কবিতা ও কথা-২
তন্ময় ভট্টাচার্যের কবিতা নিয়ে লিখেছেন, উত্তম দত্ত, সৈকত মুখোপাধ্যায়, রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়, শুভদীপ নায়ক

কবিতা- কুমারহট্ট
রামপ্রসাদের পথে সসঙ্কোচে দাঁড়ালেন শিব
বুড়ো তিনি, বৌদ্ধ উত্তরাধিকার, চড়কের গান
এখনো বাতাসে ভাসে, ভক্তের অভাবে ফিরে যায়
‘ওই শাক্ত ছেলেটির পড়েছে আমার দিকে চোখ–‘
আপ্রাণ ভাবেন তিনি, বাবা-ডাক, ও রামপ্রসাদ
আমিও সম্পর্কে তোর মায়ের প্রণয়ভিক্ষু হই
কথা
১
উত্তম দত্ত
এক একটি কবিতা হাতে নিলে হাত শীতল হয়ে যায়। অস্থির মন এক অলৌকিক প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। পড়তে পড়তে মনে হয় এই সেই লোক-প্রসিদ্ধ গহিন গাঙ, যেখানে ডুবে মরেও অতল জলের অপার্থিব সঙ্গীত শোনা যায়। ‘কুমারহট্ট’ তেমনই একটি কবিতা। আপাত সমতল এই ছয় পঙক্তির কবিতার প্রতিটি পল্বলে রয়েছে নৈরঞ্জনা নদীর অন্তঃসলিলা ইশারা। আকারে মিতভাষ এই কবিতাটি যেন পাঠকের কানে কানে প্রাণে মনে শতকণ্ঠে কথা বলছে। কবিতাটির নাম কুমারহট্ট। আমার শৈশবের স্মৃতি জাগিয়ে দেওয়া এই নাম, এই ভালোবাসার শহর। মন্বন্তর-পীড়িত বালক সেদিন বোঝেনি কুমারহট্টের ঋদ্ধিমান ঐতিহ্যের মহিমা। কিন্তু রামপ্রসাদের পবিত্র সাধনপীঠের মাটি থেকে জেগে ওঠা সুর সেদিন মুগ্ধ করেছিল তাকে :
‘কেবল আসার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হল।
যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে রল॥
মা নিম খাওয়ালে, চিনি বলে, কথায় করে ছল।
ওমা ! মিঠার লোভে, তিত মুখে সারা দিনটা গেল॥’
আজ ছাপ্পান্ন বছর পরে সেই রুদ্ধ সুরের নবমুক্তি ঘটল। যেন বহুকালের বন্ধ ঘরের কপাট খুলে কেউ হঠাৎ দেখাল ধূলিধূসর মণিমুক্তা। মাত্র ছয় পঙক্তির একটি কবিতা কেমন অবলীলায় ধারণ করে আছে ১৬০০ বছরের ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক ঐতিহ্যকে।
একাদশ শতকের কুমারহট্টই আজকের হালিশহর। গঙ্গার তরঙ্গ ছুঁয়ে এই দীর্ঘ পথচলা।
বিশাল বিশাল অট্টালিকা তথা প্রাসাদের শহর, অর্থাৎ হাভেলিশহর থেকে হালিশহর নামকরণ। সেই প্রাচীন হাভেলিশহরের ইতিহাস পাল যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা তখন তাম্রলিপ্ত থেকে সরে এসেছেন গঙ্গার ও পারে সপ্তগ্রামে। এ পারের হালিশহরে প্রায়ই আসতেন রাজা কুমার পাল। জনতার বিশ্বাস, রাজা কুমার পালের নামেই এই জনপদের নাম হয় ‘কুমারহট্ট’।মতান্তরও আছে। মৃৎ শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান ছিল কুমারহট্ট। কুম্ভকার তথা কুমোরদের হাট বসত এখানে। তার থেকেও এমন নামকরণ হতে পারে। আবার সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান ছিল এই জনপদ। রাজকুমারেরা এখানে সংস্কৃত অধ্যয়ন করতে আসতেন বলে হতে পারে এর নাম ‘কুমারহট্ট’।
পাল রাজাদের বৌদ্ধ আবহের পরিবর্তন ঘটল সেন রাজাদের কট্টর শৈব হিন্দু রাজত্বে। লক্ষ্মণ সেন ট্রাডিশন ভেঙে হয়ে উঠলেন বিষ্ণুভক্ত। শৈবধর্মের অনুষঙ্গে এলো চড়ক উৎসব। পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের হাত ধরে এলো বৈষ্ণবধর্ম। আর রামপ্রসাদ সেনের অপার ভক্তির মহিমায় এ অঞ্চলের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল শাক্ত ধর্মের স্নিগ্ধ আলো। সেদিক থেকে কুমারহট্ট এক বিচিত্র ধর্মের মিলনমেলা। কবি কয়েকটি ছোটো ছোটো তুলির আঁচড়ে একটা প্রবহমান সময়কে ধারণ করেছেন : ‘ বৌদ্ধ উত্তরাধিকার, চড়কের গান এখনও বাতাসে ভাসে।’
কিন্তু এতক্ষণ যা বলেছি, তার মধ্যে কবিতাটির মূল শৌর্যকে স্পর্শ করিনি। কবিতাটির আসল রস ও সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে অন্যত্র। ‘রামপ্রসাদের পথে সসংকোচে দাঁড়ালেন শিব’ — কী অসম্ভব নাটকীয়তা সৃষ্টি হল এই কথাটুকুতে। তারপরেই একটু থেমে ‘বুড়ো তিনি’। কেন এই বিশেষণ? শিব তো চির বৃদ্ধই। তবু আলাদা করে তাঁকে ‘বুড়ো’ বলার মধ্যে দিয়ে হারিয়ে যাওয়া কুমারহট্টের প্রাচীন ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনা হল। এক যুবক শাক্ত কবি ও গৃহী সাধকের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন এক বাতিল ও উপেক্ষিত প্রপিতামহ। তাই সংকোচ। তাই দ্বিধা। তাই ‘ভক্তের অভাবে ফিরে যায়’ — এই অসহায় আর্তি। মানুষের বিশ্বাস বদলে যায় কালে কালে। কিন্তু ঐতিহ্যের মৃত্যু নেই। নিঃসঙ্গ হয়েও সে বেঁচে থাকে ধূসর গোধূলিতে। নতুন প্রজন্মের কাছে বাড়িয়ে দেয় শীর্ণ হাত। গোটা মধ্যযুগেই দেখা যায় শৈব ধর্মের পতন, শক্তির উত্থান। শৈব চাঁদ সদাগর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হলেন নারী দেবতার পুজো করতে। শৈব ধনপতি সদাগরও হার মেনে চণ্ডীর উপাসনা করলেন। শিবের উপাসক কলিঙ্গরাজ চণ্ডীর কাছে নত হলেন। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন সামাজিক ভূমিকম্পের দিন, যখন সমাজের উপরের জিনিস নীচে আর নীচের জিনিস উপরে উঠে আসছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, দেশ তখন শ্মশান, মা কঙ্কালমালিনী, আপনার শিব আপনার পদতলে দলিতেছেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীকে বলা হয় অবক্ষয়ের কাল। সেই অবক্ষয়ের কালে অনাদৃত অবহেলিত ঐতিহ্য স্বভাবতই কুণ্ঠিত ও কোণঠাসা। তাই দেবাদিদেব শিব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজের অস্তিত্ব ও আত্মসম্মান টিকিয়ে রাখতে চাইছেন প্রতীকধর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে :’বাবা ডাক, ও রামপ্রসাদ, আমিও সম্পর্কে তোর মায়ের প্রণয়ভিক্ষু হই।’
এই শেষ পঙক্তিটিতে চূড়ান্ত নাটকীয়তা ও কবিত্ব শীর্ষবিন্দুকে স্পর্শ করেছে বলেই এই কবিতাটি আমাকে এতখানি মুগ্ধ করেছে। কবিতাটিকে কে কীভাবে নেবেন আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এটি পরিবর্তমান ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক অবক্ষয়ের পটভূমিকায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের গূঢ় আর্তনাদের কবিতা। কবির নাম জানি না। তাঁকে আন্তরিক প্রীতি ও ভালোবাসা জানাই।
২
সৈকত মুখোপাধ্যায়
কুমারহট্ট অর্থাৎ কামারহাটি। কবিতার শিরোনামেই কবি প্রাচীনকালের আবহ তৈরি করলেন। তা ছাড়া কুমারহট্ট তো সাধক রামপ্রসাদের সাধনস্থলও বটে। অতঃপর প্রথম তিন-লাইনে কবি শিব নামক দেবতাটির বিবর্তন প্রসঙ্গে একটা তথ্য স্পষ্ট করেই বলে দিলেন, “বৌদ্ধ উত্তরাধিকার”। আর অন্য কথাটা বললেন সংক্ষেপে। শিব যে বরাবরই প্রাগার্য অন্ত্যজদের দেবতা ছিলেন, আর্য-আগ্রাসনের পরে তাঁকে নানাভাবে বৈদিক দেবমন্ডলীর অন্তর্গত করা হয়েছে, এবং আপাতত তাঁর একক-আরাধনা যে বীরভূম বাঁকুড়ায় কোনঠাসা, এত কথা বলা হল ওই একটি বাক্যে– ” চড়কের গান এখনো বাতাসে ভাসে, ভক্তের অভাবে ফিরে যায়”। তার আগেই অবশ্য “বুড়ো তিনি” এই দ্ব্যর্থক শব্দবন্ধে শিব-কল্পের প্রাচীনতা বোঝানো হয়েছে।
কবিতাটার বড় গুণ হচ্ছে এর সংক্ষিপ্ততা। যেহেতু একটু বেদনাময় মজা ছাড়া এই কবিতা বিশাল বা মহৎ কোনো দর্শন কিংবা আবেগকে বহন করছে না, তাই আকারে বড় হলে ওই মজার রসটাও পাতলা হয়ে যেত। কবিকে সাধুবাদ যে, তিনি প্রকারের সঙ্গে আকারের সঠিক অনুপাতটা বুঝেছেন।
ঈশ্বরের মনুষ্যবেশে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো এই বাংলার পাঠকদের কাছে তেমন অস্বাভাবিক ঠেকে না। তারা তো জ্ঞান হওয়া ইস্তক ওই রামপ্রসাদের বেড়া বাঁধার গল্প শুনেছে। আধুনিক কবিরা সেই ট্র্যাডিশনে কম কবিতা লেখেননি। একটা ভালো কবিতা আরও দশটা ভালো কবিতার কথা মনে পড়িয়ে দেয়, আর কে না জানে, ভালো জিনিস দশজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। আলোচ্য কবিতার আত্নীয় এই কবিতাটিকে সেইজন্যেই আপনাদের সামনে পেশ করলাম।
সরস্বতীটি / জয়দীপ রাউত
আমার একটি মাত্র কন্যাসন্তান শুনে প্রৌঢ় বললেন
“বাহ, বেশ। ঘরে তবে লক্ষ্মী এসেছেন”।
আমার চঞ্চলা লক্ষ্মীটিকে ডাকি, কানে কানে বলি
এই তিনটি লজেন্স নিয়ে দুটি তোর
না হওয়া দিদিটিকে দিবি, বলবি যে বাবা তোকে
রাত্রে ডেকেছেন।
এখন অনেক রাত, লক্ষ্মী ঘুমান আর
পিতার অপেক্ষা নিয়ে জেগে থাকে দু-টাকার অধোমুখ পেন…
৩
রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়
উত্তর-আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে শাস্ত্র, পুরাণাদির অনবদ্য বিশ্লেষণ যখন কবিতার বিষয়বস্তু, তা পাঠককে এক দুর্নিবার টানে আকর্ষণ করে। যদিও এই সংযোগের ক্ষেত্রে শিরোনামটির অব্যর্থ ভূমিকা অস্বীকার করা যায়না। এখনকার হালিশহরের পূর্বতন নাম ছিল কুমারহট্ট। এ নিয়ে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রতিপাদ্য রয়েছে –
১। একাদশ শতকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের শাসনকালে রাজা কুমারপাল-এর নাম অনুসারে স্থানটির নাম হয়েছিল কুমারহট্ট।
২। গঙ্গা তীরবর্তী এই জনপদে কুম্ভকার বা কুমোরদের তৈরী মৃৎশিল্পের রমরমা ছিল। জলযানে করে সেসব সামগ্রী রপ্তানী হত দূরদূরান্তে। কুমোরদের হাট থেকে কুমারহট্ট নামটি প্রচলিত হয়।
৩। এই স্থান সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান ছিল এবং বহু রাজকুমার এখানে সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষালাভ করতে আসতেন। এই সংযোগসূত্র ধরেও কুমারহট্ট নামটির শুরু ধরা হয়।
ঐতিহাসিক গবেষণার সিংহভাগ অনুসারে দ্বিতীয়টিই অধিক গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। নামকরণের কারণ যাই হোক, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যে প্রথম এই জনপদের ‘হালিশহর’ নামটি পাওয়া যায়। ‘হাভেলীশহর’ থেকে অপভ্রংশ জনিত ‘হালিশহর’ নামের উৎপত্তির প্রেক্ষাপটে কিন্তু ‘কুমারহট্ট’ই রয়েছে। এই স্থানটি মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের মাহাত্ম্যজনিত হলেও অষ্টাদশ শতকে বিকশিত বিখ্যাত শাক্ত সাধক ও শ্যামাসঙ্গীতকার রামপ্রসাদ সেন-এর জন্মভিটে হওয়ার কারণেই পরবর্তীকালে অধিক বিখ্যাত হয়েছে। এই ইতিহাসচারণের প্রয়োজন কেন, তার সম্যক উপলব্ধি হবে ছয় পংক্তির এই ছোট্ট অথচ অসামান্য কবিতাটি পাঠ করলেই।জনপদটি যখন ‘কুমারহট্ট’ নামে প্রখ্যাত, তখন সেখানে শাক্ত ধর্মাবলম্বীদের চিহ্নমাত্রও ছিলনা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের শাসনকাল। অর্থাৎ কুমারহট্টর সঙ্গে রামপ্রসাদের সময়ের সংযোগ থাকার কথা নয়। এখানেই কবিতাটির উত্তর-আধুনিক মুখশ্রী প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।
কবি যেন এক সময়যন্ত্রে পাঠককে ভ্রমণ করাতে চান দশক পার হয়ে চলা সময়রেখার উপবৃত্তাকার পথে। রামপ্রসাদের সময়ের হালিশহর শাক্ত আরাধনার পুণ্য পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। মা কালীর উপাসনায় একাত্ম রামপ্রসাদের সরাসরি আারাধ্য না হলেও দেবাদিদেব মহাদেবকে উপেক্ষাই বা করবেন কিভাবে। সে কারণে মহাদের সংশয়াবৃত এবং মাতা-পূজারী সন্তানের প্রতি তাঁর সংকোচ যেন এক ঘোর বাস্তব রূপে মূর্ত হয়ে উঠল।
এই জনপদ একসময় বৌদ্ধ ধর্নাবলম্বীদের অধীনস্থ ছিল, বয়োবৃদ্ধ মহাদেবের শিষ্যরা চড়ক সংক্রান্তি প্রথাপালনে মুখর হয়ে উঠত, সে সবই আজ অতীত। মা কালীর সাধক রামপ্রসাদ মহাদেবকেও বাবা সম্বোধনে ভূষিত করেন স্বাভাবিকভাবেই। আর এখানেই কবিতাটির মোচড় দেওয়া শেষ পংক্তিটি এক অলীক আবহ নির্মাণ করে, যেখানে মহাদেব রামপ্রসাদকে বোঝাতে চাইছেন যে তিনি তাঁর মায়ের ‘প্রণয়ভিক্ষু’। শুধুমাত্র এই একটিমাত্র শব্দের অপলকে হু হু করে পেরিয়ে যায় সভ্যতার বিবর্তনের রূপরেখা, প্রথাগত ধর্মের সাথে অতি-আধুনিকতার যে মধুর দ্বন্দ্ব ঘনিয়ে ওঠে, তারই দিঙনির্ণায়ক রশ্মিপাতে আমাদের ধর্মাচরণ নিছক বিশ্বাসের নিরাকার নয়, স্পর্শযোগ্য বাস্তবজীবনের প্রতিভূ হয়ে ওঠে। কী অসামান্য ভাবনা! কী অতুলনীয় আবর্ত রচনার মিঠাস কবিতাটিকে মহীয়ান করে তোলে! এমন অলৌকিক সৃজনের দ্বারাই বাংলা কবিতার শুশ্রূষা সুনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
৪
শুভদীপ নায়ক
একটি সামান্য ছয় পংক্তির কবিতা, কিন্তু তারই মধ্যে একটি বিস্তর দৃশ্যরচনা করা হয়েছে। রয়েছে সম্পর্কযোগ, আলাপচারিতা, রয়েছে লুকিয়ে রাখা অব্যক্ত প্রণয়। প্রৌঢ় শিব চাইছেন বৌদ্ধ উত্তরাধিকার। ছেলেটি নিঃসন্দেহে রামপ্রসাদ, শাক্ত। অর্থাৎ, সে কালী ঠাকুরের সাধক। শক্তির উপসনায় মত্ত। সেই রামপ্রসাদের সঙ্গে আলাপচারিতার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে স্বয়ং শিব। একটি সামান্য কবিতা, সেখানে লেখা হচ্ছে ‘রামপ্রসাদের পথে সসংকোচে দাঁড়ালেন শিব’। কেন এই সসংকোচ, কারণ রামপ্রসাদ তো কালীভক্ত, কালী ঠাকুরই রামপ্রসাদের মা। সুতরাং শিব এসেছেন পিতৃত্বের অধিকারে। কেননা, শিব কালীঠাকুরের প্রণয়ভিক্ষু। রামপ্রসাদের পিতা হলেন শিব, কিন্তু রামপ্রসাদ সেটা জানে না। সে শৈব উপাসক নয়, বরং সে কালীর সাধক। কিন্তু শিবের পিতৃত্ব ছাড়া রামপ্রসাদ কি কখনও কালী মায়ের সন্তান হতে পারে? রামপ্রসাদ হয়ত এই বিষয়ে কিছুই জানে না। তবু শিব আজ এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। এমন তো কতই হয়। একটি গভীর সম্পর্কে মনের বাঁধন এতই তীব্র হয়ে পড়ে যে আমরা শেষপর্যন্ত দেহ নির্বাসন দিই একে অপরের কাছে। ফের একজন সন্তান পৃথিবীতে আসে। সেইসঙ্গে আমাদের সম্পর্কের আকাশ চিরে এসে পড়ে বিপদের বিদ্যুৎরেখা। প্রকৃতির নিয়মে সেই সন্তান পায় মাতৃস্নেহ, এবং একইসঙ্গে তাকে সহ্য করতে হয় পৈত্রিক দূরত্ব। কিন্তু সন্তানবাৎসল্য একটা সময় মেটাতে চায় তার দূরত্ব, বাড়াতে চায় সাহচর্যের হাত। কিন্তু এতদিন পর ফিরে আসে কিছু অনুশোচনার প্রশ্ন! পিতাটি কেন চাইছে তার সন্তানের কাছ ফিরে যেতে। তাহলে সন্তানটি যে রমণীর, তার প্রেম কোথাও না কোথাও পিতাটিকে আজও কাছে টানছে। প্রেমের জায়গাটা তো দেবতা ও মানুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। সত্যের সেই অমীমাংসিত রূপই হল এই কবিতা।
দেবলীনা
June 30, 2023 |কবিতাটি তো অসাধারণ…. আলোচনাও ভালো
তনিমা হাজরা
July 7, 2023 |কবিতা ও ইতিহাস। সমৃদ্ধ হচ্ছি পড়ে। দারুণ ভাবনা “বম্বে ডাক”।এভাবে উপস্থাপন করার চিন্তাটিকে সাধুবাদ জানাই।