কবিতা ও কথা- ৪
চয়ন ভৌমিকের কবিতা নিয়ে লিখেছেন পল্লব গঙ্গোপাধ্যায়, রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায় এবং শুভদীপ নায়ক


কবিতা -অদূর

অজস্র অপমানের দাগ কাটাকুটি খেলে নির্জন প্রান্তরে।

নিষ্পত্তিহীন সময় কেটে যায়…

আমি দেখি হিংস্র পৃথিবী, হেঁটে বেড়াচ্ছে
সাপের খোলস পরে,

দেখি সন্তানের মায়াময় মুখ।

তোমাকেও দেখি ঘুমময়-  চোখের নীচে
রান্নাঘরের কালি।

আমি ফিরে আসতে থাকি সারারাত জুড়ে

বাবার লেখা উঠে আসে নীল
 ইনল্যান্ডলেটারে চড়ে।

জিজ্ঞাসা করে, “ভালো আছিস?”


কথা


পল্লব গঙ্গোপাধ্যায়

ব্যক্তিগত দিগন্ত আরক্ত হয়ে উঠেছে সময় ও সম্পর্কের জটিল বিন্যাসে। বিবৃতিধর্মী  চলনে ব্যঞ্জনার একমাত্রিক ঝোঁক এড়ানো যায়নি! আস্তিত্বিক যন্ত্রণা , বিবমিষা ও মানসিক আততি আত্মজনের নিবিড় ছায়ায় আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। কবিতায় মুহূর্ত-লগ্ন আবেগ মায়াময় স্পর্শ তুলে আনলেও প্রাতিভাসিক সীমার বাইরে বাচনিক আবেদন অন্য কোনও নিহিত ব্যঞ্জনার সন্ধান দিতে পারছে না।  কবিতায় সেটা বাধ্যতামূলকও নয়। সত্তা ও সমাজসম্পর্কের অন্তর্বর্তী ক্ষয় ও শূন্যতা থেকে খুব দ্রুতই প্রতীতির স্নিগ্ধ  আশ্রয়ে পৌঁছতে চেয়েছেন কবি। বাচনিক একরৈখিকতার সহজ স্পর্শই এ-কবিতার ইতিবাচক দিক।


রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়

শব্দের সহজে এক ঝাঁচকচকে প্রাসাদের মত এ কবিতার অটুট অবস্থান। প্রান্তিক বোধ, যা অপলক আলোকবর্তিকার মত যাপনের কিনার ঘেষে সজাগ রয়েছে, তার কোন প্রকৃত বান্ধব নেই। তবুও সে একা নয়, একাকীত্বের ধারণাকে মুছে দিয়ে সে মগ্নতা লিখেছে। আর মগ্নতার কথা এলেই অনাহুত এসে পড়ে নিবিড় স্মৃতির জলধি…ছপাট ছপ…ছপাট ছপ…ফেরীখেয়া ফিরে আসে দিনের আলো ফুরিয়ে…একান্তে দুদন্ড  বসার, কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় কথা বলার, সময়কে অনাদরে ফুরিয়ে ফেলার মধ্যেও যে  সমারূঢ় রাজকীয়তার পাপড়িগুলি খসে যায়, তার জন্য ঋতু-নির্বিশেষ মুহূর্তটির কাছে কতখানি ঋণী থেকে যেতে হয়…এসব কাউকেই বলার মত নয়।একটি মোলায়েম শব্দ নির্মিত ঘুড়ি, হাওয়া কেটে কেটে নিপাট আকাশে দেদার ছড়িয়ে চলেছে সুষমায় লিপ্ত হয়ে থাকা আনন্দরেণুগুলি…আহা! এ এক প্রাণিত উড়ান! এ এক আশ্চর্য বিস্তারে সুরেলা আলাপ! ”অজস্র অপমানের দাগ…” থেকে শুরু হয়ে “…রান্নাঘরের কালি।“ পর্যন্ত যে অমলিন ঘুড়িগাথা রচিত হয় শব্দের অমোঘ অন্তরায়, তার প্রসন্ন প্রতীতিতে অনায়াস চলনের মত স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফারে যে মেলানকলির নিহিত ব্রততী ফনফনিয়ে বেড়ে উঠেছে, বুঝতে পারা গেল, যখন “আমি ফিরে আসতে থাকি সারারাত জুড়ে” পংক্তিটি আবির্ভূত হল। অনিবার্য মাধ্যাকর্ষের মত অবিরাম নিঃশব্দ প্রপাত এসে দাঁড়ায় যাপনের কাছ ঘেঁষে। সারারাত জুড়ে ফিরে আসার কার্যকারণ সম্বন্ধটি স্থাপিত হয় মায়ালীন ইনল্যান্ড লেটারের নীলে দ্রাবিত স্নেহস্পর্শে –“ভালো আছিস?”…আহা! কী অপরূপ! কী অমিতলাবণ্য! কবিতাটি সরল, সটান, সংশ্লেষের গূঢ় তানে জারিত করে। এখানেই কবিতাটি সার্থক রূপ পরিগ্রহ করেছে। নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ মানুষ, নানা সম্পর্কের সুতোয় বাঁধা মানুষ, নানা দায়িত্ত্বের, ব্যাথার, ভরসা হারানোর অভিঘাতে পর্যুদস্ত মানুষ, কোথাও গিয়ে যেন নাবালক আশ্রয়ের সেই সুনিশ্চিত মহীরূহ ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করে ভেতরে ভেতরে আজীবন। সামান্য এক চিলতে ‘ভালো আছিস’-এর আলঙ্কারিক অভিঘাতই যে কী ভীষণ ঔজ্জ্বল্যে দীপ্ত হয়ে ওঠে, এর খোঁজ যে জানে, সে-ই জানে। একটি কবিতা যখন এমন নির্বিকার নিরালম্ব বিভূতি বিলিয়ে দেয় অনুভূতির আনাচেকানাচে, মনে হয়…কবিতার জন্য সত্যিই অমরত্বও তাচ্ছিল্য করা যায়।


শুভদীপ নায়ক

‘অদূর’ একটি ধূলিধূসর মাখা সাধারণ মানুষের কাহিনি । সে দেখতে পায় অপমানের দাগ, হিংস্র পৃথিবী । একইসঙ্গে দেখতে পায় সন্তানের মুখ, স্ত্রীয়ের কালিমাখা চোখ । সে হাতে পায় পিতার চিঠি । কুশল বিনিময় পত্র যেমন হয় । কিন্তু তার কোনো ভাষা নেই । সাধারণ মানুষের ব্যথা বেদনা জানানোর ভাষা কি আদৌ আছে সমস্ত জীবন পরিশ্রম করে বেঁচে থাকা ছাড়া ?

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loading...