কবিতা ও কথা-১
প্রগতি বৈরাগী একতারা-র কবিতা নিয়ে লিখেছেন অশোক দেব, রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা– বিষমঙ্গল
মধুমাস গত হলে মুছে যায় রমণী রোদ্দুর
উথলায় ধুকপুক পূর্বতন হিরন্ময় পাপ
আমি তাতে যত্নহাতে আগুন লাগাই
ঘুরেফিরে নাচি, গাই বেদেনীর প্রাচীনপুকার
বিষসিদ্ধ ফল রাখি জিভের তলায়
গোড়ালির নিচে মুখ, কী সুখে ঘুমায়
স্নিগ্ধপ্রাণ, প্রেমশব, মথিতকুসুম
ক্ষুরচিহ্ন শির ডোবে ধূলার শয্যায়
শিরদাঁড়া ভেঙে যায় তালের আঘাতে
কী লোহিত, অকপট, ফেনা ওঠে, ফেনা ওঠে
অচিরে পিছল। তবু তার অশ্রু, তাপ
একমাত্র পরমাদ, পাঁজরের আলপথে
কুঁদে রাখা আধোতৃপ্ত সাধ
প্রণয়ে ছোপানো নখ ধুয়ে আসি
ধুয়ে আসি গুপ্তকথা আলতা অধিক
হা-হা করে আয়ুরেখা, পাটিপত্র
হা-হা করে বিষহরি ভাসানের গান
কথা :
১
অশোক দেব
অন্ধদের গ্রামে সন্ধ্যাকাল আসে। সেদিন এসেছিল। আবার ফিরে গিয়েছে। অন্ধরা বুঝতে পারেনি। সেই গ্রামে গিয়ে স্বেচ্ছান্ধ হয়েছি আমি। প্রাচীন চক্ষুতে রাখি শুদ্ধ অন্ধকার। তারপর কথা বলি।জন্মান্ধ মাত্রই সুরের সন্তান। কবিতার কথক। পৃথিবীর সকল কবিতা আসলে তাদের জন্য নির্মিত হয়। যে কবি তা জানেন, তিনিই কবি। অবশিষ্ট অবসাদ। গ্রামের প্রাচীনতম অন্ধজনকে জিগ্যেস করি, বিষহরি কে? তার ভাসান সম্পর্কে কিছু বলুন।
জল দেখেছেন?
–– হুম
–– তার তৃষ্ণাহর রূপ দেখেছেন?
–– সে তো দেখা যায় না
–– তেমনি ভাসান দেখা যায় না। না না, আমরা অন্ধ, তাই দেখি না, তা নয়। আসলে চক্ষুষ্মানরা তো কিছুই দেখে না, তাদের কথাই বলছি।
চুপ করে থাকি।
–– এক টলোমলো আছে। নারীর জীবনে সেই টলোমলো জাগে যখন বীর্যপুষ্প যায় অন্দরে তার। সেখানে ভাসে প্রাণ, প্রথমে কুঁড়ি হয়ে, পরে জীবন হয়ে। দিন গোনা শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই। একদা বেদনার আলোতে ভেসে সে বেরিয়ে আসে। ভেসে ভেসে। প্রথম ভাসান। আবার আসে আবার যায়। এই আসাযাওয়া কে দেখে? তেমনি লোকের মন টলোমলো হলে লোকে পুতুল গড়ে। পূজা দেয় দেবতাজ্ঞানে। পরে ভাসায়, কিন্তু সেটা ভাসান নয়।
–– তবে?
–– বিষনিষ্কাশন। আমরা পূর্ণান্ধ, আপনি এক অর্ধান্ধ বেটির কথা বলছেন। জরুৎকারুর স্ত্রী।
–– কিন্তু মধুমাস? রমণী রোদ্দুর?
–– বাহ্ কে বলছে গো এসব কথা?
–– জানি না, পেলাম।
–– আয়ুর কথা আছে? প্রেমের কথা?
–– আছে তো, ‘হা-হা করে আয়ুরেখা, পাটিপত্র’
–– আহা আহা, এই বিষহরি তাহলে তো সে বিষহরি নয়। সে অন্য। আপনাদের তো সবটাই বিষ। অত আলো, অত রূপ, কত বিন্যাস আর বিভুতি দেখে দেখে আপনারা কেবল বিষসঞ্চয় করেন। ওই যে শেষে এক একেলা শ্মশানে গিয়ে পাটির ওপর শোবেন, তখন বুঝবেন। এইসব প্রেম আর প্রেমের আকুতি আসলে বিষের বাজার।
–– ঠিক ঠিক,
‘প্রণয়ে ছোপানো নখ ধুয়ে আসি
ধুয়ে আসি গুপ্তকথা আলতা অধিক’
–– এই যে নানা রকম অশান্তি। ধুতে ধুতে মনে করেন, স্পষ্ট হয়ে যাবেন। আপনারা প্রতিটি স্নানে আবার পুরাতন হয়ে যান। সবই ধুয়ে ফেলতে চান, হয় না তাতে। হাতে নয়, আকাশের পারে পারে থাকে অমোঘ আয়ুরেখা, সে-ই চিৎকার করে, আপনাদের গুপ্তকর্ম সব দেখে হাহাকার করে। ভাবেন, সব বুঝি গুপ্ত থাকছে। নিজেরাই আলোকে অন্ধকার, অন্ধকারকে আলোতে অনুবাদ করতে নামেন।
–– ঠিক, ঠিক, এমনই তো বললেন,
‘উথলায় ধুকপুক পূর্বতন হিরন্ময় পাপ
আমি তাতে যত্নহাতে আগুন লাগাই
ঘুরেফিরে নাচি, গাই বেদেনীর প্রাচীনপুকার
বিষসিদ্ধ ফল রাখি জিভের তলায়
গোড়ালির নিচে মুখ, কী সুখে ঘুমায়
স্নিগ্ধপ্রাণ, প্রেমশব, মথিতকুসুম
ক্ষুরচিহ্ন শির ডোবে ধূলার শয্যায়
শিরদাঁড়া ভেঙে যায় তালের আঘাতে
কী লোহিত, অকপট, ফেনা ওঠে, ফেনা ওঠে
অচিরে পিছল। তবু তার অশ্রু, তাপ
একমাত্র পরমাদ, পাঁজরের আলপথে
কুঁদে রাখা আধোতৃপ্ত সাধ’
–– দেখলেন, পাপ হিরন্ময়?
–– এই গ্রামে এসে আমি তো আর দেখতে পাচ্ছি না কিছু
–– সেই ভালো, শুনুন, এই যে কথক উত্তম পুরুষে স্বীকার লিখছেন, কেন?
–– আপনি বলুন
–– এক দেশে এক রাজা ছিল।
–– আচ্ছা
–– তিনি বলে দিলেন, এখন থেকে স্নানে গিয়ে স্নানই করতে হবে, অবগাহন করলে সেহবে পাপ।
–– এ কেমন কথা?
–– সেটাই তো, পাপ বলে কিছু হয় না। নানারকম রাজাতে বানায়, ভেঙে ফেলে। জীবন হিরন্ময়, আলো পড়লে ঠিকরায়, পাপ বলতে আপনার যা বোঝান, আমরা তাকে খাদ বলি, না মেশালে টুটে যায়। সারাজীবন আমরা অন্ধকার বিনিময় করি পরস্পর। কে যে প্রণয়ের নামে পাপ দিয়ে যায়, নিয়ে যায়, গা করি না।
–– বুঝলাম
–– না, বোঝেননি
–– তাহলে বলুন
–– অনেক ঘুঙুর হেঁটে যাচ্ছে, শোনেন?
–– কোথায়?
–– ওই যে কথাগুলোর গায়ে গায়ে?
–– ও, ছন্দ?
–– ছন্দ নয়, চলন। সাপের রমণ দেখেছেন?
–– আপনি দেখেছেন?
–– দেখেছি, অন্ধকার চোখের ভিতরে। সেটাকেই বলে ছন্দ, কিংবা চলন। নৃত্য ব্যতিরেকে সঙ্গম নাই, কবিতাও না। এই যে চলতে চলতে, চালাতে চালাতে আপনাকে আমাকে নিয়ে চলেছেন এই কবি, কোথায়?
–– কোথায়?
––ভাসানে
–– ত্যাগ করবেন আমাদের?
–– আরে না না, বললাম না প্রথম ভাসান থাকে জরায়ু-আঁধারে
–– তাহলে ত্যাগ করবেন না?
–– না, জন্ম দেবেন। বেদনা কবির, আনন্দ আপনার।
২
রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়
বাংলা কবিতার যাত্রাপথে এমন কিছু শব্দ, শব্দবন্ধ, পংক্তি প্রোথিত ও শোভিত হয়েছে আশরীর, যাদের কাল-নিরপেক্ষতা আমাদের বিস্ময়ের বাধ মানেনি। যেমন –
১। ওরে আজ যাসনে ঘরের বাহিরে
২। আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে?
৩। ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত
৪। যেতে যেতে হঠাৎ একটা নদীর সঙ্গে দেখা
৫। কবিতা মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েষা আক্তার
৬। শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা
৭। ধর্মে আছি জিরাফেও আছি
৮। যেতে পারি কিন্তু কেন যাব
৯। অবনী, বাড়ি আছো?
১০। মাঝরাতে কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক
১১। পাখিহুশ
১২। বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো
উল্লেখ করতে থাকলে সংখ্যারা এ লেখা ছাড়িয়ে চলে যাবে। তেমনই এই আশ্চর্য কবিতায় ‘রমণী রোদ্দুর’,‘হিরণ্ময় পাপ’, ‘প্রাচীনপুকার’ প্রমুখ শব্দবন্ধে যেন সেই চিরন্তনে অঙ্গাঙ্গী হওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘মঙ্গল’ শব্দটির প্রয়োগ যে উদ্দেশ্য নিয়ে সেই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত আসে কারণ এখানে বন্দনা, কারণ খুঁজে পেলেও দেবখন্ড ও নরখন্ডের স্পষ্ট কোন বিভাজন নেই। তবু কেন মাঙ্গলিক? এই ‘কেন?’-র উত্তর পেতেই হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই, তবু… মধুমাস গত হওয়া থেকে যে ক্ষণের সূত্রপাত, তার প্রভাব কী তীব্র, কী বিস্তারী, কী বিদ্ধকারী হয়েও কী সাবলীল ভঙ্গীর স্মারক হয়ে থাকে, প্রথম স্তবক সেই নিমিত্তের দ্যোতক এবং বন্দনা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় কোন দ্বিধা থাকে না।
‘হিরন্ময় পাপ সহজ বাহের ধরণে পরবর্তী স্তবকে এসে পংক্তিধারণ করে –“আমি তাতে যত্নহাতে আগুন লাগাই” এবং এর সাথে এ আঁচের সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়া। সুরের চলনে যেমন ছোট ছোট শ্রুতিমাধুর্য জোর করে গেঁথে দিয়ে দক্ষ গায়কী প্রতিষ্ঠা করে, সৃজনের কোন বিধিবদ্ধ সীমানা হয় না, তেমনভাবেই ‘যত্নহাতে’ শব্দটির চমকে দেওয়া প্রয়োগে অবশ হয়ে আসে চেতনা। কারণ আগুন লাগানোর বিকৃত সুস্থতাও কী অনুপম শৈলীতে স্থাপিত হল! এ আগুনকে ঘিরে পালন করা হবে উচ্ছ্বাসমুহূর্ত – এতে আশ্চর্য হওয়া অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে।
এখানেই ‘বেদেনীর প্রাচীনপুকার পাওয়া গেল। এবং এতক্ষণ পর্যন্ত কবিতাটিকে চেনার ক্রমবিন্যাসও এক
ধাক্কায় বদলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শিরোনামে তাকালে দেখা গেল – আরে! সূত্রবৎ যে লগ্নতার তিরতিরে শরীরখানি পাতা আছে, তাকে তো চিনতেই পারিনি। আর এখান থেকেই কবিতাটির নতুন পাঠ শুরু হয়। বিষসিদ্ধ ফল জিভের তলায় রেখে যে অর্জন পর্যন্ত চলে যাওয়া, তার জন্য বিসর্জনের অবরোহ সম্বিত ফিরে পেতে ভুলে গেছে। ‘গোড়ালির নিচে মুখ’ থেকে ‘তালের আঘাতে’ পর্যন্ত একটি হত্যলীলার বর্ণনাকেও অসামান্য কবিত্বে জারিয়ে তোলা হল। কিন্তু কেন! কারণ ‘পাপকে ‘হিরন্ময়’ করে তোলার প্রয়োজন ছিল যে! সত্যিই কি ছিল? এই দ্বন্দ্বের সামনে এনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে মাপ নিতে চাওয়া হল বিস্ময়ের। “কী লোহিত, অকপট, ফেনা ওঠে, ফেনা ওঠে, অচিরে পিছল।“ – অকপট নিঃসন্দেহে! নিপাট এক ছবি! কিন্তু কবিতা তো নিছক ছবিকে বর্ণনার মাধ্যম মাত্র নয়। এই উন্মোচনের অন্দরে কোন এক বিজন বন্দরে এসে দাঁড়ায় এক মাস্তুল ভেঙে যাওয়া জাহাজ, যার লগবুকে শেষ নথিবদ্ধ তথ্যের ঘাত তখনও দগদগে হয়ে জেগে আছে। জেগে আছে ভাসানের কৌশলের ভেতরে চুপচাপ শুয়ে আছে সুনসান প্রান্তরে রাত্রির গড়িয়ে যাওয়ার সম্মোহ। ‘অচিরে পিছল-এর পর একটি আলতো ‘তবু’ ভেতরদালান পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। অসমাপ্তের লপ্তে রাখা দীর্ঘশ্বাসে, অবশেষের রিক্ত কাঠামোয় উন্মন টানাপোড়েনের নির্যাসে ঘনিয়ে আসে আবছায়া, চৈতন্যে ভাটার টানে যেতে যেতে নৌকার তলদেশ এসে ঠেকে গেছে পলির আসক্তিতে – এই হু হু করা আকীর্ণ হয়ে ওঠে ‘আধোতৃপ্ত সাধ’-এ। এখানে আরেকটি আশ্চর্য প্রয়োগ রয়েছে ‘একমাত্র পরমাদ! বাহ্যিক বিভঙ্গের অন্তরালে যে হারানোর আঙিনা,সেখানে যে কেউ একা, একাই…অকালপ্রয়াত ইচ্ছেদের সাকিন হারিয়ে গেছে কোথায় যেন! ‘পরমাদ’ শব্দের প্রাচীন ব্যবহার স্মরণে রেখেও অবাক হয়ে যেতে হয় কী অলীক অমোঘের সাথে পরিচিত হতে হয়! পাঁজরেরও আলপথ হয়! ওঃ কুর্ণিশ কবি!
এর পর থেকে কবিতাটি উড়াল নেয় অনবদ্যের হাওয়ামাপে সওয়ারী হয়ে।
“প্রণয়ে ছোপানো নখ ধুয়ে আসি
ধুয়ে আসি গুপ্তকথা আলতা অধিক”
– তুমুল প্রণয়ের ছাপ রয়ে যায়, গোপনকে মান্যতা দিয়ে তাকে ধুয়ে ফেলতে হয়, কারণ সর্বসমক্ষে এ কৃতির জন্য বাহবা কুড়োনোর কোন স্পৃহা থাকেনা কারকের। যা থাকে, তা এক অলক্ষ্যে লিখিত প্রেক্ষিত।
যে বিপর্যাস আয়ুর পরিপন্থী, তার আপাতশেষে যে মঙ্গলাচরণের শর্ত, ‘পাটিপত্র’ শব্দে যেন সেই প্রতীতির উদ্ভাস! অথচ প্রকৃত সন্ধিৎসায় ঠিকরে বেরিয়ে আসে বিষের অন্তে, এক অন্তহীন করুণ উজান… একটি একঢালা কাপড়ের টুকরো সেলাই-এর মুন্সীয়ানায় যেমন পোশাক হয়ে ওঠে, তেমনভাবেই শব্দের জাদুতে কিভাবে বদলে যায় আদল, কিভাবে প্রয়োগের প্রথাগতে খেলা করে আভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলনের চমৎকার, কিভাবে চাঁদও বশ্যতা স্বীকার করে নেয় শব্দের খাদ, খাদের কিনার, কিনারের ঝুঁকি, ঝুঁকির নেশা, নেশার আমেজ, আমেজের উপদ্রুত অঞ্চল ছেয়ে যাওয়া স্বতঃপ্রবৃত্তির সৈন্যে, সৈন্যরা যুদ্ধার্থে নয়, ফিরিয়ে দিতে এসেছে যা নেওয়ার কথা আদৌ ছিলনা…
কবির প্রতি আভূমা মুগ্ধতা রেখে গেলাম। আপনাকে আরও পাঠের ইচ্ছে রইল।
তনিমা হাজরা
July 7, 2023 |অপূর্ব কবিতা ও বিশ্লেষণ।