অরণ্য ভ্রমণের পাঠ
মেঘনা রায়
অচেনা ঝরনার কাছে অবহেলে হেঁটে যাওয়া খুব সহজ নয়। মাতাল জঙ্গুলে গন্ধ তীব্র এক পিছুডাক ছড়িয়ে রাখে। ব্যস্ত সড়ক পথ রহস্য রাখে না। সে বড় সোজাসাপটা, খোলামেলা। তাই তাকে পড়ে নেওয়াও সহজ। কিন্তু ইতস্তত সবুজ আলোয়ান গায়ে জঙ্গুলে সুঁড়ি পথে হঠাৎ আ্যালার্ম কল কিম্বা গাড়ি বিগড়ে গিয়ে বিশাল ঘাসের জমিতে চিতলের সাথে অনর্গল বৃষ্টি ভেজা আলাভোলা সবুজের কাহিনি প্রলম্বিত রেশ রেখে যায়। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই বিভূতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহর জঙ্গলময় পাঠশালায় আমার নাম লেখানো। ওঁদের হাত ধরে এবারের হঠাৎ জঙ্গল সফর আদপে হাতেকলমে শিক্ষার পাঠ বৈ তো নয়। নিঃস্বার্থ ভাবে শুধু মাত্র জঙ্গল আর বন্য প্রাণীকে ভালোবেসে তাদেরই রাজপাটে কটা দিন কাটানো। আমাদের যত রকমারি জঙ্গুলে বন্ধু আছেন যারা বেড়ানো বলতে কেবল জঙ্গলই বোঝেন তাদেরও চমক দেবার জন্যই এই অরণ্য বি আর হিলসকে ঘিরে এবারের কিসসা। প্রথমে উড়ান পথে ব্যাঙ্গালোর, তারপর গাড়ি বাহনে মাইসোর হয়ে ১৭৩ কিলোমিটার পথ। গনগনে গরমের মধ্যে দিয়ে একটানা ব্যাঙ্গালোর থেকে পথের ধুলো খেতে খেতে আসছিলাম। আমাদের ড্রাইভার সাহেব ধবধবে সাদা উর্দির এক অতি সজ্জন মানুষ। তবে হালকা তালকানা আছেন বলেই রাস্তা গুলিয়ে এপাশে-ওপাশে নাচিয়ে খেতের পাড় ধরে ধুলো ওড়াতে ওড়াতে একেবারে ডাঁই করা আখের সামনে এসে গাড়িখানা দাঁড় করিয়েছেন। সেই সুযোগে আখ চাখাও হল আবার রাস্তার হদিসও পাওয়া গেল। জানালা দিয়ে ভারী শুকনো লু বইছে। মনের সুখে দু পাত্তর মিষ্টি আখের রস পেটে পড়া মাত্রই দু-চোখে দুপুর বাবুর ঘুম একেবারে ঝুপ করে নেমে এল। সেই সুখনিদ্রা ভাঙতে ভাঙতে রাস্তার দু’ধারে কাবেরী নদীর জল নিয়ে আদালতের রায়ে অখুশি মানুষের মিছিল টপকে রুক্ষ সবুজ প্রকৃতিকে ধুলো ধোঁয়া মাখিয়ে বিলিগিরিরঙ্গনাবেট্টা (বি আর হিলস) পাহাড়ের মধ্যে ঢুকে গেলাম। এখানে বলা প্রয়োজন নদী কাবেরী নয়, আমাদের গন্তব্য কাবেরীরই এক শাখানদী কাব্যময়ী কাবিনীর আশ্রয়জাত অরণ্য। আমরা হলাম গিয়ে শহুরে লোক, সামাজিক গৃহপালিত, জঙ্গলের বর্গীয় জ নিয়ে যাদের কোনো ধারণাই নেই। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম কী করে একটা সটান রাস্তা ফস করে জঙ্গল হয়ে যায়। ডায়নে বাঁয়ে যত দূর চোখ যায় পাহাড়ের ওপর থেকে নীচ অবধি ঘন সবুজের বল্লরী ওম। বেলা শেষের সোনালি রোদ জরির নক্সা বুনছে ঐ শ্যামল অঙ্গবাসে। বাঁ দিকে নদীর ভগ্নাংশে একটা বাইসন জল খাচ্ছে। তার একটু বিলম্বিত ধ্যাবড়ানো ছায়া পড়েছে জলে। ঐ তো ফরেস্ট লজের প্রবেশ মুখের রাস্তায় দুটো ময়ূর কী সুন্দর যেন র্যাম্পে ক্যাট ওয়াক করছে। ময়ূর থেকে চোখ সরাতে না সরাতেই ঝোপের আড়াল থেকে কয়েকটা স্পটেড ডিয়ার বেরিয়ে বিদ্যুদবেগে ভ্যানিশ হয়ে গেল। আমি বিড়বিড় করে বললাম ‘ব্যাম্বি’। ড্রাাইভারজি সবেগে উত্তর দিলেন, বাম্বু নহী ম্যাডম , ডিয়র হ্যায় ডিয়র।
—রাত যামিনী —
ঘোঁৎ! যে দিকে তাকাচ্ছি সে দিকেই অজস্র দাঁতাল। বুনো শুয়োর আজগুবি সব শব্দ করতে করতে ঘোরাঘুরি করছে। সান্ধ্যকালীন চায়ের আসরে এসেছি গোলঘরে। কিছু শুয়োরের চেহারা দেখলেই মনে হয় তাদের জন্মই হয়েছে গৃহস্বামীর টেবিলে সসেজিত অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু এখানে যাদের দেখছি তাদের শরীর রীতিমতো ব্যায়াম করা। গায়ের ওপর ছাই ছাই রঙের নিপুণ কেশ বিন্যাস। ডাইনিং কাম গোল ঘরটাও ঠিক ঘর নয়। আকাশের নীচে নৈশভোজ করার জন্য একটা খুঁটির ওপর চারদিকে কাঠামো খাড়া করা হয়েছে। মাথার ওপর পাখি আর বাঁদরের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য লোহার জালের শক্ত নেট। এ বাদে গৃহপালিত আর বন্যজন্তুর জন্য অন্তত নৈশভোজের সময় টুকুতে আর বিশেষ কোনও বেড়া নেই। আপাতত ভরা জঙ্গলে গোলঘরের একধারে কাঠের ওপর কাঠ চাপিয়ে বনফায়ারের ব্যাবস্থা হয়েছে। কফি ফলের গন্ধে এখানে সন্ধে নামছে পা টিপে টিপে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা একটা হালকা ভেজা ঠান্ডা বাতাস রকিং চেয়ারে আধশোয়া আমাকে জঙ্গুল ঋজুদা, পৃথু, উত্তর বঙ্গের অর্জুনের কথা মনে করাচ্ছে। জঙ্গলের মহাকাব্যে স্বয়ং বুদ্ধদেব গুহ মনের গভীরে বাসা বেঁধে রয়েছেন। আসলে আমি তো ওনার সৃষ্ট চরিত্রদের সাথেই জঙ্গলে আসতে চাই বারবার। কিন্তু বনের পরে বন, তারও ওপারের বন অন্য কথামালা সাজায়। দূরের গেস্ট হাউস থেকে টেবিল-টেনিস খেলার শব্দ ভেসে আসছে। মৃদু হলুদ আালোয় ঠান্ডা বিয়ারের বোতল বুদবুদ কাটছে। গোলঘরের পেছনে ঝিঁঝিঁর ডাক। মাথার ওপরকার নীলাভ চাঁদ আকাশে বিরামহীন যাত্রাপথে লক্ষ তারার চুমকি দিয়ে ক্যানভাস এঁকেছে। অন্ধকারের প্রাগৈতিহাসিক গন্ধ আমাকে সমূলে নাড়িয়ে প্রাকৃতিক রোম্যান্টিকতার অতলের শেষ ধাপে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে মনের কোনও আগল নেই,শাসন নেই। গোলঘর থেকে একটা কাঁচা রাস্তা এঁকে বেঁকে আমাদের লগহাটের দিকে চলে গেছে। একটু গা ছমছম করা রাস্তার দু’ধারের গাছে গাছে ঝোলানো নিবু নিবু লণ্ঠনের আলো পথ দেখাচ্ছে। নৈশভোজ আর প্রকৃতির সাথে তুমুল রোমান্টিকতা শেষ করে ঘোর বাস্তবের পথ ধরে লগহাটের দিকে হাঁটা লাগালাম। এই একটু খানি সিম্পল রাস্তার মধ্যে কোনও এডভেঞ্চার থাকবে না এমন একটা নিশ্চিত ধারণা নিয়েই অন্ধকার খাড়াই ধরে কিছুটা গিয়েছি মাত্র; কেমন একটা খসখস শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। অন্ধকারে চোখ ধাতস্থ হতে দেখি এক ব্যাটা দাঁতাল তার প্রাইভেট প্রপার্টি রক্ষা করার ভঙ্গিতে তেরিয়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবস্থা বেগতিক দেখে পশ্চাদপসরণ করতে যাচ্ছি দেখি জঙ্গল লজের একটা লোক উর্ধশ্বাসে ছুটে আসছে। স্পষ্ট বাংলায় বলেন, “আরে আরে আপনারা করেন কী? এই অন্ধকারে এমন করে যেতে আছে? বুনো শুয়োর খেপে গেলে বাঘ অবধি মেরে টাগ করে দেয়। আপনারা তো কোন ছার!” আমাদের বিপরীতমুখী সমস্বরের পুলকিত জিজ্ঞাসা “আপনি বাঙালি, বাঃ!”
—ফরেস্ট মডেলচন্দ্র—
আমাদের মতো টুরিস্টদের মনে মনেও একটা চোরা কমপিটিশন থাকে যা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানে এসে ঐটা দেখতে হবে ওমুকটা বাদ গেল, ইশ! কী করে মিসেস দেবরায়কে বলবো সারা দিনমান চক্কর কেটেও আস্ত বাঘ কেন, একটু হলুদ কুচিও দেখতে পাইনি। তাই স্বভাবতই ঐ রিপু দোষেই আমরাও বাঘ দর্শনের জন্য হন্যে হয়ে গেলাম। সেই ভোরবেলার জঙ্গল সাইটিং-এ শুরুর থেকে একগাদা সম্বর হরিণ, জায়েন্ট স্কুইরাল, বার্কিং ডিয়ার, লেঙ্গুর, হাতির পাল, ময়ূর, এক লক্ষ পাখি দেখেটেখে একদম ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে গোলঘরে চা আর টা খাচ্ছি কিন্তু মন বেচারা খুব ঝুলে আছে। তোমার দেখা নাই রে, মামা তোমার দেখা নাই। সুরজিৎ এর সেই বিখ্যাত গানের কলি দৌড়ে বেড়াচ্ছে লগ হাটের এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্তে। হঠাৎ এক নব্যবিবাহিত কাপলের আবির্ভাব। হাই হ্যালো ইত্যাদি কুশল বিনিময়ের পরে কী কী জন্তু দেখলেন প্রশ্ন করলেন তারা। আমাদের উত্তর শুনে চোখ কপালে তুলে বললেন, সে কী, আপনারা এখনও বাঘ দেখেননি? আমি আশ্চর্য হবার সময়টুকুও পেলাম না যেন। কী বলে এরা? বাঘ কি শপিং মলের জিনিস? ইচ্ছে হলেই দেখা যায়? দরদাম করা যায়! ওনারা এমন ভাব করলেন যেন মনে হল চিড়িয়াখানা থেকে বাঘ দেখে ফিরব। পরে হাতরে-পাতরে জানা গেল বর কার্তিকটি শিকারী ফ্যামিলির ছেলে। তাই তাদের এতো বোল-বোলা আর কী! মনটা একটু খিঁচড়ে গেল। যাই হোক বাইরে বেরিয়েই দেখি বোর্ডে লেখা, বিকেল বেলাতেই আর একটা টাইগার সাইটিং হবে। বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না! এবার অন্য বুদ্ধি পাকড়াও করলাম। লজের সব স্টাফদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এখানে বাঘ দেখানোর কেতা লোক আছেন “থাপা সাহেব। এই থাপা সাহেবের সাথে বড়ো বেড়ালদের দোস্তি কিঞ্চিৎ অধিক। লজের পেছন দিকটায় ওনার কোয়ার্টার। গুটি গুটি পায়ে হাজির হয়ে নক করলাম ওনার দরজায়। উনি “কৌন হ্যায়” বলে বেরিয়ে এলেন। বেশ শক্ত পোক্ত চেহারা থাপা সাহেবের। তবে নাকের নীচের গোঁফ জোড়ার বিস্তার দেখে মনে হল এই গোঁফবিলাসী ভদ্রলোক কে দেখে বাঘও বোধ হয় মুচকি হাসে। “গোঁফের আমি গোঁফের তুমি গোঁফ দিয়ে যায় চেনা” এই বাংলা প্রবাদ টা ওনার জানা নেই বলে একটু দুঃখ পেলাম। মহিলা সহযাত্রী হিসেবে এডভান্টেজ নিয়ে আমিও কান এঁটো করা হাসি দিয়ে সোজা ওনার সাথে হ্যান্ডশেক। ঐ শেক অবস্থাতেই আবদারটি পেড়ে ফেললাম। একটু ন্যাকা গলায় বললাম ওনার সাথে বাঘ দেখতে যেতে চাই। উনিও রসিক মানুষ, ধরে ফেললেন বেশ। পরে শুনলাম আমার আবদারটা নাকি অনেকটা কাবাডি খেলতে যাব স্টাইলের বলা হয়েছিল। কারন খোলা জঙ্গলে ফেস টু ফেস বাঘ দেখা তো সহজ কম্ম নয়। প্রথম জঙ্গল ভেঞ্চারে যদি একটা আস্ত বাঘের দেখা কপালে থাকে তবে তার কেতাই আলাদা। যাইহোক নিন্দুকদের কথায় কান দিতে নেই। আসলে বয়সজনিত কারণে উনি সাইটিং করান না এখন, তাই এতো নাটক। উনি শর্ত দিলেন, বাঘ যেখানে থাকে সেখানে আর কেউ থাকে না। হয় বাঘ দেখতে পাবেন নইলে কিছুই পাবেন না—কি রাজি? যা বোঝার বুঝে গেলাম। তিনি দেখা না দিলে সম্বর বা বাইসন কেন একটা বেঙুরেরও দেখা পাব না। খেলতে যখন নেমেছি ময়দান ছেড়ে ভাগব না। অবশেষে রওনা দিলাম দুগ্গা দুগ্গা করে। ওঁর গাড়ি পিচের রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায় নামল। তারপর ঘাসের রাস্তায়। শেষে রাস্তা বলে আর কিছুই রইল না। থাপা সাহেব দুঃখ করলেন আাগে উনি গাড়ি নিয়ে বেরোলেই গোটা দুই বাঘ অন্তত দেখা দেবার সংকল্প নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। আার এখন —ছোঃ! এই সব কথা শুনতে শুনতে বহুদূরে চলে এসেছি | গায়ের ওপর সূক্ষ্ম ধুলোর একটা আবরণ তৈরি হয়েছে। হঠাৎ থাপা সাহেব জিপটা থামিয়ে মুখের ওপর আঙুল রেখে বললেন “শশশ।” কোথাও কোনও শব্দ নেই, বাঘ দেখে বাঁদরের পালিয়ে যাওয়া নেই, শ্বাপদের গন্ধে জঙ্গলের মধ্যে থেকে হরিণের ডাক নেই —সেই অসম্ভব নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু চোখে একটা বাইনোকুলার লাগিয়ে থাপাজির আঙুল ফলো করলাম —বাঘ। জলার ঠিক উল্টোদিকে সে রাজাগজার মতো এলিয়ে পড়ে আছে এক কাত হয়ে। দেখে মনে হচ্ছে যেন সামনের ঘাসের জমি ইজারা নেওয়া আছে। পায়চারি করতে বের হবে তাই রিলাক্স মুড। থাপা সাহেব গাড়িটা আরও একটু এগিয়ে নিলেন ইঞ্জিন বন্ধ করে। মিনিট পাঁচেক দমবন্ধ অবস্থায় কেটে গেল (বলার সময় অবশ্য বাড়িয়ে মিনিট পনেরো বলেছিলাম) — ব্যাটা হঠাৎ বোধ করি মানুষের গন্ধ পেয়ে গোল করে ঘুরে উঠে দাঁড়াল। বাইনোকুলার ছাড়া খালি চোখে ভালো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে বাঘমামাকে। মনে হলেো জলা থাকলেও যদি মামা হঠাৎ ছুটতে শুরু করে তা হলে এক কান্ড হবে। ফরেস্ট মডেল বাঘারুচন্দ্র সটান আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটুও পাত্তা না দিয়ে দুলকি চালে গাছপালার মধ্যে ঢুকে গেল। গেল তো গেল আর এল না। থাপাজির মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে। আমার স্পন্ডালাইটিসওয়ালা কাঁধে এক চাপড় মেরে বললেন—”ক্যায়া বোলাথা না, হামনে ক্যায়া?” সে চাপড়ের বোঝা এখনও কাঁধ থেকে নামাতে পারিনি। সেই দিন ফিরে এসে আমাদের নামের পাশে বোর্ডে টাইগার সাইটিং-এর ঢেঁড়া পড়ল। আমরা বড় মুখ করে রাজা উজির মারলাম। সেই শিকারী কাপল বেরিয়ে এসে বললো আমরা নাকি দারুণ লাকি গাইস। সেই রাতের ডিনারের আগে এক পশলা ব্লুলেগুন মাতিয়ে দিলো। মনটা পুরো ফুরফুরে বিন্দাস। পরদিন লগহাট ছেড়ে নেমে আসছি। হ্যামকে শেষ বার চড়তে গিয়েও হাত ছেড়ে আসছে। কাবিনী যাবার পথে বরাদ্দ দেড় দিনে এই অরণ্য প্রথম পাঠে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। ক্রমাগত পাহাড় ডিঙানো মনকে আরণ্যক নির্জনতায় ভিজিয়ে সতেজ করে দিলো। কটেজের রাস্তার দিশারি লণ্ঠনগুলো খুলে নিয়ে গেছে কেউ। লগহাটের ঠিক সামনেই একটা বেগুনি ফুলের গাছ। ঝেঁপে ফুল হয়ে আছে। এসে থেকে ভাবছি ভালো করে দেখব, ছোঁব, কথা বলব তা আর হয়ে উঠল কই? ঐ বেগুনি ফুলের নীচে আমাদের সেই সাদা উর্দি পরা তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। ফরেস্ট বাংলোর লাইব্রেরি থেকে সেলিম আলির বইটা নিয়েছিলাম “দা ফল অফ আ স্প্যারো”, সেটা রাখতে গোলঘরে গিয়ে দেখি সকালের সাফারির জিপটা জাস্ট বেরিয়ে গেল। টেবিল থেকে এখনও কড়া দুধেলা কফির গন্ধ মুছে যায়নি। টেনিস টেবিলের ওপর কে যেন একটা ছাতা রেখে গেছে। কী মনে হতে ওদের স্টোর থেকে একটা জ্যাকেট কিনলাম। খয়রির ওপর সাদা সুতো দিয়ে “জঙ্গল রিসর্ট “লেখা। মনটা খারাপ করব না ভেবেও, হয়ে যায়। সবাই আমরা এ ভাবেই একটা নতুন জায়গা ছেড়ে আর একটা নতুন পাওয়ার আশাতে এগিয়ে যাই। গাড়িতে ওঠার সময় লজের লোকজন বললো, এ তো বি আর হিলস দেখলেন, কাবিনী যান কাবিনী। বললাম, কাবিনীই তো যাব। এই টা তো কাবিনীর বাফার এরিয়া —বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ভাগ। গাড়িতে উঠেই বলি, ড্রাইভারজি কাবিনী চলিয়ে।