ক্ষতচাঁদ
সৌমী আচার্য্য


আমার ভারী আক্ষেপ ছিল কখনো আমার জীবনে আশ্চর্য কিছুই ঘটেনি। আর চার পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো নামতা জীবন আমার। আম্মুকে খুব রাগ করে বলেছিলাম, আমার যদি নিকা হয় তো অচিনপুরের পীরের লগে নিকা পড়িও। আম্মু চমকে উঠে হাতপাখার হাতল দিয়ে জোরে পিঠের উপর দু ঘা বসিয়েছিল, পির! পয়গম্বর! ফকির দীন দয়াল হ্যারা শাদি করে? যত বেমতলব কতা।যাও কিতাব নিয়া বসোগা। ভারী আজিব মানুষ আম্মু। আব্বু লুঙ্গির খুঁট আলগা করে কষে বাঁধতো যখন, তখন এদিক ওদিক নজর রাখত। এ দৃশ্য যেন কেও না দেখে। এ যেন তার লুকোনো সোনার নাকছাবির মতো জরুরি সম্পদ। আব্বুর তেজ দেখানো অশ্রদ্ধার কথা গুলোতেও কি চমৎকার হাসনুহানার হাসি হাসত, ব্যাটা লোকের কতা অত ধরা লাগেনা। মাইয়া লোকের কাজ হইলো সইজ্য করা। 

অথচ আমি দেখেছি বাড়ির জমি লাগোয়া বুড়ো অশ্বত্থ গাছটার কাছে গিয়ে আম্মু খুব কাঁদত। সেই রাতটা আমার কাছে আজও স্পষ্ট। কি এক কথায় প্রথমবার আম্মু আব্বুকে দৃঢ় ভাবে ‘না’ বলল আমি তখন ইতিহাস পড়ছি, নারীশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান। কানের কাছে আচমকা যেন বাজ পড়ল। কান মাথা ঝনঝন করে উঠল, চোখের সামনে সব অক্ষর অন্ধকারে ডুবে গেল। সে রাতে আকাশ ভরা চাঁদের আলো। আমি বুঝলাম আব্বু আমার কানের জমিতে থাপ্পড় মেরেছে যদিও আমি কিন্তু মন দিয়ে পড়ছিলাম। রাত কত কে জানে? খিদের চিনচিনে ব্যথায় উঠে এলাম দাওয়ায়। আম্মু বুড়োগাছের কাছে বিনবিনিয়ে কাঁদছে। চাঁদের আলো আলতো সরের মতো পড়ে রয়েছে মাঠে, রাস্তায় আর আম্মুর গায়ে।

-এই জ্বালা আর কি কমবো না কখনো? কি গুনাহ আমার? মাইয়াডারে লেহাপড়ি শ্যাখানোর ইচ্ছাটুকুও মানতে চায়না। এ কেমন জনম আমার?

বুঝতে পারি সমস্যা আমার পড়াশোনা নিয়ে। কি করে জানিনা আমার নিরক্ষর আম্মুর মনে হয়েছিল শিক্ষা আমাকে ওড়ার আকাশ দেবে। একটা অন্যতর জীবনের আস্বাদ দেবে। এক আশ্চর্য জগতের সন্ধান আমরা দুজনেই করতাম যদিও জানতাম না সেটা ঠিক কি? আব্বা আম্মুর এই জেদ মেনে নিতে পারছিল না। গুমর ভাঙার চেষ্টায় আমার পঞ্চাশ বছরের আব্বা নতুন নিকাহ করে ঘরে তুলল আমার থেকে বয়েসে অল্প বড় আফরিন আম্মিকে। তার সাথে এখন দুপুরে পাকা তেঁতুলের ছড়ের আগায় মরিচ লাগিয়ে চেটে খাই। ওর হাত ধরে আদার বাদার ঘুরি। আমায় বুকে জড়িয়ে সে আনন্দে হেসে ওঠে। আম্মু এখন আর ডালের বড়া ভাজে না, বটি রান্না করে না, সুর করে বিষাদ সিন্ধু পড়ে না। কেবল মুখ বুজে কাজ করে আর বুড়ো গাছের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে। রাতে আব্বা যখন আফরিন আম্মিকে নিয়ে ঘরে দোর দেয় আম্মু ছুট্টে এসে দরজায় দুটো কিল মারে। তারপর বুক চিরতে চিরতে বুড়ো গাছের গুঁড়ি ঘেঁষে বসে পরে। আমার আম্মুর সব গন্ধ আমার মধ্যে এসে জমা হচ্ছে। সব কিছু সহ্য করার অসীম গুণ পেয়েছি আমি। আব্বুর মুখ ঝামটা, রাতে পড়তে বসলে লাইট বন্ধ করে দেওয়া, খাওয়ার পাত থেকে মাছের বাটি টান দিয়ে ফেলে দেওয়া এইসব ঘটনা ভীষণ জোলো লাগত আমার। সব চেনা একঘেঁয়ে।তবে এইসবের মধ্যে আমার মাধ্যমিক পাশ করে যাওয়াটা সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা হয়ে গেল। আফরিন আম্মি আর আমার বন্ধুত্বটাও বিস্ময়ে ফেলে দিল আব্বাকে। নতুন নিকাহ করে এই মানুষটা মানে সইফুল মণ্ডল সবথেকে বিপদে পড়েছে। বড়বিবি আর নতুন বিবি দুজনেই ডানা মেলে আমাকে আগলে রাখে। আফরিন আম্মিকে নিয়ে আম্মুর আর কোনো শোক তাপ নেই। আমার আর আম্মির ঘনিষ্ঠতা আরামের ছায়া ফেলে তার মুখে। বারান্দার শেষে একটা চৌকিতে একা ঘুমায় আম্মু। রাত জেগে পড়া করি তাই মাঝেমধ্যে চাপা গড়গড় শুনতে পাই আব্বার।
-আর কত? মাইয়াডারে এবার নিকাহ না পড়ালি চলবো! কি হব এত লেহাপড়ি শিখাই?
-মানুষ হব আমাগো মত কাদায় মুখ গুঁজি বাঁচবো না।
-মাইয়া ছাওয়ালের বেশি ত্যাজ ভালো না। এরপর ঘেঁটি ধইর‍্যা বাড়ি থিকা বাইর করা লাগবো তুমারে।
-তাইলে বাঁইচা যাই। যান আপনার কচি বিবি বিছানায় একা। যান ঘরে যান।

আফরিন আম্মি আমার চুল বেঁধে দেয়, কাজল পরিয়ে দেয়, স্কুলের ব্যাগে পাঁচ দশ টাকা দিয়ে দেয়। আর বারবার বলে দেয়, এই বয়সডা বড় বেয়াকুব নাজনিন। তুমারে অকারণ সুখের ধ্বন্দে ফ্যালবো।তুমি য্যান ওরে তুমার উপুর চাইপ্যা বসতে দিবা না। লাঠি নিয়া খাড়ায় থাকবা। আমি এই কথায় বড় ভয় পেতাম। মাথা গোঁজ করার বদলে বড় বড় চোখে আস্পর্ধা খুঁজে বেড়াতাম। বয়সটাকে আমার নীচে ফেলে তার উপর সওয়ার হয়ে রাওতাড়ি গ্রামের পাকা সড়ক পেরিয়ে আরও দূরে ছুটে যাওয়াই আমার সাধ। বাড়ি ফিরে আফরিন আম্মিকে সব ঘটনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলি। আব্বার মেজাজ দিনদিন হিটলারের মাছি গোঁফের মতো নৃশংস হয়ে উঠছে। আফরিন আম্মির সুন্দর পানপাতার মতো মুখে বিষাদ যেন স্হায়ী ঠিকানা নিয়েছে। মাঝেমাঝে এমন কথা বলে আমি ঠিক বুঝি না।
-রাইত বাড়লে আসমান থিকা বটের ঝুরি ধইর‍্যা চুপিচুপি যারা নাইম্যা আসে তাগো সারা গায়ে জোনাকের আলো। তাদের থিকা স্বপন মাঙতে হয় নাজনিন।
-আম্মি, তুমি বাচ্ছা বিয়াও না ক্যান? আব্বু তুমারে মারে আমি শুনতি পাই।
-ছিঃ,পড়ার কালে ওসবে কান যায় তুমার? সব কিছু শুনতে নাই। তুমি বোঝো না তুমার আম্মু এত কাঁন্দে ক্যান? পাঁক থিকা বাইরাও, বাইরাও।

দোহার আলি সাইকেল করে গুড় বিক্রি করতে আসে। ওর চোখ ভীষণ গভীর। ফর্সা পাজামা, ফুলহাতা রঙিন পাঞ্জাবি আর তার উপর হাতকাটা সোয়েটার। গামছাটা সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে প্যাঁচানো। দোহার আমাদের উঠোনে এসে ডাকলে আফরিন আম্মির মুখে আলো আসে।
-কি মিঞা, এদিকের পথে বুঝি কাঁটার ঝোপ আছে? আসেন না বড়?
-কি যে কন? সাইকেলের চাকা কতবার আমায় ধমকায় জানেন?
-ক্যান ধমকায় ক্যান?
-বাহ্,তার আমি কি জানি। তবে হের ঘ্যানঘ্যানের চোটে উল্টা রাস্তা ধরি।
-কি কয় সে?
দোহার আলী গানের সুরে বলে, তার চক্ষু তুমায় টানে দোহার/ ঐ পথ মাড়ায়ো না আর/হারায় যাবা গোলক ধাঁধায়/ বেতাল পিরীতি বসত করবো মাতায়/ ওরে দোহার মাথার কিরা/ সাইকেল তোর এবার ফিরা।

আমি জীবনে প্রথমবার আশ্চর্য হলাম। হতেই থাকলাম। প্রতি রবিবার করে তার আসাটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়াল। আমি অঙ্কের জটিল হিসেব সেরে সাইকেলে বাড়ি ফিরি। সনাতন বৈরাগী স‍্যার আমায় বড় স্নেহ করেন। সবার সামনে আমার খাতাটা তুলে ধরে বলেন, একে বলে নিষ্ঠা, দেখ হাতের লেখা দেখ। আর কোথাও এতটুকু ভুল নেই এ যেন ছবি। এক কাজ কর তোরা রোজ এক ঘটি জল এনে ওর পা ধুয়ে সেই জল খাস। তবে যদি মা সরস্বতী একটু কৃপা করে। সমরজিৎ ঠোঁটকাটা ছেলে চট করে বলে, মুসলাদের মা সরস্বতী বেশি কৃপা দৃষ্টি দিচ্ছে এটা কিন্তু ঠিক না স‍্যার। ওরা সব ভগবান নিয়ে বাজে বাজে কথা বলে। আমার ঘাড় গুঁজে আসে। সনাতন স‍্যার রাগে থরথর করে কেঁপে উঠে দুঘা বসায় সমরের পিঠে। ওর কুঁকড়ে যাওয়া মুখ দেখে আৎকে উঠি আমি, মারবেন না স‍্যার,আমি সহ‍্য করতে পারি না। এসবেও আমি তেমন আশ্চর্য হতে পারিনা। এ তো চিরকেলে টানাটানি। কখনও এদিক রক্তাক্ত করে কখনও ওদিক। তবে দোহার আমায় আশ্চর্য করে তুলল। ওর গুড়ের চেয়ে মিষ্টি ওর সুর। উচ্চমাধ‍্যমিকের জন‍্য সময়ের হিসেব করতে বসি আর গুড় ভরা সাইকেল নিয়ে সেও আসে। দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে। ওর আর আফরিন আম্মির কথার জাল, সুরের মায়া দু চোখ ভরে মাখতে থাকি। একেকদিন আম্মু এসে দাঁড়ায়। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চলে যায় গোয়ালের দিকে।
-এসব দ‍্যাখলি যদি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওন যায়,তাহলি দ‍্যাখো আমার কুনো কতা নাই তাইলে।

বুঝতে পারি আমায় ফিরতে হবে। দোহার কথায় কথায় গান বাঁধে সুর টানে। আমার বুকের মাঝে অসুখ দানা বাঁধে। স্কুলে বন্ধু বান্ধবরা প্রেমের গল্প করে আমি চোখ বড় বড় করে শুনি। মনে মনে ভাবি আমার জন‍্যেও তবে কেও আছে? মিতশ্রী আমার পাশে বসে, মুখ নীচু করে বলেছিল, তুই তো রাতদিন বইতে মুখ গুঁজে আছিস। তাকালে দেখতি কত মুগ্ধ চোখ তোর দিকে।
-কিন্তু আমার তো কিছুই নেই মুগ্ধ হবার মতো সব তো সাধারণ।
-কি যে বলিস নাজনিন। তোর হাইট মিহিরের সমান, স্লিম, ভাসা চোখ আর কি চাস বাপু!
-কিচ্ছু চাই না।
বোঝাতে পারিনা যেসবের কথা ওরা বলছে তার জন‍্য আমি দায়ি নই। দায়ি জিন। যদি আমার নিজস্ব কিছু থাকতো তবে শান্তি পেতাম। আম্মু বলে, এইডাই তো তুমারে বুঝাই। লেহাপড়ি করলে পারবা, নিজের কিচু করতি। আর শোনো আম্মি তো কইছে তুমারে, বয়েসডারে মাথায় চড়তে দিও না। আমি ঘাড় নাড়ি। তাছাড়া যাদের কথা মিতশ্রী বলে, তাদের চোখে মুখে কিছু খুঁজে পাই না আমি। মরা পোনা মাছের মতো আকর্ষণহীন, ভাষাহীন চোখ।

আম্মু আজকাল নিজের মনে বিড়বিড় করে। আমি স্পষ্ট শুনি আম্মু বলে, আমার জীবনে কুনো দোহার আসে নাই, আসলি বাঁইচ‍্যা যাতাম। দোহারের সুরে জল নামে মরা খাতে। দোহার তবে আম্মুকে ছুঁয়ে দিয়েছে! আমি আশ্চর্য হতে থাকি। 

এক রবিবার অঙ্ক করে ফেরার পথে দুধপুকুরের কাছে নীলান্ত, অপূর্ব আর রফিক আমায় দাঁড় করাল। আমি বয়সকে আমার উপর চড়তে দিইনা, তাই অকারণ ঝাঁঝিয়ে বলি, কি ব‍্যাপার! এভাবে পথ আটকানোর কি কারণ?
-বাপরে বাপ সব সময় এমন মা মনসা হয়ে থাকিস কেনো? থুড়ি রেগে যাস কেনো?
-আসল কথা বল নীলান্ত। আমার নষ্ট করার সময় নেই।
-আচ্ছা বাবা বলছি। পরশু আমার জন্মদিন। পড়ার ব‍্যাচের সবাইকে নেমন্তন্ন করেছি, তুই তো পড়া শেষ হতেই ধাঁ, তাই রাস্তায় বলতে হল।
-ধন‍্যবাদ ভাই আমায় বললি কিন্তু আমি যাবো না।
অপূর্ব সবে বলেছে, কেনো কি আছে গেলে? সবাই তো যাবে। আর ঠিক তখন আবার আমার কানের কাছে টায়ার ফাটল, অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলাম আমি। বুদ্বুদের মতো ছোট হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। ঘোলাটে আবছায়া সরিয়ে দুটো চোখ আমায় টেনে তোলার চেষ্টা করছিল ভীষণ ভাবে। আম্মুর বিষাদ সিন্ধুর সুর শুনতে পাচ্ছি। আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি আম্মু।
-আরে ছিঃ ছিঃ এইভাবে মাইয়ার গায়ে কেউ হাত তোলে মিঞা! আপনের বোধবুদ্দি নাই নাকি। যান বাড়িত যান। ঐ মণিরুল তোর আব্বারে ভ‍্যানডা আনতি ক। মাইয়াডারে এই কসাইয়ের হাতে ছাড়ন যাইবো না। ওঠো গো দিদিমুনি ওঠো।
এই গলা আমার চেনা। এতো দোহার! গুড় বেচা ফকির তবে দরবেশ। আমায় টেনে তুলেছে অতল থেকে। ভ‍্যানে আমি আর আমার সাইকেল চড়ে বসলাম। এবড়ো খেবড়ো পথের দুলুনি পেটের ভেতর থেকে সব তুলে আনার চেষ্টা করতে লাগল ক্রমাগত। খেজুর গাছের সারির মধ‍্যে দিয়ে গুড়ের হাড়ি নিয়ে চলেছে দোহার মাঝেমাঝে আমায় দেখছে অচিন চোখে।
দুয়ার তুমার আগল দেওয়া/ কেমনে হইবো আসা যাওয়া রে/ চোকের পানি লবণ করো /হায়রে চোকের পানি লবণ করো/ আমার গুড়ের হাঁড়ি তায় ভরো রে।
এ গান কার জন‍্য দোহার? আমি আশ্চর্য হতে থাকি। এই গান আমায় টেনে নিচ্ছে এক সুপুরুষ আবর্তে। দুলতে দুলতে আকাশের ভিতর পথ খুঁজছি আমি।

ভেবেছিলাম আজ বুঝি আম্মু, আম্মির কপালেও যন্ত্রণা আছে। কিন্তু না বাড়িতে এসে দোহার গলা খাদে নামিয়ে বলল, মিঞা, মাইয়া লোগের গায়ে হাত তোলায় বাহাদুরি নাই। আপনে জিগাইতে পারতেন পোলাগুলার লগে কি কতা ছিল মাইয়ার। না শুইন‍্যা ঐ ভাবে মারার কুনো কারণ নাই। আপনের মাইয়া লেহাপড়িতে এত ভালো। শুনি তো মাস্টাররা পজন্ত চমকায়ে যায়। হেরে যত্ন করেন। তাছাড়া বড় হইসে বাজারের সম্মুকে মারে কেউ? আমার আব্বু কথাগুলো সব হজম করলেও সেদিনই রাতের গভীরে আমার ঘরে ঢুকে এল। আমি হ‍্যারিকেনের আলোয় রসায়ন খুঁজছিলাম। ঘচঘচ করে কাঁচি দিয়ে আমার চুল গুলো গোড়া পেড়ে কেটে দিলো। আমার চিৎকারে কান্নায় আম্মু আর আফরিন আম্মি ছুটে এসে বেধড়ক মার খেলো আব্বার কাছে।
-জুতাইয়া মুখ ভাঙুম এই মাইয়া যদি হিজাব ছাড়া বাইরায় আর হ‍্যারে লেহাপড়ি করনোর যদি অত শখ তয় আফরিন যাতে পোয়াতি হয় সেই ব‍্যবস্থা করো নাজনিনের পেয়ারের আম্মু।ব‍্যাটাগো লগে একদিনো যদি কতা বলতে দেহি সেইদিন হের শ‍্যাষ দিন।

সেদিন রাতে ঘুম ভেঙে ঝিঁঝিঁ ডাকা রাতের ভেতর বুড়ো গাছের কাছে দেখি দুই নারী। গোঙায়, বিনবিন করে কাঁদে। যেন প্রেত। কাছে যাই কি এক অজানা টানে।
-আফরিন দোহারের লগে পলায় যা। হের শরীর চিকন, মনে ভাব। ভালো রাখবো তরে।
-জানি তুমার বুকে আগুন জ্বলে। সোয়ামিরে ভাগ করতি টুকরা টুকরা হয়া যাও তা সে যতই ইবলিশের বাচ্চা হোক। কিন্তু তুমার কি চোক নাই! দোহারের লগে ঢলানি করি ক‍্যান হেইডা বোঝো না! আর আমি পলালে মাইয়াডারে বাঁচাতি পারবা একা!
কাঁদতে কাঁদতে আফরিন আম্মি হাসে। রহস‍্য আমাদের মতো সাধারণের জীবনে থাকে কি করে? আমাদের তো সব খোলা। তবু যেন তিরতির করে জল বয়ে যায় আমার ভেতর। গা কাঁপিয়ে হু হু বাতাস ছুটে আসে। আজ আকাশ থেকে কারা যেন নেমে আসছে। তাদের গায়ে আমি জোনাকির আলপনা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। আফরিন আম্মি আমার চেয়ে মাত্র নয় বছরের বড় আর সইফুল মণ্ডলের চেয়ে প্রায় আঠারো বছরের ছোট। সে এমন কিছু দেখতে ও বুঝতে পারতো যা বোধহয় আর পাঁচটা মানুষ হিসেব পেতনা। তার মানে আরো একটা আশ্চর্য ঘটনা আমার সামনে রোজ ঘুরে ফিরে বেড়াত কেবল আমিই বুঝতাম না! দোহার! 

ঘরে ফিরে আসি। আয়নায় নিজের ছেঁড়াফাটা মাথা দেখে কেন যে বিশেষ কোন অনুভূতি হয় না জানি না। বরং নিজেকে হেলেন কেলার মনে হয়। পরদিন সকালে কাঁচি নিয়ে মোটামুটি ছিরিছাঁদ করে নিই। বাইরে পা রাখতেই আব্বু চিল চিৎকার জুড়ে দিল। কাল রাতে আমি বুঝেছি আসলে আমি সবার দয়ার পাত্রী কিন্তু মানুষ হিসাবে আমার নিজের তো নিজের প্রতি কিছু দায় আছে। সেটাকে অস্বীকার করি কি ভাবে? আমি শান্ত হয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম।
-আব্বু, আমি মাইয়া বলেই কি আপনের এত রাগ? ক‍্যান আব্বু!ভাইব‍্যা দেহেন আপনেরে কুনোদিন অসম্মান করি নাই। আপনের ঘরের আর চাইর পাঁচটা আসবাবের মতোই নির্জীব, নির্বাক আমি। কিসে আপনের এতো রাগ?একডা কতা কই, ত‍্যাজটা ইবার থিকে অন‍্যত্র দেখাইবেন। আইন কানুন আমি কিচু জানি।যদিও সেসব মুখে কই না। পড়াশুনা ছাড়া আর কিচু চাই নাই আপনার কাছে। মাছ, মাংস, ডিম আমার পাত থিকা টান মাইরা ফালায় দেন। তাতে কিচু হয় না। ইচ্ছা শক্তির কাছে আপনের পাশবিক বৃত্তিডা বড্ড ঠুনকো।আমারে ছাইরা দ‍্যান।
আমার মনে হচ্ছিল এই বুঝি চড় নামে গালে। এই বুঝি থান ইঁট এসে পড়ে মাথায় কিন্তু আমি দেখলাম আমি ভয় পেতে পেতে অনেক পথ এগিয়ে এসেছি। ইঁটের টুকরো পায়ে ঢুকলে আমি জুতো থেকে কোনদিন বের করিনা। ঐ ব‍্যথা সহ‍্য করে অবিকল হাঁটা যায় নাকি সেই চেষ্টাতেই আমার আকর্ষণ। মেদের মাঠের শেষে বৈকুন্ঠবিলের জলে নিজেকে ভাসিয়ে দেব বলে এসে দাঁড়াই। চাইলেই সব পারা যায় না। পথ পেলেই যেমন হাঁটা যায় না। তাই কেন যেন নিজেকে ভাসানো হয় না কিছুতেই। আমার ছায়া তিরতির করে কাঁদে। আমি বুঝতে পারি আমার ভেতর যে মরা খাতটা শুয়ে রয়েছে সেখানে কোদাল চালানোর লোক এখনো আসেনি। রবিবার করে আমি আর দোহারের অপেক্ষা করি না। গুড়ের মিষ্টি তলানিতে ঠেকেছে তাই তার আনাগোনাও কমেছে। বিলের পাশে বসে পড়ি। ভেতরে একটা সুর বেজে ওঠে।
নাকছাবিডা হারায় গেলি কান্দো রাত্রিভোর/ মনের মানুষ হারায় গেলি কি হইবো গো তোর?
কে জানে মনের মানুষ কেমন তর আশ্চর্য জিনিস? আমি শুধু জানি আমায় পাঁক থেকে উঠতে হবে, যে করেই হোক। ছায়া পিছনে ফেলে বাড়ির পথ ধরি। পথ আমার সামনে এনে দাঁড় করায় দোহারকে।
-পলায় পলায় থাকো ক‍্যান দিদিমুনি! আমারে ভয় পাও?
-কে তুমি যে তোমাকে ভয় পাবো? নাজনিন মণ্ডল আল্লা ছাড়া কাওকে ভয় পায় না।
-সইফুলকেও না।
-হিসাব করুন, ভয় পেলে পড়লাম কি করে এত কাল?
-তা যাইগ‍্যা চোক বন্ধ দিয়া কি গান হচ্ছিলো?
ধরা পড়া পাখির মতো ছটফট করে উঠি। যে গানটা গাইছিলাম সেটা দোহারের বাঁধা কিন্তু অত দূর থেকে ওর বোঝার কথা নয়। তবু মিথ‍্যে বলতে আমার জীব আড়ষ্ঠ হয়ে আসে।
-হ‍্যাঁ একটা গান আওড়াচ্ছিলাম।
-কি গান?
-একটু ব‍্যক্তিগত।
হা হা করে হেসে উঠলো দোহার। মাথার উপর হাত তুলে সাইকেলের বেলে টুসকি দিয়ে বলল, গান তয় ব‍্যকতিগত হয়! আইচ্ছা, ভালো ভালো। একটা কথা কন দিদিমুনি, আপনের আব্বু যে চুল গুলান কাইট‍্যা দিল রাগ হইসিলো, আপনার?
-না হয় নি রাগ। এত তুচ্ছ কারণে আমার রাগ হয় না।
-সেকি চুল না থাকলি মাইয়া লোগের মুখের পানে তাকান যায়না যে।
-সেটাই স্বাভাবিক যদিও বাহ‍্যিক। যে মানুষকে আমি দেখতে চাই তাকে যে কোন রূপেই আমি দেখতে পারি। তার জন‍্য চুল থাকা না থাকার আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই আমার কাছে।
দোহারের মুখে একটা হাসি লেগে থাকে। সেই হাসির আখরোট সবাই ভাঙতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। আমি যে শক্ত খোসাটা ভেঙে ফেলেছি এই সংবাদ চোখে আনিনা।  সযত্নে গোপন করি। সরোবরের জলে মাছরাঙা ঝুপ্ করে ঝাঁপায়।
তুমি গোপন রাখ সকল কথা/ ঘুম পাড়াও মনের ব‍্যথা/ দোহার ছিপ ফেলে রয় অকুল জলে/ খোদায় মনোবাঞ্ছা মিলাবে বলে

দোহার ফিরে চায় না ওর গানের ব‍্যথা কানে করে বাড়ি বয়ে আনি। সেদিন রাতে আফরিন আম্মির মাথা বেকাবু হয়ে ওঠে। আব্বুর সাথে ঘরে দোর দিতে তার তীব্র আপত্তি। আম্মুর সাথে বেশ কয়েকদিন ধরেই তার বসত। বোধহয় আমার চুলগুলো মুড়িয়ে দেবার নীরব প্রতিবাদ। তবে উপযুক্ত জমি চাষ না করে চাষী বসে থাকে কতদিন। তার ঘেমে ওঠা মুখ। মেহেন্দী ছোপানো দাড়ি সবেতেই তীব্র জোর। আজ লাঙলে ফালাফালা করে দেবে গুড়িয়ে পিষে দেবে মাটির তেজ। আফরিন আম্মি নব যৌবনের সকল তেজ দিয়ে ছুঁড়ে দিল প্রতিবাদ। উল্টে পড়লো আব্বু। আম্মু চিৎকার করে উঠল। আমি দেখলাম দলা হয়ে পড়ে আছে সইফুল মণ্ডল। একটা শরীর। হয়তো ফিমার ভেঙেছে, টিবিউলাটাও গেছে। মাথা ঠুকে রক্ত বেরোচ্ছে। আশ্চর্য লোকটার রক্ত লাল। অন‍্য কিছু হলে আমি আশ্চর্য হতাম না। জানিনা আম্মু এত কাঁদছে কেন?
-নাজনিন কাউরে ডাক মানুষডা যে মইর‍্যা যায়।
আফরিন আম্মি আঙুলে চুলের জট ছাড়াতে থাকে। চোখ দূর আকাশে। আমার ভারী ভালো লাগে। এই নারীর ভেতর কি এক জাদু আছে সবকিছুকে তুড়ি মেরে পা ছড়িয়ে হিসেবে ভুল করতে থাকে। আমার আজ মনের কথা বলতে ইচ্ছা জাগল।
-কি দরকার আম্মু! যদি মইর‍্যা যায় মইর‍্যা যাক। থাকলেই তো শুধু জনতন্না দিবো।
আম্মুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বড় বড় চোখে গলা ফাটিয়ে বলল, একদিন হের সুহাগে জীবন রাঙায় তোরে পাইসি নাজনিন। লোক ডাক। আম্মুকে দুঃখ দিতে মন চায় না। লোকজন,ভ‍্যান, হাসপাতাল, ওষুধ। দুই ভিন্ন মেরুর বিবি নিয়ে সইফুল মণ্ডল বোধহয় ভেতরে ভেতরে হেরে গিয়েছিল। একটা ধাক্কা তাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল। মরলো না,তবে মরলো। অকেজো শব্দহীন এক জড়ে পরিণত হল। আফরিন আম্মি টেনে কাজল পরে বুকের আঁচল ঈষৎ নামানো। ডাগর হয়ে ওঠা ঘোষণা করে ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা বাড়ি। বিফল আক্রোশে ঘোঁঘোঁ আওয়াজে মুখে ফেনা তোলে সইফুল আর আম্মু পরম যত্নে ভেজা নেকড়ায় মুখ মোছায়। আমি মুখ রাখি জটিল সংখ‍্যা তত্ত্বে।
পীর ফকির হইবার পারি তুমার ইশারায়/ তুমার গাওছাড়া ভাব দ‍্যাখলি আমার হোশ হারায়/ দুখখের কতা কইবার পারি নদী যদি হোও/ দোহার সব ছাড়তি পারে একবার যদি কও
দোহার আফরিন আম্মিকে গান শোনায়। আমি ঠিক তখন বাইরে আসি। দোহার গান থামিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঝড়ের মুখে থাকা বাঁশপাতার মতো কাঁপছে ওর ঠোঁট। ভেতর ঘর থেকে আব্বুর চাপা বিফল বিদ্রোহ বিছানা আছড়াচ্ছে।
-আসেন আমার সঙ্গে একটু কথা আছে।
আম্মুও বোধহয় শোনে কথাটা। চেয়ে থাকে অবাক হয়ে। আম্মি বিষাদ নিয়ে হেসে আব্বুর ঘরে ঢুকে দোর দেয়। আমি বুড়ো গাছের কাছে এসে দাঁড়াই। দোহারের গায়ে পাতলা ফতুয়া।বসন্তের মৃদু গন্ধ উঠে আসছে ওর শরীর থেকে।
-আপনি আফরিন আম্মিকে নিকাহ করতে ইচ্ছুক? দেখুন আব্বু ছাড়া আমাদের মাথার উপর কেও নেই। তবু আপনের ইচ্ছে হলে আমি নিজে কাজি সাহেবের সাথে কথা বলতে পারি। ভীষণ দয়াবান মানুষ তিনি।
বিস্ফারিত চোখে দোহার দুপা পিছিয়ে যায়, ক‍্যান এমন কতা মনে হইবার কারণডা কি?
-সেকি আপনে এই সব গভীর গান শোনান আর এর দায়িত্ব নিতে রাজি নন?
-নাজনিন। পষ্ট কতা পষ্ট ভাবে বোঝানোর মধ‍্যে কোনো রঙ নাই, বড় বিস্বাদ সে কতা।
-আরে বুঝেছি আপনের কথা। শুধু কথা ঘোরালেই পাপ কাজ সহজ হয় না। মনস্হির করুন তারপর আসবেন আমাদের বাসায়। আসুন এখন।
-তুমি আমারে তাড়াও নাজনিন।
-হ!
-কতদূর তাড়াবা?
-শোনেন দোহার মিঞা, আপনের গুড় মিষ্টি, মানসের উপকারে আসবার চান সেই মনোভাবডাও মহত কিন্তু এই প্রেমের ভাব ভাব নিয়া আমাগো বাসায় আর আসবেন না।
-নাজনিন আমার মন যে তোমারে কয় কতা গুলান, হেইডা বোঝো না।
-আপনের এই কতায় আশ্চর্য হবার পারলাম না মিঞা। এই দুষ্পর্ধা দেখাবার চেষ্টা খুব সাধারণ। মার লগে বইস্যা প্রেমের কথা কইয়া মাইয়ারে নিবেদন করেন অন্তর। আপনে আসেন। এত উচ্চ মার্গের কতা আমার জইন্য না।
-নাজনিন, কি ভাবে আশ্চর্য হবার চাও জানিনা। তবে শুইন‍্যা রাখো,আশ্চর্য হওনের ক্ষমতা লাগে। হেইডা তোমার নাই। 

দোহার আমায় আশ্চর্য এক কথা শুনিয়ে গেল। আমার আশ্চর্য হবার ক্ষমতাটাই নেই!সেই ক্ষমতা খুঁজতে খুঁজতে রাওতাড়ি গ্রাম ছেড়ে সেই কবে দিল্লী এসেছি। আগামী মাসে বোস্টন যাচ্ছি। রসায়নের উপর আমার সম্প্রতি করা গবেষণা পত্রটির উপর বক্তব্য রাখব। যে ফ্ল্যাটটায় থাকি তার একটা ঘরে আম্মু থাকে। অন্যটায় আমি। আফরিন আম্মি আব্বুর ইন্তেকালের পর আর থাকেনি। আমি দিল্লী থেকে উড়ে গিয়েছিলাম। আফরিন আম্মু বলেছিল, এইবার আমার মুক্তি নাজনিন।
-তুমি, আম্মু দুজনাই আমার সাথে চল।
-কি যে কও। দ‍্যাশ ছাইড়‍্যা যাইতে যে বিদ‍্যা লাগে আমার তা নাই। এই পথের ভিতর কত পথ আছে। সেগুলা খোঁজবার লোক তো চাই। তুমি তোমার আম্মুরে নিয়া যাও।
-তুমি কোথায় যাবে?
-জামু খনে কোতাও তো ঠাঁই হইব।

দোহার এসেছিল। ওর সাথে কুলতলার মাঠ পেরিয়ে হেঁটে ফিরেছিলাম বাড়ি। মনে মনে যাই বলি, বাইরে বলেছিলাম ভিন্ন কথা।
-কি দোহার? আমার উপর রাগ খুব।
দোহার ভারী কষ্ট পেয়েছিল। নিজের গলার গামছায় হাত দিয়ে বলেছিল, আমার প্রেম যদি হয় দীঘিরে বন্ধু তুমি আসমানের চাঁদ/ ছায়া দেখি হাসি কাঁদি এ দোহারের মরণ ফাঁদ/ যদি ভাইব‍্যা দেখি সব ছাড়ান দিমু, পুকুরডারে এইবার মজামু/ চাঁদ কাঁদে বুকের পাঁজরায় আমি তারে ক‍্যামনে ছাড়মু?

ভীষণ বলতে ইচ্ছা হয়, দোহার আমি যতবার তোমায় দেখেছি আশ্চর্য হয়েছি। তুমি কোথা থেকে এমন জীবন শেখো দোহার? কোথা থেকে? আমি কেবল সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক কষে গেলাম। পাঁকের থেকে উঠতে উঠতে আমি এত দূর চলে গেছি আর চাইলেও পদ্ম ছোঁয়ার জন‍্য হাত বাড়াতে পারিনা। চোখ তুলে দেখতে গিয়ে দেখি আবছা হয়ে যাচ্ছে একটা কায়া। আমার আকাশ জুড়ে শুধুই হিসেবের ছায়া, আশ্চর্য নদীটা শুকিয়ে বয়ে গেছে কুলতলীর মাঠ পেরিয়ে।

1 Comment

  • Soma Dutta

    Reply January 24, 2023 |

    যথারীতি সৌমীর নিজস্ব মৌলিক ভঙ্গিমাটি স্বতঃস্ফূর্ত। গল্পটিতে একটি মেয়ের জন্য তার মা এবং বিমাতার লড়াই দেখে কেতন মেহতার মির্চ মশালা সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েদের পথ মেয়েরাই দেখায় সেই কথাই অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে গল্পে।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...