টা হয়তো একদিন সে ভেঙে ফেলতেও সক্ষম হবে!

 পরের দিন আমাদের আর থাকার ইচ্ছে ছিল না। ‘সাংসারিক স্বৈরতান্ত্রিক’ – এই নাম দিয়েছি রেড্ডিস্যরের। তাঁর মতো আদর্শবান মানুষের এই স্বৈরতান্ত্রিকতা মেনে নিতে পারছি না। ভালোই হয়েছে, সকালে উঠে ওনার মুখোমুখি হতে হলো না, খুব খারাপ লাগত তাহলে। কিছু বলতেও পারতাম না, সেক্ষেত্রে আমাদেরই বোধহয় তাঁর মুখ না দেখে চলে যেতে হতো কাউকে কিছু না বলে।

আন্টি আর রাজনদাদা বললেন, যদি একেবারেই না থাকতে চাই তবে অন্তত যেন দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে যাই। চিত্রাদিদি একমাত্র বুঝতে পারল আমাদের থাকতে না চাওয়ার কারণ। ও বলল, থেকে যাও। আমি গোয়ালের কাজ সেরে তোমাদের জন্য রান্না করব, খেয়ে না গেলে কষ্ট পাব। ওর কথা ভেবেই সকালে যাওয়াটা স্থগিত হলো।

জয়া বলল, দুপুর পর্যন্ত যখন থাকতেই হচ্ছে, তবে রাজনদাদার সঙ্গে কাজটা করে আসি।

আমি রাজহাঁসগুলোর ভেসে চলার ছবি তুলব বলে পুকুরের দিকে যচ্ছিলাম। সত্যি, ওরা জলেই থাকে, তবু পালকে জল লেগে থাকে না। আন্টি আর চিত্রাদিদিও কি রাজহাঁসগুলোর পর্যায়ে পড়ে?

কোত্থেকে চিত্রাদিদির ছেলে অভিজ্ঞান ছুটে এলো। তার হাতে লাটাইএর সুতোর সঙ্গে জোড়া একটা ঘুড়ি। সেটা নীচু দিয়ে উড়ছে অল্প ছাড়া সুতোর ডগায়। ওর মা কোমড়ের ঝুড়িতে গোবর নিয়ে বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে অভিজ্ঞান কী যেন বলল। সে হেসে ঝুড়িটা নামিয়ে গোবরমাখা হাতদুটো দেখাল। ছেলে হয়তো ঘুড়িটা ওড়াতে বলছে। তখন ওর মা লাটাইটা দুহাতের আঙুলে আলগা করে ধরে ঘুড়ি ওড়াতে চেষ্টা করল, তবে উড়ল না। লাটাই ছেলের হাতে ফেরত দিয়ে তার গালে আলগোছে চুমু খেয়ে কিছু বলতে সে খুশি হয়ে ছুটে চলে গেল।

আমি জিগ্যেস করলাম, কিগো, মায়েপোয়ে কী কথা হলো?

চিত্রাদিদি বলল, “ছেলে বলছে, দাদা ঘুড়ি ওড়াতে পারে না, পাপাও পারে না। তবে সে ঘুড়ি ওড়াতে শিখে গেছে, আর মাকেও সে শিখিয়ে দেবে। আমি বললাম, ঘুড়িকে আকাশ দিও, বাবা! দিনের শেষে না হয় আবার লাটাইএ গুটিয়ে রেখো, তাতে ঘুড়ি নিরাপদে থাকবে। তবে তার ওড়ার আকাশ যেন কখনও কেড়ে নিও না। নাহলে যে ঘুড়িটা বাঁচতেই ভুলে যাবে!”

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...