অসহ্য যাপন নয়, প্রকৃত সহবাসের খোঁজ
যশোধরা রায়চৌধুরী
সম্প্রতি এক দক্ষিণ ভারতীয় ছবি , “দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন” দেখে কোন কোনও মুক্তমনারও বেশ খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল- এ বড় বাড়াবাড়ি। মেয়েরা রান্না করেন, পুরুষেরা করেন না, একে কি আর পুরুষের তরফে নারীর ওপর কোন অত্যাচার বলে চালান যায়? কিন্তু প্রথমে রান্না করার দায় তারপর এঁটো তোলা তারপর স্বামীর সঙ্গে সহবাসের ব্যাপারে বিধিনিষেধ তারপর শ্বশুরের মতামতের ওপর নিজের কেরিয়ার… গোটা চলনটাই বলে দিয়েছে কী শ্বাসরোধী এক একটা গ্রেট ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি… দীর্ঘকাল ধরে এরকমই…। ছবিটির প্রথমার্ধের অধিক অংশই অস্বস্তিকর দীর্ঘ শটে দেখিয়েছে একটি স্বাভাবিক “সুখী” পরিবারের গৃহবধূ রান্নাঘরের পেছনে কতটা সময় ব্যয় করতে বাধ্য হন, কী কী করেন। আর এই সুখী মেয়েটির উদয়াস্ত শ্রম কতটাই অনুল্লিখিত মূলস্রোতের বয়ানে, তা ওই ছবিটি দেখতে দেখতে দর্শকের ভেতরে ঘটে যাওয়া চূড়ান্ত অস্বস্তিই বলে দেয়। ওই ছবিতে বার বার আসে বন্ধ হয়ে যাওয়া কিচেন সিংক-এর ছবি। ঘুর্নি তুলে ময়লা জল খুব ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হয় সেই সিংক থেকে। আটকে থাকে ময়লা।
অসহবাসের জীবন ঐ বদ্ধ জল। অসহ এক বসবাস। অন্য অর্থে, অসহবাসের জীবন শুধু সহবাসহীনতা নয়। সহবাসের বদলে সেখানে জোটে ধর্ষণ। হ্যাঁ এটাই সত্যি যে আজো এক বিরাট শতাংশ মেয়ে জানেন না কাকে বলে যৌন তৃপ্তি। কারণ তাঁদের যথেষ্ট উষ্ণ হয়ে ওঠার অপেক্ষা না করেই তাঁদের স্বামী নামিয়ে আনেন নিজেকে সজোরে তার ওপরে। আর সেটাই, এই দু পক্ষের সহমত ব্যতিরেকে রমণই আসলে অসহবাস। সহবাস নয়। প্রকৃত সহবাস প্রকৃত পরিতৃপ্তি, প্রকৃত যৌনসুখ… এসবের গল্প না হয় আরেক দিন হবে। সেসব নিয়ে আজ আমাদের দেশে গুটিকতক মেয়ে মুখ খুললেও, বিদেশের সমাজেও খুব বেশি লোকের মুখে এসব কথা শোনা যায়না। অনেক দেরিতে, অনেকটাই কম আলোচিত বিষয় এই সহবাস বনাম অসহবাস। নতুবা পোলিশ ছবি দেখে কীভাবে জানি যে সত্তরের দশকে প্রকৃত মিলনের শ্বাসরোধী কথা, পারস্পরিক সহযোগ থেকে ঘটিত সুখের কথা লিখেছিলেন যে নারী, যিনি নিজেই চিকিৎসক, নারীশরীরের , গর্ভধারণের নানা সমস্যা, এবং অপরিতৃপ্তিঘটিত নানা মানসিক ত্রুটি দেখে দেখে ক্লান্ত, তাঁর লেখা পান্ডুলিপিকে চাপা দিতে কীভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর সমাজ। বইটিকে পার্টির হাই কমান্ড ছাপতে মানা করে কীভাবে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন বছরের পর বছর। টেবিলের তলায় অন্য কাগজের তলায় চাপা দিয়ে পড়েছেন যাঁরা, সেইসব পুরুষ রাজনীতিবিদেরাই ভয় পেয়েছেন এ বই ছাপতে দিতে। পার্টি বলে কথা। রক্ষণশীল মানসিকতা সেখানে জোরালো এক ভূমিকা পালন করে।
আমাদের দেশের কথাই বলি। আমাদের সমাজে রাস্তা ঘাটে যত মেয়ে আক্রান্ত তার চেয়ে অনেক বেশি ত আসলে গৃহ অভ্যন্তরেই আক্রান্ত!!! এই শেষের বাক্যটি যে কতভাবে প্রমাণিত, গুচ্ছ গুচ্ছ নানাধরণের স্টাডি ও সমীক্ষায় তার হদিশ মিলবে।
২০২১। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা। দেশের এক বড় অংশের মেয়েরা জানালেন, স্বামীর দ্বারা প্রহৃত হওয়ার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। আপত্তিরও না। যথাযথ কিছু কারণে বাড়ির পুরুষটি “পরিবারের” ওপরে হাত তুলতেই পারে। যথাযথ কারণগুলো সাতরকমের। তার মধ্যে এক প্রান্তে পরপুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হবার মত কারণ যেমন আছে, অন্য প্রান্তে আছে খারাপ রান্না করাও!
এ কী গো বিস্ময়! সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ। ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ায়, মেয়েদের কাছে স্বামীর দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়া কোন বিস্ময় নয়, বিচলিত হবার বা আপত্তি করার মত বিষয়ও নয়। সেই কোন শৈশবে শুনেছিলাম মনুর বিধান হল, “নারী শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর ও প্রৌঢ়ত্বে পুত্রের অধীনা”…এইরকম উক্তির কয়েক ছটাক কথায় কথায় আমাদের পাতে এসে এসে পড়ত, কখনো পারিবারিক সূত্রে, শ্লেষ ও নিন্দার্থে কারণ ভাগ্যবলে যে মা বা দিদিমাদের পেয়েছিলাম তাঁরা সকলেই “আলোকপ্রাপ্ত” ছিলেন। আবার বহুজনের মান্য, উদ্ধৃত, এবং সর্বাংশে আপত্তিকর কথাও ভাসতে ভাসতে আসত। সমাজ কানে এনে তুলত। এমনকি প্রাচীনপন্থী ও রক্ষণশীলদের লেখা থেকেও টুপটাপ খসে পড়ত এমন কথা। ‘স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং পুরুষস্য ভাগ্যং / দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ’ এই উক্তিটি শুনেই শিখেছিলাম মেয়েদের নিজের ভাগ্য বলে কিছু থাকতে নেই। শুধু আছে চরিত্র নামক এক ফাঁদ। জীবনের শেষ দিন অব্দি যা টলমল করে। ‘পুড়ল মেয়ে উড়ল ছাই/ তবে মেয়ের গুণ গাই।’ তার আগে নয়। আট থেকে আশি যে কোন মেয়েই ভোগ্যা, আর তাকে ভোগ করেন যিনি সেই দৃপ্ত পুরুষটির চরিত্রে ছ্যাঁকা লাগে না, তিনি সোনার আঙটি, তার আবার সোজা আর বাঁকা। কিন্তু মেয়েটির চরিত্র তছনছ হয়ে যায়। সে চিরতরে নষ্টা, কুলটা ইত্যাদি ইত্যাদি হয়। তাই চরিত্রে সন্দেহ? সে এক বিশাল জিনিস। সেজন্যে দু চারটে চড় থাপ্পড় দিয়ে তাকে সুপথে আনয়ন করা স্বামীর পবিত্র কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। মেয়েদের শরীরের সম্মানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত পরিবারের ইজ্জত।
এইসবই আশৈশবের লালনে একটি মেয়ের মাথায় পুরে দেওয়া হয়। এক্কেবারে সেই হীরক রাজার দেশের মগজ ধোলাই এর স্টাইলেই। আমাদের সনাতন সমাজ স্বীকার করেনা মেয়েদের চারিত্রকর্ম বা এজেন্সি, বাক্যের সাবজেক্ট হতে দিতে চায় না কখনো তাকে। সে হবে বাক্যের প্রেডিকেট। পুরুষের বিবিধ কর্মের অবজেক্ট, নানা চাওয়ার উপযোগী কাঙ্ক্ষিতা। আর এই কাঙ্ক্ষিতা নারীকে সবলে অধিকার করাই আমাদের সমাজে প্রেমের চরিতার্থতা, তার শরীরের ওপর সম্পূর্ণ দখলদারিই শেষ কথা। পরিবারের প্রথম ধাপই দাঁড়িয়ে আছে এই অধিকারের ওপরে। মেয়েদের ওপর পুরুষটি ও তার পরিবারের অধিকারবোধকে কায়েম করা ও কায়েম রাখার গল্পটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ সমাজ। আর, পুরুষের কাছে স্ত্রী যদি সম্পত্তি হয়, তার শরীর যদি সম্পত্তি হয়, নিষ্প্রাণ আলমারি বিছানার মতই… তাহলে তাকে অনুমোদনহীন রমণ অর্থাৎ বৈবাহিক ধর্ষণ যেমন করা চলে তেমন দু চার ঘা-ও নিশ্চিন্তে দেওয়া চলে। আশৈশবের মগজ ধোলাই-তে, স্ত্রীও তাইই ভাবতে শেখে। নিজের ভাগের ছাগলটিকে যেমন মালিক ল্যাজের দিকে কাটবে না মাথার দিকে, সেটা মালিকের ইচ্ছাধীন, তেমনই, তখন এটাও ভেবে নেওয়া চলে, যে স্ত্রীর ওপর স্বামীর দু আধখানা চড়চাপড়ও যুক্তিযুক্ত, জায়েজ।
এত এত কাল ধরে এতগুলো পরিবর্তন, শোধন, আইন সংশোধন থেকে আরো নানা আন্দোলন সবই তাহলে মিথ্যা! সেই ইঙ্গিতই উঠে এসেছে এবারের সমীক্ষায়।
এ তালিকায় সর্বোচ্চ স্থানে তেলঙ্গানা। সে রাজ্যের ৮৩.৮ শতাংশ মহিলা বউপেটানোর সপক্ষে। তেমনই পুরুষদের মধ্যে সবার আগে কর্নাটক। সেই দক্ষিণী রাজ্যের ৮১.৯ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, স্বামী যদি স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন, তাতে কোনও দোষ নেই! হিমাচলে আবার পুরুষ নারী নির্বিশেষেই এসব বিশ্বাস করেন খুব কম শতাং শ মানুষ। পশ্চিমবঙ্গ? ৪২ শতাংশ মেয়ে পিটুনিতে রাজি! পিটুনির সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে কি? পশ্চিম বঙ্গে দেখা যাচ্ছে, শ্বশুরকুলে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করাটাই স্বামীর হাতে স্ত্রীর মার খাওয়ার যথেষ্ট যুক্তি। অন্য এক এক রাজ্যে এই কারণের পাল্লা এক একদিকে ভারি। কেউ ভাবছেন, পরকিয়ার সন্দেহে স্ত্রীকে মারা বৈধ, কেউ ভাবছেন, ভাল রান্না না করার জন্য মারাই যায় বউকে… সংসার আর সন্তানের যথোপযুক্ত দেখভাল না করাটাও বড় কারণ।
গত দুশো বছর ধরে নবজাগরণ, রামমোহন বিদ্যাসাগর, আইন গড়া, রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র আশাপূর্ণা ….. সাহিত্যের ভাঁজে ভাঁজে মেয়েদের প্রতি অবিচার নিয়ে এত কথা। ভারতীয় সমাজ যে দুশো বছরে অপরিবর্তিত আছে তা অতিবড় মূর্খেও বলবে না। তথাপি কিছু কিছু বদ্ধ কাঠামো, তলদেশে চাড়ানো শিকড়ে কোন পরিবর্তন হয়নি কি তবে। দেশ স্বাধীন হবার ৭৫ বছর পর ও, আমাদের সমাজের মূলগত কাঠামোটি এতটুকুও বদলাবে না?
হ্যাঁ অবশ্যই মেয়েদের আপাতদৃষ্টিতে প্রচুর বদল । তাদের পোশাক, তাদের হাতের ফোন, তাদের ঘরের শোভা সবই সমসময়ের সঙ্গে তাল দিয়ে। তাদের ভেতরে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, ভাল খাওয়া ভাল পরার দাবি আছে, আছে নতুন নতুন গ্যাজেটের জন্য চাহিদা, বাচ্চাকে বড় ইশকুলে পাঠানোর ইচ্ছা। কিন্তু হ্যাঁ এখনো তিনি সহবাসের ব্যাপারে মুখে রা কাড়েন না। অসহ্য হলেও সয়ে যান। কারণ সমাজ তাঁকে শিখিয়েছে মুখ বুজে থাকতে। স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে। তাঁকে বুঝিয়েছে আশৈশবের লালন , যে অসহবাস এক স্বাভাবিক জিনিস। সর্দি জ্বরের মতই। একে সয়ে নিতে হয়।
প্রকৃত রমণ , প্রকৃত আনন্দ, শরীরের সুখ, শরীরকে নিজে ভালবাসা, নিজে নিজের প্রতি মনোযোগী হওয়া, এসবকে খুব খারাপ চোখে দেখিয়েছে সমাজ তাকে। যারা এসব করে তারা ত স্বৈরিণী, বলেছে সমাজ। স্ব যুক্ত ঈর। নিজের ইচ্ছা। স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী যে মেয়ে, তাকে কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই সমাজে আশ্রিত হতে হলে, চলো নিয়মমতে। অসহবাসকে মেনে নাও।
তবু, নিজের নিয়মে, নিজের সহবাসকে নিয়ন্ত্রিত করতে আমরা চেষ্টা করতেই পারি। এখনও খুব দেরি হয়ে যায়নি। তাই… অসহ্য যাপনকে উল্টোমুখে ঘুরিয়ে দিয়ে অপরূপ যাপনে পরিণত করা যাক, আসুন!!! নিজের শরীর ও মনের ওপর দখল নেওয়া যাক প্রথমে ত, তারপর… প্রিয় মানুষটির দিকে এগোব না হয়।
Soumi Acharya
January 1, 2022 |লেখাটি পড়তে পড়তে বহুকথা মনে হচ্ছিল,ঠাকুমার কথা ,মায়ের কথা আরো অনেকের কথাই।কি যে যন্ত্রণা।প্রবন্ধ যে কত প্রঞ্জল হতে পারে উপলব্ধি করলাম।শ্রদ্ধা।
Nina Gangulee
January 3, 2022 |ভাগ্য ভাল যে মা দিদিমা ও শ্বশুরবাড়ি সব আলোক প্রাপ্ত পেয়েছি – জীবনে বহু দেশ ঘুরলাম বহু মানুষ দেখলাম – মনে হয় এই জেনডার টা সেকেন্ডারি করে মানুষ টাকে প্রাইমারি করে এগোলে হয়ত ভাল হয়। জানিনা just a thought!
লেখাটা দারুণ
yashodhara Ray Chaudhuri
January 2, 2022 |ধন্যবাদ সৌমি আচার্য। হ্যাঁ এ সবার কথা!!
পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
January 3, 2022 |বিদগ্ধ আলোচনা। শেষ প্যারা অতি চমত্কার
Tanima Basu
January 2, 2022 |খুব সুন্দর লিখেছেন । অসহবাস যদি কিছুটা হলেও সহবাসে পরিনত হয় তাহলে সমাজের জন্য ভালো । খিটখিটে সমাজের ধীরে ধীরে অবসান হবে । বেশ দরকারী লেখা । স্যালুট জানাই দিদি কে ।
Ishita Bhaduri
January 3, 2022 |ভালো লিখেছো
Anjanaa Chattopadhyay
January 4, 2022 |চমৎকার লেখা! “দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন” দিয়ে শুরু করায় আরও বেশি মুগ্ধ। কারণ এই ছবিটার বিষয় বঙ্গসমাজে আজও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক অথচ এটা নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে আশানুরূপ আলোচনা-সমালোচনা শোনা গেল না! সচেতনতার অভাব, না সচেতন উপেক্ষা?
আরও নানাদিক থেকে আলোচনা পড়তে আগ্রহী থাকলাম।
Jaya Kundu
January 4, 2022 |Eto satyi kayhagulo. Khub bhslo laglo pore.