কয়েকটি ব্যক্তিগত গদ্য
প্রবুদ্ধসুন্দর কর


 
১)

অস্বীকৃতি ও খণ্ডন, তারুণ্যের ধর্ম।তারুণ্যের ধর্ম স্বপ্ন। তারুণ্যের ধর্ম চিন্তা ভাবনার শাণিত ঘোষণা। অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব স্বপ্ন, অস্বীকৃতি, খণ্ডন ক্রমশ ম্লান হতে থাকে। হাস্যকর হতে থাকে। যেন জেগে ওঠে এক পুনর্বিবেচনাবোধ। একদা যে সত্যের ধারণাকে ধ্রুব বলে মনে হয়েছিল, সেই ধারণাটি যেন মিথ্যে বা পরিবর্তিত সত্যের ধারণা হয়ে তাড়া করে আসে।

একমাত্র ঈশ্বর অথবা শয়তানের হাত থেকেই পুরস্কার গ্রহণ করা চলে, কৃত্তিবাসের লেখকদের এই একদা ঘোষণা, পরবর্তী সময়ে, তাদের অনেকেরই পুরস্কার গ্রহণের মধ্য দিয়ে হাস্যকর হয়ে উঠেছিল।বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, এই একদা ঘোষিত স্বপ্ন আর বিশ্বাস যখন একদিন পুঁজিবাদী কাঠামোর চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় আত্তীকরণের পর সংসদীয় হয়ে ওঠে, তখন আপাত সত্যের ধারণা আর মিথ্যের ফারাক প্রায় থাকে না বললেই চলে।অবস্থানান্তরই আমি-র বিবর্তনকে আপাতসত্য বা মিথ্যা থেকে একের পর এক আপাত সত্যের ধারণা বা মিথ্যার দিকে ঠেলে দেয়।

গোয়েন্দা লেলিয়ে দিয়েও সুনীল চর্যাপদে এক লাইনও কবিতা খুঁজে পাননি কোথাও। তারুণ্যের এই স্পর্ধিত ঘোষণা প্রৌঢ়ত্বে বা বার্ধক্যে এসে কি সুনীলকে অনুতপ্ত করে তুলেছিল?
তুলা ধুনি ধুনি আঁসু রে আঁসু
আঁসু ধুনি ধুনি নিরবর সেঁসু।
কাব্যময় এই দুটো পঙক্তি সুনীল এড়িয়ে গেলেন কী করে? প্রজন্মের কাছে রেখে যাওয়া সুনীলের এই অভিভাবন যে একদিন মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে পুনরাবিষ্কৃত হবে কে-ই-বা জানত?

ত্রিপুরাতে আমরা যখন বাংলা কবিতার নিশিডাক শুনে বেরিয়ে এসেছি, তখন অদ্ভুত এক স্থিরচিত্র। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন অগ্রজ কবিদের আইকন। দারিদ্রকে আইডিয়ালাইজ না করলে কবিতা লেখা অসম্ভব, এইসব মনোলিনিয়র বুলি ফুলি বেশ শুনছি। প্রতিবাদ, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, কবিতায় সামাজিক সংস্কারের ফিরিস্তি টিরিস্তি শুনে আমাদেরও মনে হয়েছিল, বিপ্লব কি তাহলে মাত্র দেড় হাত দূরে? পরে যখন জেনেছি, দুধে চুমুক দিয়েই ভাতের ফেনা-র কবিতা রচিত হয়েছিল কিংবা একদা বিপ্লবী কবিকুল পরে ঈশ্বরী পাটনি হয়ে এল আই সি আই, প্রভিডেন্ট ফান্ড, শেয়ার মার্কেটে মনোযোগ দিয়েছেন, মনে হয়েছিল, দুটো অবস্থানই আপাত সত্যের ধারণা বা মিথ্যে। এক সাক্ষাৎকারে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, শুধুই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান নিয়ে কবিতা লিখলে চলবে না। এ জীবনে যা আছে ও যা নেই তা নিয়েও লিখতে হবে। অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর প্রশ্নের উত্তরে এই বীরেন্দ্রবচন সেই কবিরা কি পড়েছেন? ভ্রম ভাঙে, যখন জীবনানন্দ বুদ্ধদেব বসু-র কঙ্কাবতী আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন, কবিতায় সমাজসংস্কার করতে গেলে কবি কিংবা সংস্কারক কোনোটাই হয়ে ওঠা হয় না।

আমাদের নিজেদেরও তারুণ্যের উদ্ধত ঘোষণাগুলি থেকে এক পুনর্বিবেচনাবোধ জেগে ওঠে বই-কি। যে মায়াকোভস্কি কিংবা হপকিন্সকে মনোলিনিয়র বলে মনে হয়েছিল একদিন, আজ প্রাকবাণপ্রস্থে এসে অন্য বোধ কাজ করে। মানুষের মূর্তি-র দেবদাস আচার্য ও আজকের দেবদাস এক নন। যেমন সোনার বুদ্বুদ পেরিয়ে আরও সাংকেতিক হয়ে ওঠে জলপাই কাঠের এস্রাজ। কালের কলস আর বখতিয়ারের ঘোড়ার মাঝখানে যেমন ক্রমশ এক অবস্থানান্তর বা আমি-র বিবর্তন।

২)

A poem is never finished, only abandoned

-Paul Valery

বন্ধু মজনু শাহ-র জেব্রামাস্টার কাব্যগ্রন্থের উপক্রমণিকা পল ভালেরির এই উদ্ধৃতিখচিত। abandoned শব্দটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবি, এর প্রতিটি অর্থই কবিতার সঙ্গে বিজড়িত কিনা। Profligate, utterly deprived, deserted ইত্যাকার পরিভাষা ছাড়াও careless and free mannered, surrendered to impulses ধরে নেওয়া যেতে পারে কি? কবিতা নিজেই লম্পট কিনা এ নিয়ে কবিবন্ধু অশোক দেব, যৌবনে, ইদানীং আর বলে কিনা জানা নেই, প্রায়ই বলত, কবিতা সেই গণিকা, একেক কবির কাছে যে একেক দামে ধরা দেয়। ভাবি, কবিতা কি সত্যিই বঞ্চিত? ভাষা ভাবের ঘাতক নাকি বিধায়ক? এক মোক্ষম প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সুধীন্দ্রনাথ আমাদের হতবিহ্বল করেছিলেন বই-কি। সেই অর্থে ভাবঘ্ন ভাষাবয়ব এক বঞ্চনাকেই সূচিত করে কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কবিতা কি পরিত্যক্ত? স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে, কার দ্বারা? কেন? কিংবা কোনও এক সময় কি অবিচ্ছেদ্য ছিল? প্রতিনিয়ত প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে করে, যাবতীয় কু-ডাক, সংকেত বয়ে এনে আমাদের অস্তিত্বকে বিপদসংকুল করে ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে এড়িয়ে গেলেই যে স্থূলজাগতিক ভালো থাকা ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। আবেগের কাছে আত্মসমর্পিত, ছন্নছাড়া স্বাতন্ত্রের এই সংখ্যালঘু  রক্তবীজ অনশ্বর। Never finished। যেন তীর্থ-বিতাড়িত। যেন পাপঠাসা এক ভাঙা বেহালার ভয়াবহ স্তব্ধ কোনও রাত।

৩)

একটি কবিতা কীভাবে স্মরণযোগ্য হয়ে ওঠে? ছন্দ এর একটা কারণ। আবার অনেক ছন্দহীন কবিতাও শুধুমাত্র Uniqueness of thought content-এর কারণেও আমাদের মনে থাকে। ছন্দোবদ্ধ কিংবা ছন্দহীন কবিতা অনেক সময়ই আখ্যানধর্মিতার কারণেও স্মৃতিতে বিদ্ধ হয়ে থাকে। চিত্রকল্পের জন্যেও একটি কবিতা পাঠকের মনে গেঁথে থাকে। Memorable Speech কিংবা স্মরণযোগ্য পঙক্তিও কবিতাকে বিস্মৃত না হতে আমাদের সহায়তা করে বই-কি।

মনে পড়ে, সেই কবে ঠাকুরনগরে আমাদের স্তব্ধ করে রেখে বিনয় মজুমদার কাল্পনিক তানপুরাতে আঙুল চালিয়ে পরপর স্মৃতি থেকে বলে যাচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের একেকটি দীর্ঘ কবিতা! নির্ভুল স্মৃতি থেকে হিমাদ্রি দেবের মেঘনাদবধ কাব্য অনর্গল বলে যাওয়া! সপ্তর্ষি বিশ্বাস, অমিতাভ দেব চৌধুরী, দীপক দেব, তপোধীর ভট্টাচার্য, ত্রিদিব চক্রবর্তীদের স্মৃতি রীতিমতো মিথ।

জনৈক সুহৃদ আমাকে বলেছিলেন, এত এত কবিতার স্মৃতি, প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ তোমার কী করে মনে থাকে? উত্তরে বলেছিলাম, তুমি যে স্কুলে সায়েন্স পড়াও, এত সূত্র, নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত তুমিই বা কীভাবে মনে রাখ? বলেছিল, পেটে ভাত দেয় বলে।আমারও প্রাণের আহার্য কবিতা, এটুকুই বলেছি বন্ধুকে।

৪)

সন্তান বলতে কয়েকটি কবিতা, মৃত্যুর পর এরাই আগুন দেবে মুখে, এরকমই তো বলেছিলেন, রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী। ভুলচুক থেকে যাওয়া স্মৃতিপ্রতারিত উদ্ধৃতিটিতে অকৃতদার, নিঃসন্তান কোনো পুরুষের হাহাকার আমি খুঁজে পাই না কোথাও। বরং কবির দার্শনিক স্বজ্ঞাকেই অন্য মাত্রা দেয় এই উদ্ধৃতিটি।এক ভিন্ন নির্ণয় কবিকে তৃপ্ত ও আশ্বস্ত করে। এটাই প্রতীয়মান হয়, কবির রেতঃশরীর কবিতা, সন্তান নয়। এই রেতঃশরীরই কবিকে পরম্পরায় বাঁচিয়ে রাখে। বংশপঞ্জি নয়, Pillowed upon my fair love’s ripening breast / To feel for ever its soft fall and swell-ই কীটসকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজও। চণ্ডীদাসের বংশপরম্পরা নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহই নেই। সখি, বিষাদে বিদরে হিয়া, এই উচ্চারণই যেন কবির রেতঃশরীর, কবির সন্তান।

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...