কবিতা ও কথা-৫
গৌরাঙ্গ মণ্ডলের কবিতা নিয়ে লিখেছেন সৈকত মুখোপাধ্যয়, পল্লব গঙ্গোপাধ্যায়, রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায় এবং শুভদীপ নায়ক

কবিতা- স্বভাব পাখি
আকাশে বেড়াতে এলে,মনে হয়– তরুণীর স্তনে
যুবক রেখেছে নীল, জলহীন
রঙের সাগর
গোপনে, তোড়ণ জুড়ে ঘনীভূত প্রথমায়
দু’হাতে ছড়ানো মেঘ, বিষাদ জালিকা
আমিও পুরুষ, শুধু রাত হলে উধাও…উধাও…
কেউ অবসন্ন, তবে স্লথ হয়
হাতের ধনুক
পুনরায়, পাখি হও; উঠোনের গাছ
নিঝুম নিঝুম পায়ে
হেঁটে যাই
হেঁটে চলে যাই
তুমি বিচলিত, ভাবো–
“এ ব্যাটা শিকারী নাকি নপুংসক!
দাঁড়ায় না আমাকে দেখেও”
কথা
১
সৈকত মুখোপাধ্যায়
ভারি সুন্দর এক উপমা দিয়ে শুরু হয়েছে এই কবিতা। আকাশ এক নীল গম্বুজ তো বটেই, যাকে নীলরঙে রাঙিয়ে দেওয়া স্তন বলেও ভাবা যায়। স্তনে রঙ দিয়ে গেছে গোপন প্রেমিক।
কবির আকাশ ভ্রমণ এখানেই শেষ হয় না। এরপর তিনি দেখেন, “তোরণ জুড়ে ঘনীভূত প্রথমায় দু’হাতে ছড়ানো মেঘ, বিষাদ জালিকা”। প্রথমা এখানে কোন অর্থ বহন করছে আমি ফ্র্যাঙ্কলি বুঝতে পারছি না। তবে কবিতার অন্তর্গত সমস্ত শব্দের অর্থ যে বুঝতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। ছায়াচ্ছন্ন গুম্ফার দেয়ালে যে তন্ত্রোক্ত দেবদেবীর ছবি আঁকা থাকে কবিতা অনেকটা তাঁদের মতন। কিছু জায়গার রঙ নষ্ট হয়ে গেলেও, কিছু কোণায় আবডালে আলো না পৌঁছলেও, সমগ্রের রূপে চোখ জুড়িয়ে যায়। তাহলে প্রথমাকে বাদ দিয়ে যদি পড়ি তাহলে বাক্যটা দাঁড়াচ্ছে, “তোরণ জুড়ে ঘনীভূত দু-হাতে ছড়ানো মেঘ, বিষাদ জালিকা”। তোরণ অর্থে প্রবেশদ্বার। সেখানেই ঘনীভূত মেঘ। তাহলে কি প্রবেশে বাধা পাচ্ছে কেউ বা কিছু ? আমার তো তাই মনে হচ্ছে। স্পষ্ট করেই বলি, আমার এই উপমাটিকে নারীর যৌন শীতলতার উপমা মনে হচ্ছে। তোরণ এখানে যোনি। তোরণের দুদিকের দুই স্তম্ভ আসলে দুই যোনিওষ্ঠ যা নায়িকার বিষাদে রুদ্ধ…সঙ্কুচিত। জালিকা শব্দটির প্রয়োগ এখানে লক্ষণীয়। কে না জানে, যোনিই হোক বা শিশ্ন, তাদের উত্থান বা ব্যাদানের পিছনে রক্তজালিকারই খেলা থাকে। বিষাদ এসে সেই জালিকাকে অকেজো করে দিচ্ছে। ফলে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তোরণ বা যোনিপথ।
এই যে আমার মনে-হওয়া, তার পেছনে আসলে সম্পূর্ণ কবিতাটির প্রসঙ্গ কাজ করছে।
কেন সেটা বোঝা যাবে এর পরের স্তবকেই। এবং শেষ লাইনেও। ” আমিও পুরুষ, শুধু রাত হলে উধাও…উধাও”, “শ্লথ হয় হাতের ধনুক” এবং “এ ব্যাটা শিকারী নাকি নপুংসক”। সবকটি উচ্চারণই স্পষ্টত এক যৌন টেনশনের দিকে নির্দেশ করছে। পাখি, গাছ ইত্যাদি নিয়ে যে শিকারক্ষেত্র, অবসন্ন ব্যাধ সেই ক্ষেত্র ছেড়ে চলে যায় স্বেচ্ছায়। কারণ কি তার অবরোধের পূর্ব অভিজ্ঞতা?
এই গেল কবিতাটির আপতিক অর্থ, অর্থাৎ প্রথম পাঠে যা মনে হয়। অবশ্য কবিতার ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রথম পাঠের অর্থটাই শেষাবধি থেকে যায়, কারণ এ তো আর গুপ্তধনের সঙ্কেত নয় যে, অর্থের জন্যে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পড়ব। তবে, হ্যাঁ। পাঠকের বয়স, লিঙ্গ, মনের গঠন ও পড়াশোনার ব্যপ্তিভেদে একই কবিতার নানা৷ রকম অর্থ হতে পারে। এই কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
২
পল্লব গঙ্গোপাধ্যায়
ধূপছায়া যৌনতা পরাবাস্তব ছুঁয়ে চিত্রকল্পের গাঢ়তা এনেছে। বাস্তব পরাবাস্তবের দোলাচলে অনেক সময় শব্দরা নিরাশ্রয় হয়ে যায়। এ কবিতায় সেটা হয়নি! এরপর কবিতা এগিয়েছে ছিন্ন ইশারার নিগূঢ় কোলাজে! যৌন-ইশারা অন্তর্বর্তী দ্ব্যর্থের দিগন্ত উন্মুক্ত রেখেছে বহুমাত্রিকতার পরিসর তৈরি করে! গতির একটা অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে, যা মূল আর্তির সঙ্গে চমৎকার যায়। ধূসর ইশারার অন্তরালে দ্ব্যর্থের প্রান্তসীমা ছুঁয়ে আবছায়া হয়েছে চিত্রকল্পের শরীর! ইন্দ্রিয়সীমার অনুপুঙ্খে তাকে স্পষ্ট করা কবির উদ্দেশ্যও ছিল না। বরং ইঙ্গিতের আভাস, আর যৌন প্রতীকের রূপকীয় চলনে স্পষ্ট হয়েছে দ্যোতনার অন্তর্মুখী একটা যাত্রা! কবিতার শেষে দ্ব্যর্থের প্রশ্রয়ে নতুন ব্যঞ্জনা বাজিয়ে তোলার বাকচাতুর্য ও নাটকীয়তা একটু বেশিই প্রকট! কিন্তু ইশারা আর প্রতীকের জোরালো অভিঘাতে কবিতার মূল আর্তি তাতে লঘু হয়নি এতটুকু!
৩
রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়
পাখি স্বভাব নয়! ফুরফুরে মেজাজে শুরু হওয়া কবিতাটিতে বহিরঙ্গের আলগা আশ্লেষ কখন যে অন্দরে প্রবেশ করিয়ে নিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে বিস্ময়ের কার্ণিশে, ডানায় রেখেছে আলাপী আলস্যের মৌতাত…বুঝে ওঠা যায় না। যখন উপলব্ধি হয়, ততক্ষণে কয়েক পরত তলিয়ে যাওয়াকে রোখা যায়নি।
একেকটি আপাত নিরীহ পংক্তির অভিকর্ষে নামিয়ে আনা অনিবার্য পংক্তিবান্ধবেরা ধুন্ধুমারে কিস্তিমাত করে দিতে আগ্রাসী হয়, এই দ্বন্দ্বের চাঁদমারি হয়ে পাঠক অবতার খুলে রাখি কবিতার সানুতলে। কবিতার শিরোনামে ‘পাখি’ থাকলেও গোটা কবিতাটিতে কোথাও ‘ওড়া’ বা ‘ডানা’ বা ‘পালক’-এর মত অনুষঙ্গ নেই। তাহলে কি আছে? আছে, আশ্চর্য বিন্যাসের বাগানবাড়ি, যেখানে কবিতাটি শুরু হচ্ছে –“আকাশে বেড়াতে এলে, মনে হয়”…মনে হওয়া তো নিঃসীম হতেই পারে, হয়েওছে তাই, এর সংরাগে যে আর্তির থরোথরো কেঁপে ওঠা মূর্ত হয়, সেটুকুই কবিতার মনোভূমি।
“-তরুণীর স্তনে
যুবক রেখেছে নীল, জলহীন
রঙের সাগর”
কেয়াবাৎ! কেয়াবাৎ! মনে হল মহার্ঘ্য এক দেবযানে শুরু হল অনিন্দ্য সফর…
গন্তব্য জানা নেই…এরপর স্তবক ভাগ করে রাখা হল ‘গোপনে’ শব্দটি এবং এরপর ‘,’ দিয়ে কী আশ্চর্য এক প্রেক্ষিত রচিত হল! কেন এই গোপন? এর উত্তরে নিপুণ শৈলী ও ব্যঞ্জনায় অধীর করে তোলা হল এক অনাস্বাদিতপূর্ব প্রভাব। কবিতার অভিসার এমন দুর্দমনীয় অভিমুখেই তো ধাবিত হয়।
পরের স্তবকে এসে, যখন উচ্চারিত হল ‘আমিও পুরুষ’ – নিমগ্ন পাঠ থমকালো। কেন ‘আমিও’ রাখা হল? এ কবিতায় আগে ভাষ্য, সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা তারপর। পৌরুষত্বের একমাত্র অভিজ্ঞান যে রাত্রিই নয়, এই বোধের তীব্র অথচ স্তিমিত বহিঃপ্রকাশ ‘আমিও’! এর পর এই স্তবকের প্রত্যেকটি শব্দ, যতি, স্পেস নিজেরা নিজেদের কথা বলে। রাত হলে অবসন্নতায় পুরুষেরও হাতের ধনুক খসে পড়তে পারে, এই অকৃত্রিম বাস্তবই অনুপম আলো হয়ে ওঠে।
যখন মায়াবী ব্যাপনে প্রতিটি কণায় শব্দের রণন ভরে উঠতে থাকে, তখন উপেক্ষণীয়র ঝাঁক, দল বেঁধে দূরে চলে গেছে। ‘পুনরায়’ শব্দটি নির্দেশ করে, আগে ঘটেছিল, আবারও তা ঘটতে চলেছে। যে অলীক পাখিজন্মের রেশ অনন্তের দিকে চলে গেছে, সে অনিবার্যতাই প্রার্থিত হয়ে উঠতে চায়, আরেকটি প্রত্যাশা ঘনিয়ে ওঠে। চলন-কে ‘নিঝুম’ শব্দের দ্বিরুক্তিতে চমকে দেওয়া প্রয়োগে ঝিম ধরে যায়। কবিতার ভাষা কী অবিশ্বাস্য স্পন্দনকাব্য হয়ে উঠতে পারে, তারও নমুনা রইল এই স্তবকটিতে,
– “নিঝুম নিঝুম পায়ে
হেঁটে যাই
হেঁটে চলে যাই”
‘হেঁটে যাই’-এর পর আরও তারল্যের পুনর্বাসন যেন ‘হেঁটে চলে যাই’…মোহ, মোহমুক্তি, সব…
এর আগে একটি অদ্ভুত প্রয়োগ রয়েছে –“পুনরায়, পাখি হও; উঠোনের গাছ” – হঠাৎ এই ‘উঠোনের গাছ’ এল কেন? এর প্রসঙ্গসাযুজ্যই বা কি? এ আসলে পরিমিতি নির্দেশক চিহ্ন কিন্তু রহস্যচন্দনে প্রলিপ্ত।
শেষ স্তবকটিই এ কবিতার সর্বাপেক্ষা জোরের জায়গা। এক বিষম ঝাঁকুনি, অনভিপ্রেতের আন্দোলন, ভাষার প্রয়োগে আপাত রক্ষণশীলতা ভেঙে ফেলে কবিতা নিজেকে কি প্রমাণ করতে চাইল? না, কিছু প্রমাণ করার দায় নয়, আসলে মোক্ষম না-হওয়াই যখন নিয়তি হয়ে ওঠে, আরোপিত মোড়ক খসে পড়ে যেতে চায়…ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে, স্পর্শযোগ্য হয়ে ওঠে বিস্ময়বোধ। বিচলিত হয়ে ওঠার কারণে ঘৃতাহুতি পড়ে, ‘শিকারী’ ও ‘নপুংসক’-এর সন্ত্রস্ত বিভেদরেখা মুছে আসে। হাত থেকে ধনুক পড়ে যাওয়াতেও অবাক-না-হওয়াই অবাক হয়ে যায় অপসরণের নিখাদ ভঙ্গীতে, যেন কোন আকর্ষণ বোধ নেই, লালসা নেই, অতিরেক নেই…শিকারী ও নপুংসক না হয়েও এক অমোঘ সৌম্যের আদলে যে ধ্যানমগ্নতার নিঃসীম বালিয়াড়ি, সেখানে পড়ন্ত আলোয় এসে একা দাঁড়ানোটির নামও তো কিছু একটা, যা তোমার জানা নেই…তাই বলেই তো সে মিথ্যে হয়ে যায়না! শেষতম পংক্তিটির প্রয়োগ নিয়ে পাঠকভেদে বিভিন্ন বিতর্ক থাকতেই পারে। আমি আর একে আলোচ্য করে তুললাম না। শুধু বলি, আধুনিক কবিতার সোজাসাপটা নিঃসরণকে রক্ষণশীল মাপকাঠিতে পর্যালোচনা বা সমালোচনার দিন ফুরিয়েছে। এই সত্যকে অস্বীকার করার সাধ্য কই!
এই কবিতার কবি কে, আমি জানিনা। তাঁকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। আশ্চর্যের ভেতরে আশ্চর্যের খোঁজ দেওয়া যে সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং সাফল্যও, তার প্রতি আনুগত্য দেখানোয় কোন হীনমন্যতা নেই।
৪
শুভদীপ নায়ক
এই কবিতার শুরু হচ্ছে ‘আকাশ’ শব্দটি দিয়ে। একটি পাখি যখন আকাশে বেড়াতে আসে, কবি তাকে দেখে একটি দৃশ্যের কথা কল্পনা করছেন। যেন তরুণীর স্তনে তার যুবক প্রেমিক রেখেছে একটি রঙিন সাগর। ভাবুন, সাগরটি জলের নয়, সম্ভবত সাগরটি নীলের, জলহীন একপ্রকার ‘রঙের সাগর’। তার দু-হাতে মেঘ ছড়ানো, কেমন সেই মেঘ, সেই মেঘ আসলে ‘বিষাদ জালিকা’। পরিকল্পিত প্রণয় কি আদৌ আমাদের জীবনে সুখ এনে দেয়? আমি তো পাইনি কখনও। আমার সব প্রেমই নষ্ট করেছে আমাকে। আমাকে নিয়ে গিয়েছে পাপে, উন্মার্গগামিতায়। তারা কখনও সুখ দেবে বলে আসেনি। বরং তারা আমাকে চিরদিন ও চিরকাল দিয়েছে যন্ত্রণা, বিষাদ জালিকা, আমাকে জুগিয়েছে অন্তহীন তৃষ্ণা। কিন্তু পুরুষের কেমন আচরণ এই প্রেমের প্রতি? কেউ অবসন্ন, কেউ শ্লথ, কেউ হেঁটে চলে যাচ্ছে। প্রেম আসলে যা প্রত্যাশা করে, আমরা তা কখনও পূরণ করতে পারি না। কেননা, আমরা নিজেরাও একেকটি স্বভাব-পাখি ।
উত্তম বিশ্বাস
June 29, 2023 |কবিতাটি পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম! হ্যাঁ এইভাবেই বেড়া ভাঙতে হয়! সাহস আছে কবির।
আর আলোচনা…?
আমি সেই সেদিনের এম এ ক্লাসে হারিয়ে গেছি!!!