একলা বালিশে লেখা নারীর অক্ষর
মানসী কবিরাজ
কোথাও কী লেখা আছে সেই অস্ফুট জলের আগুন, যখন আমার সব রোদ্দুরের ভাষা পোঁটলায় পুরে নিয়ে তারা চলে গেছে দূরে। চলে গেছে লক্ষ্মণরেখার গণ্ডি পেরিয়ে। তবুও অন্ধকার ফালা ফালা করে ফুলে ফেঁপে উঠছে আমার ভিতর কথার ঢেউ। কী যে ম্যাজিক লণ্ঠনের ছটা আর মনকেমনের রেশ লেগে আছে সেই ভাষার গহীনে! যেন এক ষ্টেশন থেকে অন্য ষ্টেশনে ছুটে চলা ভাষা, যেন আসলে কোথাও কিছুই হারায় না বলে চলা ভাষা ঝরে ঝরে পড়ছে টুপটাপ। যেন এক নিরালা ছাদের উপরে আছড়ে পড়া বিধুর ঘুঘুর ডাকের মতো ভাষা। অথচ অমোঘ এই বিষাদ ফেনা চুপচাপ গিলে নিতে নিতেও আমার নাচ পাই, কিংবা নাচের আমাকে পায়! আর অসংখ্য গাংচিল উড়ে যাওয়া ল্যান্ডস্কেপে আমি খুঁজি আমার ভিতর মানুষীর নিজের ভাষাকে।
যেন এক আলবাট্রসের পাখা ধার ক’রে আকাশে উড়ে যাচ্ছে সেই মানুষী। পেরিয়ে যাচ্ছে মাধ্যাকর্ষণের টান। স্বপ্নে কোনও বোর্ডিং পাস লাগে না, লাগে না সিকিউরিটি চেকিং। সে তার নিজস্ব ডায়েরি আর প্রিয় বাগানখানা নিয়ে ভেসে যাচ্ছে, ভেসেই যাচ্ছে। অথচ স্বপ্নেই ভেঙে যায় স্বপ্নটা! মুছে যায় আকাশ আর মাটির দিগন্ত রেখা। বাগান থেকে খুলে যায় মাটির নির্যাস। তার ডায়েরির গোপন, মুছে যায় নিষ্ঠুর জলের আক্রোশে। তার আলবাট্রস ডানা থেকে খসে পড়ে উড়ানের ভেলভেট ওম। ধূধূ বিছানায় পড়ে থাকে শুধু মৃত পালকের রাশ। মানুষী খুঁজে পায় না তার ধার করা ডানা। সে মুখ থুবড়ে শুয়ে থাকে বরফ চাদরে, শুয়ে থাকে একা; ভাষাহীন, শব্দহীন একা …
তবুও সে বেঁচে থাকে, যেমন জিভ কেটে ফেললেও বেঁচে থাকে খনার বচন। সে নিজেই নিজেকে বলে “ আমার ভেতরে যদি আগুন জাগ্রত থাকে / কতদিন ছাই চাপা দেবে / আমি যে লিখতে চাই আমি যে বলতে চাই / আমারও মুখের ভাষা আছে।”
কিন্তু কে শুনবে তার ভিতরের ভাষা! অথৈ জলে ভেসে যাবার আগে সেই যে আমার ভিতরের মেয়েটি, যে খড়কুটো আঁকড়েও প্রাণপণ বেঁচে থাকতে চায়, তার এই একলা বাঁচার যে নিজস্ব ভাষা, কে শুনবে তাকে! কেউ কি পড়তে বা শুনতে চেয়েছিল এই যে প্রতিনিয়ত একটা অস্তিত্বের সংকট, এই যে রকমারি ট্রমা নিয়ে যে মেয়ের বাস তবুও সেই মেয়ের কলম যখন লিখেছিল… কতটুকুই বা দেখতে পেরেছ! বাঁদিকের নীল তিল আর মধ্যদেশের রক্তিম জন্ম জড়ুল? এসব উজিয়েও ছিল পাখির ধুকপুক ছিল জলের সহজ নাব্যতা। অথচ শুধুই শিকার উন্মুখ চোখে বসে আছ! সাবধানী হাতে, মেখে রাখছ চারের অনুপাত। কতগুলো কেঁচো, ময়দা কতটুকু, কতটাই বা চিটেগুড় আঠা। তবুও বড়শি গিলে হায়, এ কেমন রাধিকা নূপুর! পদাবলী রাগে ঘন কুঞ্জ সাজিয়ে, খোঁপার গহীনে লেখে যমুনার ছল।
সেই আলতামিরার গুহাযুগ থেকে মনু-সমাজের ভাষা কতবার যে রক্ত চক্ষু দেখিয়ে শক্ত করেছে তার নিদান কিন্তু একাকিনীর স্বপ্নের ভাষা, বন্ধ ঘরের মেঝেতে কেটে ফেলা জিভের ভাষা! না সেই ভাষা কোনও নিষেধ মানেনি, কোনও রক্ত চক্ষু মানেনি। যদিও কোনও পরিসংখ্যানে বা ভাষিক ইতিহাসে সেই একাকী মেয়েটির কথা উঠে আসেনি কোনদিন, অথচ আবহমানকাল ধরে সে বেঁচেবর্তে আছে। যেমন ইট চাপা দিলেও বেঁচে থাকে দূর্বাঘাসের প্রাণ।
সে তার শরীর বন্ধক রেখেছে নিদান মেনেই কিন্তু তার মনের নিজস্ব ভাষা? কে করবে সেই মর্মলিপির পাঠোদ্ধার! অবশ্য কে না জানে কুসুমদের তো কেবলই শরীর, কুসুমদের মন নাই তাই মনের ভাষাও নাই …
সহপাঠী কুনুই এর খোঁচা মেরে বলে – দ্যাখ দীঘা যাওয়া একদম ঠিক তুই যেন মফস্বলী বাবা-মায়ের ধুয়ো তুলে ন্যাকা সেজে বাগড়া দিস না। মেয়ে তখন প্রজাপতি। আবহে গান বাজে ‘চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায় শুরু হোক পথ চলা শুরু হোক কথা বলা’ অথচ তেজস্ক্রিয় আমেজ পেরিয়ে পাড়ে না উঠতেই, সব কথা শেষ হয়ে গেল! বিশ্বাসঘাতক ক্যালেন্ডার থেমে থাকল না, থেমে গেল ঋতুচক্রের সীমা। সৈকতের নীল মাখা শেষে সহপাঠী বদলে ফেলল তার পুরানো পিন কোড। মেয়েটি ঝাপসা অ্যালবামে হাত রাখে, হিসহিস ক’রে ওঠে বিষধর ফণার অতীত, যা সে চাইলেও এডিট করতে পারে না, সেই অতীত যে অতীত তার সমস্ত রোদ্দুরের ভাষা গিলে ফেলেছিল। মেয়ের ঘর জুড়ে নীচে নেমে আসেতে থাকে সিলিংএর ফ্যান আর ঠিক তখনই, সেই মাঝ রাত্তিরে, যখন রাতও ঘুমিয়ে যায় ঘোর নিদ্রায়, মেয়েটি আচমকা শীতঘুম থেকে প্রথম দ্বিধাহীন নিজেকে জাগায়, মেয়ে তখন ঝাঁপি খুলে বসে। শুরু হয় মেয়ের নিজস্ব ভাষার বিশুদ্ধ পাঠ। অন্ধকারে যখন ছায়াও আত্মগোপন করে মেয়ে তার নিজস্ব ভাষায় পৃথিবীর পবিত্র আবাদ চাষ করে।
“ আর আমি আমি জানি জানি / চোরাবালি কতখানি / গিলেছে আমাদের রোজ / আর আমি আমি জানি জানি/ প্রতি রাতে হয়রানি / হারানো শব্দের খোঁজ …” কী খোঁজে মেয়ে! ভাষার শব্দ নাকি শব্দের ভাষা! সব ভাষার কী শব্দ আছে! ভিতরের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে বাইরের মেয়েটি। সামনে তার অনন্ত আয়না। আয়না নাকি ভারী সত্যবাদী! যে আয়না আইলাইনার উজিয়ে পড়ে নিতে পারে চোখের ক্লান্ত বলিরেখা, সেই আয়না কি পড়ে নিতে পারে আমার ভিতর- মেয়েটির নিজস্ব ভাষাও! না না বাইরের আমার নয়, আমার যে ভিতর-মেয়েটি, সব বেড়াজালের মধ্যেও শ্বাস নেওয়া মেয়েটি। তার নিজস্ব ভাষা পড়তে পারে সেই আয়না!
একেই মেয়ে তাই তার আবার নিজস্ব ভাষা! তথাকথিত শাস্ত্রে নাকি বিধান দিয়েছে নানাবিধ! বুক ফাটলেও মেয়ের যেন মুখ না ফোটে। বলেছে ‘পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই / তবেই মেয়ের গুণ গাই’। বলেছে , সাত চড়েও রা কাড়ে না যে মেয়ে তেমনটাই চায় এই সংসার। তবুও কৃষ্ণের গোকুলে বাড়ার মতো গোপনে গোপনে বেড়ে ওঠে মেয়ের নিজস্ব ভাষা। যেন কংক্রিট দেওয়াল ফাটিয়ে মাথা তুলছে চিকণ অশ্বত্থের চারা। মেয়ে নদীর কাছে যায়। নদী তার কথা শোনে স্রোতের আখরে। বেড়ে দেয় পিপাসার স্নান। মেয়ে গাছের কাছে যায়। হাত রাখে। ফুটে ওঠে ফুলের কোমল। শুধু মনুর সমাজে, তার নিজের ভাষা বলা সর্বৈব মানা। সে শুধুই শুনেই যাবে আজীবন।
মেয়ে জানে, তারও নিজের ভাষা আছে শুনে বিদ্রুপে মেতে উঠবে সালিশি সভা। সে জানে, অকপটে বলতে নেই সব কিছু। মেয়ে মানে আসলে তো মেয়েছেলে বা বড়জোর মেয়েমানুষ। তাকে সত্যিই বলতে নেই নিজস্ব ভাষা। বললেই যারা প্রকাশ্যে বাহবা দেবে, সেই তারাই ঠেকের আড্ডায় রসকেলির ফোয়ারা ছোটাবে। যারা কিছুই বলবে না সোজাসুজি, তারা ইঙ্গিতময় হাতছানি দেবে। মেয়ে তাই অনন্যা হয়েও নিজের ভাষা বলে না। বলে শেখানো পাখিপাঠ। সে পুরষ্কার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে, রান্না আর ঘরকন্নার কাজ সে কত ভালোবাসে … স্বামী আর সন্তানের সাফল্যই তার পরম প্রাপ্তি… তার স্বামী তাকে এতো স্বাধীনতা দিয়েছে ( আসলে তার তো অধীনতাই প্রাপ্য কিনা! ) তাই সে ধন্য হয়ে গেছে… বলে বাইরের মুক্ত আকাশ নয় গৃহকোণই তার সমস্ত আলোর ভাণ্ডার। আর যাবতীয় খাপ পঞ্চায়েত গোঁফে তা দিয়ে ভাবে, দ্যাখো কেমন রেখেছি বশ করে।
আয়নার পিঠ থেকে ছিটকে নামে পারদের দগ্ধ রূপালী।
ভিতরের লাভা স্রোত ডানা ঝাপটায়।
মেয়ে তার একলা বালিশে আঙুল অক্ষরে লেখে … আর কত আফিম মেশাবে প্রভুপাদ! না, কোনও গভীর জলের মাছ নয়, আমিই ফেলেছি ছুঁড়ে অভিজ্ঞান আংটি সমূহ। আমার এই নগ্ন আঙুলে আজ আত্মবিশ্বাসের গাঢ় লেগে আছে। এখন আমি নিজেই নিজের ভাষা, করি নির্মাণ। ফুটন্ত লাভাদাহ নিয়ে, একা একাই হেঁটে যাই অন্তর্লীন হামামের কাছে।
প্রাজ্ঞ গিরগিটি সকল, নিষ্ঠা ভরে পাঠ করে মনু সংহিতা।।