আমি ও আমার শ্মশানবন্ধুরা
তনিমা হাজরা
(১)
কেউ সত্যি সত্যি ডাকলে
সেখানে যেতেই হয়,
প্রচুর দায়সারা ভোজে সায়
দিতে দিতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি,
বাইরের চমকে আর মন জাগে না, মৃত শরীরের দাওয়ায় বসে মুখ নির্বাক ভাঁটার টানে বালিময়,
কেউ সত্যি ডাকলে ঠিক বোঝা যায়, কোথা থেকে যেন ছুটে আসে যত জোয়ারের জল।।
(২)
কিছুই প্রমাণ করার নেই কারো কাছে, না ভালবাসা, না বিদ্বেষ, না ভক্তি, না ভয়-
সব সম্পাদ্য ও উপপাদ্যের দায় মিটিয়ে পীথাগোরাসকে ডাকি,
পানপাত্রে সুরা ঢেলে বলি,
আসুন জ্যামিতি পান করি।।
(৩)
এই একাকীত্ব আসলে আমার এককত্ব,
অনেক জঞ্জাল সরাবার পরে, ,br>জিরিয়ে বসে একটু চুরুট জ্বালাবার বিলাসিতা।।
(৪)
সারাদিন ছিল বহু কোলাহল,
বন্ধু ও অবন্ধু মিলে
অনেক মানুষ, পানপাত্রে ঢালাঢালি
অমৃত গরল।।
রোদ পড়ে এলে,
কাজের বাক্স গুছিয়ে নিয়ে
ফিরে গেছে যার যার মতো করে ঘরে।।
কিছুজন যায়নি কখনো ছেড়ে,
হয়ত তাদের কাউকে কাউকে
আমি হাত ধরে পৌঁছে দেবো আগুনের কাছে,
কেউ কেউ আমাকে পৌঁছে দিয়ে পরে যাবে নিজে।।
(৫)
ক্ষমা করে দিলে সবকিছু,
বাসনা সমতল লাগে,
পুরনো দাঁতের কামড়,
অথবা নখের আঁচড় পুড়ে হোম অগ্নি জ্বলে ওঠে।
পুরনো ঘায়ের উপর ঘৃতের প্রলেপ লেগে দ্বেষ গন্ধ মুছে যায় বনজ সহজে
বাক্যবাণ ভয়ংকর সাজানো, গোছানো যতো তূণে,
ভীষ্মজন্ম সবারই তো আছে।।
ইদানীং, স্বকীয় নির্বিকারত্বের চাপে সব ভোঁতা হয়ে গেছে, বিজয়ী বিজয়ী লাগে তাই,
পুতুল পুতুল ঘোর, সুতোর আগায় নাচন, ঘের দেওয়া চকমকে পোশাক,
ডুগডুগি ফেলে চলে গেছে সব খেলায়েতি পুরনো বাঁদর।।
ঘোমটায় শুকিয়ে থাকা নদী, অন্তঃসলিলা,
মরুভূমি পেরিয়ে পেরিয়ে যে মেয়ের সারাটি জীবন জল নিতে কেটে গেছে,সে এখন অম্লান বদনে পায়ের খাড়ুয়া খুলে রাখে।।
দেরি হয়ে গেল, মেয়ে ভাত রাঁধো,
দাও কিছু মুখে,
আমি বলি, নাহ! বাঁধো হে চৈতন্য,
জাগো মা, মুখে দাও বুলি,
শিউলি ফুলের গন্ধভার ভোরে,
যে মানুষ প্রিয় নাম ধরে ডাকে স্বপ্নের ভিতরে, তার জন্য নির্ভয়ে সদর দুয়ার খুলি,
সবার অলক্ষ্যে তারই সাথে ঘর বেঁধে থাকি, সেই ঘরে বোধের পিদিম জ্বলে ধিকিধিকি,
একাকী চোখ বুজে বসি তার ঠাঁয়ে,স্পর্শহীন স্পর্শের ভেতর সে ছুঁয়ে যায়, সমাজের চোখে ছুঁড়ে দিই হোমের ভস্মরাশি আর খিলখিল হাসি,
ভয় নেই, ছিলে, আছো
এই সুখে মরণ কামড় সেরে ঘুরে উঠে বাঁচো।।
সেই স্বপ্ন বাস্তবের চেয়েও সত্য,
বাস্তবের চেয়েও তীব্র,
রক্তের ঢেউ এসে আছাড়িপিছাড়ি করে চেতনা চত্ত্বরে, মূলাধারে অমৃত তৃপ্তি তুলে ধরে,
এখনো যে প্রাণ আছে দেহে,
এখনো যে সমস্ত দৈনন্দিনের ওপরে অবিভক্ত জীবনের সর পড়ে,
সেই আগন্তুকেরই মুখ মনে করে,
যার মুখ দেবতার মতো, যার মন আকাশের মতো নীল, বিষব্যথা মেখে একা,
সেই কী পায়ের পাতায় দিলো লতানে গাছের বেড়ি,
দোলে দুটি নীল অপরাজিতা,
যাত্রা স্তব করে,
যাই যাই করে তবু যাওয়া হয়নি তো কোনোদিন যার ঘরে,
এ হাটে, ও মাঠে, এ গাঁয়ে, সে বাটে, পঞ্চভূতের দেহ ঘুরে ঘুরে মরে।।
(৬)
মৃত্যুকে সবাই কতো ভয় পায়,
অথচ মৃত্যুই প্রিয় বন্ধুর মতো স্নেহে সব গর্ব, সব দ্বেষ, সর্বস্ব খুইয়ে মাটিতে মিশতে শেখায়।।
(৭)
সবাই আমাকে ভাঙতে চেয়েছিল
অথচ আমি উঠে দাঁড়ালাম স্বচ্ছন্দ একটি গাছের মতন।
ডালপালা মেলে দিয়ে বল্লাম, এসো তোমাদের অক্সিজেন দান করি আর কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নিই।
আমার শিকড়ের দৌড় দেখতে দেখতে ওরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।।
(৮)
আমাকে সাজাবে তারা অন্তিম ফুলসাজে,
অগুরু চন্দনে দেবে শেষ রূপটান,
যাবার সময় দেবে,
চোখের জলের বেদগানে,
অবগাহন স্নান।।
(৯)
তারাই তো শেষ অব্দি যাবে,
অশ্রুজল ইন্ধন করে জ্বালাবে আগুন,
অতঃপর,
ছাই হাতে হেঁটে ফিরে যাবে
স্মৃতির ভিতর।।
(১০)
মৃত্যুর অমোঘ দুটি
উজ্জ্বলতম চোখ,
আত্মবিশ্বাসের তারে ঝংকার তুলে বলে, এসো,
কর্মযোগের বেদগান গাওয়া হোক।।