একটা উদোম লোক, কিছু উদোম শব্দ
শুভ আঢ্য
আধখোলা একটা দরজা, যদিও ফাঁক দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না পরিষ্কার করে। পরিষ্কার করে দেখার প্রয়োজনও নেই। সামান্য ঠেললে ভেতরে যাবার কথা। ভেতরে না গেলেও তার খুব একটা এসে যায় না। ক’জনই বা এখন আর ভেতরে যায়। আর ভেতর জিনিসটা খুব একটা ভরাট হলেও সৌন্দর্যের দিক দিয়ে তেমনটা নয়। এই যেমন ধরা যাক, পৃথিবীর ভেতরেই তো লাভা ছাড়া আর কিছু নেই, অথচ ওপরে হিমালয়, ভিক্টোরিয়া, তাজমহল, ভিক্টোরিয়ান মর্যালিটি, সাহিত্য, চেতনা, বোধ এইসব সৌন্দর্যের কারবার। ভেতরে ‘র’ জিনিসপত্র, সুন্দর খুব সামান্য কিছু, যদি না আপনি ভয়ংকর রস সম্বন্ধে সচেতন হন।
ভেতরে গিয়ে যেমন দেখা যায় – দু’টো সিঙ্গল খাট, চাদরে গতরাতের দু’একটা চানাচুর বা চিঁড়েভাজা। খুঁটে পাকানো মশারি। ঘরটা মোটের ওপর পরিষ্কার। বেড সাইড টেবিলে ক’টা গ্লাস। প্লাস্টিকের বোতল। তা’তে না শেষ হওয়া কিছুটা জল ও পাশে শেষ হওয়া কাচের বোতলটি নেশায় শুয়ে আছে। তার উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অব্দি নেই লোকটির সামনে। যেন গেলরাতে তার ভেতরের পুরো নেশাটাই এখন একটা সিনিয়র সিটিজেনের পাকস্থলীর ভেতর। একটা মশার ধূপ মশা তাড়িয়ে তাড়িয়ে ছাই হয়ে গেছে।
ভেতরে গিয়ে যা দেখা যায় না – এখানে বাংলা সাহিত্যের খ্যামটা সরানো হচ্ছে। ভদ্দরলোকের কাছ থেকে ভাষাকে ও ভাবনাকে টেনে (বাবা-বাছা করে নয়, খানিক জোর করেই) নিয়ে যাওয়া হয়েছে টালিনালার পাশে ছিটেবেড়ার ঘরে, যেখানে দরজা দিয়ে ঢুকলেই ইয়াব্বড় ঢাউস সাইজের মা-কালীর ক্যালেণ্ডার, তলায় রান্নার এনামেল ও সিলভারের বাসন, এঁটো থালা, এঁটোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া আরশোলা। ভাষা আইঢাই করার আগেই তাকে এখানে জোয়ানের আরক খাইয়ে দেওয়া হয়। ভাষা এখানে পুরুষ্টু। শীতাতপে থাকা সাইজ জিরো আর ফ্যাকাশে মুখ নয়। সে ঘরে ভাষা কেমন তা একটা জিরিয়ে বলার জিনিষ। টালিনালার পাশে সন্ধ্যেয় দিলখুশ মটকা এসেছে। সেখানে জমানো মালাইয়ের ওপর কাঠি গোঁজা হচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো ঈষৎ গোল আঁটোসাটো মহিলা। কদিন বাদে সে মেনোপজে পড়বে। হাত ও পায়ের গোছ সামান্য ভারি। পায়ে মোটা রূপোর মল। হাতে দু’গাছা চুড়ি। ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেলেও তা সোনার। কপালে ঘাম, গাছকোমর করে পরা শাড়ির কোলের কাছে সামান্য হলুদ আর তেলাপিয়ার ঘ্রাণ। এখানে শব্দ খলবল করে ওঠে।
যে ঘরের কথা হচ্ছিল। ঘরটায় ভেতরে লুঙ্গি আর হাফ শার্ট পরে ঘামলাঘাটের নায়ক। নায়ক না বলে খলনায়কও বলা যায়, তবে পার্শ্বচরিত্র একেবারেই নয়। ভাষা লোকটার কাছে একটা বারমুড়া ট্র্যাঙ্গেলের মতো। শব্দ তার কাছে কোনো গহীন ম্যানহোলের ভেতর ঢুকে যায়। মুখে বসন্তের দাগ খানিক। আধারকার্ড অনুযায়ী লোকটা বাসে উঠে বসার জায়গা পাবার কথা। তবে কথা তো কতই থাকে! কে’ই বা মানে সে’কথা। এই যেমন ভদ্দরলোকের ভাষা ও ভাবনা একটা হেজিমনি। তা সিংহভাগ দখল করে রেখেছে কলকাতা। এখান থেকে বেরিয়ে ভাষা যে কালাপানি পার করতে পারে তার ধারণা আঁকতে বসা লোকটা বেসিক্যালি দেহাতি। বাঙালি না বললেও চলে। বা বললেই বরং চায়ের সেন্টার টেবিলের কাচের তলায় যে সব বাড়িতে দেশ, বিদেশ রাখা থাকে তারা একটা মিনমিনে আপত্তি তুলে থাকতে পারেন। বাকি কিছু উত্থিত করা বিষয়ে জানতে গেলে বইমেলায় বড় বড় হাজার স্কোয়ারফিটের স্টল ছেড়ে লিটিল ম্যাগাজিনে ‘শহর’ পত্রিকার টেবিলে আসতে হবে যা অনেকের কাছেই শারীরিক মানসিক বা সামাজিকভাবে কষ্টসাপেক্ষ। লোকটার গা দিয়ে কয়লার গন্ধ। দাঁতের ভেতর খনির অন্ধকার, খানিকটা ভাঙা। সেখান থেকে শ্রাব্য ও অশ্রাব্য ভাষা বেরিয়ে আছে সময় অন্তর। সে হেজিমনিকে মানে না। একটু আগে রেখে যাওয়া চা’য়ের সাথে গতরাতে না খাওয়া একটা আটার রুটি। ভাষাকে দুমড়ে মুচড়ে দেবার কথা অনেকের ক্ষেত্রে বসানো যায়। তবে ওই লোকটা যেন বেসিক্যালি বেনিয়াটোলের কোনো গ্যারেজের মেকানিক। সফল ভাষা যা চলতে পারছে না, অ্যাক্সিলারেটরে গোলমাল; তা ওর সামনে ফেলে দিয়ে আসলে তাকে জিপ বানানোর ক্ষমতা ওর কুক্ষিগত। ভাষার ভেতর থাকা শব্দকে হাতুড়ি ছেনি দিয়ে কেটে কেটে ছুরির মতো শান দিয়ে তাকে ধারালো করে ছাড়ে। তার সাথে আছে আরও এদিক ওদিক থেকে কুড়িয়েবাড়িয়ে আনা শব্দ। এখানে শব্দসম্ভার লেখা যেত, কিন্তু গেল না একটাই কারণে যে লোকটা অভিধান থেকে শব্দ তুলে আনত না। সে একটা রঙচটা লড়ঝড়ে বাইক নিয়ে বিয়াল্লিশ ডিগ্রী টেম্পরেচারে, কাঁধে খুব সামান্য একটা ব্যাগ নিয়ে খাদানে খাদানে শব্দ খুঁজতে বেরোত। সেখান থেকে দোমড়ানো লোকেদের ঠোকরানো শব্দ তাদের মজ্জা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বের করে আনত। শব্দ সামান্য নিচু স্বরে কথা বললে এমন চরিত্রের মুখে তাদেরকে বসিয়ে দিত যে সেগুলো যথারীতি হাই ভলিউমে বাজত।
এখন এসব থেকে লোকটাকে যতটা জাস্টিফাই করা যায়, তা অনেকটা ভদ্দরলোকেরা দীঘা, মন্দারমণি গেলে যতটা রেবেল সাজার জন্য বউকে শর্ট ড্রেস পরায়, ততটাই। তবে লোকটা ভেতর থেকেই রেবেল, তার ওপর যৌনতা নিয়ে ছুঁতমার্গহীন। মুখে আগুন জ্বলছে, তা সে আক্ষরিকই হোক বা শব্দের। ভেতরে একটা ছটফটানি, যেন পাঁঠার নলি কাটার পর তার চার পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে আর প্রাণ বেরোনোর অপেক্ষা না করেই চামড়া তোলার মতো ব্যাপার। যদিও ঘটনাটা অনভিপ্রেত ও ভয়ংকর তবে তা ঘটার সম্ভবনা একেবারে অস্বীকার করার কথা লোকটা কল্পনা করে উঠতে পারত না বলেই মনে হয়। তা কিছু আসল, খাঁটি ও নিখাদ তা সেভাবেই বাহুল্যবর্জিতভাবে তার লেখায় ফুটে উঠতে দেখেছি যেভাবে উনুনের ভেতর কয়লা লাল গনগনে হয়ে ফুটে ওঠে। সে ফুলে হাত লাগানোর ক্ষমতাও সকলের না থাকারই কথা।
এতক্ষণে লোকটার সাথে সমাজ, সমাজের সমকালীন বা বিষমকালীন লেখালিখি থেকে যে কয়েক যোজন দূরত্ব তা বুঝিয়ে ফেলা গেছে। সাধারণ রোগীর কাছে লোকটা ও তার শব্দ পুরোপুরি ভাইরাস। যা ঢুকলে তা ভেতরের যন্ত্রপাতি শুধু বিকলই করে না, প্রায় অনেকটা তার মতো করে অভিযোজন করিয়েও নেয়। এই অভিযোজনের জন্য যা লাগে তা প্রাণশক্তি। তা নিয়ে নিঃশেষ করে ফেলার ক্ষমতা তার লেখা রাখে। তবে তা দেবার মতো দায় ক’জনেরই বা আছে। তাই তা’র ঘরের ভেতরেও বিয়াল্লিশ ডিগ্রী। তার ভেতরের তাপমাত্রা তার চেয়েপ খানিক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। এমন একটা জঁরের মানুষ যাকে চালাতে গেলে রেকর্ড প্লেয়ারের পিন ভাঙার আশঙ্কা প্রবল। তার ফ্রিকোয়েন্সির চিৎকার সহ্য করার কর্ণপটহও দুর্লভ। এসব দিয়ে’ও লোকটার সাড়ে ছত্রিশ ভাগের পৌনে একভাগই ধরা যায় মাত্র।
এতটুকুই দেখা। এর বেশি চেয়ে থাকার মতো রেটিনার ক্ষমতা এই মিডিওকারের নেই।
ঘর থেকে বেরোলে যা দেখা যায় – একটা বিশাল মাঠ। যার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে শব্দের পাহাড় নৈঃশব্দের মতো পড়ে আছে। তারা কথা বলতে পারছে না। তার ওপর উদোম গায়ে লোকটা চড়ে বসেছে। মুখ হাতের পুরোটা ডুবিয়ে দিয়ে খুঁজে নিয়ে আসছে একটার পর একটা শব্দ। বসাচ্ছে কঙ্কালের ওপর ও বানাচ্ছে আরেকটা কঙ্কাল। কারণ তা’ই সত্য। তার অলংকার একটা সময় খসে পড়বে। লোকটার মুখে ক্রূঢ় হাসি যেন শব্দের, ভাষার আর চেতনার ভেতর লুকানো ইজেরের দাগ সে দেখে ফেলেছে। দেখা যায় তার পাশ দিয়ে কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে কবিতা সংকলন, গদ্যপাঠ, সাহিত্য আলোচনা। টিমটিম করে জ্বলা একটা ঠেকের ভেতর লোকটা একটা বস্তা কাঁধে ঢুকে পড়ল। সেখানে ভাষা হয়তো সেই অরণ্যের দিনরাত্রির ‘দুলি’র মতো তার জন্য অপেক্ষা করছে নেশা নিয়ে। রঙিনের পরিবর্তে যা কিছু এসবই কালো-সাদা, কিছুটা ধূসরও। ঠেকের প্লাসটিকের ওপরে একটা সঙ্গমরত ছায়া। ছবিটা ভালো করে দেখা যায় না। গোঙানির শব্দ পাওয়া যায় শুধু।
লোকটা – অজিত রায়
Basab Mondal
May 20, 2022 |প্রনাম অজিত বাবু
আর শুভ রং লেখাটা justttt অনবদ্য