আঠাশে জুলাই
অজিতেশ নাগ
সুখময়বাবুর একটা ডেইলি রুটিন আছে। সেটা আজকের নয়। সেই যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকলেন, সেই সময় থেকে। রোজ সকালে উঠে পাশের রাস্তায় আধাঘণ্টা হাঁটা, তারপরে পার্কে যাওয়া, সেখানে কিছু চেনা বন্ধুবান্ধবদের সাথে সামান্য আড্ডা মেরে সোজা বাজার। সেখান থেকে বেছে বেছে আলু, বেগুন, ঢেঁড়স, লাল কানকো দেখে মাছ ইত্যাদি কিনে পাঙ্কুর চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চিনি ছাড়া লাল চা পান করে সোজা বাড়ি।
দীর্ঘ ছত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে ইতি টেনেও তার এই রুটিনের কোনও ব্যত্যয় হয়নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আগের মত বাজারের থলে ফেলে রেখেই টয়লেটে ঢোকেন না। কারণ অফিসে যাওয়ার তাড়া আর তার নেই। শেষ হয়েছে বছর দেড়েক হল। এখন বাড়ি ফিরে প্রথমে সামান্য আরাম, পরে ব্রততীর হাতে এক কাপ চা। তারপরে মন দিয়ে খবরের কাগজের আদ্যোপান্ত প্রায় মুখস্ত করে ফেলা। ব্রততী অবশ্য গজগজ করেন, “সেই তো বাড়িতে এলেই চা বানিয়ে দিই, তাহলে পাঙ্কু না টাঙ্কু কার দোকানে চা খাওয়ার দরকার কী তোমার বাপু? আমি দেখেছি একদিন। ইস, কী নোংরা সসপেন! কী কালো কালো বয়াম! কী যে সুখ পাও কে জানে!”
সুখময়বাবু খবরের কাগজের পাতা খুলে নিয়ে পড়তে পড়তে মৃদু হাসেন। কখনও বলেন, “অভ্যেস, বুঝলে অভ্যেস। যেমন তোমার কোনদিনও অভ্যেস হল না আমার সাথে বেরোবার। এই যে তোমার সুগার সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মত বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। আমার মত হাঁটলে যে সুগারটাও কমে আর সকালের নির্মল বাতাস ফুসফুসে ঢোকে, সেদিকে হুঁশ আছে? কী যে সুখ পাও বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে!”
এটা অবশ্য ঠিক। বহু চেষ্টা করেও যেমন সুখময়বাবু তার অভ্যেস ছাড়তে পারেননি, তেমনই ব্রততীকেও ধরাতে পারেননি। সুখময় বিছানা ছাড়ার অন্তত ঘণ্টাখানেক পরে ব্রততী ওঠেন ঘুম থেকে। অবশ্য এরপরে আর ঘুম আসার প্রশ্ন নেই। কারণ ততক্ষণে ভেজানো দরজা ঠেলে মান্তুর মা এসে বাসি বাসনপত্রের ঝনঝনাৎ শব্দে বাড়ি কাঁপিয়ে তোলে। তার সাথে অনর্গল মুখনিঃসৃত শব্দব্রহ্ম। ঘুমোয় কার সাধ্য?
ব্রততী অনেকবার ভেবেছেন মান্তুর মাকে বলে দেবেন একটু কম শব্দ করে বাসন মাজতে আর অল্প কথা বলতে। কিন্তু শেষমেশ পারেননি। এই বাড়িতে মান্তুর মা আজকের নয়। টুটুল যখন পেটে তখনই তার এই বাড়িতে আগমন। টুটুল আসার পরে ব্রততী অসুস্থ ছিলেন অনেকদিন, একমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো ছাড়া টুটুলের দেখাশোনা কিছুই করতে পারেননি। সেইসময় মান্তুর মা না থাকলে যে কী হত পরে ভাবতে গিয়েও শিউরে উঠেছেন ব্রততী। টুটুল ছিল প্রি-ম্যাচিওরড বেবি। তুলোর বলের মত টুটুলকে কোলে নিয়ে কত দিন যে বসে বসে কাটিয়েছে মান্তুর মা, হিসেব রাখা অবান্তর।
তারপর কত বছর কেটে গেল। সেই টুটুল বড় হল। স্কটিশ চার্চ থেকে বেরিয়ে হায়ার স্টাডিজের জন্য বিলেত গেল এবং বিলেতেই রয়ে গেল। প্রকাশ্যেই নিঃশ্বাস দীর্ঘ হয় ব্রততীর।
সুখময়বাবু অনেকবার বলেছেন, “বিলেত শব্দটা আজকাল আর চলে না। ওটা ফিলাডেলফিয়া। পেন্সিলভেনিয়ার সবচেয়ে বড় শহর। আর সব মিলিয়ে ব্যাপারটা আমেরিকায়।”
ব্রততী কিছুতেই মনে রাখতে পারেন না। যেমন সুখময়ও আজকাল ভুলে যান বাজার থেকে কী কী আনতে হবে, ডিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোন। ব্রততী কি আজ মুরগীর ডিম আনতে বলেছিল? বলে থাকলে ক’টা? বিউলির ডাল নাকি মুসুর, কোনটা ফুরিয়েছে? ক’দিন দেখে ব্রততী বলেছিলো, “আর পারিনে বাপু, এক কাজ কর, চোখের সামনে যা দেখবে, তাই কিনে আনবে। ফ্রিজে রেখে দেব।”
অবশ্য এই করতে গিয়ে ফ্রিজে কাতলা মাছের পরিমাণ এত বেড়ে উঠল যে শেষে ব্রততীই একটা করে লিস্ট ধরিয়ে দিত হাতে। এবার নিশ্চিন্তি। লিস্ট ধরে ধরে কিনে আনলেই হল। ব্রততী চিরকালের হিসেবী মানুষ। সুখময় হেসে বলেন, “আর অত হিসেব করে খেয়ে কী হবে? টুটুল যা ডলার পাঠাচ্ছে, তা তো ব্যাঙ্কেই জমছে। আমার পেনশনের টাকাই সবটা খরচ করে উঠতে পারি না।”
ব্রততী হাতের হলুদ আঁচলে মুছে বলেন, “তা বললে হবে? বিলেতে আজকাল যা শুনছি। চাকরি বাকরির নাকি ঠিক নেই। আজ আছে, কাল নাকি ফুড়ুৎ! না হলে হতে কতক্ষণ? তখন কত করে বললাম, ছেলেকে বিলেতে পাঠিও না। সেই তো শেষে সব হারিয়ে মারিয়ে কাশ্যপগোত্র হয়ে ফিরে আসবে। আর তুমি এটা ছাড়ো দেখি বাপু। তিন কাল পেরিয়ে গেলো আর….’
ব্রততীর যাতে চিরকালের আপত্তি, সেই সিগারেট একটা ধরিয়ে আরাম করে টান দিয়ে সুখময় বললেন, ‘কী কথায় কী এনে ফেললে? বলি, টুটুল দেশে ফিরে এলেও কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে? নিশ্চয়ই একটা চাকরি জুটিয়ে নেবে। এখনও আমার যা সোর্স আছে তাতে করে…। তাহলে? আর আমি মারা গেলে যা রেখে যাব…”
কথা শেষ করতে দিলেন না ব্রততী। ইউ টার্ন নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, “আর ছেলের বিয়ে? তাতে খরচ নেই?”
“আরে ধুর। আজকালকার ছেলে। তোমার ভাষায় বিলেত ফেরত। পাত্রী ঠিক জুটে যাবে। তুমি এক কাপ চা দাও দেখি। সারাজীবন তো হিসেব করলে…”
সে কথায় কান না দিয়ে ব্রততী বললে, “তা যা বলেছ। কিন্তু…”
থেমে গিয়ে ব্রততী ঢুকে গেলেন রান্নাঘরে। ঘণ্টাখানেক পরে নানান রান্নায় হাতা খুন্তি নাড়তে নাড়তে টের পেলেন তার মাথার চিন্তাটা যাচ্ছে না। কুট কুট করে কামড়েই যাচ্ছে। আচ্ছা, টুটুল যদি….
ফোনটা এসেছিল গত সোমবার। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে ব্রততী বসেছিলেন ফোনটা হাতে ধরে। বার বার তাকাচ্ছিলেন দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। ব্রততী ফিলাডেলফিয়া শব্দটা ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু এই ক’বছরে এটা তার মজ্জায় ঢুকে গেছে যে, ভারতীয় সময় দুপুর তিনটে মানে ঐ দেশে এখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। প্রতি সপ্তাহের সোমবার। ব্রততী সারা সপ্তাহ অধীর আগ্রহে বসে থাকেন এই দিনটার জন্য। টুটুল ঘুম থেকে উঠে ফোন করবে তাকে।
করেওছিল। ছেলের সাথে এটা সেটা কথা বলেন ব্রততী। খানিক কাজের, খানিক অবান্তর। তবে সব ছাপিয়ে টুটুলের শরীরখানা ঠিক আছে কিনা এটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিতে ভোলেন না। এই প্রসঙ্গে সুখময় তাকে অনেক বুঝিয়েছেন, কিন্তু ব্রততী সেই পাত্রীই নন। তার একমাত্র ছেলে যে মায়ের হাতের রান্না খেতে না পেরে অ্যাদ্দিনে শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে এই বিষয়ে গভীর বিশ্বাস এবং আক্ষেপ তার। ফোন রেখে দু চার ফোঁটা চোখের জলও খরচ করেন তিনি। সুখময় হেসে বলেন, “প্রতি মাসেই তো এক গাদা করে ছবি পাঠায় মেলে, দেখতে পাও না? ছেলে তোমার দিব্য আছে। বরং মুটিয়েছে খানিক। বাজে কথা না বলে যাতে আজে বাজে খাবার না খায়, রেগুলার এক্সারসাইজ করে, সেটা বলে দাও।”
ব্রততী ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “কোথায় মোটা? ঐ তো কন্ঠার হাড় দেখা যাচ্ছে। ইস, কবে যে দেশে ফিরবে।”
সুখময় মনে মনে বলেন, “আর ফিরেছে তোমার ছেলে।”
সুখময়ের চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সে সন্তানের ব্যাপারে কোনও অযথা আগ্রহ প্রকাশ করে না। তার সাফ কথা, বড় করে দিয়েছি, এবার নিজেই চরে খাও। তার বাবা এইরকম ছিলেন। ছোট থাকতেই সুখময়কে পাহাড়ের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরেও কদাচিৎ বাবার দেখা পেতেন তিনি। এমনকি যখন তিনি সাউথ দিনাজপুরের ডিএম হয়ে এসে বাবাকে প্রণাম করেছিলেন, সামান্য হেসে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। মায়ের ইচ্ছে ছিল না, তবু বাবাই আদেশ দিয়েছিলেন একপ্রকার, “ওখানে থেকেই কাজ কর, ঘনঘন বাড়িতে আসতে হবে না। মনে রেখ কাজে-অকাজে, অজুহাতে বাড়ি ফিরে আসার প্রবণতাটাই বাঙালী ছেলেগুলোকে কূপমণ্ডুক করে রেখে দিলো আজীবন। আশা করি তুমি তা হবে না।”
এমনকি ছেলের বিয়ের সময়েও তিনি সাফ বলে দিয়েছিলেন, “তুমি যাকে বুঝবে, যে তোমার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে পারবে, তাকেই বিয়ে কর। আমাদের কোনও মত-অমত নেই।”
সেই ব্যাপারটা সুখময়ের মধ্যেও রয়েছে। অবশ্য ছেলে মানুষ করতে সে পিছ পা হয়নি কোনদিনই। টুটুল আসার পরে মাঝেমধ্যেই ব্রততী অসুস্থ হয়ে পড়তেন। সুখময় যখন অফিসে থাকতেন ততক্ষণ মান্তুর মা চালিয়ে নিতো। কিন্তু সন্ধ্যের পরে তো মান্তুর মা আর থাকত না। তখন দেখেছে ব্রততী। অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই লোকটা লেগে যেত কাজে। টুটুল হয়তো পটি করে ফেলেছে মেঝেয়। সেই কোত্থেকে একটা পোস্টকার্ড জোগাড় করে সেইসব সাফ করে ফেলতেন সুখময়। তারপর দুধ গরম করা, ভেজা কাঁথা ধুয়ে দেওয়া কত কী। মান্তুর মা সকালে এসে রাগারাগি করত, “দাদাবাবু এইসব করে কেন? সকালে আমি এসেই তো ধুয়ে ছাদে মেলে দিতে পারি।”
কিন্তু সুখময় শুনতেন না। ছেলের কাজ নিজের হাতে করাটা যেন একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল লোকটার। তারপরে সেই ছেলেকে নিয়ে ছাদে ঘুরতে ঘুরতে ঘুম পাড়ান। কতদিন হয়েছে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ব্রততী দেখেছে, লোকটা ভেজা কাঁথা পাল্টে দিচ্ছে, নয়ত জল গরম করছে। কিছু বলতে গেলেই সুখময় বলত, “তুমি আবার জাগলে কেন? আমি আছি তো।” আবার পরদিন ঠিক সময়ে হাঁটতে বেরিয়ে যাওয়া।
বলতে গেলে ব্রততী শুধু ছেলেরর জন্য চাড্ডি রান্নাই করেছে সারাজীবন। তা বাদে টুটুলের পড়াশোনা, হোম-টিউটর, স্কুল-টাস্ক, পুজোর জামাকাপড়, জুতো সবেতেই সুখময় ছিল একাই একশো। ব্রততী ভেবেছিলেন, ভাগ্যিস শ্বশুরের স্বভাব পায়নি।
যেদিন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে ফর্ম ভর্তি করেছিল টুটুল, অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠেছিল ব্রততীর। যাওয়ার দিন মান্তুর মা অবধিও চোখের জল ফেলেছিলো। একমাত্র সুখময় ছিল নিরুত্তাপ। যেন দিঘায় বেড়াতে যাচ্ছে সপরিবারে, এমন উৎসাহ তখন তার চোখমুখে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে ব্রততী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আঁচলে চোখ চেপে বলেছিলেন, “বাবামশাইয়ের রক্ত তো, সেই রক্তই কথা বলছে আজ। আমারই কপাল!”
সুখময় খুব মন দিয়ে রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে বলেছিলেন, “আমিও কূপমণ্ডুক হইনি, আমাদের ছেলেও হবে না।”
আজ বুধবার। গত পরশু টুটুলের ফোন আসা ইস্তক গুম মেরে গিয়েছিলেন ব্রততী। সুখময়ের কাছে ভাঙতে চাননি প্রথমে।
কী হবে এই নিঃস্পৃহ মানুষের সাথে কথা বলে? কিন্তু শেষ অবধি থাকতে পারলেন না।
সুখময় দুপুরের খাওয়ার সেরে একটা সুপুরির কুচি মুখে ফেলে আড়চোখে স্ত্রীকে দেখেই বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “টুটুলের ফোন আসেনি এই হপ্তায়?”
“আসলেই বা তোমার কী! একদিনও কথা বল ছেলের সাথে? কেমন আছে, কী খাচ্ছে….”
“কী মুশকিল! জিজ্ঞেস করলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? আমি যদি বলি, বাপধন, হটডগ খেও না, চাড্ডি ভাত-ডাল মেরে দাও। কাজ হবে? ওর যাতে সুবিধে….”
“তুমি থাম তো। তোমার মত চুপচাপ থাকতে আমি পারব না। আমি মা। চিন্তা হয় না একটা?”
“চিন্তা করে লাভ? যাক গে। টুটুল কী বলল? এর মধ্যেই বাড়ি চলে আসছে না তো?”
কটমট করে স্বামীর দিকে তাকান ব্রততী। বলেন, “সে তো আসবেই। কিন্তু…”
“আবার কিসের কিন্তু কী! উদ্বাহু হয়ে খানিক নেচে নাও।”
ব্রততী চুপ করে থাকলেন। ভাবনার গতিপথ আন্দাজ করে সুখময় বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে ঘুড়ন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শরীর-টরীর…”
“শরীর ঠিক আছে। কিন্তু একটা ব্যাপার। ভেবেছিলাম বলব না। কিন্তু…”
সুখময়ের দিকে ঘুরে বসলেন ব্রততী, “একটা মেয়ে।”
“মেয়ে?”
“হ্যাঁ। টুটুলকে নাকি রেজন গস্ত না কি, ওসব রান্না করে খাইয়েছে।’
“রেজন!”
“কী জানি। মাংস দিয়ে বানায় টানায়।”
সুখময় আন্দাজ করে নিলেন, “রেজওয়ানি গোস্ত?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। হ্যাঁগো, গরুর মাংস নয় তো?”
সুখময় ফ্যানের দিক থেকে চোখ না ঘুরিয়ে বললেন, “হিসেব মতো তাই তো হওয়ার কথা। তবে গোস্ত মানেই গরু নয়। যে কোনও মাংসই গোস্ত। তাতে…”
সুখময়কে থামিয়ে দিয়ে একপ্রকার আর্তনাদ করে উঠলেন ব্রততী, “মেয়েটা মুসলমান।”
সুখময় শব্দ করে হেসে উঠলেন। তার দুপুরে ঘুমোনোর অভ্যেস নেই। জরাসন্ধ রচনাবলীর তৃতীয় খণ্ডটা হাতে তুলে নিয়ে ‘মসিরেখা’ উপন্যাসের মার্কিং করা পাতাটা খুলে নিয়ে বললেন, “তাতেই বা কী হল? মেয়েটার ছবি দেখেছ?”
যেন মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছে এমন মুখ করে ব্রততী বললেন, “মেয়েটা পাকিস্তানী। টুটুল তো তাই বলল।”
বইটা ভাঁজ করে রেখে স্ত্রীকে কাছে টেনে নিলেন সুখময়, “ব্রততী, আজকালকার ছেলেমেয়েদের কোনও জাত হয় না, কোনও দেশ হয় না। ওরা বিশ্বনাগরিক। টুটুলদের মত ছেলেমেয়েরা কেউ পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশী, ভিয়েতনামী থাকে না গো। আর বড়জোর এক বছর। তারপরে দেখবে সবাই আমেরিকান। বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। ব্যস। সবাই এক। নো টাকা, নো রুপি, অনলি ডলার। হাহাহা। বুঝলে কিছু?”
ব্রততী সুখময়ের কাছে সরে এসে বললেন, “ না গো, তোমাকে বলা হয়নি। আজকাল টুটুল কথায় কথায় ওদের ধর্মের খুব প্রশংসা করে, আচ্ছা, ওরা বিয়ে করে নেবে না তো?”
“করলেই বা তোমার কী? আর যদি একসাথেই থাকে, তবে বিয়ে করে থাকাটাই তো বেটার। তাই না?”
“আঃ। আমার একমাত্র ছেলে। সে মুসলমান বিয়ে? আমি মানতে পারব না বাপু।”
“তোমার মানা না মানায় কী আসে যায়? ওসব চিন্তা বাদ দাও না। আমি নিজে পছন্দ করে তোমাকে বিয়ে করেছি। আমার ছেলেও তাই করবে এটাই স্বাভাবিক। সে বুঝবে কার সাথে সে ভাল থাকবে। সেখানেও নাক গলাবে তুমি? টেনশন কোর না। বেশি টেনশনে ছেলের কিস্যু যায় আসবে না, তোমার সুগার বেড়ে যাবে। বাই দ্য ওয়ে, মেয়েটার নাম কী?”
“সে সব কি ছাই জানতে ইচ্ছে করে? আমার ছেলেটা…”
“আসবে বলে কিছু জানালো কি?”
এবার সামান্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল ব্রততীর মুখ, “আরে আসল কথাটাই তো বলা হয়নি তোমায়। টুটুল আসছে। মাস দুই লাগবে। বলল তো ভিসা কনফার্ম হয়ে গেলেই জানাবে। আবার মেয়েটাও না পোঁ ধরে এসে হাজির হয়। হ্যাঁগো, মেয়েটা আবার টুটুলকে মুসলমান বানিয়ে দেবে না তো?”
“সেকি? খামোখা মুসলমান বানাতে যাবে কেন টুটুলকে?”
“মানে, আমি শুনেছিলাম গো। ওদেরকে বিয়ে করতে গেলে নাকি ধর্মান্তরিত-টরিত হতে হয়।”
“ব্রততী, এটা একবিংশ যুগ। তুমি কোন যুগে আছ? তুমি একটা কাজ করতে পারবে? খুব দরকারি।”
উৎসুক মুখে তাকায় ব্রততী। সুখময় বলে, “তুমি ঘুমিয়ে পড়। দুপুরে না ঘুমোলে তোমার না মাথা ধরে?”
আগুন চোখে একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ব্রততী।
এক সপ্তাহ পরে। চিরাচরিতভাবে সুখময় দুপুরে জরাসন্ধ পড়ছিলেন। আচমকা ঝড়ের মত ঘরে ঢুকলেন ব্রততী। সুখময় চমকে তাকাতেই দেখলেন ব্রততীর চোখ মুখে খুশি উপচে পড়ছে। সুখময় বই নামিয়ে রেখে প্রশ্ন করলেন, “তারিখ জানাল বুঝি?”
“হ্যাঁগো। আঠাশে জুলাই। এবার কনফার্ম। ভিসা হয়ে গেছে। ইসস আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে। তোমার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে?”
ব্যঙ্গটা বুঝলেন সুখময়। তিনি হেসে বললেন, “হ্যাঁ। হচ্ছে। মানে হবে আর কী! যখন শেষমেশ তোমার ছেলে জানাবে বিশেষ কোনও কারণবশত সে আসতে পারছে না।”
“ধ্যাত, খালি অমঙ্গুলে কথা তোমার। আর সবচেয়ে বড় কথা কি জান? মেয়েটা আসছে না।”
“ভগবান!”
“সে তুমি যাই বলো, আমি আমার টুটুলের বিয়ে কিছুতেই মুসলমানের মেয়ের সাথে… যাক গে। টুটুল আসছে এটাই বড় কথা।”
সুখময় ফের জরাসন্ধ তুলে নিলেন, “ক’দিন থাকবে কিছু বলল?”
“ও আবার কী কথা। নিজেদের ছেলে নিজের বাড়িতে থাকবে, তাতে আবার দিনক্ষণ কী? আর কী হবে বল তো এই বিশাল বাড়িটা নিয়ে? আমরা আর কদ্দিন? এরপরে…”
“ব্রততী, ব্রততী, সিরিয়ালের ডায়লগ মুখস্থ বোলো না। অসহ্য লাগে।”
মানুষটার এই গলার আওয়াজের সাথে ব্রততী পরিচিত। তিনি চুপ করে গেলেন। ঘুমিয়ে পড়ার আগে মনে মনে তার ইতিকর্তব্য ঠিক করে নিলেন। টুটুল চলে যাওয়ার পরে দোতলায় ওর ঘরটা বন্ধই পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে মান্তু’র মাকে বলেন তালা খুলে ঘরটা ঝাড়পোঁছ করে রাখতে। আসলে ঐ ঘরটায় গেলেই ব্রততীর মন ভারি হয়ে যায়। ঘরের দেওয়াল জুড়ে টুটুলের নানান বয়সের ফটোগ্রাফ। দেওয়ালের তাকে ছোটকালের একটা টেডি বিয়ার, এক পায়ে দোল খাওয়া পুতুল, গলায় স্প্রিং দেওয়া তুলোর দাদুমূর্তি আরও কত কী! টুটুলের একপ্রকার শখ ছিলো পুরোন গিফটগুলোকে সাজিয়ে রাখা। মাঝে মধ্যে সেগুলোকে নেড়েচেড়ে দেখা। নিজের দুবছর বয়সের জামাটাও ফ্রেমে সাজিয়ে টাঙিয়ে রেখেছে দেওয়ালে। ব্রততী জানেন, চেহারায় যতই লম্বা-চওড়া হোক, ছেলে তার সেই ছোট্টটিই রয়ে গেছে। এখনও হাতে একটা পুতুল ধরে দিলে সে খেলতে বসে যাবে হয়ত।
এই ঘরের মালিক আসছে। ব্রততী ঠিক করলেন কাল সকাল থেকেই তাকেই নেমে পড়তে হবে। মান্তু’র মা অ্যাদ্দিন কী কাজ করেছে না করেছে, সে সব কাল সকালে নিজের চোখে পরখ করে দেখবেন। ঘরে নতুন পর্দা টাঙাবেন, পাল্টাবেন বিছানার চাদরটাও, ঝাড়পোঁছ তো আছেই। সবই ঠিক আছে, শুধু ঐ মেয়েটার কাঁটাটা থাকলে… ব্রততীর মন খচখচ করতে লাগল। হাতের কড়ে হিসেব করে দেখলেন আঠাশে জুলাই আসতে এখনও এক মাস তের দিন বাকি। এরপরে কেটে গেছে দিন কুড়ি। ব্রততী আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। মাঝে একবার সুখময় হাল্কা আওয়াজ দিয়েছেন, “মনে হচ্ছে ছেলের বিয়েটাও একবারে দিয়ে দেবে, আসা মাত্রই?”
ব্রততী কথার উত্তর দেন না। এই লোকটার ছোটখাট উপহাসে আজকাল আর রাগ হয় না তার। এর মধ্যে নিয়মমাফিক ছেলের ফোন এসেছে বার তিনেক। একবার ব্রততী ইচ্ছে করেই ঐ মেয়েটির প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। হাল্কা হ্যাঁ-হুঁ করে এড়িয়ে গেছে টুটুল। ব্রততীও আর ঘাঁটাননি। অপ্রিয় প্রসঙ্গ যত কম তোলা যায় ততই ভাল। শেষ ফোনটার মেয়াদ অবশ্য মিনিটখানেক ছিল। কী একটা কাজে খুব ব্যস্ত ছেলে। অত ভোরে কী কাজ থাকতে পারে, যাতে মায়ের সঙ্গে আরও মিনিট তিনেক কথা বলা যায় না? নাহ, ব্রততী ঠিক করেছেন টুটুল দেশে ফেরা ইস্তক আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না তিনি। বলা তো যায় না। আজকালকার ছেলে। মায়ের কোন কথায় কী ভেবে বসে, শেষে হয়ত আসাটাই বানচাল করে দেবে। নাহ, থাক বাবা। ব্রততী দুহাত তুলে অদৃশ্য ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানান।
চার পাঁচ দিন পরের কথা। সুখময় তার দৈনন্দিন বিকেলের বেরানো সেরে এসে বসেছেন সোফায়। এই গরমের দিনে বেলা পাঁচটাতেও যেন রোদের তেজ মরছে না। সুখময় অনুভব করলেন তার সারা গা ঘামে ভিজে গিয়েছে। একটা শাওয়ার না নিলেই নয়।
ইতিমধ্যে ব্রততী এক কাপ চা এনে রেখেছেন সামনে। সঙ্গে দুটো বিস্কুট। সুখময় সবে সিগারেটটা ধরিয়েছেন এমন সময় তার মোবাইল বেজে উঠল। এমনিতে সুখময়ের মোবাইলে বিশেষ কেউ ফোন করেনা। করলেও সামান্য ছুটকোছাটকা কথাবার্তা। মাঝেমধ্যে মুম্বাইয়ের এক প্রবাসী বন্ধু ফোন করে, তখন সময় কীভাবে কেটে যায় বোঝাই যায় না। কিন্তু সে তো ফোন করলে করে সকালে। আর টুটুল ফোন করলে তো ওর মা’র নাম্বারেই করে। সুখময় হ্যান্ডসেটটা হাতে তুলে চমকে উঠলেন। বিদেশের নাম্বার। তিনি প্রথমে রিসিভ করলেন না। এইরকম আজকাল প্রচুর ফোন আসে লোকের কাছে। সব ফ্রড। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নানান ফিকির। ফোনটা বেজে বেজেই কেটে গেল একসময়।
পরক্ষণেই ফোনটা ফের বেজে উঠল। সেই এক নাম্বার। দোনামোনা করে কলটা রিসিভ করলেন সুখময়। ‘হ্যালো’ বলতেই চোস্ত ইংরেজী ভাষায় কেউ একজন পুরুষ কন্ঠে তার নামটাই বললেন, যদিও বিকৃত উচ্চারণে। সুখময় সম্মতি জানালেন। সুখময়ের ফোনের আওয়াজে ততক্ষণে ব্রততী এসে দাঁড়িয়েছেন। ব্রততী সর্বদাই ভাবে, কোনও ফোন আসলেই বুঝি সেটা টুটুলের হবে।
সুখময় ফোনের ওপারের মানুষটার বক্তব্য এক মনে শুনলেন। শুনতে শুনতে তার হাতে ধরা সিগারেটটা খসে পড়ে গেল মেঝেয়। খানিক পরে ফোনটা সোফায় রেখে থম মেরে বসে থাকলেন সুখময়। ব্রততী উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলেন। বারচারেক অনুরোধ করবার পরে সুখময় মুখ খুললেন। অত্যন্ত স্খলিত গলায় জানালেন, কেউ একজন আমেরিকা থেকে ফোন করেছিল। শুভ মিত্র অর্থাৎ টুটুল যে শহরে থাকে সেই শহর থেকেই ফোন। এইটুকু বলে সুখময় বসে রইলেন বজ্রাহতের মত। কাঁদো কাঁদো হয়ে ব্রততী জিজ্ঞেস করল, “ওগো, টুটুলের কোনও খবর? কোনও বিপদ-আপদ হয়নি তো?”
ঝাড়া দিয়ে সুখময় উঠে পড়লেন সোফা থেকে, “ধ্যাত, কী সব বাজে খবর। লোকটা কী বলে জান? শুনলেও হাসি পায়। বলে শুভ মিত্র যে নাকি লাস্ট উইকে ফারহান ইমরোজ রিজভী নামে কনভার্টেড হয়েছে আর সে নিখোঁজ। কোনও মানে হয়?”
ব্রততী সোফায় বসে পড়লেন, “মানে?”
“মানেটা কি আমিই বুঝতে পারলাম? তোমার ছেলে নাকি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। যত্তসব ফার্স। টুটুল ফর নাথিং কনভার্টেড হতেই বা যাবে কেন? সেটা বড় কথা নয়। ওকে নাকি আবার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেটাই চিন্তার।”
ব্রততী এইবার হাউমাউ করে উঠলেন, “টুটুল মুসলমান হয়েছে? কী বলছো গ? কী শোনাচ্ছ? ঐ মেয়েটা, আমি বলেছিলাম, ঐ মেয়েটাই যত নষ্টের গোড়া। নিশ্চয়ই ওকে বিয়ে করেছে আর বাধ্য করেছে… আমি বলেছিলাম, বলেছিলাম তোমাকে। তখন আমার
কথায় কান দাওনি।”
সুখময় হাল্কা ধমকে উঠলেন, “তুমি চুপ করবে? একটু ভাবতে দাও। কনভার্টেড হওয়ার সাথে নিরুদ্দেশের কী সম্পর্ক?
নিশ্চয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। তোমাকে বলেছিল না, আঠাশ তারিখে আসছে?”
“বলেছিল গো। একবার নয়, যতবার ফোন করেছে ততবার বলেছে। সাতাশ তারিখে ভোরে ফ্লাইট ধরে ঐ ফিলাফিয়া না ঢিলাফিয়া সেখান থেকে দিল্লি। সেখান থেকে ফের প্লেনে বাগডোগরা। সেখান থেকে…”
কথা শেষ করতে পারলেন না ব্রততী। চোখে আঁচল চাপা দিলেন। কান্নার বেগ থামলে তিনি বললেন, “আমার টুটুল কী হয়েছে বললে? ফারহান…?”
খুব ধীরে ধীরে শব্দ ক’টা টেনে টেনে উচ্চারণ করলেন সুখময়, “ফারহান ইমরোজ রিজভী।”
“হ্যাঁগো। ফারহান মানে কী গো?”
“জানি না।”
বাল্যবন্ধু অমরেশ ফোন করলেন, “খবরটা দেখেছিস তুই? সত্যি নাকি রে?”
সত্যি মিথ্যে কী বলবে ভেবেই পেল না সুখময়। ঘরে একটা টেলিভিশন সেট আছে বটে কিন্তু টিভি দেখা সুখময়ের ধাতে সয় না। এমনকি খবরের চ্যানেলও সে দেখে না। তার মতে ছাপার অক্ষর পাঠ করে যে আনন্দ, সেটা পর্দায় নেই। ব্রততীও যে খুব একটা অ্যাডিক্টেড তাও নয়। সে দিনে বেছে বেছে গোটা তিনেক ডেইলি সোপ দেখে। ব্যস।
সুখময় ভারি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী ব্যাপার? আমি তো কিছুই জানি না।”
অমরেশ বললেন, “ওহ! তুই ফোনটা কাট, টিভি দ্যাখ আগে।”
সুখময়ের একবার মনে হল অমরেশটা শেয়ার-বাজারের পোকা। হয়ত শেয়ার বাজারে ধ্বস নেমেছে, নয় উঠেছে। আর তাতেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে। বহুবার এই শেয়ার বাজারে তাকে ঢোকাবার জন্য, একটা ডি-ম্যাট না সি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট কী বলে, খোলাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। সুখময় সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, অনেকদিন চাকরি-বাকরি করে সে ক্লান্ত। এইবার বাকি জীবনটায় আর এক্সেস মেন্টাল প্রেশার নিতে রাজি নয়। ব্রততী কাছেই ছিল। তাকে, ‘রিমোটটা কোথায় রেখেছো?’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার হ্যান্ডসেটটা আরেকবার বেজে উঠলো। নাম্বারটা দেখে একবার বুক কেঁপে উঠলো সুখময়ের। সেই বিদেশী নাম্বার! ফোনটা ধরে বেশ কিছুক্ষণ শুনলেন তিনি।
ইতিমধ্যে ব্রততী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। সুখময় ফোনটা রাখতেই তিনি ঝটপট বললেন, “কার ফোন?”
“আবার আজে বাজে কথা বলছিল। তুমি একবার টিভিটা চালাও তো। নিউজ চ্যানেলটা দিও।”
টিভি খুলতেই বেশ কিছুক্ষণ এ জায়গা ও জায়গার খবর দেখানোর পরে সেই খবরটা চোখের সামনে এল ব্রেকিং নিউজের তকমা পরে। আজ আমেরিকান সময় সকাল সাড়ে ন’টার কিছু পরে ফিলাডেলফিয়ার চার্চে একটি সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয়। প্রায় পনের মিনিট ধরে চালানো এই তাণ্ডবে গির্জার প্রার্থনা উপলক্ষ্যে জমায়েত হওয়া ভক্তদের মধ্যে একুশজন নিহত আর জনা চল্লিশেক আহত। গির্জার সিসিটিভি ক্যামেরায় সম্ভাব্য চারজন সন্ত্রাসবাদীর ছবি শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। তার মধ্যে একজন ভারতীয়। নাম ফারহান ইমরোজ রিজভী ওরফে শুভ মিত্র। বাড়ি ইণ্ডিয়ার ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেটে। বাড়ির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। চারজনের মধ্যে একজন ধরা পড়েছে। বাকি তিনজন ফেরার।
টিভিতে দেখাচ্ছে সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদীদের ছবি। সুখময় টিভির পর্দার আরও কাছে এগিয়ে গেলেন। ফারহান ইমরোজ রিজভী নামক ব্যক্তির মুখটা কালো কাপড়ে ঢাকা। মাথাটাও কাপড়ে আবৃত। সুখময় বিড়বিড় করে বললেন, “এটা টুটুল? ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি একবার দেখ তো।”
বার কয়েক ডেকেও সাড়া না পাওয়ায় সুখময় চেয়ে দেখলেন ব্রততী কখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে সোফার উপরে।
মোটামুটি ভোরের আলো ফোটার আগেই এক অভাবিত চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল সুখময়-ব্রততী’র। সুখময় তখন সবে উঠবো উঠবো করছেন।
তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলেন। এ কী! তার বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে রীতিমত ভিড় লেগে গেছে। প্রচুর মানুষ। তাদের কারও হাতে বুম, কারও হাতে খাতা পেন। একটা ক্যামেরা ভ্যানকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি। ব্যাপারটা কী! পরবর্তী আরেকটা ব্যাপারও চোখে এল। কোথা থেকে চার-পাঁচটা পুলিশ এসে হাজির হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন সেই ভিড় সামলাতে লেগে পড়ল আর একজন, হোমরা-চোমড়া গোছের পুলিশ অফিসার, তার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সদর দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। এইবার আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। দরজা খুলে অফিসারকে ভেতরে আসতে দিলেন সুখময়বাবু।
স্নান-খাওয়াদাওয়া সব মাথায় উঠল। দফায় দফায় পুলিশ এল আর গেল। তাদের কী বিচিত্র সব প্রশ্নাবলী! বিকেল নাগাদ অস্থির হয়ে উঠলেন সুখময়বাবু। ব্রততীও এই ম্যারাথন জেরার প্রকোপ থেকে বাদ গেল না।
তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। এর মধ্যে সাংবাদিক আর পুলিশের জিজ্ঞাসা আর জিজ্ঞাসায় জেরবার হয়ে গেলেন মিত্র দম্পতি। মোটামুটি একই ধারার প্রশ্ন, সামান্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এও শোনা গেল বিদেশ থেকে নাকি ইন্টারপোল থেকে কে একজন আসছেন, এই এসে পড়লেন বলে।
ব্রততীর ফোন এর মধ্যে বেজেছিল একবার। সুখময় আগেই জানতেন তাদের ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে। তাই তিনি ব্রততীকে বলেই দিয়েছিলেন, এমন কোনও কথা সে না বলে, যাতে সামান্য খেয়ে পরে থাকাটাও মাথায় উঠে যায়। সেই কথা মাথায় রেখে ব্রততী ফোনটা ধরতেই ওপার থেকে একটা নারী-কণ্ঠ ভেসে এসেছিল। তার হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত ভাষা বুঝতে না পারলেও দুটো তিনটে কথার পরেই ব্রততী বুঝতে পেরেছিলেন, এ সেই মেয়েটি। ফোনটা সুখময়ের কানে ধরতেই সুখময় যেটুকু সারমর্ম বুঝতে পেরেছিলেন, তা হল, শুভ মিত্র নিজের ইচ্ছেয় ধর্মান্তরিত হয়েছিল এবং সেটা নাকি এক মহৎ উদ্দেশ্যে। সারা পৃথিবীকে শোষক-মুক্ত করে ওরা এমন এক পৃথিবীর জন্ম দিতে চলেছে, যেখানে এই সুন্দর পৃথিবীর প্রতিটি শিশুই যাতে স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারে, কোনও শিশুকেই যেন আর অভুক্ত থেকে মরতে না হয়। সব মিলিয়ে এক বড় সুন্দর এক সাম্যবাদী পৃথিবী। আর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা।
কিন্তু তার আগে রাক্ষসগুলোকে খতম করতে হবে। মেয়েটিকেও বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো শুভ মিত্র ওরফে ফারহান ইমরোজ রিজভী, কিন্তু মেয়েটি মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। অতঃপর তাকে ফেলে চলে গেছে শুভ। মেয়েটি শুভকে ভালোবেসেছিল।
আরও অনেক কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল মেয়েটি। গলায় কান্না স্পষ্ট। সুখময় ফোন কেটে দিলেন এবং প্রস্তুত হলেন কাল সকাল থেকে আরও বেশি করে পুলিশি অত্যাচারের সম্মুখীন হতে। স্বয়ং সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে জড়িত কথাবার্তা! পুলিশ ছেড়ে দেবে?
রাতে আজকাল আর ঘুমোন না ব্রততী। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে সুখময় দেখেন ব্রততী বিছানায় উঠে বসে আছেন পাথরের মূর্তির মত। আজকাল আর কোনও কাজ করেন না ব্রততী। মান্তুর মা-ও আর আসে না। সুখময়ের রুটিন ভেঙে চৌচির। একদিন বিকেলে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, পাড়ার লোক হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। তবে কিছুক্ষণের জন্য। পরমুহূর্তেই সরে পড়ছিলো চট করে। সুখময় নিজেই সংসারের নানা কাজ করেন। তাদের বাড়ি ছেড়ে বেরোনো মানা করে দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
ব্রততী শুধুমাত্র একটি বাক্যই উচ্চারণ করেন আজকাল। একটা প্রশ্ন। সুখময়কে করেন। জানালা দিয়ে রাহাচলতি কাউকে দেখতে পেলেই করেন। চারদিকে কেউ না থাকলেও চিৎকার করে করেন। একটাই জানার ইচ্ছে তার, “ফারহান শব্দের মানে কী?”
সুখময় গুগল সার্চ করে দেখেছেন ফারহান শব্দের অর্থ হ্যাপিনেস। কী এক আশ্চর্য সুখের সন্ধানে বেরিয়ে গেছে তাদের একমাত্র ছেলে! নাহ, ব্রততীকে এসব বলে আর লাভ নেই।
আজ আঠাশে জুলাই। ভোর রাতে কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সুখময়ের। কলিং বেলটা বেজে যাচ্ছে বার বার। শব্দে ঘুম ভেঙেছিল ব্রততীরও। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে দরজার দিকে দৌড়ে যেতে গিয়ে পড়ে গেলেন মেঝেয়। মাথাটা মেঝেয় ঠুকে গিয়ে
রক্ত বেরিয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে। সুখময় শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘করছটা কী? কোথায় যাচ্ছ?’
ঐ অবস্থাতেই ব্রততী বললেন, “শুনতে পাচ্ছো না? টুটুল এসেছে। ওগো টুটুল এসেছে। দরজাটা খুলে দাও। আজ যে আঠাশে জুলাই।”
সুখময় জানেন কারা এসেছে। তিনি ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
বুঝলেন ঝড় আসছে।